(Bengali Novel)
টানা দু-বছর কাকুর ট্রেনিং-এ থেকে মোহনা একে একে শিখে নিল, কাগজ, প্রেস, বই, ম্যাগাজিনের লে-আউট, প্রুফ দেখা, এমনকি প্রেসের বিভিন্ন কাজও। তবে কাজটা সহজ ছিল না। এতগুলো বছর বাদে সেগুলো ভাবলে অবাক লাগে নিজেরই। কী সব দিন গেছে! রাত-দিন ভুলে খালি একটাই প্রচেষ্টা। অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে যেভাবেই হোক। তার মধ্যেই শ্বশুরমশাই চলে গেলেন। অফিসের স্টাফেরা যতরকম অসহযোগিতা পারলেন করলেন। সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করেছিলেন হলধরবাবু। তিনি যে মালিকের আড়ালে এই প্রকাশনীর বই বিক্রির একটা সমান্তরাল ব্যবসা চালাচ্ছিলেন, সেটা ধরা পড়ে যাওয়া মাত্র তিনি লোকজন জড়ো করে ধর্নায় বসলেন। শুধু তাই নয়, মোহনার সম্পর্কে যে সব শ্লোগান ও কদর্য আক্রমণ সেদিন হেনেছিল, সেগুলো মনে পড়লে এখনও তার ইচ্ছে করে লোকটাকে খুন করে ফেলতে। (Bengali Novel)
কিন্তু কাকু সেদিন কোনও আইনি পদক্ষেপ নিতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, কারোর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ, এমনকি মিডিয়া কভার করতে এলেও কোনও প্রতিক্রিয়া দিবি না।
সেই অনুযায়ী সেদিন মিডিয়াকে মোহনা জানিয়েছিল- আমি এখন মানসিকভাবে বিষণ্ণ। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অমিত চৌধুরী চলে গেলেন। আমার স্বামী কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে বিদেশে। এখন আমার একমাত্র কাজ শাশুড়ি ও আমার মেয়ে রাইয়ের দিকে নজর রাখা। বুঝতেই পারছেন, দুজনে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। (Bengali Novel)
-কিন্তু দিদি এই যে এঁরা যে দাবি করছেন, আপনি এঁদের অমিতবাবু চলে যাওয়ার সাথে সাথেই ছাঁটাই করেছেন। এমনকি প্রাপ্য টাকা পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করেছেন!
-দেখুন আমি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখনও আইনিভাবে যুক্ত নই, এই সিদ্ধান্ত আমি কীভাবে নেব? তাছাড়া এর ভবিষ্যৎ দায়িত্ব কে বা কারা নেবেন, তাও এখনও ঠিক হয়নি। কাজেই এই অভিযোগ সঠিক নয়।
-ওঁরা বলছেন, আপনিই নাকি নিজেকে মালিক বানাতে চাইছেন!(Bengali Novel)

-শোকের মাথায় মানুষ অনেক কিছু বলেন। ওঁরা দীর্ঘদিন আমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। এই সংস্থার ভাল-মন্দ সব কিছুতেই তাঁরা ছিলেন। আশা করি থাকবেনও। কিন্তু এখন আমি এগুলো নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আগে সব কাজ মিটুক। যাই ঘটুক না কেন আমি আপনাদের জানাব। আর বাবাকে নিয়ে আমরা একটা শোকসভা করব, অবশ্যই বইপাড়ার যাঁরা আমাদের মাথার ওপর আছেন, তাঁরা থাকবেন। আমি তো এ সংক্রান্ত কিছুই জানি না। খালি আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, সেদিন সবাই আসবেন। (Bengali Novel)
পনেরো দিনের মাথায় অমিতবাবুর শোকসভা রবীন্দ্রসদনে বিশালভাবে হওয়ার পর, এক মাস মোহনা অফিস গেলেন না। এই সময় আলোককাকু অফিসের দায়িত্ব নিলেন। কড়া হাতে বিক্ষুব্ধদের দমন করলেন এবং একে একে ছাঁটাই করলেন। পুরোনো স্টাফেদের মধ্যে বিশুবাবু ছাড়া, আজ আর কেউই নেই।
সেইসব পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কাকুকে ফোন করল মোহনা। (Bengali Novel)
“মিষ্টি তার ভীষণ পছন্দের জিনিস। ছোটবেলায় পাড়ার মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলত- মা আমাদের কত পয়সা আছে গো?”
-বল। তোর ফোনের অপেক্ষা করছিলাম।
-এমনিতে তো মনে হচ্ছে ঠিকঠাক মিটিংই হল। ওঁরা মেইলে যা বলেছিলেন, রাহুল সেগুলোই বললেন। এগ্রিমেন্টটা করা রইল। আশা করি ভালই হবে।
-আচ্ছা। তুই অফিস থেকে বেরলি?
-না, অফিসেই আছি। কেন বলো, তুমি অফিসে আছ?
-আমি আজ যাইনি। শরীরটা ঠিক লাগছে না।
-কেন কী হল? (Bengali Novel)

-ওই সেই পুরোনো সমস্যা, পায়ের পাতাগুলো নিয়ন্ত্রণে নেই। ভালবাসার উপহারগুলো মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয়, তোমার এই জীবন পরে পাওয়া বাড়তি জীবন। বলে জোরে হেসে উঠল আলোক। শোন, তোকে একটা কথা বলি, এই সুযোগে রাইয়ের সঙ্গে বসে হটস্টারে বা হৈচৈ-তে ওয়েব সিরিজ, সিনেমা দেখে নে। আমি একটা সিরিজ দেখলাম। মন্দ নয়।
-কে আছে?
-আরে নাম কি মনে থাকে? ওই যে মিস ইউনিভার্স বা মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছিল বাঙালি মেয়েটা, কি যেন নাম!
-উফ কাকু! এটাও মনে নেই? সুস্মিতা সেন।
-হ্যাঁ। পারলে দেখিস। আমার ভাল লেগেছে।
-বেশ। সাবধানে থেকো। রাখছি। ফোন রেখে দিল মোহনা। (Bengali Novel)
টানা ক্লাস হওয়ার পর পনেরো মিনিটের বিরতি। রাই ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিল। তারপর ড্রইংরুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খেল। মিষ্টি তার ভীষণ পছন্দের জিনিস। ছোটবেলায় পাড়ার মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলত- মা আমাদের কত পয়সা আছে গো?
আরও পড়ুন: জলকে চল: অষ্টম পর্ব
-কেন? পয়সা নিয়ে কী করবে?
-এই মিষ্টির দোকানটা কিনে নেব।
-শেষ পর্যন্ত সব ছেড়ে মিষ্টির দোকান? এক কাজ করব তোকে আমি ময়রার সঙ্গে বিয়ে দেব।
-ময়রা কাকে বলে মা?
-মিষ্টি বানাবার কারিগরদের। তোকে তোর ইচ্ছে মতো মিষ্টি বানিয়ে দেবে, আর তুই বসে বসে খাবি।
-না বাবা! আমি বিয়ে করব না। মিষ্টির দোকানের মালিক হয়ে বসে থাকব, আর খাব। (Bengali Novel)
মেয়ের কথায় হেসে উঠত মোহনা। বেশ, তাহলে পড়াশনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রোজগার কর। তারপর দোকানটা কিনে নিস।
-ততদিন এই দোকানটা থাকবে?
“নকুড়ের দোকানটার পুরো নাম গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী। যতদূর মনে পড়ছে ১৮৪৪ সালে তৈরি হয়েছিল। মানে প্রায় দু’শো বছরের কাছাকাছি হতে চলল। আমি যখন স্কটিশে পড়তাম মাঝে মাঝেই ওখান থেকে মিষ্টি কিনে খেতাম।”
নিশ্চয়ই থাকবে। ভাল মিষ্টির দোকান কখনও বন্ধ হয় না। দেখিস না, নকুড়ের বা কে সি দাসের দোকান কত দিনের পুরোনো বলত! তাও কেমন চলছে এখনও।
রাই অনুসন্ধানী মন নিয়ে জিজ্ঞেস করে- কতদিনের পুরোনো? (Bengali Novel)
-নকুড়ের দোকানটার পুরো নাম গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী। যতদূর মনে পড়ছে ১৮৪৪ সালে তৈরি হয়েছিল। মানে প্রায় দু’শো বছরের কাছাকাছি হতে চলল। আমি যখন স্কটিশে পড়তাম মাঝে মাঝেই ওখান থেকে মিষ্টি কিনে খেতাম।
-তোমার কলেজের সামনে?
-একেবারে সামনে নয়। হেঁদোয়ার উল্টোদিকের গলিতে ঢুকে যেতে হয়। বেথুন কলেজের পাশের গলি। চকলেট রসগোল্লা যা বানায় নারে কী বলব!
-কিন্তু রসগোল্লা তো নবীন চন্দ্র দাস বানিয়েছিলেন প্রথম।
-ঠিক, সে দোকানও আছে। কে সি দাসের রসগোল্লাও পৃথিবী বিখ্যাত। সেটাও মনে হচ্ছে ১৮৬৬ এর আশেপাশে তৈরি।
-তাহলে ঠিক আছে। এই দোকানটাও থাকবে আরও বছর তিরিশ, আর আমিই কিনব। (Bengali Novel)
“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাই বলল- আসলে কী বলতো, রাষ্ট্র চায় মানুষ শিক্ষা না পাক। শিক্ষা ক্ষেত্রে যা চলছে দেখতেই পাচ্ছ।”
এসব যখন বলত রাই, তখন সে নেহাতই বালিকা। কিন্তু এখন তন্বী হয়েও একই কথা ভাবে ও স্থির বিশ্বাস করে, এ দোকান একদিন তার হবেই।
ফ্রিজ খোলার শব্দে স্নেহলতা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। ক্লাস শেষ?
-না, ব্রেক।
-শুধু রসগোল্লা না খেয়ে একটু ফল খাও রাই। টেবিলে কলা, আঙুর এমনকি মা আম কেটেও রেখে গেছে।
-খাব, ক্লাস শেষ হোক। জীবনটাই বোর হয়ে গেল এই অনলাইন ক্লাসে বুঝলে আম্মা।
-সে আর কী করবে? যখন যেমন তখন তেমন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? (Bengali Novel)
-অনলাইন টিউশন করতে ভাল লাগে না। কোথায় ভেবেছিলাম এখানে ভর্তি হলে দিল্লি গিয়ে ক্লাস করব। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাই বলল- আসলে কী বলতো, রাষ্ট্র চায় মানুষ শিক্ষা না পাক। শিক্ষা ক্ষেত্রে যা চলছে দেখতেই পাচ্ছ। মূল বিষয় হল শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থা- এই দুটোকে যদি পঙ্গু করে দেওয়া যায় তবে রাষ্ট্র বা সরকার যা খুশি করতে পারবে। লোকজনের নিজস্ব যে চিন্তা ভাবনা তা গড়ে উঠবে না, আর কোর্ট নিয়ন্ত্রণে থাকলে মানুষের বিচার চাইবার অধিকার থাকলেও পাবে না।
-বাপরে বাপ! তুই দেখি অনেক ভাবতে শিখে গেছিস? কোথা থেকে জানছিস এত কিছু?
-আম্মা তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়ছি। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ভাবনা, গতিপথ, এগুলোই আমার পড়ার বিষয়।
-বুঝলাম। (Bengali Novel)

-গুড। এবার আমি যাই। ক্যামেরা অন করে বসি। নইলে পার্সেন্টেজ দেবে না। যা একটা কলেজ! আগে ভাবতাম, এখানে না পেলে বুঝি জীবনটাই বৃথা। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দু’দিন অন্তর পরীক্ষা আর প্রোজেক্টের ঠেলায় প্রাণ যায়।
-সে আর কী করা যাবে! তুমি পড়ছ রাষ্ট্র আবার বিজ্ঞান এই দুই নিয়ে। দুটো বিষয়ই যথেষ্ট ওজনদার।
-হুম। আসলে কী বলতো আগেকার দিনের লোকের হাতে অঢেল সময় ছিল, তারা বসে বসে খালি লিখেই যেত। একই লোক লিখছে নানা বিষয় নিয়ে। তুমি যেদিকেই যাও না কেন তাদের মতবাদ শুনতেই হবে। (Bengali Novel)
রাইয়ের কথা শুনতে মজা লাগছিল স্নেহলতার- তা কাদের মতবাদ শুনছ?
-এই যে এ্যারিস্টটল, দেকার্ত, প্লেটো, রুশো, ভলতেয়ার এমনকি কৌটিল্য বা চাণক্য। কী নিয়ে যে এঁরা বলেনি, বলো! হিস্ট্রি, ইকনমিক্স, ফিলোজফি, সোসিওলজি, পলসায়েন্স, সাইকোলজি… যেদিকেই যাও না কেন, এদের বিশাল বিশাল বক্তব্য তোমাকে পড়তেই হবে। আচ্ছা বলো এতদিন আগে যা ভেবেছিল, এখন কি তা প্রাসঙ্গিক?
-তোমাদের মার্ক্স লেনিন মাও সে তুং পড়তে হয় না?
-হয় না আবার? সারা বিশ্ব থেকে মার্ক্স চলে গেলেও আমাদের দেশে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক…শ্রমজীবি মানুষের আশ্রয় এরাই বুঝলে। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: সপ্তম পর্ব
-সব তো বুঝি না। তবে এটুকু বুঝলাম তোমাকে এখন একটু জল পান করতে হবে।
-কেন? রাই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।
-এত বড় বড় মানুষের বক্তব্য পড়তে গেলে শুনতে গেলে শরীরে জল না থাকলে যে সব মাথা অবধি
ঢোকার আগেই কুপোকাৎ হয়ে যাবে। (Bengali Novel)
-মজা করছ? সাধে বলি আপদ বালাই নিয়ে ঘর সারা জন্ম জ্বলে মর… আমাকে জ্বলেই মরতে হবে বুঝলে? বলে নিজের ঘরে ফিরে গেল রাই।
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিতস্তা ঘোষাল ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি', 'সারস্বত সম্মান', 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার', 'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, 'দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান', 'বিজয়া সর্বজয়া', 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে?
