(Goddess Kali)
কালী শব্দ হল ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। আবার এর আরও একটি অর্থ হল ‘কৃষ্ণ’ কালো অর্থাৎ ‘ঘোর বর্ণ’। সময়কে যিনি কলন করেন, তিনিই কালী। তাঁর রূপ ভয়ঙ্কর হলেও তিনি কল্যাণী, আনন্দময়ী এবং মঙ্গলময়ী। যুগ যুগ ধরে শাক্ত সাধকেরা বিশ্বাস করে এসেছেন যে কালীই পরম ব্রহ্ম। তিনি শাসন ও সংহার করলেও স্নেহময়ী। ঘোরাং, মুক্তকেশি, চতুর্ভুজঙ দেবী কালিকা বিভিন্ন রূপে বঙ্গে পূজিতা। কখনও তিনি দক্ষিণাকালী, কখনও আবার শ্যামা, কখনও চামুণ্ডা, কখনও ছিন্নমস্তা! (Goddess Kali)
দশমহাবিদ্যা তাঁরই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। এই বাংলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক সতীপীঠ এবং সাধনপীঠ। বিশেষ করে বীরভূম জেলার নানা স্থানে শক্তিরূপা কালী বিরাজ করছেন নলহাটিতে, তারাপীঠে, অট্টহাসে, কংকালীতলায়, কিন্তু আজ বীরভূম নয়, বলব মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের অদূরে বিষ্ণুপুরের কালী মন্দিরের কাহিনি। মা এই মন্দিরে ‘করুণাময়ী’ নামেই পূজিতা হন। প্রতি বছর পৌষ মাসে করুণাময়ী মায়ের আবির্ভাব দিবস উপলক্ষে এই মন্দির ঘিরে এক মাসব্যাপী মেলা হয়। স্থানীয় ভক্তেরা বিষ্ণুপুর কালী মন্দিরকে বহরমপুরের কালীঘাট বলে থাকেন। (Goddess Kali)
করুণাময়ী দেবীকে ঘিরে নানা কাহিনি রয়েছে। শোনা যায় সাধক বামাখ্যাপা এখানে এসে মায়ের দর্শন করেছিলেন। করুণাময়ী মায়ের দর্শনে আসতেন শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী। এক সময় এই স্থান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, মন্দিরে যাওয়ার পথে সেই পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল ওলোন্দাজদের এক কবরখানা। বর্তমানে সেই ভয়াবহ পরিবেশ আর নেই, মন্দির যাওয়ার পথে গড়ে উঠেছে জনবসতি। মায়ের অধিষ্ঠান তখন ছিল এক সামান্য চালাঘরে। মন্দির সংলগ্ন এক বিরাট দীঘি রয়েছে, যাকে বলা হয় হোতার সাঁকো। আনুমানিক ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীতে ভাগীরথী নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়াতে সরস্বতী নদীর তীরে বন্দর সপ্তগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য কমতে শুরু করে। (Goddess Kali)

পরবর্তীকালে বাংলার মধ্যবর্তী স্থানে আনুমানিক ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার অঞ্চলটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে কাশীমবাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বিগুন বেড়ে যায়। সপ্তগ্রাম এবং কলকাতা বন্দরের পরেই বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত কাশিমবাজার। সেই কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ি যাওয়ার পথেই অবস্থিত এই বিষ্ণুপুর করুণাময়ী কালীমন্দির। কথিত আছে এখানকার করুণাময়ী মা ভীষণ জাগ্রত। অতীতের ইতিহাস বলে বাংলার তৎকালীন নবাব সরফরাজ খানের শাসনকালে মহারাষ্ট্র থেকে এ রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে আসেন এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ কৃষ্ণচন্দ্র হোতা। নবাবের অধীনে কাশিমবাজারেই কাজ করতে শুরু করেন এই ধার্মিক ব্রাহ্মণ। (Goddess Kali)

তাঁর কোনও সন্তান ছিল না। অনেক প্রার্থনার পরে মায়ের স্বপ্ন পান তিনি। এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ মেয়ের নাম রাখেন করুণাময়ী। কৃষ্ণচন্দ্র হোতা থাকতেন বহরমপুরের সৈদাবাদে। প্রতিদিন দপ্তর থেকে ফেরার পথে তিনি বিষ্ণুপুর কালীমন্দির সংলগ্ন জঙ্গলাকীর্ণ মহাশ্মশানে বটবৃক্ষের নীচে বসে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যান করতেন। এখানকার মাতৃমূর্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মায়ের মূর্তি এখানে অর্ধেকটা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর চরণযুগল এবং চরণতলে মহাকাল প্রকট হননি! (Goddess Kali)
“সেই ছোটবেলার স্মৃতি এখনও ম্লান হয়নি। তখনও মন্দিরে যাওয়ার পথের দু’পাশ ছিল জঙ্গলে ভর্তি। আর এক পাশে কবরখানা। সেই সময় মূল মন্দিরের ভেতরে কোনও নাটমন্দির ছিল না বিশেষ করে সন্ধেবেলার দিকে গেলে বেশ গা ছম ছম করত।”
অতীতের সেই নির্জন পরিবেশে মাতৃমূর্তি দর্শন করলে শরীরে শিহরণ জাগত। খুব শৈশবে মায়ের কাছে শুনেছি বর্তমান নিবন্ধের লেখকের জন্মও বিষ্ণুপুরের করুণাময়ী মা কালীর দোর ধরে! ছোট থেকেই দিদিমার মামারবাড়ি বহরমপুরে গেলেই করুণাময়ী মায়ের দর্শনের অভিপ্রায় নিয়ে মন্দিরে যেতাম এবং এখনও সুযোগ পেলে যাই। (Goddess Kali)

সেই ছোটবেলার স্মৃতি এখনও ম্লান হয়নি। তখনও মন্দিরে যাওয়ার পথের দু’পাশ ছিল জঙ্গলে ভর্তি। আর এক পাশে কবরখানা। সেই সময় মূল মন্দিরের ভেতরে কোনও নাটমন্দির ছিল না বিশেষ করে সন্ধেবেলার দিকে গেলে বেশ গা ছম ছম করত। সেখানকার অখন্ড নির্জনতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে কাশিমবাজার থেকে ট্রেন ছুটে যেত বহরমপুর কোর্ট রেলস্টেশনের দিকে। ওই শব্দে চমক লাগত! আজও সেই রেলপথ ধরে ট্রেন চলাচল করে, কখনও লাল গোলার দিকে আবার কখনও শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে। (Goddess Kali)
“এই বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে অনেকের মনে হতেই পারে এসব নিতান্তই গাল গল্প। সেই শ্রেণীকে বিশ্বাস করাবার কোনও দায় আমার নেই কিন্তু অন্তর থেকে করুণাময়ী মার কথা সকলকে জানাবার তাগিদ থেকেই এই নিবন্ধটি লেখার প্রয়োজন অনুভব করেছি।”
অতীতের পরিবেশ আজ ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। করুণাময়ী মায়ের ভক্তসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে গাড়ির যাতায়াত। মন্দির ঘিরে গজিয়ে উঠেছে পুজোর সামগ্রী কেনাবেচার জন্য একাধিক দোকান লোকালয় ক্রমশই গ্রাস করছে অতীতের নির্জন শান্ত পরিবেশকে। আমার মাতামহ কবি-গীতিকার অমিয় বাগচীর সহধর্মিনী অর্থাৎ আমার দিদিমা খুব অল্প বয়সে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে জানিয়ে দেন রোগীর আর বাঁচার আশা নেই। প্রসঙ্গত বলে রাখি সেই আমলে যক্ষার কোনও চিকিৎসা ছিল না। (Goddess Kali)

অজ্ঞাত পরিচয় কোনও এক ব্যক্তির কথার ওপর নির্ভর করে দাদু বাড়ির কারুকে না জানিয়ে এক নির্জন মধ্যাহ্নে করুণাময়ী কালীবাড়িতে যান। অপরিচিত সেই ব্যক্তির কথা অনুযায়ী মন্দির প্রাঙ্গনে বসে থাকাকালীন কোলের ওপর পড়ে থাকতে দেখেন একটি টাটকা পঞ্চজবার ফুল। সেই ফুল নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আর মনের মধ্যে জন্ম নেওয়া বহু প্রশ্ন নিয়ে দাদু বাড়ি ফিরে এসে দিদিমার বালিশের তলায় রাখেন। (Goddess Kali)
আরও পড়ুন: বাংলার মন্দিরের টেরাকোটার ফলকে মা কালীর বিবর্তন
যাঁর অনুরোধে এবং কিছুটা নির্দেশে দাদু কালীবাড়ি গিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন এই বিষয়টি নিয়ে কারুকে কিছু না বলতে এবং এও বলেছিলেন বালিশের নীচে এই প্রশাদী ফুলটা রাখার পরে দিদিমার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে কিন্তু ক্রমে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। এই ঘটনার পর থেকে আজীবন কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী এবং প্রবলভাবে রবীন্দ্রঅনুরাগী আমার মাতামহ প্রতি দ্বিপান্বিতা অমাবস্যায় তাঁর কেশবচন্দ্র স্ট্রিটের ঠাকুরঘরে মায়ের ছবি প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। (Goddess Kali)
নাহ, কোনও ভাড়া করা পুরোহিতকে দিয়ে নয়, নিজেই সেই পুজো করতেন। এই বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে অনেকের মনে হতেই পারে এসব নিতান্তই গাল গল্প। সেই শ্রেণীকে বিশ্বাস করাবার কোনও দায় আমার নেই কিন্তু অন্তর থেকে করুণাময়ী মার কথা সকলকে জানাবার তাগিদ থেকেই এই নিবন্ধটি লেখার প্রয়োজন অনুভব করেছি। সংস্কার করা নবনির্মিত মন্দিরে আজও করুণাময়ী মা তাঁর স্নেহ আর করুণা নিয়ে বরাভয় ভঙ্গিতে বিরাজমান। (Goddess Kali)
ছবি ঋণ: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।