(Tripti Mitra)
রাজা যদি অরূপ বীণা, তিনি সেই বীণার গান।
ষাট বছর আগে বহুরূপীর ‘রাজা’ নাটকের সুদর্শনার চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে লিখেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ। গানের মতোই ছিলেন তিনি। সহজ, কোমল একটা গান। মাঝে মাঝে জীবনের যে-গানে মীড় দিয়ে যেত মৃত্যুর বোধ। তাকেও বেশ সহজ করে হাত পেতে নিতেন তৃপ্তি মিত্র। নইলে, যেমন জানিয়েছেন সৌমিত্র বসু, কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরে অবলীলায় এমন করে বলেন কী করে, না বাবা, ওই রকম হঠাৎ করে মরতে আমি রাজি নই। বেশ বুঝতে পারব, মৃত্যু আসছে, তবে তো! (Tripti Mitra)
নদীর ধারে ছেলেবেলার বাড়ি তাঁর। টাঙন নদীর ধারে। তাঁর স্মৃতিতে সেই নদী। লিখছেন, “আমার জন্মস্থান উত্তরবঙ্গে অধুনা বাংলাদেশের ঠাকুর গাঁও সাব ডিভিশনে। আবহাওয়াটা ছিল একেবারেই গ্রাম্য। তাও টাউন বলা হত কারণ কোর্ট-কাছারি, ব্যাঙ্ক, এ সবই ছিল। এমনকী একটি ছোটখাটো থিয়েটার হলও ছিল। ছেলেদের জন্যে হাইস্কুল, মেয়েদের জন্য মাইনর গার্লস স্কুল এ সবই ছিল। আমেজ ছিল গ্রামের খোলামেলা। মেয়েদের স্কুলের পাশ দিয়ে এসডিও-র বাড়ির ধার ঘেঁষে এঁকেবেঁকে যে পাহাড়ি নদীটি বয়ে গেছে, তার নাম টাঙন। তারই অদূরে আমাদের বাড়ি।” (Tripti Mitra)
আরও পড়ুন: শেষ ভাইফোঁটার বর্ণ-ছবি
পাহাড়ি নদীরই তো মেজাজ তাঁর সমগ্র সৃজনে। যাঁকে বিয়ে করে মিত্র হলেন যেন তাঁর সৃজন-সত্তার বিপরীত। গঙ্গা যেন হেসে দুলায় ধূর্জটির জটা। বলি, ইঁদুর কিংবা বিদ্রোহিণী— তাঁর লেখা সবকটি নাটকেই হয়তো তাই ‘অবিশ্রান্ত গতির উত্তেজনা’ লক্ষ করেন সমালোচক। তাঁর নট-জীবনেও আশ্চর্য এক চঞ্চলতা, চ্যালেঞ্জ নেওয়ার চঞ্চলতা। (Tripti Mitra)
ঠাকুরগাঁয়ের মাইনর গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, তারপর ১৯৩৯-এ কলকাতার প্যারীচরণ সরকার স্কুলে। ১৯৪৩-এ সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আশুতোষ কলেজে। বাংলার সংস্কৃতির তখন উথালপাথাল সময়। বদলে যাচ্ছে চারপাশ, জীবন আর ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় নেই, সংস্কৃতিকর্মীরা খুঁজে চলেছেন নতুন পথের দিশা। কলেজের ছাত্র ফেডারেশনের শাখা গার্লস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নাটকের রিহার্সাল হয় দিদি-জামাইবাবু শান্তি-অরুণ মিত্রের সদানন্দ রোডের বাড়িতে। শেখাতে আসেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু ভট্টাচার্য। (Tripti Mitra)

পাহাড়ি নদীর জীবনের দ্রুত বাঁকবদল হতে লাগল। কলেজে পড়তে পড়তেই দুর্ভিক্ষের রিলিফ কিচেন চালানোর টাকা তোলা, ফার্স্ট এইড শিখে ছিন্নমূল চাষিদের পাশে দাঁড়ানো ক্রমেই নিয়ে আসছিল বহু জনতার মাঝে। গণনাট্য সঙ্ঘে তাই জড়িয়ে পড়া। মাসতুতো দাদা বিজন ভট্টাচার্য সেই ১৯৪৩-এই আগুন নাটকে অভিনয় করালেন। তার পরে ‘নবান্ন’। (Tripti Mitra)
“আর আছে তাঁর কিছু সাক্ষাত্কার। যেগুলো এক প্রবল পারফর্মার অভিনেত্রীর প্রস্তুতির আলো-আঁধারের কথা বলে, কথা বলে আনন্দবিপ্লবের।”
বাকিটা ইতিহাস। তিলে তিলে তৈরি হয়ে ওঠার ইতিহাস। আশ্চর্য সব চরিত্রে অভিনয়ের ইতিহাস। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় ১৯৪৬-এর রবীন্দ্র সপ্তাহে কলকাতার টেগোর সোসাইটি ‘মুক্তধারা’ করল। পরিচালক শম্ভু মিত্র ও গঙ্গাপদ বসু। নবান্ন-র টিমটাই অভিনয় করল। অম্বার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র। গণনাট্য সঙ্ঘে সেটাই শেষ অভিনয়। (Tripti Mitra)
তারপরে বহুরূপীর যুগ। নানা বাঁকের নানা চরিত্র, মঞ্চে তাঁদেরই ফোটানো, মনের অতলের সমস্ত বাঁকবদলসমেত। এমন করেই ফোটাতেন তৃপ্তি মিত্র যে অভিনয়ের কোনও এক চিরস্মরণীয় অতলের সন্ধানে দর্শকের হৃদি ভেসে যেত অলকানন্দা জলে। রাধিকা (নবান্ন), সুমিত্রা (পথিক), করুণা (উলুখাগড়া), ফুলজান (ছেঁড়াতার), এলা (চার অধ্যায়), মঞ্জু (দশচক্র), নন্দিনী (রক্তকরবী), বুলু (পুতুল খেলা), অম্বা (মুক্তধারা), গুণবতী (বিসর্জন), ইয়োকাস্তে (রাজা অয়দিপাউস), সুদর্শনা (রাজা), সুব্রতা (সুতরাং)— শুধু তালিকায় সে-ইতিহাসের কিছুই বোঝা যায় না। নাট্য আমাদের দেশে এখনও সেভাবে সংরক্ষিত হয় না। তাই রাধিকা থেকে অপরাজিতা হয়ে ওঠার ইতিহাস কেবল প্রবীণের স্মৃতিধার্য হয়ে আছে। (Tripti Mitra)

আর আছে তাঁর কিছু সাক্ষাত্কার। যেগুলো এক প্রবল পারফর্মার অভিনেত্রীর প্রস্তুতির আলো-আঁধারের কথা বলে, কথা বলে আনন্দবিপ্লবের। যেমন, ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে বলছেন, সেই রাজার কথা ভাবো— রাজা নাটকে রানী সুদর্শনা, দেখো তার আগে ‘অয়দিপাউস’-এ রানী করেছি, অনেক রানী দেখেছি, যাত্রা থিয়েটারের অভিনয়ে, এদেশের বিদেশের অনেক রানী চরিত্র দেখেছি। কিন্তু ‘রাজা’র যে রানী ‘সুদর্শনা’ সে একেবারেই অন্যরকম। কে রাজা? রানী কে? অয়দিপাউসের রানী করা সহজ কারণ, এরকম রানী ইতিহাসে ছিল। কিন্তু ‘রাজা’-র রানী কোথাও নেই, কেউ ছিল না। (Tripti Mitra)
“১৯৭১-এ, ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে সেই তৃপ্তি মিত্রের আমি একা, তিনটি পুরোপুরি আলাদা মেয়ের চরিত্রে। সে অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিল।”
রূপে ছিল না যে, তাকেই রূপ দিলেন তৃপ্তি মিত্র। সেই রূপকেও সমকাল ছাড়িয়ে পৌঁছে দিতে চাইলেন অরূপের দিকে। সেই চাওয়াটাই তাঁর পথ চলা। (Tripti Mitra)

১৯৭১-এ, ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে সেই তৃপ্তি মিত্রের আমি একা, তিনটি পুরোপুরি আলাদা মেয়ের চরিত্রে। সে অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ওই তিন মেয়েকে নাকি নিজের ভেতরে রপ্ত করতে করতে পথ চলতেন তৃপ্তি মিত্র, নাসিরুদ্দিন শাহ রোডের বাড়ি থেকে ‘বহুরূপী’র রিহার্সালে যাওয়ার রাস্তায়। হয়তো রপ্ত করে নিয়েছিলেন বাণিজ্যিক থিয়েটারে নানারকম আপোষের সঙ্গে অভিনয় করাটাও, সংসার চালানোর তাগিদে। ১৯৫৯ সালে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বরূপা থিয়েটারে। ‘সেতু’ নাটকে অভিনয় করতেন, করেছিলেন ১২৫০ রজনী। বিষম চলার ঘায়েই হয়তো পাড়ি দিতে পেরেছিলেন মারের সাগর। (Tripti Mitra)
আরও পড়ুন: রক্তকরবী: বইয়ের শতবর্ষ, নাটকের নয়
যেমন পেরেছিল অপু, অপরাজিতা রায়। আঠেরোটা চরিত্রে একা অভিনয় করতেন ওই অপরাজিতা নাটকে। করতেন, করে গিয়েছেন ক্যানসার নিয়েও, আড়াই ঘণ্টা ধরে। মঞ্চে ওই নাটকেই শেষ নেমেছেন, শেষের আগের জন্মদিনে। (Tripti Mitra)
সাল-তারিখ হয়তো শেষ কথাটা এত সহজে উচ্চারণ করতে পারে। বাংলা থিয়েটারের আবহমান অন্ধকার কী করে ভুলবে সেই অবাক আলোর লিপিকে, আজ তাঁর শতক-ছোঁয়া জন্মদিনে! (Tripti Mitra)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
আশিস পাঠক বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা ও বিপণন আধিকারিক।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা আকাদেমি, কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বিভাগের নানা প্রকল্পে, নানা পুরস্কারের বিচারক হিসেবে। সংস্কৃতির নানা মহলে তাঁর আগ্রহ, বিশেষ আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থবিদ্যায়।
