মৃদুল দাশগুপ্ত বাংলা কাব্যজগতে একজন অগ্রগণ্য কবি। তাঁকে সত্তর দশকের কবি বলেন কেউ কেউ। কিন্তু কবিকে সময়ের শৃঙ্খলবন্ধনে সীমায়িত করা অনাবশ্যক। কারণ কবি সকল যুগের ধারক বলেই তিনি কবি। মৃদুল দাশগুপ্ত কবি হিসেবে শক্তিমান, প্রতিবাদী, স্পষ্টবাক। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন সুস্নাত চৌধুরী।
সুস্নাত চৌধুরী: প্রতিষ্ঠান বলতে আপনারা শুধু একটা ভার্নাকুলার মিডিয়া গোষ্ঠীকেই টার্গেট করে নিলেন কেন? আপনি নিজেও তো একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এগুলি কি আপনার প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানে আঘাত করেনি?
মৃদুল দাশগুপ্ত: বিভিন্ন সংবাদপত্রে আমি কাজ করেছি সাংবাদিক হিসেবে। এবং আমি যে কবিতা লিখি, বা আমি একজন অমুক সময়ের কবি, এই ক্লেম বা দাবি আমি কোনও কর্মক্ষেত্রে করিনি। অমৃতবাজার পত্রিকা উঠে যাবার আগে আগে শেষ শারদীয়া সংখ্যা জন্য় প্রফুল্ল রায়, গৌরাঙ্গ ভৌমিক, সেই সঙ্গে কৃষ্ণ ধরও আমাকে বললেন, একটি কবিতা তুমি দাও। আমি দিয়েছিলাম। সেটা যুগান্তরের শেষ শারদীয়া সংখ্যায় বেরিয়েছিল। এখানে কবিতা দিলেও পরবর্তী কুড়ি একুশ বছর আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। কিন্তু একটা সময় এল, যখন আজকাল পত্রিকায় আমার ১৩-১৪ বছর কাজ করা হয়ে গিয়েছে, তখন আমার ভ্রাতৃসম বন্ধু অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, এঁরা আমাকে কবিতা দিতে অনুরোধ করলেন। তাঁদের কথা আমি অবহেলা করতে পারিনি।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা যেমন নৈতিক আবেদন থেকে আসে, তেমনি মানবিক আবেদন থেকেও স্নেহ ভালবাসার বন্ধন সবসময় অস্বীকার করা যায় না। আর একটা কথা হচ্ছে যে, আমি কী লিখতে চেয়েছি সেটাই তো মূল কথা। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মূল কথাও ওটাই। আমি কী লিখতে চেয়েছি। আমি যা লিখতে চাই, আমি যা লিখেছি, তার ওপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ আমি সহ্য করব না।

সুস্নাত চৌধুরী: আপনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে একাডেমি পুরস্কার ও রবীন্দ্র পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। অতি যোগ্যজন হিসেবেই এই স্বীকৃতি, সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনার আট বা নয়ের দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবমূর্তি কি এতে টলেনি?
মৃদুল দাশগুপ্ত: স্বীকৃতি শেষ পর্যন্ত সমাজই লেখক বা কবিকে দেয়। আমার মূল প্রতিবাদ সাহিত্যে অন্যায় নিয়ন্ত্রণ এবং যোগ্য ব্যক্তির বঞ্চনা নিয়ে। এই পুরস্কারগুলি কমবেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এসেছে। তবে এই স্বীকৃতি গ্রহণ করলেও এগুলো আমার কোনও অলংকার নয়।
সুস্নাত চৌধুরী: পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পাঠ্যক্রমে এখন আপনার কবিতা পড়ানো হয়। এই ব্যাপারটির অভিজ্ঞতা কেমন? এ-প্রসঙ্গে বিশেষ কোনও ঘটনা মনে পড়ে?
মৃদুল দাশগুপ্ত: সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার একটি কবিতা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষত্ পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্রথমে আমি কিছুই জানতাম না, পরে অবশ্য তাঁরা আমাকে জানান। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এতে খুব খুশি হয়েছিল।
[the_ad id=”266918″]
সুস্নাত চৌধুরী: আপনি আড্ডা মারতে বসে বহুবার বলেছেন, “নোবেল পুরস্কার পেলাম।” এমনকী বাঁকুড়ার ঘোড়া পেয়েও বলেছেন। কোনও আবেগ নিশ্চয়ই এই বিষয়ে কাজ করে?
মৃদুল দাশগুপ্ত: একবার তমলুক শহরে গিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে বেরতে পারছি না। প্রবল বৃষ্টিতে তমলুক ভেসে যাচ্ছে। একটি কবিসভায় আমায় কবিতা পড়তে হবে। একক কবিতাপাঠ। আয়োজন হয়েছিল একটি সিনেমা হলের ভেতরে। আমি কোনও রকমে যখন পৌঁছলাম, মল্লিনাথের সঙ্গে দু’ তিনটি ছেলে আছে, বাকি হল ফাঁকা। আমি ওদের জন্যই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়তে লাগলাম। মঞ্চ থেকে চোখে পড়ল ভিজে চুপু-চুপু হয়ে প্রায় আমার বয়সী তিনজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন একদম শেষে। আমি আধ ঘণ্টা ধরে কবিতা পড়লাম। সেই তিন মহিলা আমার কাছে এলেন। তাঁরা তিন বান্ধবী। তাঁদের কারও হাতে পলিথিনের ব্যাগ, কারওর হাতে কাপড়ে জড়ানো বই। আমারই বই সেইসব। ‘এভাবে কাঁদে না’, ‘জলপাইকাঠের এসরাজ’, ‘গোপনে হিংসার কথা বলি’। এই বৃষ্টিতে তাঁরা এসেছেন সই নিতে। এটাও একটা নোবেল পুরস্কার।

সুস্নাত চৌধুরী: ঘোড়ার ঘটনাটা?
মৃদুল দাশগুপ্ত: ওটাও আমার কাছে নোবেল পুরস্কার। আমার কবিতায় বাঁকুড়ার প্রসঙ্গ আছে। স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় সেগুলি বাঁকুড়ার মানুষকে শুনিয়েছেন। তো বাঁকুড়ার রিক্সাচালকেরা বলে, আমাদের বাঁকুড়ার কথা লিখেছেন সেই জন্যে আমরা এই দুটো ঘোড়া দিলাম। রিক্সাচালক ইউনিয়ন দিয়েছিল। পাঠ্যক্রমে আমার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে আমি যে বিশেষ আপ্লুত ছিলাম, এমনটা নয়। কিন্তু এই বিষয়ে একটি ফোন আমাকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দিল। একদিন কাকভোরে একটি ফোন এল। একটি কচি কণ্ঠ —- “কাকু ছাড়বে না ছাড়বে না। আমি মালা বলছি। আমি পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি স্কুলে পড়ি। আমাদের মর্নিং স্কুল। তোমার কবিতাটা খুব ভাল।” এরকম আরও কয়েকটি বাচ্চা আমাকে বলেছে বিভিন্ন সময়ে।
[the_ad id=”270084″]
সুস্নাত চৌধুরী: প্রায় এক দশক অপেক্ষার পর আপনার নতুন কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠক চূড়ান্ত কথা বলবেন, ঠিকই। তবু এই বই নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?
মৃদুল দাশগুপ্ত: আমি আর কী ভাবব। ১০০টা কবিতা লিখব বলে শপথ করেছিলাম, লিখতে পেরেছি। যুগান্তরে যখন কাজ করতাম, বড় বড় সব ঔপন্যাসিক আমার আশেপাশে ছিলেন। এক দিকে শ্যামলদা (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়), একদিকে অতীনদা (অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়), ওইখানে প্রফুল্ল রায়। এঁরা সব বড় বড় উপন্যাস লিখতেন। তাঁদের দেখে মনে হত, বড় গদ্য লেখা খুবই পরিশ্রমসাধ্য। সেই তুলনায় কবিতা লেখা অনেক ফুরফুরে কাজ। আর আমি তো দীর্ঘ কবিতা লিখিনি। যাই হোক, লিখে ফেলতাম। কিন্তু এই বইটা লিখতে গিয়ে বুঝেছি, যে কবিতা লেখাও একটা পরিশ্রমের কাজ। লেখাটাই পরিশ্রমের কাজ। এই বইটার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে। আগের কোনও বইয়ের ক্ষেত্রে মনে হয়নি। আগের বইয়ের কবিতাগুলো বেশ অনেক দিন ধরে লেখা এক একটি সংগ্রহ। কিন্তু এই বইটি পরিকল্পিতভাবে ১০০টি কবিতা নিয়ে তৈরি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এতগুলো কবিতা লেখা যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ।
সুস্নাত চৌধুরী: দু’বছর হল আপনার গল্পের বইটি প্রকাশের। ‘পার্টি বলেছিল ও সাতটি গল্প’। কথা প্রসঙ্গে একবার আপনি বলেছিলেন, এই বইটি বাংলা ছোটগল্পের তাকে ঈষৎ তেরছা হয়ে দাঁড়িয়ে। এমন বক্তব্যের কারণ?
মৃদুল দাশগুপ্ত: এই গল্পগুলোতে অসত্য কিছু তুলে আনিনি। বহুবার নানারকম ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি আমার হয়েছে। এমনকী সেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যেমন হাওড়া স্টেশনের পিছনে আমি দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার মাঠ দেখেছিলাম। আমার পরলোকগতা মাকে আমি অনুভব করেছি। এত গভীর সেই অনুভব, যেন ওই মা রান্নাঘরে রয়েছেন। আমি বোনকে বললাম, মাকে এক কাপ চা দিতে বল। এগুলোকে তুমি অলৌকিক বলতে পার, অধিবাস্তব বলতে পার, কল্পনা বলতে পার বা উড়িয়ে দিতে পার। কিন্তু আমার কাছে এগুলো প্রত্যেকটি সত্যি। এরাই আমার গল্পে আছে।
[the_ad id=”266919″]
সুস্নাত চৌধুরী: মা মারা যাওয়ার কতদিন পরে এই ঘটনা?
মৃদুল দাশগুপ্ত: মা মারা যাওয়ার ধর দু’ তিন মাস বাদে। মাস তিনেক বাদে।
সুস্নাত চৌধুরী: আপনার পরিচিতি কবি হিসেবে। কিন্তু আমরা জানি, ছড়ার ক্ষেত্রেও আপনি ভীষণ সংবেদনশীল এবং আগ্রহী। ১৯৯৭-এর ‘ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি’ থেকে ২০১৭-র ‘খেলাচ্ছড়া’– এ পর্যন্ত আপনার প্রকাশিত ছড়ার বই পাঁচটি। বাংলা ছড়ার যে বিস্তার, তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের লেখাগুলি নিয়ে আপনার কী অ্যানালিসিস? অধুনা অবহেলিত বাংলা সাহিত্যের এই প্রকরণটি নিয়ে আর কোনও পরিকল্পনা রয়েছে?
মৃদুল দাশগুপ্ত: ছড়া আমি প্রচুর লিখেছি। কবিতার জগতে বা সাহিত্যরসিকদের কাছে, অনেকের কাছেই, ছড়া খানিক কম গুরুত্ব পায়। যেন কবিতার চেয়ে ছড়া কিছু নীচের দিকে। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। ছড়া একটি অন্য আঙ্গিক, অন্য ভাষা। এর সারল্য, এর ছন্দ, এর ব্যঞ্জনা এমনই সহজ কিন্তু প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় এমনই গভীর, তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সুকুমার রায় স্মরণ করলেই আমার এই কথাটি তুমি বুঝতে পারবে।

সুস্নাত চৌধুরী: নিজের ছড়া লেখার ক্ষমতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মৃদুল দাশগুপ্ত: আমি খুব ভাল ছড়া লিখতে পারি। এটা মনে হয় যে আমি একজন বড় মাপের ছড়াকার। কবিতায় এটা বোঝা যায় না। খুব বড় বড় কবিও বুঝতে পারেন না যে তাঁরা আদৌ কবি কিনা।
সুস্নাত চৌধুরী: অনেক ছড়াই এখনও গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। সেগুলো নিয়ে কী ভাবছেন?
মৃদুল দাশগুপ্ত: এরকম প্রচুর রয়েছে। সব আমার কাছে নেই। রাজনৈতিক ছড়া যুগান্তরে অনেক লিখেছি। বিভিন্ন নামে লিখেছি। কেউ যদি বই করতে চান, আমার সংগ্রহে যা আছে তাই দিয়ে করতে পারেন।
সুস্নাত চৌধুরী: কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ, রিপোর্টাজ– মুখ্যত কবি হলেও নানাদিকে ডালপালা বিস্তার করেছে আপনার সাহিত্যকর্ম। পাঁচ দশক ধরে পাতার এপিঠে-ওপিঠে যুগপৎ আপনি লিখে গিয়েছেন অসামান্য সব রাজনৈতিক ও প্রেমময় ভাষ্যের কবিতা। আজ মধ্যষাটে, শীতের এই সন্ধ্যায় উষ্ণ পানীয়ে হালকা চুমুক দিতে দিতে কী মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোয় নিজেকে কেমন ভাবে দেখতে চান?
মৃদুল দাশগুপ্ত: প্রত্যেকেরই তো জীবনের একটা সীমা আছে। তাই না? আমি এখন ৬৫ পেরিয়ে গেছি। হয়তো আর ১০ বছর বাঁচব ম্যাক্সিমাম। হয়তো আর একটা বই লিখতে পারব। এটাই মনে হচ্ছে। আমার বেঁচে থাকা সম্পর্কে আর কী বলব? আমার মনে হয় লোকে আমাকে ভুলবে না। এই আর কি!
*ছবি সৌজন্য: boighar.in এবং সুস্নাত চৌধুরী
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সুস্নাত এখন মুদ্রণশিল্পের ওপর মনযোগ দিয়েছেন। বোধশব্দ পত্রিকা ও প্রকাশনীর সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে সময় পেলেই লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বই প্রকাশের নানা দিক নিয়ে ওয়র্কশপ পরিচালনা করে থাকেন।
2 Responses
মৃদুলের গল্পগুলি পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি,কবির অনুভব, কবির গদ্যভাষা ওর গল্পকে আলাদা করেছে, সব গল্পেই সময় চিহ্নিত হয়েও জীবন প্রসারিত হয়েছে অনেক। মৃদুল বছরে একটি দুটি গল্প লিখতে পারে। আমি পড়তে পারি।
Bhalo Interview