Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- বিদ্রোহ, ধ্বংস ও আগামীর স্বপ্ন

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫

Eli Cohen
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Eli Cohen)

ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশিতে স্বর্ণালী আভা। দূর দিগন্তে যেখানে অনন্ত জলের সঙ্গে আকাশের সখ্য, সেখানে রঙ ছড়িয়ে দিন ফুরিয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের এমনই এক গোধূলিবেলায় আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্রসৈকতে অনবরত পা ধুয়ে যাওয়া জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এক মনে তা দেখছিলেন এক যুবা। আজই রাতে তিনি তাঁর জন্মভূমি, তাঁর শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবনের ধাত্রী এই বন্দরনগরীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কত দিন, কত রাত যুবা এই সমুদ্রসৈকতে বসে আকাশপাতাল কত কী ভেবেছেন। দিগন্ত ছোঁয়া জলরাশিকে দেখে কতদিন মনে মনে ভেবেছেন তিনিও কবে তাঁর ‘প্রোমিজড ল্যান্ড’এর দিকে যাত্রা করবেন। (Eli Cohen)

আজ যখন সেই সময় আগত, তখন তাঁর প্রিয় বালুকাবেলা, ঘন নীল সমুদ্রের অনন্ত উর্মিমালার ভাঙাগড়া শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছেন। আর হয়তো কোনওদিনও এই সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে তাঁর এই সূর্যাস্ত দেখা হবে না। অষ্ফুটস্বরে যুবা বললেন, “তোমার জন্য মন কেমন করবে, আলেকজান্দ্রিয়া। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। দেশকে বাঁচাতেই হবে।” ইতিহাসের লিখনও তাই। তরুণ এলি কোহেন আর কোনওদিন আলেকজান্দ্রিয়ার বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তে দিবা অবসান দেখতে পাননি। (Eli Cohen)
শুরু হল এলি কোহেন পঞ্চম পর্ব…

আরও পড়ুন: গণহত্যার অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো

মেমোরি গেম

আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপথ দিয়ে একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে। রাস্তার ধারের জানালায় বসে কিশোর এলি রাস্তায় সেই গাড়ি চলা দেখে চলেছে। কিছুক্ষণ অলসভাবে দেখার পর, হঠাৎ কিশোর এলির মনে হল এটাকে নিয়ে একটা মজার ‘মেমো’রি গেম’ খেললে কেমন হয়। খেলাটা হল, যে সব গাড়ি যাচ্ছে তার নম্বর প্লেটের নম্বরগুলোকে মনে রাখা। (Eli Cohen)

শুরু হল এক অভিনব মেমোরি গেম। প্রথম প্রথম গোটা দশেকের বেশি গাড়ির নম্বর মনে থাকত না। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল কিশোর এলির স্মরণশক্তি বেড়েই চলল। শেষমেশ বহু গাড়ির নম্বর গড়গড় করে বলে যেতে পারত সে। অনেকদিন পর, যখন সে ভিনদেশে মোসাদের এজেন্ট তখন এই খেলাচ্ছলে প্রাপ্ত বিদ্যা ভালই কাজে লেগেছিল। (Eli Cohen)

আদতে আলেকজা্ন্দ্রিয়াতে এলির শৈশব, কৈশোর কেটেছে এক টালমাটাল সময়ে।

“লেখাপড়ায় উজ্জ্বল ছাত্র এলির ছোটবেলা থেকেই তাই হিব্রু, গ্রিক, ফরাসি, ইংরেজির মতো নানান ভাষায় যেমন পারদর্শীতা তেমনি আরব দুনিয়ার শহবৎ ও কায়দাকানুন হাতের তালুর মতো চেনা।”

১৯২৫ সাল। বছর সাতেক হল রক্তক্ষয়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে। কিন্তু তাতে ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বরং জার্মানি অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরিতে তা ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, যাকে মূলধন করে পরবর্তী দশকে পশ্চিম ইউরোপে রাজ করবে নাৎসিদের মতো অতি দক্ষিণপন্থী দলগুলো। ফলে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা পাড়ি জমাচ্ছেন ব্রিটিশ অধিকৃত প্যালেস্তাইন আর উত্তর আফ্রিকার মিশরে। ফলে ধীরে ধীরে জনাকীর্ণ হচ্ছে বন্দরনগরীর ইহুদি মহল্লা। (Eli Cohen)

Eli Cohen
এলি কোহেন

কিন্তু চাপা উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ তখনও হয়নি। সুপ্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া তখনও বিশ্বের মিলনস্থল। আরব, আর্মেনীয়, গ্রিক, ইতালির ব্যবসায়ীরা গমগম করছে বাজারে। ব্রিটিশ ও ফরাসী কূটনীতিকদের নিত্য আনাগোনায় বন্দর নগরীর গুরুত্ব মিশরীয় রাজধানী কায়রোর চেয়ে কোনও অংশে কম না। বরং বলা যায় ইউরোপীয় আধুনিকতা আর মিশরীয় প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন এই শহরে। (Eli Cohen)

তাই এলির ছোটবেলা কেটেছে ইহুদি, আরবি, ইংরেজ, গ্রিক, ইতালীয়, ফরাসি বন্ধুদের সঙ্গে মহল্লার রাস্তায় খেলে। লেখাপড়ায় উজ্জ্বল ছাত্র এলির ছোটবেলা থেকেই তাই হিব্রু, গ্রিক, ফরাসি, ইংরেজির মতো নানান ভাষায় যেমন পারদর্শীতা তেমনি আরব দুনিয়ার শহবৎ ও কায়দাকানুন হাতের তালুর মতো চেনা। ‘মেমোরি গেমস’ এর মতই আরব দুনিয়ার এই গভীর জ্ঞানও পরবর্তীকালে, তাঁকে ইনটেলিজেন্স দুনিয়ার আলো আঁধারি জগতে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে তীব্র জাতীয়তাবোধ। (Eli Cohen)

“শহরের যেকোনও উৎসবে ইহুদি আর খ্রীস্টান মহল্লা অংশ নিত। দ্বন্ধ ইর্ষা থাকলেও তা প্রকাশ্য রাস্তায় এসে পড়েনি। কিন্তু ৩০ এর দশকে এসে দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে।”

প্রতি রাতে মোমবাতির আলোকে নৈশভোজের টেবিলে শল তাঁর পরিবারকে বলতেন ইজরায়েলে নিজেদের ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিদের সহস্রাধিক বর্ষ ধরে চলে আসা সংগ্রামের কথা। শলের কথায়, “আমরা আজ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছি। কিন্তু যেন কখনও না ভুলি আমাদের আত্মপরিচিতি। জীবনের কী লক্ষ্য আমাদের।” ধর্মভীরু কোহেন পরিবারে শলের কথা ছিল বেদবাক্য। তাই ছোট থেকেই এলি বড় হতে থাকে এক ইহুদি জাতীয়তাবাদ পরিবেষ্টিত পরিবেশে। (Eli Cohen)

কিন্তু এ ছিল আপাত শান্ত আলেকজান্দ্রিয়া যেখানে ইহুদি, আরবি, খ্রীস্টানরা সমানভাবে শহরের সব কিছুতে অংশ নিত। শহরের যেকোনও উৎসবে ইহুদি আর খ্রীস্টান মহল্লা অংশ নিত। দ্বন্ধ ইর্ষা থাকলেও তা প্রকাশ্য রাস্তায় এসে পড়েনি। কিন্তু ৩০ এর দশকে এসে দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: ম্যান ইটার্স অফ সাভো থেকে প্যালেস্তাইন ক্যাম্পেন

ইউরোপের পট পরিবর্তন

ইউরোপীয় রাজনীতিতে ৩০ এর দশকে এক প্রলঙ্কারী ঘটনা ঘটে। প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের পরাজয়ের গ্লানিকে পুঁজি করে জার্মান রাজনীতির ভাগ্যাকাশে অ্যাডলফ হিটলার নামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক আহত অস্ট্রিয় সেনা তথা চিত্রকরের উদয় হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে দেশের সন্মান করা সম্ভব নয় থেকে ইহুদিদের গোপন চক্রান্তেই আসলে জার্মানি হেরেছে, অপমানজনক ভার্সাই চুক্তিতে সই করতে হয়েছে-এই দ্বৈত শ্লোগান নিয়ে হিটলার তাঁর ন্যাশনাল সোসালিস্ট জা্র্মান ওয়ার্কারস পার্টি (যা নাৎসি পার্টি নামে পরিচিত) কে নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েন। ইতিহাস বলে, যুদ্ধে পরাজয়ের দগদগে ক্ষত নিয়ে জার্মানি তখন এমনিই ফুঁসছিল। হিটলারের জননোরঞ্জক উত্তেজক শ্লোগানে জনসমর্থনের বাঁধ ভেঙে যায়। আর সেই জনসমর্থনের উর্মিমালায় চেপে নাৎসি পার্টি ১৯৩৩ সালে ক্ষমতা দখল করে। (Eli Cohen)

কিছুদিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায় হিটলার শুধু জার্মানি শাসন করেই ক্ষান্ত হবেন না। ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ডের মতো বিশ্বশাসনের অংশিদার হতে চায় সে। হিটলার বলে বসেন, “জার্মানিও সূর্যের নীচে বাস করে” যা বার্লিনের আগ্রাসী বিদেশনীতিকেই সামনে নিয়ে আসে। পাশাপাশি প্রথমে জার্মানি জুড়ে ও পরে জার্মান অধিকৃত ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের উপর লাগামছাড়া বর্বর অত্যাচার শুরু করে নাৎসি জার্মানি। (Eli Cohen)

“ইউরোপ থেকে বিপুল শরণার্থি আসায় ১৯৩৬ সাল নাগাদ প্যালেস্তাইনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজারে যা সেই দেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। প্যালেস্তাইনের এক সপ্তমাংশ কৃষিজমিতেও চাষ করতে শুরু করে ইহুদিরা।”

ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় আরেক মহাযুদ্ধের পদধ্বনি যখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল,তখন ইউরোপ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ত্যাগ করতে শুরু করে। পরিসংখ্যান বলছে, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে ১৯৩৩ সালে ৩০ হাজার, ১৯৩৪ সালে ৪২ হাজার ও ১৯৩৫ সালে ৬১ হাজার ইহুদি দেশান্তরী হয়। ইউরোপ থেকে বিপুল শরণার্থি আসায় ১৯৩৬ সাল নাগাদ প্যালেস্তাইনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজারে যা সেই দেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। প্যালেস্তাইনের এক সপ্তমাংশ কৃষিজমিতেও চাষ করতে শুরু করে ইহুদিরা। (Eli Cohen)

আর ইহুদিদের এই ক্রমাগত জনবসতি বৃদ্ধি ব্রিটিশ শাসিত প্যালেস্তাইন আর মিশরে ধীরে ধীরে অন্য এক সমস্যার জন্ম দিল। প্যালেস্তাইনে ইহুদি বসবাসকারীদের সঙ্গে স্থানীয় আরবদের ছোটখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকত। বেশ কয়েকবার বড়সড় ঝামেলাও হয়। ইংরেজরা দু’পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আসলে দীর্ঘময়াদী শত্রুতার বীজ রোপন করে। (Eli Cohen)

Eli Cohen
আরব বিদ্রোহ

অল-কাসাম ও আরব বিদ্রোহ

প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের বিবাদের মধ্যে প্রথম যে নামটা উঠে আসে তা হল এক সিরীয় ইমাম ইজ অল-দিন অল-কাসাম। ১৮৮২ সালে সিরিয়ার জাবলে শহরে জন্মানো অল-কাসামকে ১৪ বছর বয়সে কায়রো পাঠানো হয় সহস্র বর্ষ প্রাচীন অল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। সেখানে তাঁর শিক্ষক হন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলম (আরবিতে যার অর্থ শিক্ষক) শেখ মহম্মদ আব্দু। মিশরীয় ইসলামিক পণ্ডিত আব্দু ছিলেন সংস্কার আন্দোলনের এক পুরোধা, যিনি পরবর্তীকালে মিশরের গ্র্যাণ্ড মুফতিও হন। শেখ আব্দু তাঁর গুরু জামাল অল-দিন অল-আফগানির সঙ্গে ‘অল-হুরা-অল-হুক্তা’ নামে এক কট্টর ইসলামপন্থী পত্রিকাও বার করতেন যাতে আরব দুনিয়াকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিমী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দেওয়া হত। এহেন গুরুর শিষ্য হন অল-কাসাম। আব্দুর প্যান-ইসলাম মন্ত্রে দীক্ষিত হন অল-কাসাম। (Eli Cohen)

“প্রথম থেকেই প্যালেস্তাইনে ইহুদি আগমন মেনে নিতে পারেননি আল-কাসাম। কিন্তু প্রতিবাদের রাস্তা খুঁজছিলেন। ১৯২৮ সালে সেই সুযোগ এসেও গেল।”

সিরিয়ায় ফিরে জাবলের মানসুরি মসজিদের ইমাম হয়ে তাই চুপ করে বসে থাকলেন না অল-কাসাম। ১৯১১ সালে যখন মিশরের পড়শি দেশ অটোমান শাসিত লিবিয়াতে ইতালি আক্রমণ করল, তখন ইতালীয় বাহিনীর বিরদ্ধে লড়ার জন্য সিরিয়াতে ছেলে জোগাড় করে লিবিয়াতে পাঠালেন। (Eli Cohen)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ফরাসি সেনাবাহিনী যখন সিরিয়া দখল করল, তখন তার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করলেন অল-কাসাম। ১৯২০ সাল অল-কাসামের নামে ফরাসিরা হুলিয়া জারি করলে ব্রিটিশ শাসিত প্যালেস্তাইনের হাইফা বন্দরনগরীতে পালালেন অল-কাসাম। হাইফার ইস্তিকলাল মসজিদ হল তাঁর নয়া ঠিকানা। (Eli Cohen)

প্রথম থেকেই প্যালেস্তাইনে ইহুদি আগমন মেনে নিতে পারেননি আল-কাসাম। কিন্তু প্রতিবাদের রাস্তা খুঁজছিলেন। ১৯২৮ সালে সেই সুযোগ এসেও গেল। আরবদের, পশ্চিমীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য ওই বছরে মিশরে ইমাম হাসান অল-বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড সংগঠন তৈরি করলেন। অনুপ্রাণিত হয়ে আল-কাসাম গড়ে তুললেন অল শাবাব অল-মুসলিমিন নামে এক সংগঠন যার শ’দুই সদস্য ব্রিটিশ আর ইহুদি বসতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি হল। (Eli Cohen)

“পিল কমিশন তাদের রিপোর্টে ইহুদি-আরব বৈরিতার একটা স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান সূত্র বার করার লক্ষ্যে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন দুটো রাষ্ট্রর গঠন করার সুপারিশ করেন। ইহুদিরা এতে সানন্দে সম্মতি দেয়।”

বেশিদিন লাগল না লড়াই বাঁধতে। আল-কাসাম ঠিক করেন ১৯৩৫ সালের শীতকালে তিনি লড়াই শুরু করবেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর উপর নজরদারি রাখছিল। ১৯৩৫ সালে ২০শে নভেম্বর জনা পঁচিশেক সঙ্গী নিয়ে আল-কাসাম বেরোতেই পশ্চিম তীরের জেনিন আর তুলকরাম শহরের মধ্যে এক জায়গায় ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাঁর দলের সংঘর্ষ হয়। ৬ ঘণ্টার গুলিযুদ্ধে আল-কাসাম প্রাণ হারান। (Eli Cohen)

কিন্তু এই ঘটনা প্যালেস্তাইনে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ইতিহাস বলে যে জেরুজালেমের মুফতি আমিন অল-হুসেনি বেঁচে থাকতে আল-কাসামকে তেমন গুরুত্ব দেননি সেই হুসেনিই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩৬ এর এপ্রিল থেকে ১৯৩৯ সালের অগস্ট অবধি চলা এই জনরোষ ‘আরব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। আর আল-কাসাম আরব দুনিয়ায় আজও যে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় প্যালেস্তাইন জঙ্গী গোষ্ঠী হামাস তার এক ডিভিশন আল-কাসামের নামে করায়। (Eli Cohen)

প্রথম দিকে এই বিদ্রোহকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরে পরিস্থিতি সামলাতে বিশ হাজার সেনা প্যালেস্তাইনে আনে ব্রিটিশরা। হাজার পনেরো জনের সশস্ত্র ইহুদি বাহিনীও গড়ে তোলা হয়। বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে আইন শৃঙ্খলা মোটামুটি রক্ষা করা গেলেও চোরাগোপ্তা খুন, সংঘর্ষ চলতেই থাকে। তখন লন্ডন এই জনরোষের কারণ খতিয়ে দেখতে ১৯৩৬ সালে প্রাক্তন ভারত সচিব লর্ড উইলিয়াম রবার্ট ওয়েলেসলি পিলের নেতৃত্বে এক দুই সদস্যের কমিশন গঠন করে যা ‘পিল কমিশন’ নামে খ্যাত। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে পিল কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। (Eli Cohen)

Eli Cohen
আরব বিদ্রোহ

পিল কমিশন তাদের রিপোর্টে ইহুদি-আরব বৈরিতার একটা স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান সূত্র বার করার লক্ষ্যে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন দুটো রাষ্ট্রর গঠন করার সুপারিশ করেন। ইহুদিরা এতে সানন্দে সম্মতি দেয়। ইজরায়েল গঠনের পথে এটাকে তারা প্রথম ধাপ হিসাবেই দেখে। কিন্তু আরবরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। তাদের মতে, আরবরা প্রথম থেকেই বলে আসছিল ইহুদিদের প্যালেস্তাইনে এনে স্থানীয় আরবদের জমি নিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি যে বানানো হচ্ছে তা আসলে ইজরায়েল গড়ার কাজ। পিল কমিশনের রিপোর্টে এই গোপন অভিসন্ধিই সামনে এনেছে। (Eli Cohen)

এটা ঘটনা, প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে দুটো রাষ্ট্র গঠনের কথা পিল কমিশনের রিপোর্টই প্রথম বলে, (যে বিষয়টির চূড়ান্ত মীমাংসা আজও হয়নি)। এই রিপোর্ট পেশের মাস দুয়েকের মধ্যে পিল প্রয়াত হন। ওদিকে ইউরোপেও ক্রমে যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। এই পরিস্থিতি পিল কমিশনের রিপোর্ট ঠাণ্ডা ঘরে চলে যায়। (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপট

যাত্রার আগের কথা

কিন্তু ভূমধ্যসাগরের ওপারে এই আরব বিদ্রোহের আঁচ এসে পড়ে। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনগুলো মিশরে আরব জাতীয়তাবাদের নামে সংকীর্ণ রাজনীতি নিয়ে আসে। যে ইহুদিরা আলেকজান্দ্রিয়ার সব কিছুর সঙ্গে একাত্ম ছিলেন, তারা ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিশোর এলিও বুঝতে পারে শহরটার বাতাসে কেমন যেন বিদ্বেষের গন্ধ। যে রাজপথে আনন্দ কোলাহল হত তা ক্রমে ভরে যাচ্ছে ইহুদি বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে। তার বন্ধুরাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। (Eli Cohen)

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইনের অধিকাংশ অংশ নিয়ে ইজরায়েল আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ে এলির জীবনেও। যৌবনে পা দেওয়া এলি তখন প্রচণ্ড দ্বিধায় রয়েছেন। কোন দিকে নিজের জীবনকে নিয়ে যাবেন? নিজের কথা ভাববেন, না দেশের কথা। ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে ইহুদি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস শুনে শুনে ১৯৪৮ সালে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারছেন দু’হাজার বছর পরে ফের তাঁর দেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাই এখন সর্বশক্তি দিয়ে নবজাতক ইজরায়েলকে বাঁচাতে হবে। (Eli Cohen)

Eli Cohen
অল-কাসাম

এক বিকেলে অন্তরঙ্গ বন্ধু ডেভিডের সঙ্গে এক কাফেতে বসে নিজের মনের কথাটা বললেন এলি। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ডেভিড বলছিল, “চারিদিকে কী অবস্থা শুনছিস? কায়রোতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বেছে বেছে ইহুদিদের দোকানপাঠ লুঠ হচ্ছে। আর চিন্তার কথা কি জানিস? দাঙ্গা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। বলছে ইহুদিদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। কোথায় যাব বলতে পারিস?” (Eli Cohen)

এলিও কফিতে চুমুক দিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললেন, “বলতে পারি। আমাদের ইজরায়েল যেতে হবে। কারণ যত দিন যাবে এখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
ডেভিড প্রবল আপত্তি করে- “আরে মিশর আমার দেশ। এখানেই জন্মেছি। এখানেই বড় হয়েছি। স্কুল কলেজ সব এখানেই। কী করে ছেড়ে যাব?
এলি ইস্পাতকঠিন স্বরে বললেন, “কীসের আমার দেশ। এই দেশ আমাদের জন্য জেলখানা হয়ে উঠছে। কিছু না করলে এখানে পিষে মরতে হবে।“
ডেভিড তবুও মরিয়া চেষ্টা করে বন্ধুকে বোঝাতে- “ইজরায়েলকে চারিদিক ঘিরে রয়েছে দুশমনরা। ওরা শেষ করত চাইছে এই নবজাতককে।” (Eli Cohen)

ঠান্ডা গলায় এলি বললেন, যেতে আমাকে হবেই। এখানে থাকার আর কোনও অর্থ নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব, পরিচিতি, সমাজ- সব একেএকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে পারব না। আগামীর জন্য লড়তেই হবে।”

বন্ধুর চোখে চোখ রেখে এলি বলেন- “শুধু এই কারণেই ইজরায়েল যাওয়া দরকার। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে দেশটাকে বাঁচাতে হবে। দু’হাজার বছর লড়াই করে ইজরায়েল পেয়েছি। তাকে কখনই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না।” (Eli Cohen)

কয়েকদিন পরে নৈশভোজের টেবিলে বাড়ির লোকজনদেরও এলি জানালেন তাঁর ইজরায়েল যাওয়ার কথা। টেবিলে নিস্তব্ধতা নেমে এল।
মা সোফি প্রথম কথা বললেন,”কোথায় যাবি? ইজরায়েল? একদম না। মারাত্মক ঝুঁকি। পদে পদে বিপদ।”
ছোটভাই মরিস বলল, “আমাদের কী হবে? তারপর যদি ফিরতে না পারিস?” (Eli Cohen)

ঠান্ডা গলায় এলি বললেন, যেতে আমাকে হবেই। এখানে থাকার আর কোনও অর্থ নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব, পরিচিতি, সমাজ- সব একেএকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে পারব না। আগামীর জন্য লড়তেই হবে।” (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: অন্ধকার সময় বা অ্যার্জের কাহিনি

সল এতক্ষণ ছেলের কথা শুনছিলেন। এবার শান্তস্বরে বললেন, “মাই সন, সামনের রাস্তা অতীব বিপদসঙ্কুল। কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তোমাকে যেতে হবে। কিন্তু মন প্রাণ দিয়ে যদি আমাদের মানুষদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও তো আমি তোমার সঙ্গে আছি। পূর্বজদের স্বপ্ন থাকবে তোমার সঙ্গে। কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তুমি সাবধান থাকবে।” (Eli Cohen)

এলি বাবার কাছে করলেন সেই প্রতিজ্ঞা। তারপর আরবদের চোখে ধুলো দিয়ে কীভাবে ইজরায়েল যাবেন সেটা ছকে ফেললেন। (Eli Cohen)

প্রোমিজড ল্যান্ড ডাকছে এলিকে।

তথ্যসূত্র-
(১) এলি কোহেন-আ লাইফ অফ এসপিওনাজ অ্যান্ড স্যাকরিফাইস,
(২) এনসাইক্লোপেডিকা ব্রিটানিকা

মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

Author kingshuk banerjee

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে

Picture of কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে
Picture of কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

বিতস্তা ঘোষাল
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

শ্রুতি গঙ্গোপাধ্যায়
অমৃতা ভট্টাচার্য
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

বিহার

প্রদীপ্ত চক্রবর্তী

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

বিতস্তা ঘোষাল
বিতস্তা ঘোষাল
[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com