মুক্তিযুদ্ধের গান বলতেই আজও যাঁর কথা প্রথমেই মনে পড়ে, তিনি অসমের বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী তথা সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস। লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে বাংলা গণসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তাঁর লেখা, “শোন দেশের ভাই ভগিনী শোন আচানক কাহিনী, কাঁদো বাংলা জননী” গানটি নতুন করে জনপ্রিয় হয় একাত্তরের যুদ্ধের সময়। প্রবাদপ্রতীম শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কথা তো বলতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের গানে বিশেষ অবদান ছিল তাঁর। ‘হে দোলা হে দোলা’, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’ ভীষণ জনপ্রিয় হয় এই সময়।
বিশ শতকের চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গণনাট্য সংঘের অনেকে বিভিন্ন ভাষায় গান রচনা করেছিলেন। সলিল চৌধুরী ছাড়াও যাঁরা সুর দিয়ে গান লিখেছিলেন তাঁদের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য । তাঁরা বিভিন্ন স্বদেশী গানও কোরাসের মাধ্যমে ‘গণসঙ্গীতে’ রূপান্তর করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানও তাঁরা গাইতেন।
তবে রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতির পর গণনাট্য সংঘের আন্দোলনের সময় গাওয়া সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা ভুপেন হাজারিকার গানই কিন্তু বেশি প্রচারিত হয়েছে, বিশেষতঃ সলিল চৌধুরীর গান মনুমেন্টের পাদদেশে দাঁড়িয়ে গাওয়া হত ১৯৭১ সালে। জ্বালাময়ী ছিল এসব গানের কথা।
“ঢেউ উঠেছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে
ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে আলো ফুটেছে প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে
গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে
মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠেছে”
১৯৪৬-এর ২৯ জুলাই নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে সারা দেশব্যাপী যে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সেই উপলক্ষে রচিত সলিল চৌধুরীর এই বিখ্যাত গানটি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নিয়মিত গাওয়া হত। একদিকে এইসব দিকপাল সুরকাররা যেমন লোকগীতির সুর ভেঙে নতুন চেতনার সুর দেওয়ার কাজে অনড় থেকেছেন, ঠিক তেমনি জীবনে জীবন যোগ করার আগ্রহে অধিকাংশ সময় গণসঙ্গীতকাররা লোকগীতির ভাষা ও সুরও ধার করেছেন । তবে, সলিল চৌধুরী ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। তিনি ছিলেন এক ইন্সটিটিউশান। সম্মিলিত গণজাগরণের গান রচনা করে গেছেন তিনি।
এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত যে সব গান রচিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে, সেগুলি পুনঃপ্রচারিত হয়েছে ১৯৭১-এ । এর অধিকাংশ ঢাকা বা চট্টগ্রামের স্টুডিওতে রেকর্ড করা বা ঢাকায় প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ড। আকাশবাণীর ইথারতরঙ্গে ভেসে আসা সেইসব গান পৃথিবীর সর্বকালীন শান্তির গান, মুক্তির গান, জাগরণের গান হিসেবে পরিচিত।

পরাধীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সংগঠিত পদক্ষেপ, অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শপথবাণী ঘোষিত হয় ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল। আকাশবাণীতে খবর এল, রাতে দু’জন সাংবাদিককে একটি বিশেষ কাজে কোথাও যেতে হবে। ঠিক করা হল, প্রণবেশ সেন এবং উপেন তরফদার আকাশবাণীর প্রতিনিধিত্ব করবেন। তৎকালীন বি.এস.এফ-এর পিআরও সমর সেনের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের দল যখন সীমান্ত পেরিয়ে কুষ্টিয়া দিয়ে বাংলাদেশের মেহেরপুরে পৌঁছল, তখন ভোর হয়ে গেছে। সেখানে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় ধ্বনিত হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও অন্যান্য নেতাদের উপস্থিতিতে সেখানে অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণ করলেন। দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন ‘পূর্ব-পাকিস্তান আজ থেকে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’। কলকাতার থিয়েটার রোডে তৈরি হল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অফিস, যার বাংলাদেশি নাম হল মুজিবনগর।
পরের দিন, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল ওই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং আকাশবাণী থেকে সম্প্রচার করা হল। আসলে সেই সময়ে আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান মুক্তিবাহিনীকে প্রেরণা জোগাত। ‘দুই বাংলার মনের কথা’, ‘সংবাদ পরিক্রমা’ বা ‘সংবাদ বিচিত্রা’তে নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত কথিকা, সঙ্গীত, কবিতা, নাটক, বক্তৃতা, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া বা যুদ্ধের তাজা খবর লড়াইয়ের উৎসাহ জোগাত।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, দীনেন গুপ্তের সুরে অংশুমান রায়ের গাওয়া গান ‘একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুর’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের কাছে মন্ত্রের মতো ছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের এই গানটি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কামরুল হাসানের উপস্থিতিতে দীনেন গুপ্ত সুর করেছিলেন একটি খাতা বাজিয়ে। অংশুমান রায় ওই ভাবেই গানটি রেকর্ড করেন। সেই রেকর্ডিং-এর মাঝখানে মুজিবুরের বক্তৃতা দিয়ে গানটি যখন সম্প্রচার করা হয় তখন সেই গান হয়ে ওঠে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবন-আলেখ্য।
এ ছাড়া ওই সময়ে আকাশবাণীর আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ছিল রেডিও কার্টুন। পাক সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে খুব ছোট ছোট এই রেডিও কার্টুন সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম এ ধরনের অনুষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র আকাশবাণীর পুর্ণ সহযোগিতায় সম্প্রচার ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অনুঘটক রূপে কাজ করতে থাকে।
শ্যামল গুপ্তের লেখা গান, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি নাম মুজিবর’ বাংলাদেশের শিল্পী মহম্মদ আব্দুল জব্বারের গলায় বা গোবিন্দ হালদারের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের জন্য লেখা গান “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে” বা “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল ” সেই সময়ে বাংলাদেশ বেতার এবং আকাশবাণীতে নিয়মিত বাজত। এই স্বাভাবিক সখ্যের প্রতিচ্ছবি দিয়েই তৈরি হয় ‘মৈত্রী রেডিও’ চ্যানেল যেটি আজও সমান ভাবে জনপ্রিয়।

ওদিকে বাংলাদেশের অরক্ষিত বেতারকেন্দ্রে অহোরাত্র বাজছে “জয় বাংলা, বাংলার জয়” অথবা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উজ্জীবিত করা আর একটি কালজয়ী গান- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ যার স্রষ্টা ছিলেন গোবিন্দ হালদার। আর পশ্চিমবাংলায় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বেতারকেন্দ্রে বাজছে শ্যামল মিত্রের গাওয়া, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের “আমরা সবাই বাঙালী”। দুই বাংলাতেই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল আব্দুল লতিফের কথায় ও সুরে শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে এই গানটি– “সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি। তার চেয়ে খাঁটি আমার বাংলাদেশের মাটি। ”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে একটি অভিযান চালায় এবং গভীর রাতে আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার আগে অর্থাৎ ২৬ মার্চের ভোরে মুজিবর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) একটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরেরদিন, ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের একটি বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে মান্যতা দেন। ততদিনে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বাত্মক হিংসা, গণহত্যা। আওয়ামী লিগের অন্যতম প্রধান নেতা গ্রেফতারি এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। গোপনে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকেন। ৩০ মার্চ তিনি ফরিদপুর-কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকেন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে এই নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে তাজুদ্দিন কুষ্টিয়া সীমান্তে এক অধিবেশন ডাকেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লিগের নেতারা সেখানে হাজির হন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে গণপ্রজাতন্ত্রী সার্বভৌম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানো হয়। এরপর ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর। পরবর্তীকালে এই মন্ত্রীপরিষদই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমণ্বয়ের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান।
“শোনো একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুর” এখনও বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং বনশ্রী সেনগুপ্ত গাইলেন “বঙ্গবন্ধু ডাকে রে, মুজিব ভাই ডাকে রে, পথেঘাটে, গ্রামে গঞ্জে কোথায় আছ”। ওদিকে যুদ্ধ চলছে রণাঙ্গনে আর এদিকে শিল্পীরা গান লিখে, সুর করে মনপ্রাণ উজাড় করে পরিবেশন করছেন যোদ্ধাদের মনোবল জোগানোর জন্য। অনুপ্রেরণা জাগানোর জন্য।

শুধু যে বাঙালিরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধপীড়িত দেশের মানুষদের গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন তাই নয়। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশী শরণার্থীদের শিবিরে সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন বিটলস এর ফেমাস গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন, জোন বায়েজ়-সহ আরও অনেকে। সেসময় লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে সফলভাবে আয়োজিত হয় “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”। পণ্ডিত রবিশংকর একদিকে তাঁর সেতারে তখন তুলছেন বাংলা ধুনের অনুরণন। অন্যদিকে জোন বায়েজ় বিদেশি অ্যাকসেন্টে করুণ স্বরে গাইছেন, “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” বলে আর জর্জ হ্যারিসন ঠিক সেই সময়েই গলা মেলাচ্ছেন ‘to help us save some lives, Bangladesh’-এর সুরে। এই ত্র্যহস্পর্শে যেন আজও প্রাণে প্রাণে ধ্বনিত হয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের গান।
*ছবি সৌজন্য: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
তথ্যসূত্র:
বিবিসি
এই সময়
প্রিয় ডট কম
ভোরের বার্তা
প্রথম আলো এবং
বিশেষ কৃতজ্ঞতা অন্তরা চৌধুরীকে। সলিল চৌধুরীর গানগুলির বিষয়ে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করার জন্য।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।