(Upendrakishore Ray Chowdhury)
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
(১৮৬৩–১৯১৫)
বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার ছিলেন। সন্দেশ পত্রিকার শুরু তাঁরই হাতে, যা পরবর্তীতে তাঁর পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই, ইত্যাদি তাঁর অমর সৃষ্টি।
এক রাজার সাত রানী, কিন্তু ছেলেপিলে একটিও নেই। রাজার তাতে বড়ই দুঃখ, তিনি সভায় গিয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকেন, কেউ এলে ভাল করে কথা কন না। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
একদিন হয়েছে কি-এক মুনি রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। মুনি রাজার মুখ ভার দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাজা, তোমার মুখ যে ভার দেখছি, তোমার কিসের দুঃখ?’
রাজা বললেন, ‘সে কথা আর কি বলব, মুনি-ঠাকুর! আমার রাজ্য, ধন, লোকজন সবই আছে কিন্তু আমার যে ছেলেপিলে নেই, আমি মরলে এসব কে দেখবে?’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
এই কথা বলে মুনি চলে গেলেন। তারপর দিন গেল, রাত হল, ক্রমে রাত ভোর হল। তখন রাজামশাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে সোজাসুজি উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যি বনের ধারে একটা আমগাছ আছে তাতে পাকা পাকা সাতটি আমও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
মুনি বললেন, ‘এই কথা? আচ্ছ, তোমার কোন চিন্তা নেই। কাল ভোরে উঠেই তুমি সোজাসুজি উত্তর দিকে চলে যাবে। অনেক দূর গিয়ে একটা বনের ধারে দেখবে একটা আমগাছ রয়েছে। সেই আমগাছ থেকে সাতটি আম এনে তোমার সাত রানীকে বেটে খাইয়ে দিলেই, তোমার সাতটি ছেলে হবে। কিন্তু খবরদার, আম নিয়ে আসবার সময় পিছনের দিকে তাকিয়ো না যেন।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
এই কথা বলে মুনি চলে গেলেন। তারপর দিন গেল, রাত হল, ক্রমে রাত ভোর হল। তখন রাজামশাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে সোজাসুজি উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যি বনের ধারে একটা আমগাছ আছে তাতে পাকা পাকা সাতটি আমও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই বনে তিনি কতবার শিকার করতে এসেছে, কিন্তু আমগাছ কখনো দেখতে পান নি। যা হোক, তিনি তাড়াতাড়ি সেই গাছে উঠে আম সাতটি পেড়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরে চললেন। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
খানিক দূরে যেতে না যেতেই শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাকে ডাকছে,
ওগো রাজা, ফিরে চাও,
আরো আম নিয়ে যাও।
বিদায় অভিশাপ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মুনি যে সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে কথা রাজার মনে ছিল না। তিনি পিছন থেকে ডাক শুনেই ফিরে তাকিয়েছে, আর অমনি আমগুলো তাঁর হাত থেকে ছুটে গিয়ে আবার গাছে ঝুলতে লেগেছে। কাজেই রাজামশাই-এর আবার গিয়ে গাছে উঠে আমগুলি পেড়ে আনতে হল। এবার আর তিনি কিছুতেই মুনির কথা ভুললেন না। তিনি চলে আসবার সময় পিছন থেকে তাকে কতরকম করে ডাকতে লাগল, ‘চোর’ ‘চোর’ বলে কত গালও দিল। রাজামশাই তাতে কান না দিয়ে বোঁ বোঁ করে বাড়ি পানে ছুটলেন। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
বাড়ি এসে রানীদের হাতে সাতটি আম দিয়ে রাজামশাই বললেন, ‘তোমরা সাতজনে এই সাতটি আম বেটে খাও।’
মেটরানী তখন সেখানে ছিলেন না। বড় রানীরা দুজনে মিলে তাকে কিছু না বলেই সব কটি আম খেয়ে ফেললেন। টেরানী এর কিছুই জানতে পারলেন না, কিন্তু তার কি সব দেখল। বড় রানীদের খাওয়া হয়ে গেলে সে আমের ছলগুলি চুপিচুপি কুড়িয়ে নিয়ে গেল। সেই হলগুলো ধুয়ে বেটে ছোটরানীর হাতে দিয়ে বলল, মা, এই ওষুধটা খাও, তোমার ভাল হবে। ওষুধ খেতে হয়, তাই ছোটরানী আর কোন কথা না বলেই সেটা খেয়ে ফেললেন। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তারপর বড় রানীদের সকলেরই এক-একটি সুন্দর থোকা হল, রাজা তাতে খুশি হয়ে ধুমধাম আর গানবাজনা করালেন। ছোটরানীরও একটি খোকা হল, কিন্তু সেটি হল বানর। বানর দেখে রাজা চটে গিয়ে ছোটরানীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দেশের লোকের তাতে বড়ই দুঃখ হল। তারা একটি কুঁড়ে বেঁধে টেরানীকে বলল, মা, তুমি এইখানে থাকো। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেইখানে ছোটরানী থাকেন। বানরটি সেখানে থেকে দিন দিন বড় হচ্ছে। সে মানুষের মত কথা কয়। আর তার এমনি বুদ্ধি যে, কোন কথা তাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। যখন যে কাজের দরকার, অমনি সে তা করে। সারাদিন সে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, যেখানে যে ফল দেখে তা খায়; খুব ভাল লাগলে মার জন্যে নিয়ে আসে। তাকে কেউ কিছু বলে না, কারুর গাছের ফল খেতে গেলে সে ভারি খুশি হয়ে ভাল ভাল ফল দেখিয়ে দেয়। তার বুদ্ধি দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়! (Upendrakishore Ray Chowdhury)
এমনি করে দিন যাচ্ছে। বড় রাণীদের ছটি ছেলেও এখন বড় হয়েছে। তারা বানরটিকে যার পর নাই হিংসা করে, সে তাদের সঙ্গে খেলা করতে গেলে তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তারপর একদিন বানরটি দেখল, যে বড় রানীদের ছেলেদের জন্য মাস্টার এসেছে, তারা পুঁথি নিয়ে তার কাছে বসে পড়ে। তা দেখে বানর গিয়ে তার মাকে বলল, “মা, আমাকে পুঁথি এনে দাও, আমি পড়ব।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হায় বাছা, কি করে পড়বে? তুমি যে বানর।’
বানর বলল, ‘সত্যি মা, আমি পড়ব; তুমি বই এনে দিয়েই দেখো। তুমি আমাকে পড়াবে।’
বানরের এমনি বুদ্ধি, যে বই পায় সে দুদিনে পড়ে শেষ করে ফেলে। সে দুবছরে মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠল। বড় রানীদের ছেলেরা তখনো দু-তিনখানি বই-পুঁথি শেষ করতে পারে নি; রোজ খালি মাস্টারের বকুনি খায়।
এ-সব কথা শুনে রাজা একদিন বললেন, ‘বটে? বানরের এমনি বুদ্ধি? নিয়ে এসো ত তাকে, আমি দেখব।’
বানরের কিছুতেই ভয় নেই, রাজা ডেকেছে শুনে সে অমনি তার কাছে উপস্থিত হল। তাকে দেখে আর তার কথাবার্তা শুনে রাজার এমনি ভাল লাগল যে, তিনি আর কিছুতেই ছোটরানীকে কুঁড়েঘরে ফেলে রাখতে পারলেন না।
বানরের কিছুতেই ভয় নেই, রাজা ডেকেছে শুনে সে অমনি তার কাছে উপস্থিত হল। তাকে দেখে আর তার কথাবার্তা শুনে রাজার এমনি ভাল লাগল যে, তিনি আর কিছুতেই ছোটরানীকে কুঁড়েঘরে ফেলে রাখতে পারলেন না। বাড়িতে আনতেও ভরসা পেলেন না, পাছে বড় রানীরা কিছু বলেন। তাই তিনি ছোটরানীকে রাজবাড়ির পাশেই একটি খুব সুন্দর বাড়ি করে দিলেন। সেই বাড়িতে তখন থেকে ছোটরানী তার বানর নিয়ে থাকেন। টাকা- কড়ি যত লাগে রাজার লোক এসে দিয়ে যায়। লোকে তাঁর বাড়িটাকে বলে বানরের বাড়ি। এ-সব দেখে বড় রানীদের ছেলেরা বানরকে আরো বেশি হিংসা করতে লাগল। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
একটু একটু করে ছেলেরা বড় হয়ে উঠল। সকলে রাজাকে বলল, ‘রাজপুত্রেরা বড় হয়েছে, এখন এঁদের বিয়ে দিন।’
রাজা বললেন, ‘তাদের দেশ বিদেশ ঘুরতে দাও। তারা নানান জায়গা দেখে, নানানরকম শিখে টুকটুকে ছয়টি রাজকন্যা বিয়ে করে আনুক।’
সকলে বলল, ‘বেশ বেশ! তাই হোক।’
তারপর ছয় রাজপুত্র সেজেগুজে, টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নানান দেশ দেখতে বেরুল। তা দেখে বানর তার মাকে গিয়ে বলল, ‘মা, আমিও যাব।’
তার মা বললেন, তুমি কি করতে যাব জাদু, তোমাকে কোন্ টুকটুকে রাজকনা বিয়ে করবে?’
মা বললেন, ‘তুমি যে দেশ দেখতে যাবে, আমি তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব? ৩৬২ উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র বানর বলল, ‘আমি দেখতে দেখতে ফিরে আসব। তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে যেতে দাও।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
কাজেই ছোটরানী আর কি করেন? বানরকে যেতে দিতেই হল।
ছয় রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে রাজবাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। একটা বনের ভিতর দিয়ে তাদের পথ, সেই পথে চলতে চলতে তাদের নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় বনের ভিতর থেকে বানর বেরিয়ে এসে বলল, ‘দাদা, আমিও এসেছি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তাতে রাজপুত্ররা যার পর নাই রেগে বলল, ‘বটে রে, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমরা রাজকন্যা বিয়ে করে আনতে যাচ্ছি বলে তুইও তাই করতে যাবি! দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’ এই বলে তারা বানরকে মারতে মারতে আধমরা করে একটা গাছে বেঁধে রেখে চলে গেল। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেই বনে ছিল একদল ডাকাত। তারা দেখল যে ছয়জন রাজপুত্র ভারি সাজ করে টাকাকড়ি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। দেখেই ত তারা মার-মার করে চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল। রাজপুত্রেরা ভয়েই জড়সড়, তলোয়ার খুলবার কথা আর তাদের মনেই নেই। তাদের টাকাকড়ি, ঘোড়া, পোষাক-সবসুদ্ধ তাদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে যেতে তাদের দু মিনিটও লাগল না। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
কলাবতী রাজকন্যা: দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
রাজপুত্রদের ধরে নিয়ে খানিক দূরে এসেই ডাকাতেরা দেখল পথের ধারে একটা বানর বাঁধা রয়েছে। তাকেও তারা সঙ্গে করে নিয়ে চলল। বানর যেন তাতে বেশ খুশি হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের সঙ্গে যেতে লাগল। তা দেখে ডাকাতেরা ভাবল, বুঝি কারু পোষা বানর, কাজেই তাকে আর তারা তেমন করে বাঁধল না। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেই বনের ভিতরেই ডাকাতদের ঘর। সেদিন তাদের বড় পরিশ্রম হয়েছিল, তাই। রাজপুত্রদের নিয়ে সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে এসে বাঁধনসুদ্ধই ছটি ভাইকে একটা জায়গায় ফেলে রেখে তারা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন খুব করে তাদের নাক ডাকতে লেগেছে, তখন বানর চুপিচুপি করে নিজের বাঁধন দাঁত দিয়ে কেটে তাড়াতাড়ি গিয়ে রাজপুত্রদের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তখন আর তারা বানরকে ফেলে যাবে কোন্ লাজে? কাজেই তাকেও সঙ্গে করে, জিনিসপত্র নিয়ে, ঘোড়ায় চড়ে অমনি তারা প্রাণপণে ছুট দিল, ডাকাতেরা কিছুই টের পেল না। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
ডাকাতদের ওখান থেকে পালিয়ে রাজপুত্রেরা প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে লাগল, ভোরের আগে আর তারা কোথাও থামল না। সকালে তারা দেখল যে তারা ভারি চমৎকার একটা শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে খুব বড় এক রাজার দেশ;তার বাড়ি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে যেন একটা ঝকঝকে সাদা পাহাড়। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
ছয় রাজপুত্র সেই বাড়ির কাছে গিয়েই টকটক করে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার ভিতরে ঢুকে পড়ল। দারোয়ানেরা তাদের পোশাক আর ঘোড়ার সাজ দেখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সেলাম করল, আর কিছু বলল না। বানর কিন্তু জানে যে, সে সেখানে গেলেই তাকে ধরে ফেলবে;তাই সে রাজবাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে, খিড়কির পুকুরের ধারে শুয়ে রইল। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেই দেশের রাজারও ছিল সাত রানী। তাদের বড় জন ছিল ভারি হিংসুক আর দেখতে বিশ্রী, আর ছোটটি ছিলেন পরীর মত সুন্দর আর বড় লক্ষ্মী। বড়রা রাজাকে মিছামিছি নানান কথা বলে, ছোটরানীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; তিনি খিড়কির পুকুরের ধারে একটি কুঁড়ের ভিতরে থাকতেন, রাজা তাঁর কোন খবরও নিতেন না।
সেই দেশের রাজারও ছিল সাত রানী। তাদের বড় জন ছিল ভারি হিংসুক আর দেখতে বিশ্রী, আর ছোটটি ছিলেন পরীর মত সুন্দর আর বড় লক্ষ্মী। বড়রা রাজাকে মিছামিছি নানান কথা বলে, ছোটরানীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; তিনি খিড়কির পুকুরের ধারে একটি কুঁড়ের ভিতরে থাকতেন, রাজা তাঁর কোন খবরও নিতেন না। বড় ছয় রানীর ছটি মেয়ে ছিল, তারা দেখতে ছিল ঠিক তাদের মায়ের মতন, আর তাদের মনও ছিল তেমনি। আর ছোটরানীর যে মেয়েটি ছিল, সেও ছিল ঠিক তার মার মত—তেমনি সুন্দর, তেমনি লক্ষ্মী। তা হলে কি হয়, বড় রানীরা রাজাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ছোটরানীর মেয়েটা পাগল, কালো, কুঁজো, কানা, খোড়া, কালা আর বোবা। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেই খিড়কির পুকুরের ধারে, সেই ছোটরানীর কুঁড়েঘরের কাছে বানর গিয়ে শুয়ে রয়েছে। খানিক বাদে বড় রাণীদের ছয় মেয়ে ছটি ঘটি নিয়ে সেখানে স্নান করতে এল, ছোটরানীর মেয়েটিও তার ছোট্ট ঘটিটি নিয়ে এল। তারা স্নান করে চলে আসবার সময় সেই মেয়েটির ঘটি থেকে কেমন করে খানিকটা জল বানরের গায়ে পড়ে গেল। অমনি বড় রানীদের ছয় মেয়ে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ওমা! ওমা! তোমরা দেখো এসে—ছোটরানীর মেয়ে বাঁদরটাকে বিয়ে করেছে!”
বড় রানীরাও তা শুনে ছুটে এসে বলতে লাগল, ‘তাই ত, তাই ত। ছোটরানীর মেয়ে বানরটাকে বিয়ে করেছে!’
সেই খবর তখনি তারা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। দেশের সকল লোক রাজ সভায় বসে শুনল যে, ছোটরানীর মেয়ের একটা বানরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।
ছোটরানীর মনে যে কি কষ্ট হল, তা আর কি বলব! তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, মেয়েটিকে বুকে নিয়ে মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। তা দেখে বানর তাঁদের ঘরের দরজায় এসে বাইরে থেকে হাত জোড় করে বলল, মা, আপনি কাঁদবেন না। ভগবান যা করেন ভালই করেন; এ থেকেও আপনাদের ভাল হতে পারে।’ বানরকে মানুষের মত কথা কইতে দেখে রানী উঠে বসলেন। তার মনের দুঃখ যেন কোথায় চলে গেল। সেই থেকে বানর তার ঘরের কাছে গাছের ওপরে থাকে আর প্রাণপণে তাঁর সেবা করে। রাণী যখন শুনলেন যে, সে রাজপুত্র, তখন সে যে বানর, সে কথা তিনি ভুলে গেলেন; তাঁর মনে হল যে এমন ভাল আর বুদ্ধিমান তোক আর মানুষের ভিতরে নাই। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
এদিকে হয়েছে কি, সেই ছয় রাজপুত্রও রাজার বাড়িতে ঢুকে একেবারে তাঁর সভায় এসে হাজির হয়েছে; রাজা দেখেই বুঝতে পেরেছেন, এরা রাজপুত্র। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাপু তোমরা কে? কি করতে এসেছ?’ তারপর যখন তাদের বাপের নাম শুনলেন, আর শুনলেন যে তারা বিয়ে করবার জন্য রাজকন্যা খুঁজতে বেরিয়েছে, তখন ত আর তাঁর খুশির সীমাই রইল না। তিনি বললেন, ‘বাঃ! তোমরা যে আমার বন্ধুর ছেলে! বেশ হল; আমার হয় মেয়েকে তোমরা ছজনে বিয়ে করবে।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
ঠিক এমনি সময় বাড়ির ভিতর থেকে খবর এল যে, ছোটরানীর মেয়ের একটা বাঁদরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। রাজপুত্ররাও তখনি বুঝে নিল যে এ আর কেউ নয়, তাদেরই বাঁদর। তাদের মনে হিংসাটা যে হল! বাঁদর এসে তাদের আগেই রাজার মেয়ে বিয়ে করে ফেলল, লোকে আবার কানাকানি করে বলে যে সে মেয়ে নাকি রাজার আর ছয় মেয়ের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর আর ভাল। এ-সব কথা তারা যত ভাবে ততই খালি হিংসায় জ্বলে মরে। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
যা হোক, রাজার মেয়ের সঙ্গে ত তাদের ছয় জনের বিয়ে হয়ে গেল, তারপর ঝকঝকে ময়ুরপঙ্খী সাজিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তারা বউ নিয়ে দেশে চলল। বানরও একটি ছোট নৌকায় করে তার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের পিছু পিছু চলেছে। তাকে দেখেই ছয় রাজপুত্র রেগে ভূত হয়ে গেছে আর ভেবেছে যে একে বউ নিয়ে দেশে পৌছতে দেওয়া হবে না। মুখে কিন্তু ‘ভাই, ভাই’ বলে ভারি আদর দেখাতে লাগল, যেন তাকে কতই ভালবাসে। শেষে যখন বাড়ির কাছে এসেছে, তখন রাত্রে ঘুমের ভিতরে বেচারার হাত-পা বেঁধে তাকে জলে ফেলে দিল। ভাগ্যিস ছোট বউ টের পেয়ে তাড়াতাড়ি একটা বালিশ ফেলে দিয়েছিল, আর তাই ধরে অনেক কষ্টে সে কোনমতে ডাঙ্গায় উঠল, নইলে সে যাত্রা আর উপায়ই ছিল না। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তারপর সকালবেলায় নৌকা এসে ঘাটে লাগল, রাজা খবর পেয়ে ছেলেবউদের আদর করে ঘরে নিতে এলেন। ছয় ছেলে এসে তাকে প্রণাম করল, রাজা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বানর কই?’ তারা বলল, ‘সে জলে ডুবে মারা গিয়েছে।’
তারপর সকালবেলায় নৌকা এসে ঘাটে লাগল, রাজা খবর পেয়ে ছেলেবউদের আদর করে ঘরে নিতে এলেন। ছয় ছেলে এসে তাকে প্রণাম করল, রাজা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বানর কই?’ তারা বলল, ‘সে জলে ডুবে মারা গিয়েছে।’
বানর ত মরে নি, সে নদীর ধারে ধারে তাদের আগেই ঘাটে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা ‘সে জলে ডুবে মারা গেছে’ বলতেই বানর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রাজাকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি মরি নি বাবা, ওরা আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে জলে ফেলে দিয়েছিল, আমি অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছি।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তখন ত রাজপুত্রদের মুখ চুন। রাজা ভয়ানক রেগে তাদের বললেন, ‘বটে! তোদের এই কাজ? দূর হ তোরা আমার দেশ থেকে; আর তোদের মুখ দেখব না।’
এই বলে দুষ্ট ছেলেগুলিকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজা যার পর নাই আদরের সহিত বানর আর ছোট বউকে ঘরে নিয়ে এলেন। বানরের মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে আর এমন সুন্দর লক্ষ্মী বউ ঘরে এনে যে কত সুখী হলেন তা বুঝতেই পার। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
তারপর খুব সুখেই তাঁদের দিন কাটতে লাগল। এর মধ্যে হয়েছে কি, বউমা দেখলেন যে বানর শুধু দিনের বেলায়ই বানর সেজে বেড়ায়; রাত্রে সে বানরের ছাল খুলে ফেলে দেবতার মত সুন্দর মানুষ হয়। এ কথা তিনি ছোটরানীকে বললেন, ছোটরানী আবার রাজাকে জানালেন। রাজা ত শুনে ভারি আশ্চর্য হয়ে এসে বললেন, ‘বউমা, তুমি এক কাজ করো। আজ রাত্রে যখন সে বানরের ছাল খুলে ঘুমোবে, তখন তুমি সেই ছালটাকে পুড়িয়ে ফেলবে।’ (Upendrakishore Ray Chowdhury)
সেদিন বানরের শোবার ঘরের পাশের ঘরে মস্ত আগুন জ্বেলে রাখা হল, বানর তা জানতে পেল না। তারপর রাত্রে যেই ছাল খুলে রেখে সে ঘুমিয়েছে অমনি রাজকন্যা চুপিচুপি নিয়ে সেটাকে সেই আগুনে ফেলে দিয়েছেন। সকালে বানর উঠে দেখে তার ছাল নেই। তখন সে ত ধরা পড়ে গিয়ে খুবই ব্যস্ত হল, কিন্তু ব্যস্ত হয়ে কি হবে, আর বানর বার জো নেই। দেখতে দেখতে সেই খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ল, আর ছেলেবুড়ো সকলে ছুটে এসে, সব দেখেশুনে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। (Upendrakishore Ray Chowdhury)
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।