(Shyam Benegal)
তাঁর ছবিকে সমান্তরাল বলব, না ধ্রুপদী! কোন গোত্রে ফেলে ছবিগুলির বিশ্লেষণ করলে সুবিচার করা হবে, তাই ভাবছি। আজ তাঁর প্রস্থানের পরে মনে হচ্ছে সমাজের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজে তাঁর অবস্থান এবং প্রতিটি ছবির মাধ্যমে যে ইতিবাচক বার্তা তিনি দর্শকদের দিতে চেয়েছিলেন, সেগুলি নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। (Shyam Benegal)
আরও পড়ুন: স্বর্ণযুগের শেষ প্রতিনিধি, নির্মলকুমার
শ্যাম বেনেগাল অবশ্য নিজের ছবিকে নতুন ধারার ছবি বলতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় সমাজের সাম্প্রদায়িক সমস্যা, উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক এবং বিত্তশালী মানুষের প্রবল ক্ষমতার কাছে নিম্নবর্গের গরীব বারে বারে পরাস্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিক শোষণ তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। দেহাতের প্রান্তিক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি তিনি খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গ্রাম্যসমাজে জাতের ভিত্তিতে বিভাজন রেখার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন ছবিতে। (Shyam Benegal)

সহজবোধ্য চিত্রনাট্যতে যেমন বাস্তবতা ছিল, তেমনই ছিল প্রেম, পরকীয়া, ষড়যন্ত্র, চিরাচরিত ক্ষমতার আস্ফালন। নারীদের একক সংগ্রামের বিষয়টিও বাদ যায়নি। সমাজের সর্বস্তরে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন আর তার ফলে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা, সেই বিশেষ বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে ছবিতে। শ্যাম বেনেগাল বুদ্ধিজীবী তকমাধারী কোনও চলচ্চিত্রনির্মাতা নন। তিনি আমাদের দেশীয় সমাজেরই একজন, উনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রর আলি আকবর খান। (Shyam Benegal)

ধ্রুপদী উপাদান আর নতুনের মেলবন্ধনে ছবি উপহার দিতেন দর্শকদের। তিন দশক আগে দিল্লির এক প্রেক্ষাগৃহে ‘মন্থন’ ছবিটি দেখেছিলাম, ছবির থিম সংটি এখনও মনে আছে, কিন্তু সাম্প্রতিককালে ছবিটি যখন আবার নতুন করে দেখলাম, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ১৯৭৬ সালে নির্মিত ‘মন্থন’ ছবির বিষয়বস্তু আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এখনও গ্রামীণ ভারতের উন্নতি অধরা, সেখানকার অনুন্নত শ্রেণীর মানুষদের বঞ্চিত করা হয় সমস্তরকম সুযোগ-সুবিধা থেকে। নারীর অধিকার, যৌন শোষণ, সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারের মতো বিষয়গুলি শ্যাম বেনেগলের বেশিরভাগ ছবিতেই প্রকাশ পেয়েছে। (Shyam Benegal)
পণ্ডিত নেহেরুর চোখে দেখা ভারতকে তিনি ‘ভারত এক খোঁজ’- এর মাধ্যমে ছোট পর্দায় ধরে রেখে গেলেন। দেশকে নতুন করে চিনতে এবং জানতে এই ধারাবাহিকটি আগামী প্রজন্মকে সাহায্য করবে।
ইউরোপের ছবির প্রভাব তাঁর কাজে পড়লেও ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক শ্যামসুন্দর বেনেগালের কাজে ভারতের সংস্কৃতির ছাপও সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। পণ্ডিত নেহেরুর চোখে দেখা ভারতকে তিনি ‘ভারত এক খোঁজ’- এর মাধ্যমে ছোট পর্দায় ধরে রেখে গেলেন। দেশকে নতুন করে চিনতে এবং জানতে এই ধারাবাহিকটি আগামী প্রজন্মকে সাহায্য করবে। একদম ভিন্ন স্বাদের ছবি ‘সুরাজ কা শতয়া ঘোড়া’ তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দর্শকদের। (Shyam Benegal)

ধর্মবীর ভারতীর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি ১৯৯৩ সালে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবিটিও প্রমাণ করছিল চলচ্চিত্র জগতে শ্যাম বেনেগাল অন্য পথের পথিক। সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের পরে আদুর গোপাল কৃষ্ণনের কাজ নিয়ে যতটা চৰ্চা হয়েছে, শ্যাম বেনেগালের ছবির আলোচনা বা চৰ্চা ততোটা হয়েছে বলে মনে হয় না, এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। (Shyam Benegal)

চলচ্চিত্র পরিচালনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আরও একটা পরিচয়, যা হল, তিনি একজন হিউম্যানিস্ট। মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়েই ছবি তৈরি করেছেন সারা জীবন। তাঁর কাজের মধ্যে থেকে কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করাটা মনে করি জরুরি। সব থেকে চর্চিত ছবি ‘মন্থন’। দেহাতের প্রত্যন্ত গ্রামে দুগ্ধ সমবায় গঠনের ইতিবৃত্ত। এই উদ্যোগের বিরোধিতা, সমর্থনের মাঝে কিছু সম্পর্ক, ষড়যন্ত্রর বলি একটা গোটা হরিজন গ্রাম। (Shyam Benegal)
সমবায় সমিতি গঠনের নেপথ্যে থাকা আধিকারিককে অন্যত্র বদলি করার পরেও গ্রামের জনৈক হরিজন যুবক ভোলার একক প্রচেষ্টায় সমস্ত রকমের ষড়যন্ত্র, জটিলতা এবং বিরোধিতা সত্ত্বেয় শুভ শক্তির মুখেই শেষ হাসি দেখা যায়। বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর আত্মসচেতনতাই জয়ী হয়। ছবির শুরু ট্রেনের আগমন দিয়ে আর শেষও ট্রেনের প্রস্থান দিয়ে। কিন্তু শেষ দৃশ্য আশার আলো দেখায়। গ্রামের ধুলোমাখা মানুষগুলো কিন্তু নতুন ভোর আনার জন্য আবার নতুন উদ্দামে কাজ শুরু করে। একটি দেহাতি লোকগীতি সারা ছবিতে স্বতন্ত্র এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ছবিটি আবার নতুন করে দেখতে গিয়ে তরুণ মজুমদারের গণদেবতার কথা মনে হচ্ছিল। শ্যাম বেনেগাল একদল নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাঁর ছবিতে কাজ করার সুযোগ দেন। নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমী, মোহন আগাশে, গিরিশ কর্ণাড, রজিৎ কাপুর প্রমুখ তাঁর ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেন। (Shyam Benegal)
সুস্থ সামাজিক চেতনাবোধ নিয়ে সারাজীবন ছবি তৈরি করে শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তাঁর আরও একটা ছবির আলোচনা করব, সেটা ১৯৭৭ সালে তৈরি ‘ভূমিকা’। এই ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন স্মিতা পাতিল, অমল পালেকর, ওমরিশ পুরি, মোহন আগাশে প্রমুখ। এক নায়িকার অভিনয়-জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া জটিলতা, দাম্পত্যকলহ, সন্দেহ, পরকীয়া নিয়ে। নায়িকা উষার চরিত্রে স্মিতা পাতিলের অনবদ্য অভিনয় এই ছবির প্রধান সম্পদ। এখানে দাম্পত্য কলহর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনস্তত্বের বিষয়টি। দিশাহীন জীবনযাত্রার পথে চলে, ঊষা শেষে মিলিত হয়, নিজের কন্যার সঙ্গে, তখনও পরকীয়ার টানাপোড়েন! ফোনের সংযোগ কেটে ঊষার প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে ছবি শেষ হয়। হংসধ্বনি রাগের অনুরণন ছবিতে যেন সূত্রধরের ভূমিকা পালন করেছে। (Shyam Benegal)
শ্যাম বেনেগালের ছবি বাজারি না হয়েও বক্সঅফিসকে কিন্তু পুরোপুরি নিরাস করেনি। একজন স্রষ্টার সব কাজ অসাধারণ হতে পারে না, তাই তাঁর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি ‘bose the forgotten hero’ ছবিটি মনে দাগ কাটতে পারেনি। এটাও আমার ব্যক্তিগত মত। কলকাতার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের কথা সবাই জানেন, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সুস্থ সামাজিক চেতনাবোধ নিয়ে সারাজীবন ছবি তৈরি করে শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সমান্তরাল ছবির জগতে তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
