ভরত বংশের এক রাজার নাম হস্তি, তিনিই হস্তিনাপুর নগর স্থাপন করেন। হস্তির চার পুরুষ পর কুরু রাজা হন। কুরুর পিতা সংবরণ ও মাতা তপতী। কুরুর নাম অনুসারে কুরুক্ষেত্র ও কৌরব বংশ। কুরুর অধস্তন অষ্টম পুরুষের নাম শান্তনু। শান্তনুর পিতা প্রতীপ ও মাতা সুনন্দা। শান্তনুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবাপি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন বলে শান্তনু হস্তিনাপুরের রাজা হন। শান্তনুর কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম বাহ্লীক। শান্তনু সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যাঁকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেন তিনি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হলেও নবযৌবন ফিরে পেতেন। এই কারণে তাঁর নাম ‘শান্তনু’। শান্তনু ছিলেন সম দেবতার মতো সুদর্শন, কম্বুগ্রীব, মহাসত্ত্ব এবং রাজচক্রবর্তীলক্ষণযুক্ত।
পূর্বজন্মে শান্তনু ছিলেন ইক্ষাকু বংশীয় রাজা মহাভীষ। গঙ্গার সূক্ষ্ম বস্ত্র বায়ু দ্বারা অপসৃত হলে দেবতারা অন্য দিকে চোখ ফেরালেও মহাভীষ গঙ্গার রূপ দু চোখ ভরে দেখতে লাগলেন। তাই ব্রহ্মা তাঁকে মর্ত্যে পুনরায় জন্মানোর অভিশাপ দেন। মহাভীষ প্রতীপের পুত্র হিসাবে জন্মানোর বাসনা প্রকাশ করেন। গঙ্গা মহাভীষকে ভাবতে ভাবতে মর্ত্যে আসছিলেন। রাস্তায় দেখা হয় মূর্চ্ছিত অষ্টবসুর সঙ্গে। বশিষ্ঠ বসুদের চুরির অপরাধে নরযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দিয়েছেন। বসুরা গঙ্গাকে বলেন, তিনি যেন তাঁদের জননী হন আর পিতা হিসাবে তাঁরা কুরুবংশীয় রাজাকে চান। আর জন্মের পরেই যেন তাঁদের জলে ফেলে দেওয়া হয়, মানে মেরে ফেলা হয়। গঙ্গা বলেন, কুরুবংশীয় রাজাই তোমাদের পিতা হবেন। কিন্তু আট জনকে আমি বিসর্জন দিতে পারব না তাতে আমার সঙ্গম ব্যর্থ হবে। বসুরা তাতেই সম্মত হলেন।
কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষ রাজা প্রতীপ একদা গঙ্গাতীরে বসে ধ্যান করছিলেন। এমন সময় দেবী গঙ্গা এসে প্রতীপের দক্ষিণ ঊরুতে বসলেন। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, কল্যাণী তুমি কী চাও? গঙ্গাদেবী জবাব দিলেন, আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই। প্রতীপ জানালেন, পরস্ত্রী ও অসবর্ণা তাঁর অগম্যা। গঙ্গা উত্তর দিলেন, তিনি দেবকন্যা ও পরস্ত্রী নন। প্রতীপ বললেন, তুমি আমার বাম ঊরুতে না বসে ডান ঊরুতে বসেছ যেখানে কন্যা, পুত্র ও পুত্রবধূর স্থান; তুমি আমার পুত্রবধূ হয়ো। গঙ্গা বললেন, কিন্তু আপনার পুত্র আমার কোনও কার্যে আপত্তি করতে পারবেন না। রাজর্ষি প্রতীপ উচ্চারণ করলেন, তথাস্তু।
প্রতীপ ও তাঁর স্ত্রী সুনন্দা এক জন সর্বগুণান্বিত পুত্রের আশায় তপস্যা করতে লাগলেন। তাঁদের একটি পুত্র আছে বটে কিন্তু সে সংসারবিমুখ। যথাকালে মহাভীষ প্রতীপ-সুনন্দার দ্বিতীয় পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করলেন। পুত্রটি যৌবনে পদার্পণ করলে প্রতীপ তাঁকে বললেন, তোমার জন্য এক রূপবতী কন্যা আমার কাছে এসেছিল, তুমি তাঁকে বিবাহ করো। শান্তনুকে রাজত্বের ভার দিয়ে প্রতীপ সস্ত্রীক বনে গমন করলেন।
পূর্বপুরুষদের মতো শান্তনু মৃগয়া ভালবাসতেন। একদা মৃগয়ায় গিয়ে ভাগীরথী তীরবর্তী উপবন অতিক্রম করার সময় এক জন দিব্যাভরণভূষিতা পরমাসুন্দরী নারীকে দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বলেন, তুমি দেবী, দানবী, অপ্সরা না মানবী? আমি তোমার পাণিপ্রার্থনা করি। গঙ্গা জবাব দিলেন, আমি তোমার মহিষী হব কিন্তু আমার কোনও কার্য তোমার অপ্রীতিকর লাগলেও তুমি আমাকে বাধা দেবে না বা আমার বিরুদ্ধে পরুষ বাক্য বলবে না, তেমন হলে আমি তোমাকে ত্যাগ করব।
শান্তনু সম্মত হলেন। মনু-নির্দেশিত অষ্টম বিবাহের অন্যতম গান্ধর্ব-বিধান অনুসারে তাঁরা আবদ্ধ হলেন। হস্তিনাপুরে মনুসংহিতা অনুযায়ী সব বিধি পালন করা হত।
বিবাহের পর সঙ্গম, তার পর পুত্র। একে একে সাত পুত্রের জন্ম দিয়ে গঙ্গা তাদের জলে নিক্ষেপ করে বলতেন, এই তোমার প্রিয় কার্য করলাম। শান্তনু শর্ত অনুযায়ী কিছু বলতেন না। কিন্তু অষ্টম পুত্র জন্মানোর পর শান্তনু গঙ্গাকে বললেন, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? গঙ্গা জবাব দিলেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি আর থাকব না। গঙ্গা নিজের পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের কাহিনি সবিস্তারে বললেন। গঙ্গা নবজাতককে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন। রাজা শান্তনু দুঃখিত হৃদয়ে কালাতিপাত করতে লাগলেন। বেশ কয়েক বছর পর, শিশুত্ব কেটে গেলে অষ্টম পুত্র দেবব্রতের ভার পিতা শান্তনুকে দিয়ে চলে গেলেন গঙ্গা। শান্তনু পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। চার বছর কেটে গেল।
শান্তনু আবার মৃগয়ায় গেলেন এক দিন। এই বার কিন্তু গঙ্গার তীরে নয়, গঙ্গার জল বড় শুভ্র আর তার পণ্যপ্রবাহ যেন যৌথ সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। যমুনার জল বড় কালো। সেই নদীতীরের অরণ্যে মৃগয়ায় গিয়ে বিপত্নীক শান্তনু সুগন্ধ পেলেন কিন্তু কীসের সেই খুশবু? অনুসন্ধান করে জানলেন যমুনার এক খেয়ানীর শরীর থেকে এই গন্ধ আসছে। তার নাম মৎস্যগন্ধা—মৎ বা নিজস্ব সম্পত্তির গন্ধ তার গায়ে, সে এককালে সমাজে ছিল নিন্দিত। পরাশর নামক এক ঋষির কল্যাণে সে গন্ধবতী ও সমাজে নন্দিতা হয়। সেই কালী নামের কন্যার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু জানলেন যে ওই কন্যা শূদ্রকন্যা, সে এক ধীবরের মেয়ে। রাজা শান্তনু তার পিতা ধীবর দাশরাজের কাছে গিয়ে ওই কন্যার পাণিপ্রার্থনা করলেন। কন্যা ও তার পিতা জানেন, খেয়ানী পূর্বে একবার গান্ধর্বমতে বিবাহ সম্পাদন করেছেন এবং এক পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। হস্তিনায় যে সংহিতা চালু রয়েছে তা মনুস্মৃতি, সেই বিধিসমূহ কন্যার এমন দ্বিতীয় বিবাহকে অনুমোদন করে না। উপরন্তু হস্তিনার বার্তা বা অর্থনীতি গঙ্গাপ্রবাহের অনুসারী। কীভাবে এই বিবাহ সম্পন্ন হবে, ভেবে পেলেন না দাশরাজ। ধীবর দাশরাজ শান্তনুকে বললেন, এই বিবাহ-সম্পর্কে তিনি সম্মত হবেন যদি রাজা তাঁর কন্যার গর্ভজাত পুত্রকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
শান্তনু পড়লেন মহা সঙ্কটে। গঙ্গাপুত্র দেবব্রত হস্তিনার যুবরাজ। এখন যমুনার খেয়ানীর পুত্রকে তাঁর পরিবর্তে কীভাবে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন তিনি! সে তো মহা অধর্ম হবে। তা ছাড়া এই কন্যা পূর্বে গান্ধর্ব-বিবাহবিধান অনুসরণ করে এক পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করেছে এবং সেই পুরুষ জীবিত। জীবিত বা মৃত হলেও সেই পুরুষের ক্ষেত্র এই ধীবরকন্যা—তেমনই বলা আছে সংহিতায়। ভাবতে ভাবতে সময় কাটে, কৃশকায় হয়ে যেতে লাগলেন রাজা শান্তনু। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না পুত্র দেবব্রতর। তিনি অমাত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে পিতার বিবাহে উদ্যোগী হলেন। দাশরাজ আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, দেবব্রতর পুত্ররা যদি সিংহাসন নিয়ে ঝামেলা করে! দেবব্রত জানালেন, তেমন হওয়ার পথ তিনি রুদ্ধ করে দেবেন। বিবাহসম্পর্কিত সংহিতাসূত্র পালটে গেল। কন্যার পূর্বতন গান্ধর্ব-বিবাহ-সঙ্গী পরাশরের বানানো নতুন নিয়ম মানতে শুরু করল হস্তিনার রাজপ্রাসাদ। দেবব্রত সিংহাসনের দাবি ছেড়ে আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার শপথ গ্রহণ করলেন।
শান্তনু পুত্র দেবব্রতের এমন আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন।
দাশরাজের কন্যা মৎস্যগন্ধা যাঁকে কালী বা গন্ধবতী বলেও ডাকা হয়, তাঁর নতুন নাম হল সত্যবতী। তিনি হলেন শান্তনুর স্ত্রী, হস্তিনার নতুন রাণী। সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুই পুত্র জন্মলাভ করে—একজন চিত্রাঙ্গদ ও অন্যজন বিচিত্রবীর্য। এই দুই পুত্রকে শিশু অবস্থায় রেখে শান্তনু লোকান্তরিত হন। তিনি ছত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন।
শান্তনুর চরিত্রে তেমন কোনও বৈচিত্র্য নেই। গঙ্গা একে একে সাত পুত্রকে শিশু অবস্থায় হত্যা করা সত্ত্বেও কেন তিনি মুখ ফুটে কিছু বলেননি, এটাই আশ্চর্যের। এতই পত্নীনিষ্ঠ ছিলেন শান্তনু। তিনি দৈব বিষয় সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত কিছুই জানতেন না। জেনেছিলেন, গঙ্গা যখন চলে যান যেই সময় অর্থাৎ অষ্টম পুত্র জন্মানোর পরে। পণ্ডিতেরা বলেন, শান্তনুর এটা পত্নীপ্রেম নয় বরং বিমুঢ়তা এবং তিনি প্রবৃত্তির স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন।
শান্তনুর রাজত্বকালে দুটি বড়সড়ো পালাবদল ঘটে। হস্তিনার বার্তা বা অর্থনীতি সম্পূর্ণ পালটে যাওয়ার বন্দোবস্ত শুরু হয়ে যায়। শান্তনুর সময়ে পূর্বের বিধানসমূহ ধীরে ধীরে পালটাতে শুরু করে। রাজনীতির বদল হতে শুরু করে। হস্তিনার রাজপ্রাসাদে পরাশরের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।