(Wasim Kapoor)
ভাল শিল্পী আর একই সঙ্গে ভাল মানুষের সমন্বয়, খুব একটা চোখে পড়ে না! ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে আর সেই ব্যতিক্রমী শিল্পীদের মধ্যে একজন হলেন বিশিষ্ট চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর। অন্য প্রদেশের মানুষ হয়েও তিনি একদিন এই শহরের নাগরিক হয়ে উঠেছিলেন! তাঁর নাম আর কাজ জড়িয়ে পড়েছিল বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে। তাঁর কাজ প্রথম দেখি দক্ষিণ কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে। তখন আমার বয়স বেশ কম, চিত্রকলার তেমন কিছুই বুঝি না কিন্তু আজও মনে আছে তাঁর ছবিতে দেখেছিলাম পাথরের একটি স্তূপের ওপরে একটি সূর্যমুখী ফুল আর তার নীচে একটি শিশু খুব মন দিয়ে ফুলটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু বুঝি আর নাই বুঝি ছবির বিষয়টা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। ওয়াসিম কাপুরকে প্রথম দেখি এবং পরিচয় হয় লা মার্টিনিয়ার স্কুলের আর্ট শিক্ষক এবং চিত্রশিল্পী ঋতু সিং-এর বাড়িতে। (Wasim Kapoor)
আরও পড়ুন: নবতিপর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ওঁদের দুজনের সঙ্গে একবার মাদার হাউসে মাদার টেরেসার কাছে গিয়েছিলাম। সবাই জানেন যে ওয়াসিমজির আঁকা ‘মাদার টেরেসা’-র সিরিজের সব ছবিগুলিই বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন শিল্পী ওয়াসিম কাপুর কোনও সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজের আদর্শ ত্যাগ করে অন্য কোনও ছত্রছায়ার তলায় আশ্রয় নিতে যাননি। বোধহয় সেই কারণেই বর্তমান সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুরকে চিত্রকলার জগতে উচ্চমানের শিল্পী বলে মানতে নারাজ। ওয়াসিমজির খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সাংবাদিকতার সূত্রে। পুজোশিল্প, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাঁর মতামত শুনতে একাধিকবার ফোনে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে হাজির হয়েছিলাম মধ্য কলকাতার প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে ওঁর বাড়িতে। ঘরের এক কোনে ছোট্ট একটি খাটে শুয়ে বা বসে থাকতেন, সদাই হাসি মুখে! (Wasim Kapoor)

ঘরের চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত নানান আকারের ক্যানভাস। প্রভু যিশু, মাদার টেরেসা, মা দুর্গার নানান অবয়বে ক্যানভাস ভর্তি। বাড়িতে গেলে প্রথমেই এক গেলাস ঠান্ডা জল, তারপর কফি বা চা, আর তার সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের স্মৃতিচারণ। অবাঙালি এই শিল্পীর মধ্যে কোনওদিনও কোনও জটিলতা দেখিনি। কারুর সমালোচনাও করতেন না। প্রতিটি প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত কিন্তু মননশীল উত্তর দিতেন। আবারও বলছি কোনও বিষয়কেই জটিল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্লেষণ করতেন না। বিষয়টির সঙ্গে যদি কোনও ছবি আঁকার প্রয়োজন হত, নিজের কাছে রাখা ক্যানভাস বোর্ড নিয়ে তার ওপর ছবি এঁকে দিয়ে দিতেন! (Wasim Kapoor)
“ওয়াসিমজির বাড়িতে গিয়ে তাঁর সংগ্রহ করা বইয়ের সম্ভার দেখেও অবাক হয়েছি! শিল্পসংক্রান্ত বই তো ছিলই আর ছিল বিদেশী সাহিত্যের বই।”
সেই ছবি ফেরত পাওয়ার প্রত্যাশাও করতেন না। পণ্ডিত রবিশঙ্করের জীবনবসানের পরে নন্দনে পন্ডিতজির স্বরণে আমাদের সংস্থা তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাতদিনব্যাপী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম, তখন ওয়াসিমজিকে অনুরোধ করি রবিশঙ্করজির একটা ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। দু’দিনের সময় চেয়েছিলেন। এরপর এক বড়দিনের সকালে নিজেই ফোন করে আমাকে জানালেন ছবির কাজটি শেষ হয়েছে। (Wasim Kapoor)
সুবিধে মতো গিয়ে যেন ছবিটি নিয়ে আসি। ছবি নিতে গিয়ে আমি বেশ লজ্জিত, আবার একই সঙ্গে অবাকও হলাম! একটি বড় ক্যানভাসে আক্রালিক মাধ্যমে সেতার হাতে রবিশঙ্করজির এক ধ্যানস্ত মূর্তি! অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। ভাবলাম উনি জানতেন ওইরকম একটি ছবির মূল্য বা সাম্মানিক দেওয়ার সামর্থ আমাদের নেই কিন্তু তবুও কী অসম্ভব যত্ন নিয়ে কাজটি করেছেন। (Wasim Kapoor)

হাতে ছবিটি দিয়ে সেই পরিচিত হাসিমুখে বলেছিলেন প্রদর্শনী হয়ে গেলে ছবিটা আপনার কাছেই রেখে দেবেন। প্রদর্শনী হয়ে গেলে ওই ছবিটি একটি বর্ষপঞ্জীতেও ব্যবহার করেছিলাম। অনেকেই জানেন একটি বিশেষ শারীরিক সমস্যা তাঁর ছিল, তবুও সাহায্য করতে বা আবদার মেটাতে তিনি কখনও দ্বীধাবোধ করতেন না! ওয়াসিমজির বাড়িতে গিয়ে তাঁর সংগ্রহ করা বইয়ের সম্ভার দেখেও অবাক হয়েছি! শিল্পসংক্রান্ত বই তো ছিলই আর ছিল বিদেশী সাহিত্যের বই। যখনই তাঁর কাজ নিয়ে একক প্রদর্শনী হয়েছে, তখনই ফোন করে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমিত্ব প্রকাশের ইঁদুরদৌড়ে নিজেকে যুক্ত না করেও শিল্পসাধনা করে গেছেন চিরকাল। তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়ার খবর পেয়ে মনে হয়েছিল আজও অনেক শিল্পী আছেন কিন্তু একজন নিপাট ভাল মানুষের অভাবটা আরও একটু বেড়ে গেল। (Wasim Kapoor)
আরও পড়ুন: কাছে ছিলে দূরে গেলে
দুঃখ পেয়েছি যখন দেখেছি বাংলার শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনী থেকে দায়িত্ব নিয়ে তাঁর কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে। অন্যদিকে দেখেছি নিজের ছবি আঁকার জগৎ ছেড়ে অন্য বিষয়ে জড়িয়ে পড়া শিল্পী যখন ওয়াসিমজির নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন! (Wasim Kapoor)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
