অন্য জীবন আর অন্য মননের খোঁজে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ালাম সে কথা আজ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। বরং এইটুকু বলি, এই খোঁজ আসলে ফুরোয় না। ফুরোবে কেমন করে! এ তো কোনও একক জীবনের গল্প নয়! বহু জীবনের যাপিত জীবনচর্যা আসলে। সেই জীবনচর্যা নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশ করতে শেখায়। বিশ্বায়নের বেড়াজালে যা কিছু পণ্য, তার যেন কোনো লয় নেই, ক্ষয় নেই। তা যেন একই ছাঁচে ঢালাই করা । সেখানে মানুষের স্বাতন্ত্র্য গুরুত্ব পায় না। অথচ ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়, এই স্বাতন্ত্র্যের খোঁজ কিন্তু আমাদের জীবনে ছিল।
সে যেন কোনও এক ফেলে আসা জীবন। কৌমের মধ্যে থেকেও ব্যক্তি মানুষের ছোঁয়া তখন গুরুত্ব পেত, সমাদর পেত। গ্রামের মানুষ জানত সে কোন তাঁতীর হাতে বোনা শাড়ি পরে, চাদর পরে। ঠিক যেমন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদন তাঁতী! গ্রামের লোক জানে, মদন গামছা বোনে না। মদন শিল্পী। এই ব্যক্তিগত ছোঁয়াকেই এখন খুঁজে বেড়াতে হয় পণ্য সংস্কৃতির স্তূপ পেরিয়ে। সেখানে একজন ডমিনিক ক্রেন আছেন, সেখানে একজন অ্যালিস ওয়াটার আছেন। আছেন এমন একজন নারী যিনি অনেক বন্যা পেরিয়ে এসে বীজ সংগ্রহে নেমেছেন। দেশি বীজের সঞ্চয়ে ভরে উঠেছে ওর কোঁচড়।

কী আশ্চর্য দেখুন, যাঁদের কথা আমি বলতে চেয়েছি তাঁরা আসলে ব্যতিক্রমী। খুব তলিয়ে দেখলে টের পাওয়া যাবে, তাঁরা আসলে বিশ্বপণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাননি, বলা ভালো যেতে চাননি। কেউ ভেবেছেন গাছেদের কথা, কেউ ভেবেছেন বিষমুক্ত খাবার পরিবেশনের কথা। কারও বা উৎসাহ নগরের ভিড়ে প্রাকৃতিক উপাদানে বাড়ি বানানোয়। এরা কিন্তু চাইলেই সহজ পথটি বেছে নিতে পারতেন। ভিড়ে মিশে যেতে পারতেন। শহরের রেস্তোরাঁ গুলোয় সুশির থালা ভরে উঠছে নরম আলোর মায়ায়। অথচ আমরা এতদিন খেয়ালই করলাম না, সুশির দুনিয়া পৌরুষ দিয়ে ঘেরা। মেয়েলি হাতের উত্তাপে সুশির স্বাদের তারতম্য ঘটে যায় এটুকুই আমরা জানলাম।
সে যেন কোনও এক ফেলে আসা জীবন। কৌমের মধ্যে থেকেও ব্যক্তি মানুষের ছোঁয়া তখন গুরুত্ব পেত, সমাদর পেত। গ্রামের মানুষ জানত সে কোন তাঁতীর হাতে বোনা শাড়ি পরে, চাদর পরে। ঠিক যেমন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদন তাঁতী! গ্রামের লোক জানে, মদন গামছা বোনে না। মদন শিল্পী। এই ব্যক্তিগত ছোঁয়াকেই এখন খুঁজে বেড়াতে হয় পণ্য সংস্কৃতির স্তূপ পেরিয়ে। সেখানে একজন ডমিনিক ক্রেন আছেন, সেখানে একজন অ্যালিস ওয়াটার আছেন। আছেন এমন একজন নারী যিনি অনেক বন্যা পেরিয়ে এসে বীজ সংগ্রহে নেমেছেন। দেশি বীজের সঞ্চয়ে ভরে উঠেছে ওর কোঁচড়।
রান্নাঘরের রাজনীতি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতেই পারতাম। অথচ তেমন করে ভেবে ওঠা হয়নি আমাদের। এইসব ভেবে দেখতে গিয়ে দেখেছি, পৃথিবী তো নিটোল একখানা নিরেট গোলাকার বস্তু মাত্র নয়! বৈচিত্রে ওর তল পাওয়াই সার। এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে এক ছাঁচে ঢালাই করার যে আয়োজন সে বড় কঠিন। সে যেন আদতে আরেকখানা যক্ষপুরীই। সেখানে মানুষের নাম হারিয়ে যায়। মানুষ সেখানে উনসত্তরের ঙ হয়ে যায় । ঠিক যেমন করে আমাদের সব ভোগ্যপণ্যগুলি একই রকমের। মেশিন মেড। কিন্তু এর বাইরেও তো পৃথিবীতে কেউ কেউ নিজের মতো করে একটা পরিসর তৈরি করার চেষ্টা করতে পারেন! এই চেষ্টাগুলো যে সব সময় একবারেই সাফল্য পায় তা নয়। কিন্তু এই চেষ্টাটুকুও অনেকখানি।
আঞ্চলিক ভাষারা যেমন করে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, তামাদি হয়ে যাচ্ছে! তেমন করেই হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক রান্নার ভাষা, স্বাদ, গন্ধ। হারিয়ে যাচ্ছে ভেষজকে চেনার মানুষ। এই হারিয়ে যাওয়া গুলো মনখারাপ করা। বিশ্ব অর্থনীতির হয়তো এসব নিয়ে না ভাবলেও চলে। কিন্তু কেউ কেউ এমন করেই ভাবতে ভালোবাসেন। তারা চাষজমিতে মুঠো মুঠো বিষের পরিবর্তে সামান্যেই খুশি। তারা জৈষ্ঠ্যমাসে ফুলকপি কিনে বাজার সারতে চান না। জীবনটা তাদের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান বলেই তাঁরা এই বেঁচে থাকার মুহূর্তটিকে উদযাপন করতে চান নিজেদের মতো করে।

এই উদযাপন কখনও শান্ত, কখনও উচ্চকিত। কিন্তু তা একান্তই ব্যক্তিগত। একজন প্রায় দৃষ্টিহীন মানুষ যখন তার মায়ের হাতের রান্নার কথা ভেবে ভেবে কেবল ইন্দ্রিয়চেতনা দিয়ে আস্ত একখানা রান্না শেষ করেন, সাজিয়ে তোলেন, – সারা বিশ্ব তাতে মুগ্ধ হয়। তাঁরা মুগ্ধ হয় ওর গুণে তো বটেই তার চেয়েও বেশি, ওর এমন করে ভাববার ক্ষমতায়। ভালো খাবার মানে ওর কাছে জাঙ্ক নয়,সুষম খাবারই। আলুভাজা বলতে গ্রাম শহর শহরতলি সকলেই এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বুঝছেন। ঠাণ্ডা শীতল পানীয় বলতেও তেমনই কিছু। এই একক নির্মাণের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন যাঁরা, – আমি তাঁদের খুঁজতে চেয়েছি। সব সময় যে খুঁজে পেয়েছি তা নয়। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি! কিন্তু এও এক নিরন্তর প্রক্রিয়া।

এই দেখুন না বাংলার গ্রামে গঞ্জে কত কত মহিলারা আগে নিপুণ হাতে পাটি বুনতেন, তালাই বুনতেন। তার কতই না নক্সা ছিল, বাহারি নাম ছিল মোটিফের। সেসব হারিয়ে এখন কেবল ঘরে ঘরে নাইলনের মাদুর। আমাদের মতো গরমের দেশে অমন মাদুরে শুলে আরও গরম লাগে, ঘামে ভিজে যায় শরীর। খেজুর পাতার চাটাই হারিয়ে যেতে যেতেও টিকে আছে গুটি কয়েক জীবনে। তেমনই একজন মাহাজারা বিবি। আমার প্রতিবেশী। অপূর্ব ওর হাতের বুনন। কী নিপুণ। এই তো কদিন আগেও রসুন পাতা বেটে কী সুন্দর চিতই পিঠা বানাচ্ছিলেন। নরম সবুজ রঙের পিঠা, অসাধারণ তার ঘ্রাণ। এক পলকে দেখলে মনে হয় কোনো জাপানি শিল্পীর ছোঁয়া পেয়েছে এই পিঠে। ওয়াসাবি না হোক নুন মরিচের চাটনি দিয়ে গরম গরম পিঠে এই পিঠে খেয়েছে যারা, তারা জানে মাহাজারা বিবির নিরাভরণ রান্নাঘরটি কেমন।

আকাশের তলায় ভারী সামান্য আর ভারী সুন্দর। পিঁড়ি পেতে বসে গরম গরম পিঠে দিয়ে বিকেলের জলখাবার খাওয়ার সুখ কি কম! অথচ আমরা তো একে ফাইন ডাইনিং বললাম না কখনও। বলতেই পারতাম কিন্তু! মাহাজারা বিবি’র সঙ্গে আমার তাই আপনাদের আলাপ করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এমন কত কত মাহাজারা বিবি যে কত কত যাপিত জীবনে অভ্যস্ত! তারা ফুড কালার চেনেন না, আর্টিফিসিয়াল এসেন্স চেনেন না। তারা কেবল চাল বেটে পিঠে বানানোর হরেক দেশজ স্বাদকে চেনেন। অ্যালিস ওয়াটারের স্লো ফুড ম্যানিফ্যাস্টো পড়বে না কোনোদিন মাহাজারা বিবি। অথচ সে বইয়ের ভিতরের কথাটি ও জেনেছে। আমরাও খানিক খানিক জানলাম বৈকি। জীবন যে কার সঙ্গে কখন দেখা করিয়ে দেয়! বিশ্বপণ্যের বাজারে এক ছাঁচে ঢালা ব্যস্ত জীবনের বাইরে নানা জীবনকে ছুঁয়ে দেখার লোভ আমার। সেসবই আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া গেল কিছু কিছু। তবে, কথা ফুরোলেও নটে গাছটি কিন্তু মুড়োয় না। সে আরও আরও ডালপালা ছড়িয়ে দেয় ‘অন্য জীবন’এর খোঁজে।
ছবি সৌজন্য: লেখক, roar media
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।