(Tintin)
টিনটিনের চন্দ্রাভিযান হয়েছিল নীল আর্মস্ট্রংদের অ্যাপেলো ১১ মহাকাশযান চড়ে চাঁদে নামার এক দশকেরও আগে। টিনটিনের কল্পিত চন্দ্রাভিযানের সঙ্গে বিস্তর মিল আছে ১৯৬৯-এ মার্কিন নভোচরদের চাঁদে নামার মধ্যে। একইভাবে অ্যার্জের ভিনগ্রহের প্রাণী(যাদের এলিয়েন বলা হয়)দের নিয়েও আলোচনা টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারে এসেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অ্যার্জে এক্ষেত্রেও সঠিক প্রমাণিত হবেন। (Tintin)
আরও পড়ুন: অ্যার্জে-কমিকসের জুল ভের্ন
অ্যার্জের কল্পবিজ্ঞানের সেরা কাহিনি যে টিনটিনের চন্দ্রাভিযান তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। তবে এই কাহিনি বলার আগে একটু প্রাককথন প্রয়োজন, যাতে কী দমবন্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে টিনটিন কাহিনি রচনা করেছেন অ্যার্জে, তার কিছুটা আন্দাজ পাঠককূল পান। (Tintin)
আসুন, পড়ে নেওয়া যাক চতুর্থ পর্ব…

দমবন্ধকর পরিবেশ
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিত্রবাহিনী ব্রাসেলসে ঢোকে। তাসের ঘরের মতো জার্মান দখলদার প্রশাসন ভেঙে পড়ে। বেশিরভাগ জার্মান ব্রাসেলস ছেড়ে পালায়। ব্যতিক্রম হয়নি জার্মান অধীন লি স্যোয়ার ক্ষেত্রেও। জার্মান প্রকাশক পালালেন। ফলে মালিকহীন সংবাদপত্রটি বন্ধ হয়ে গেল। টিনটিন কাহিনি তো বন্ধ হলই, অ্যার্জে নিজেও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হলেন। রাতারাতি সব কিছু পাল্টে গেল। যে অ্যার্জেকে নিয়ে দেশময় এত নাচানাচি, হঠাৎ সেই শিল্পীকে দখলকার জার্মান বাহিনী সমর্থক বলা শুরু হল। কারণ আর কিছুই নয়, অ্যার্জে কাজ করতেন জার্মান নিয়ন্ত্রিত কাগজে। তাই একদলের কাছে জর্জ রেমি হয়ে গেল জার্মান সমর্থক। নতুন প্রশাসনের তো বটেই, যুদ্ধের সময় জার্মান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে আসা বিভিন্ন রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের কালো তালিকায় উঠে এল অ্যার্জের নাম। তাঁকে বেশ কয়েকবার আটক করা হল, অবশ্য গ্রেফতার করা হয়নি শিল্পীকে। প্রতিবারই জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে অ্যার্জের শিল্পী হিসাবে সংবাদপত্রে কাজ করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল। তবে লি স্যোয়াতে অ্যার্জের অনেক সহকর্মী কিন্তু এত সহজে রেহাই পেলেন না। জার্মানদের সহযোগিতা করার অভিযোগে অনেকেরই দীর্ঘ কারাবাস হল। (Tintin)
যে অ্যার্জেকে নিয়ে দেশময় এত নাচানাচি, হঠাৎ সেই শিল্পীকে দখলকার জার্মান বাহিনী সমর্থক বলা শুরু হল। কারণ আর কিছুই নয়, অ্যার্জে কাজ করতেন জার্মান নিয়ন্ত্রিত কাগজে।
এরই পাশাপাশি নানান পারিবারিক সমস্যাও অ্যার্জেকে ঘিরে ফেলল। ১৯৪৫ এর ২১শে এপ্রিল অ্যার্জের ছোটভাই পলের ভুয়ো মৃত্যুর খবর শুনে অ্যার্জের মা এলিজাবেথের নার্ভাস ব্রেকডাউন হল। বছর খানেক রোগভোগের পর এলিজাবেথ মারা যান। কিন্তু এবার অ্যার্জের রক্ষাকর্তা হয়ে দেখা দিল টিনটিন। প্রবল জনপ্রিয়তা দিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে তাঁর স্রষ্টাকে টেনে তুলল টিনটিন। (Tintin)

কীভাবে হল এই অসাধ্যসাধন?
যখন চারিদিকে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না অ্যার্জে, ঠিক সেই সময়, ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে আশার প্রদীপ হাতে তাঁর কাছে এলেন রেমন্ড লুব্ল্যো নামে এক প্রকাশক। আদতে ল্য ভ্যামসিয়েম সেঁকনা (যেখানে টিনটিনের আত্মপ্রকাশ) সংবাদপত্রের ডিরেক্টর পিঁয়ের উজেরের ভাই এই রেমন্ড। টিনটিনের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে টিনটিন নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করছেন তিনি। এই নতুন পত্রিকার আর্ট ডিরেক্টর হিসাবেই অ্যার্জেকে চাইলেন তিনি। পত্রিকার সব আঁকাজোকার চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি নতুন টিনটিন কাহিনি করতে হবে অ্যার্জেকে। বিনিময়ে অ্যার্জের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার ব্যাপারে সাহায্য করবেন রেমন্ড। চারিদিকের চাপে তখন অ্যার্জের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। ফলে পত্রপত্রিকায় ফিরে আসার এই ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার’ সুযোগ শিল্পী হেলায় হারাতে চাইলেন না। অ্যার্জে টিনটিন পত্রিকায় যোগ দিলেন। (Tintin)
আরও পড়ুন: টিনটিনের অন্দরমহলে: দ্বিতীয় পর্ব
অবশ্য অ্যার্জের আরও একটি কারণ ছিল এই নয়া পত্রিকায় যোগদানের পিছনে। প্রকাশক রেমন্ড আদতে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়াম রেজিস্ট্যান্স গ্রুপে। যুদ্ধ শেষে ভাবলেন বেলজিয়ান ও ফরাসি ভাষায় শিশু ও কিশোরদের জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করার কথা। অনেক ভেবে টিনটিন নামটাই রেমন্ডের যুৎসই মনে হল। অর্থ্যাৎ যুদ্ধোত্তর বেলজিয়ামে রেমন্ড তখন বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। তাঁর নাগাল একদম প্রধানমন্ত্রীর টেবিল পর্যন্ত। অথচ একদা সেলিব্রিটি অ্যার্জে তখন বন্ধুহীন। তাঁর প্রায় সব বন্ধুই অন্তরীণ। অ্যার্জের চারিদিকে শত্রু। তাঁকে প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় শান্তিতে কাজ করার জন্য কোনও ক্ষমতাশালী বন্ধুর ছত্রছায়া ভীষণভাবে দরকার ছিল অ্যার্জের। রেমন্ড হলেন সেই ইচ্ছাপূরণ। (Tintin)
প্রকাশক রেমন্ড আদতে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়াম রেজিস্ট্যান্স গ্রুপে। যুদ্ধ শেষে ভাবলেন বেলজিয়ান ও ফরাসি ভাষায় শিশু ও কিশোরদের জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করার কথা। অনেক ভেবে টিনটিন নামটাই রেমন্ডের যুৎসই মনে হল।
১৯৪৬ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর বের হল টিনটিনের প্রথম সংখ্যা। আর সেটাই যাকে বলে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। দুরুদুরু বক্ষে হাজার ষাটেক কপি বাজারে ছেড়েছিলেন রেমন্ড। তিন দিনের মধ্যে তা নিঃশেষ। ফলে দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে আরও বিশ হাজার কপি বেশি বাজারে ছাড়া হল। শুধু তাই নয়, পাঠকদের উচ্ছ্বসিত চিঠিপত্র অ্যার্জেকে ফের সাহস জোগাল। লি স্যোয়ারে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রিজনার্স অফ দ্য সান আবার টিনটিন পত্রিকায় চালু করে দিলেন অ্যার্জে। (Tintin)
সেই শুরু। এরপর আর কখনও অ্যার্জেকে থামতে হয়নি। ১৯৮৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত টানা খান দশেক টিনটিন কাহিনি ঠাঁই পেয়েছে এই পত্রিকায়। এমনকি টিনটিনের শেষ অসমাপ্ত কাহিনি ‘টিনটিন অ্যান্ড আলফ আর্টও এর ব্যতিক্রম নয়।

খুঁটিনাটি গবেষণা
টিনটিনের চন্দ্রাভিযানের কাহিনি বিশ্ব কমিকসের জগতে তো বটেই, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও এক মাইলফলক। সিয়ান লি তাঁর ‘দ্য ইন্সপিরেশন বিহাইন্ড টিনটিন-দ্য রিয়েল অ্যার্জে’তে জানিয়েছেন, ১৯৪৮ সালে ‘ল্যান্ড অফ ব্ল্যাক গোল্ড’ (১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ অবধি এটি টিনটিন পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়) শেষ করার পরই টিনটিনের পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার হিসাবে চন্দ্রাভিযান ঘোষিত হয়। এবং এই চিন্তার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ ‘ডেসটিনেশন মুন’ এবং ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ ‘এক্সপ্লোরার্স অন দ্য মুন’ পরপর টিনটিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (Tintin)

এক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনে অ্যার্জের সময় জ্ঞানের প্রশংসা করতেই হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কার্যত মহাকাশ গবেষনায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধোত্তর পর্বে শুরু হল আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে চূড়ান্ত রেশারেশি যা পরে ঠান্ডা যুদ্ধের রূপ নেয়। এই রেশারেশির থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানও বাদ যায় না। ফলে চাঁদে কোন দেশ প্রথম নামতে পারবে সেটাই তখন দু’দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে টিনটিন চন্দ্রাভিযান করলে সেটা যে বিশ্বের নজরে পড়বে তা বুঝতে দেরি হয়নি অ্যার্জের। (Tintin)
চাঁদে কোন দেশ প্রথম নামতে পারবে সেটাই তখন দু’দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে টিনটিন চন্দ্রাভিযান করলে সেটা যে বিশ্বের নজরে পড়বে তা বুঝতে দেরি হয়নি অ্যার্জের।
তাই যা ভাবা সেই কাজ। পুরোদমে মহাকাশ সম্বন্ধে জানতে নেমে পড়েন অ্যার্জে। জ্যোতির্বিদ্যার উপর ছোটখাট লাইব্রেরিই গড়ে তোলেন। তাঁর এই মহাকাশ অভিযান গবেষণা ও কাহিনির কাঠামো তৈরি সংক্রান্ত কাজে সহায়তার জন্য বিভিন্ন কার্টুনিস্টের কাজ করা, আইন জানা আলবার্ট ওয়েনবার্গ নামে এক সহকারীকে নিলেন। মহাকাশ যানের ককপিটের খুঁটিনাটি জানার জন্য ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল চিঠি লিখলেন রুশ-ফরাসী মহাকাশযান বিশেষজ্ঞ আলেকজান্দ্রে অ্যানানফকে। অ্যানানফ সানন্দে সাহায্য করতে রাজি হলেন। মহাকাশ বিজ্ঞান বুঝতে অ্যার্জে সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চে পর্যন্ত গেলেন। সেন্টারের ডিরেক্টর ম্যাক্স হোয়াক্সের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেন। গবেষণার কাজের পরে স্টোরি বোর্ডে হাত দিলেন অ্যার্জে। তখন যে রকেটে চেপে টিনটিন চাঁদে যাবে বলে ঠিক করা হল সেটা তৎকালীন ভি-২ রকেটের আদলে করা হল। ভি-২ রকেটের নির্মাতা জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ভন ব্রন পরে নাসায় যোগ দেন। ফলে দেড় দশক বাদে যখন আর্মস্ট্রংরা অ্যাপেলো ১১ চেপে চন্দ্রাভিযানে গেলেন তখন গল্পের রকেটের সঙ্গে রকেটের বিস্তর মিল নজরে এল। এই মহাকাশ যানের আঁকার খুঁটিনাটি আবার অ্যানানফকে দেখিয়ে নিলেন যাতে কোনও ভুল না থাকে। (Tintin)
আরও পড়ুন: অ্যার্জের ছেলেবেলা বা টিনটিনের গপ্পো
শুধু কি তাই? নয়া সহকারি বব দি মুরের সঙ্গে একটানা বসে নিঁখুতভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠ এঁকে ফেললেন অ্যার্জে। এত খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দিয়ে কমিকস তৈরির ক্ষেত্রে টিনটিনের এই জোড়া কাহিনি সত্যিই নজির গড়ল। ১৯৫০ এর ১২ মার্চ থেকে প্রতি সপ্তাহে টিনটিন পত্রিকায় ‘ডেস্টিনেশন মুন’ প্রকাশিত হতে শুরু করল। কল্পবিজ্ঞান কমিকসে থাকলেও তা যে কতটা বস্তু নিষ্ঠ হতে পারে তা অ্যার্জের এই জোড়া কাহিনি দেখিয়ে দিল। (Tintin)

অ্যার্জের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে হ্যারি থম্পসন লিখলেন, “আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন যখন অ্যাপেলো মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে চাঁদের বুকে পা রাখলেন, সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গেল। শুধু অবাক হল না টিনটিন ভক্তরা। দু’দশক আগেই তারা জেনে গিয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠ কেমন দেখতে। কারিগরি দিক দিয়ে দেখলে এক্সপ্লোরারস্ অন দ্য মুন কিন্তু জুল ভের্ন, এইচ জি ওয়েলসের কাজের সমতূল্য। অ্যার্জে জানেন তাঁর কল্পনাকে কখন লাগাম দিতে হয়। পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়াশোনা আর বাস্তবজ্ঞান না থাকলে এত সঠিকভাবে চাঁদের পরিবেশ ফুঁটিয়ে তোলা যায় না।” (Tintin)
তথ্যসূত্র:
(১) টিনটিন অ্যার্জে অ্যান্ড হিজ ক্রিয়েশন- হ্যারি থম্পসন
(২) দ্য রিয়েল অ্যার্জে- সিয়ান লি
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে