চরিত্র:
পীযুষ কান্তি চৌধুরী (৬০ বছর)
সুজাতা (৫৫ বছর)
শেখর (১৯ – ২০ বছরের কলেজ পড়ুয়া)
লীনা (শেখরের সহপাঠী)
ওয়েটার
স্থান – একটি পার্ক এবং সংলগ্ন চায়ের দোকান
সময় – বিকেল
(পীযুষ কান্তি চৌধুরী, বয়স আনুমানিক ৬০। সৌম্য সুদর্শন চেহারা, পার্কের একটি বেঞ্চে বসে ব্যোমকেশ বক্সীর উপন্যাস পড়ছেন। কিন্তু পড়ায় খুব বেশি মনোযোগ নেই। বার বার বই থেকে মুখ তুলে পথের দিকে দেখছেন। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন। একটু বাদেই পীযুষের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উনি দ্রুত বইতে মুখ লুকালেন। পার্কে প্রবেশ করলেন সুজাতা সেন। পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছর বয়স, কিন্তু চেহারাটা ধরে রেখেছেন। পীযুষ মুখ লুকিয়ে মাঝে মধ্যেই সুজাতাকে দেখছেন। সুজাতা হেঁটে যেতে যেতে পীযুষের সামনে এসে হঠাত্ থমকে দাঁড়ালেন। হাতের ব্যাগটা খুলে মোবাইল ফোনটা বার করতে গিয়ে ওঁর অলক্ষ্যে একটা লিপস্টিক পড়ে গেল মাটিতে। ব্যাপারটা সুজাতার নজর এড়ালেও, পীযুষের নজর এড়ায়নি। সুজাতা মোবাইল বার করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। পীযুষ অধীর নয়নে কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকলেন। তারপর এদিক ওদিক দেখে বেঞ্চ থেকে উঠে লিপস্টিকটা তুলে নিলেন। একবার ভাবলেন ছুটে গিয়ে সুজাতাকে দিয়ে আসবেন। কিন্তু কী ভেবে, দাড়িয়ে গেলেন। পকেটে লিপস্টিকটা পুরে বেঞ্চে ফিরে এলেন। ঘড়িটা একবার দেখে, আবার বইতে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই আর মন বসছে না। লিপস্টিকটা বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর আবার পকেটে রেখে দিলেন। বইয়ে মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করলেন। এই সময়ে অল্প বয়সী কলেজ পড়ুয়া এক যুবক যুবতী প্রবেশ করল – শেখর আর লীনা। কথা বলতে বলতে ওরা পাশের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে।)
শেখর: লীনা, তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস। সমীর স্যার তোকে ওরকম কিছু মিন করে বলেন নি।
লীনা: না মিন করে বলেননি! তোরা ছেলেরা কী বুঝবি? কোন ছেলে কী মিন করে কী বলছে, কী করছে, আমরা মেয়েরা সব বুঝতে পারি। সমীর স্যারটার পটেটো হাইলি ডিফেক্টিভ। সব সময় ছোঁক ছোঁক করছে। সেদিন সোহিনীকে কী করেছে জানিস? ক্লাসের মধ্যে, ওর কাঁধের ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছে, একেবারে গায়ে গা ঘেঁষে। দেখে আমারই গা শির শির করছিল। সোহিনী বলল, সমীর স্যারের নিশ্বাস ওর কানে গালে লাগছিল। কতটা কাছে বুঝতে পারছিস? সোহিনী তো হ্যারাস্মেন্ট কমপ্লেন করবে ভাবছিল। আমরাই বারণ করলাম।
শেখর: তোদের ক্লাসের সোহিনীটা কিন্তু হেব্বি জিনিস। সমীর স্যার কেন, যে কেউ ওর জন্য লাট্টু হয়ে যাবে।
লীনা: এই খবরদার! ওর দিকে তাকিয়েছিস কি চোখ গেলে দেব।
শেখর: এই হচ্ছে তোদের প্রব্লেম জানিস। তোরা নিজেরাও দিবি না, অন্যের কাছ থেকে নিতেও দিবি না।
লীনা: নেকু! এই বাজে না হেজিয়ে, ব্যগ থেকে বাদাম ফাদাম কিছু বার কর তো। হেবি খিদে পেয়েছে।
শেখর (ব্যাগ খুলতে খুলতে): বাদাম নেই, চকোলেট আছে। চলবে?
লীনা: দৌড়বে। পরে কফি খাওয়াবি।
(শেখর চকোলেট বার করে লীনাকে দেয়।)
লীনা: একটা হেবি ঘাপলা কেস হয়েছে জানিস। আমাদের পাশের বাড়িতে শ্যামলিদি আছে না? একটু নেকু টাইপের, গান টান করে?
শেখর: হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি। এই মাইরি, গোটাটা খেয়ে ফেলিস না। আমার জন্যেও রাখিস।
লীনা: তো খা না, কে না করেছে?
(লীনা চকোলেট বার এগিয়ে দেয়, শেখর এক কামড় নেয়)
শেখর: তা কী করেছে তোর শ্যামলিদি? কারও সঙ্গে পালিয়ে টালিয়ে গেছে নাকি?
লীনা: না না, ওসব কিছু নয়। শ্যামলিদিকে দেখতে একটা ছেলে এসেছিল। আমেরিকায় থাকে, খুব বড়লোক। আর দারুণ হ্যান্ডু দেখতে।
শেখর: এই, এবার কে হ্যান্ডু ছেলেদের দেখছে? আমিও চোখ গেলে দিতে পারি।
লীনা: আঃ! বাজে না বকে আমার কথাটা শুনবি?
শেখর: হ্যাঁ বল।
লীনা: ছেলেটা নাকি শ্যামলিদিকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু শ্যামলিদি কাটিয়ে দিয়েছে। আর কার জন্য জানিস? ওই ক্যাবলা কাত্তিক সুজয়দাটার জন্য। এমন বোকামো কেউ করে?
শেখর: বোকামো? আমরা সবাই জানি, শ্যামলিদি আর সুজয়দার চলছে। আমেরিকার ছেলে বলে এতদিনের প্রেম কাটিয়ে চলে যাবে?
লীনা: আমি হলে তো যেতাম। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে?
শেখর: তুই – তুই এমন কথা বলতে পারলি? আজ যদি আমেরিকা থেকে কোন ছেলে এসে তোকে প্রপোজ করে, তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
লীনা: সে যদি তোর চেয়েও কিউট আর হ্যান্ডসাম হয় –
শেখর: তুই থাক আমি চললাম।
লীনা: এই না না বস। তোর চেয়ে কিউট আর কে হতে পারে বল তো?
শেখর: বেশি বাড়াবাড়ি করলে না, আমি কিন্তু সোহিনীর সঙ্গে –
লীনা (দুহাতে শেখরকে জড়িয়ে ধরে): ইস, আমি যেতে দিলে তবে না?
(শেখর চুমু খাবার জন্য মুখটা নামিয়ে আনে। লীনা দ্রুত মুখ সরিয়ে দেয়।)
শেখর: যাহ্ বাবা। কী হল?
লীনা: ওই বেঞ্চে লোকটা বসে আছে।
শেখর: থাক না।
লীনা: পাবলিক প্লেসে অসভ্যতা করবি না শেখর। খুব খারাপ হবে।
শেখর: শোন না, সুবীরদার ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে রয়েছে। আমার কাছে চাবি আছে। যাবি? প্লিজ প্লিজ প্লিজ চল।
লীনা: এই তুই আমাকে কি ভেবেছিস রে? তোকে আমি আগেই বলে দিয়েছি, চুমু টুমু অব্ধি এলাও করতে পারি, তার বেশি একদম না।
শেখর: আমি তোকে ভালবাসি লীনা। প্লিজ এরকম করিস না।
লীনা: অসম্ভব। জোর করলে কিন্তু আমি তোকে স্রেফ কাটিয়ে দেব শেখর।
শেখর: আমি জোর করছি না। কিন্তু দেহ ছাড়া ভালবাসা হয় বল? ওটাই তো আল্টিমেট!
লীনা: এই সব কথা তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে রে? পল্লব না? আমি ওকে দেখাচ্ছি দাঁড়া।
শেখর: পল্লব কেন হতে যাবে? আসলে, তুই কাছে থাকলে, তোকে দেখলে – আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। তুই এত হট! প্লিজ লীনা, আমাকে রিফিউজ করিস না।
লীনা: ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। তাহলে তুই নিজেকে ঠিক রাখতে পারবি তো ?
(লীনা উঠে দাঁড়ায়, শেখর ওর হাত টেনে ধরে)
শেখর: যাস না, প্লিজ। আমার কথাটা শোন।
লীনা: তোর কথা আমার শোনা হয়ে গেছে।
শেখর: বস না। বস। প্লিজ। খুব ইম্পরট্যান্ট কথাটা। বললে বুঝবি আমি কেন তোকে এতটা জোর করছি।
লীনা (বসে): যা বলবি তাড়াতাড়ি বল।
(শেখর ওর মোবাইল খুলে একটা কিছু লীনাকে দেখায়)
শেখর: এটা পড়।
লীনা: কী এটা?
শেখর: খবর। হেডলাইনটা পড়।
লীনা: দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড! মানে?
শেখর: আর মাত্র দশ দিন লীনা। মেরে কেটে দু’সপ্তাহ। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে লীনা। আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব।
লীনা: তুই এইসব আজগুবি খবর পাত্তা দিচ্ছিস? তোর মাথাটা সত্যি গেছে।
শেখর: উড়িয়ে দিস না লীনা। আমেরিকায় এক নামকরা স্বামীজি, অতুলানন্দ, উনি বলেছেন এই ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ। অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিকরা এই ফোরকাস্ট সমর্থন করেছে। বেশ কিছু সিম্পটমও দেখছেন তারা। বলছেন সময়ের একটু এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু ধ্বংস অনিবার্য।
লীনা: ঠিক আছে। ধ্বংস হবে তো হবে। আমি চললাম।
শেখর: লীনা তুই ব্যাপারটার সিরিয়াসনেসটা একটু বোঝার চেষ্টা কর। ঠিক আছে, যদি এই প্রেডিকশান সত্যি না হয় তাহলে কোনও প্রব্লেম নেই। কিন্তু যদি সত্যি হয়? কী হবে বুঝতে পারছিস?
লীনা: না বুঝতে পারছি না। বুঝতে চাই না।
শেখর: সব শেষ হয়ে যাবে লীনা। তুই আমি সোহিনী সমীর স্যার কেউ থাকব না। সব ছবি হয়ে যাব। না ছবিও থাকবে না, সব ভ্যানিশ!
লীনা: বেশ তো, সবাই একসঙ্গে শেষ হয়ে যাব। ভালই হবে। চল, উঠি।
শেখর: কিন্তু আমাদের ভালবাসা? আমাদের ভালবাসার পরিণতি পাবার আগেই আমরা শেষ হয়ে যাব? একবার, মাত্র একবার লীনা। মহা শূন্যে লীন হয়ে যাবার আগে, আমি একবার আমার লীনার শরীরে লীন হয়ে যেতে চাই। ব্যস আর কিছু না। শেষ হয়ে যাবার আগে একবার স্বর্গ সুখ উপভোগ করে যেতে চাই। এই চাওয়াটা কি খুব বেশি চাওয়া?
লীনা: তোর হ্যাংলামো কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে শেখর। এরপর কিন্তু মার খাবি।
শেখর: ডোন্ট বি সো ক্রুয়েল লীনা। আমি এইভাবে মরে যেতে চাই না। তুই প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর।
লীনা: আমাকে বোকা বানাতে পারবি না শেখর। আমি সে চিজ নই। চললাম। বাই!
চলবে
ছবি সৌজন্য: Pxfuel
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।