গায়ে যখন ছ্যাঁকা এসে লাগে, বা কোনও আঘাত, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আর্তনাদ করে। আবার এমনও হয়, ঘটনার ভয়ংকর অভিঘাতে সে পাথর এবং বোবা হয়ে গেল। ভাষাহীন হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে আমরা মুংখের সেই বিখ্যাত ‘চিৎ্কার’ নামক পেইন্টিংটির কথা বলতে পারি। নীরবতা তো অনেক সময় শান্তির হয় না। সেই নীরবতার মধ্যে অনেক আকাশ ছিঁড়ে দেওয়া আর্তনাদও থাকে। লাশের রাজনীতি থাকতে পারে, মৃত্যুর রাজনীতি থাকতে পারে, আবার এই শোকপ্রকাশেরও রাজনীতি থাকতে পারে।
কিন্তু আসুন আমরা ফিরে যাই ঘটনাস্থলে, সেই সময়ে, মানসিকভাবেই, যখন রামপুরহাটে একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার উন্মত্ত হিংস্র খুনিরা। সেই সময়ে আপনি নিজে হয়তো সেই বাড়িতে রয়েছেন কিংবা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন এই ভয়ংকর কাণ্ড। তখন আপনার যে প্রতিক্রিয়া তাও অনেক রকম হতে পারে। আপনি উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন, আপনি পাথর হয়ে যেতে পারেন। আপনি প্রতিহিংসার বশবর্তী হতে পারেন। এমন নানা কিছু। সে সময় রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের কথা মনে থাকে না। কারণ ঘটনার অভিঘাত হয় তার চোখ খুলে দেয়, নয় তাকে অন্ধ করে দেয়।
একজন কবি তো আসলে কোনও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। তিনি থাকেন ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে। অথবা হয়ে ওঠেন এনজেনৎসবার্গের মতো ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে থেকেই অন্তর্ঘাতী। এই দ্বিতীয় ভূমিকাটি হয়ে ওঠা খুবই কঠিন। কিন্তু আবার একজন কবি, ভয়ংকর সময়ের এক জীবন্ত দলিল রচনাও করতে পারেন। তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি বিভিন্ন কবির লেখায়। জার্মান কবি লিখটারস্টাইনের কবিতায় বা লোরকার কবিতায় তা জীবন্ত, গা শিরশির করে ওঠে। স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ দেখে যেমন আমরা অস্থির হয়ে উঠি, এ সময়টা তো তেমনই। সারা বিশ্বেই তো চলছে একপ্রকার হিংসা ও প্রতিহিংসার খেলা। তার তরঙ্গে আমরা নিজেরাও যে সহিষ্ণুতা হারাচ্ছি না, তা নয়। হয়তো আমাদের মনের ভিতরেও হয়ে চলেছে একপ্রকার অভিযোজন, যার কথা আমরা জানতেও পারছি না। কিন্তু এই চলমান ধ্বংসলীলার মধ্যে একজন কবি যখন তাকিয়ে থাকেন, তখন তাঁর অসহায়তা ও পাথর হয়ে যাওয়া দুঃখের ভিতর থাকে একপ্রকার অন্তর্দৃষ্টি। তা অনেকাংশেই হয়তো আবেগপূর্ণ, আবার অনেকাংশেই আবেগবর্জিতও বটে।

কবি জয় গোস্বামী এর আগেও নন্দীগ্রামের ঘটনায় যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে লিখেছিলেন ‘শাসকের প্রতি’। না লিখে তাঁর উপায় ছিল না। কদিন আগে রামপুরহাটের কাছে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফসল যে গণহত্যা, তা এতটাই নারকীয়, যে কোনও শিল্পের পক্ষে সহজে তা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু জয়কে তাঁর মনের ভিতরে থাকা রক্তাক্ত অক্ষরগুলিকে লিখে ফেলতেই হত। আর তিনি লিখলেন একটি চটি বইয়ে। বইটির নাম ‘দগ্ধ’। প্রকাশ করেছেন গুরুচণ্ডালী। মাত্র আটটি কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থে। কিন্তু প্রতিটি কবিতাই এই রক্তাক্ত সময়ের, এই হিংস্র সময়ের দলিল হয়ে রয়ে গেল।
বারো পাতার একটি বইয়ের আলোচনায় সব কবিতা তুলে দিলে বইটির প্রতি অবমাননা করা হয়। তাই এক্ষেত্রে সেই সংযম দেখাতেই হচ্ছে। কিন্তু ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ছ’টার সময়ে লেখা কবিতাটিতে জয়ের এক সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বোধ ফুটে উঠেছে, যা আমরা সচরাচর প্রতিহিংসাবশত ভুলে যাই।
ওরা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার?
কার গোষ্ঠী? কার গোষ্ঠী? কার?
ওই পাঁচজন মহিলার
পোড়া শক্ত কালো দেহ জানাবে কি ওদের ওপর
কীভাবে সক্রিয় ছিল কোন বিশেষ গোষ্ঠীঅধিকার?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন রয়েছে এই ক্ষুদ্র কাব্যপুস্তিকাটিতে। পারিবারিক বিবাদের জের, না রাজনৈতিক ঘটনা তা আমাদের জানা নেই। কবি কী জানেন? জানেন এইটুকুই, একটি বাচ্চা আগুনের মধ্যে ছোটাছুটি করে লাশ হয়ে হাসপাতালের মর্গে বিকৃত দেহ হয়ে পড়ে আছে, যাকে চেনাও যাচ্ছে না।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত, আতঙ্কে, ভয়ে, অসুস্থ হয়ে একজন সংবেদনশীল কবি লিখে চলেছেন একটার পর একটা কবিতা। রাত ১টা ১৫-তে লেখা একটি কবিতায় তিনি বলছেন– “ এখন কী করব আমি?/ কবিতা লিখতেও হাত পুড়ে যায়, পুড়ে যায়, পোড়ে…”। সেইসব গলিত বিকৃত, পুড়ে আংরা হয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে তিনি দেখতে পান অভীক, অর্ক, অভিরূপদের, দেখতে পান বুকুন, কাবেরীকে। পিতৃহৃদয়, বন্ধুহৃদয় মিশে যায় আবহমান কাল ধরে প্রবাহিত এই রাজনৈতিক হিংসাস্রোতে। তাঁর তো অন্য কোনও রাস্তা জানা নেই। রাত সাড়ে তিনটের সময় তাঁর মনে হয় এই পুড়ে যাওয়া লাশগুলিকে তিনি কোথায় দাফন করবেন? ‘ ওদের দাফন করব এখন কোথায়?/ বলো, কোন কবিতার কাছে?’
এই কবিতার বইয়ে কোনও আশাবাদ নেই। আশাবাদ থাকার কথাও নয়। কারণ কবি এই কবিতাগুলি লিখতে চাইছেন না। অথচ কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনও মাধ্যম নেই তাঁর কাছে যেখানে তিনি এই কথাগুলি বলবেন। এই কথাগুলি কি রাজনৈতিক? রাজনীতি মানে কী? দলীয় বিবাদ? মিছিল, মিটিং, নির্বাচন? বিপ্লব শব্দটি তো এখন আভিধানিক। হয়তো দিবাস্বপ্নে মানুষ উচ্চারণ করে। রাজনীতি মানে তবে কী? কোন দল, কোন গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা নেই? আমরা যদি মানুষ হিসেবে উন্নত না হতে পারলাম, তবে রাজনীতি করেই বা আমরা কী করব? যদি না হিংসার বিপরীতে প্রতিহিংসাকে প্রশ্ন করতে পারলাম, তাহলে আমরা কী রাজনীতি করি? আদিম প্রবৃত্তিগুলিকে আধুনিক অস্ত্র করে তোলার নাম তো রাজনীতি নয়। বা, তারই নাম হয়তো রাজনীতি। আমরা জানি না। কিন্তু এর ফলে কী হয়?
মানুষ দগ্ধ হয়। মানুষ চরম অপমানিত হয়। মানুষ এই পৃথিবীতে থাকার সামান্য একটা জীবন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। জয় গোস্বামীর এই কবিতার বইতে যেমন দুই লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যতায় তিনি শ্বাস নিচ্ছেন, এক একটা প্রশ্নের পর তিনি নিরুত্তর তাকিয়ে থাকছেন সময়ের দিকে, তেমনই, এক একটি প্রশ্নচিহ্নকে পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন ভাবার জন্য। কার গোষ্ঠী, কাদের গোষ্ঠী,কেন গোষ্ঠী— এসবের থেকে বড় কথা সময়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই পোড়া পোড়া লাশ, যারা আর কোনওদিনই কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। জানতেও পারবে না, এই হিংসা ও প্রতিহিংসার খেলায় কেন তাদের মৃত্যু হল? কেন কবিকে দাফন করতে হল তাদের এই সব কবিতার মধ্যেই?
দগ্ধ, নির্জন এক শ্মশানক্ষেত্র বা কবরের মতোই পড়ে থাকে এই কাব্যগ্রন্থটি। কিছু প্রশ্ন নিয়ে, যার উত্তর কখনও আসবে না।
গ্রন্থ: দগ্ধ
লেখক: জয় গোস্বামী
প্রকাশক: গুরুচণ্ডালী
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২২
বিনিময়: ১৫ টাকা
*ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: Sangbad Pratidin, HTBangla, Guruchandali, Youtube
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।