(Mob Violence)
এখন কাগজ খুললেই প্রতিদিন একটা না একটা মন খারাপ করা খবর চোখে আসে। বাংলাদেশ থেকেই বেশি।
আমাদের এখানে উত্তর ভারত থেকেও ভেসে আসে এরকম খবর।
কী ব্যাপার? না, ‘মব’ হামলা হয়েছে কোথাও। হামলার জেরে অনেকে অর্ধমৃত, কেউ কেউ মারাই গিয়েছেন। (Mob Violence)
বাংলার পরিচিত শব্দাবলীর মধ্যে বহুদিন ঢুকেই পড়েছে ‘মব’ শব্দটি। আমাদের সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে যখন যাচ্ছে, তখন আর অভিধানে ঢুকে পড়তে অসুবিধা কোথায়?
আরও পড়ুন: কই সেই চিনি পাতা সাদা দই
‘মব’ মানেটা কী? নাউন অর্থে ব্যবহার করলে ইংরেজি শব্দের বাংলা মানে দাঁড়ায় ভিড়। যে ভিড় যখন তখন ভয়ংকর উগ্র হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে কোনও মুহূর্তে মারপিট শুরু করে দিতে পারে। আবার ভার্ব হিসেবে ব্যবহার করলে মানে দাঁড়াচ্ছে, কোনও একজন বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমূহকে ঘিরে তাঁদের উত্যক্ত করা। অকথ্য গালাগাল দিয়ে মারধর করা। প্রয়োজনে মেরেই ফেলা। (Mob Violence)
‘মব’ শব্দটা না জানলেও, আমরা বাঙালিরা জানি মগ শব্দটা। দুর্বৃত্তদের কথা বোঝাতে ‘মগের মুলুক’ বহু জন ব্যবহার করে থাকে। মবের মুলুক কথাটাও ওরকমই। এই উপমহাদেশ এখন কার্যত মবের মুলুক হয়ে দাঁড়়িয়েছে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘মব’ শব্দটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে। এই ‘মব’ কখনও ভেঙে দিয়েছে শেখ মুজিবরের মূর্তি। কখনও লুটপাট করেছে শেখ হাসিনার বাড়ি। কখনও বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে হাঁটিয়েছে প্রকাশ্যে। কখনও দীপু দাসের মতো কাউকে আগুন দিয়ে মেরে ফেলেছে ভয়ঙ্করভাবে। কোনওদিন আয়েশার মতো বছর পাঁচেকের মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে নিজের বাড়িতে। পিরোজপুর গ্রামে হিন্দুদের বাইরে থেকে আটকে আগুন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ এত হিংস্র হয়? হতে পারে? (Mob Violence)
আমরা ভারতীয়রা কি বাংলাদেশের এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গায় রয়েছি আদৌ? না, আমরা সেই জায়গায় নেই। তিনদিন আগে ত্রিপুরার বছর চব্বিশের এক এমবিএ ছাত্রকে ছুরি মেরে ফেলা হল দেহরাদুনে। ছেলেটির সঙ্গে তাঁর ভাইকে লোকে গালাগাল দিচ্ছিল চিনা বলে। ছেলেটি চাকমা। বারবার বলছিল, ‘আমরা ভারতীয়, আমরা চিনা নই।’ কোনও লাভ হয়নি। ছ’জন তাঁকে ঘিরে ধরে মারে। ছেলেটি ও তাঁর ভাই মাইকেল বাজার করতে গিয়েছিল সেখানে। দুঃখের বিষয় হল, এঁরা এখানে এক বছরের বেশি ছিলেন। তাতেও তাঁদের বিদেশি ভাবা বন্ধ হয়নি। (Mob Violence)
“১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় হাজার খানেক লোক মারা যান। ৫০ হাজার মানুষের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২৫০ গ্রাম ধ্বংস।”
এই যে ওড়িশায় বাঙালি শ্রমিককে বাংলাদেশি বলে মেরে ফেলা হল, অনেককে মারাত্মক জখম করা হল, এটাও তো সেই মবের মুলুকের উদাহরণ। কেন এদের এত উত্তেজনা, কেন এত অধৈর্য তারা!
নাগাল্যান্ড থেকে কেরল, কোথাও এর শেষ নেই। ঘটনা আলাদা। খলনায়ক আলাদা। তবে স্টাইল এক।
এই হিংস্র মানুষ আমরা সীমান্তের এপারে আমাদের এখানেও দেখেছি। ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায়! ১৯৮৪ সালে দেশজুড়ে শিখহত্যায়। ২০২০ সালে নয়াদিল্লি দাঙ্গায়। প্রথম ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে ১০৪৪ জন মারা গিয়েছিলেন, বেসরকারি ভাবে ২০০০ জন। অধিকাংশ মুসলিম। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ৩০০০ শিখ মারা গিয়েছিলেন দীর্ঘদিনের দাঙ্গায়। তৃতীয় ক্ষেত্রে ধর্মীয় মব রাজধানীতেই ৫৩ জনকে মেরে ফেলেছিল। আহত হন ২০০র বেশি। এই যে ঢাকায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসে মব আক্রমণ হল, সেখানে কিন্তু কোনও লোক মারা যাননি। (Mob Violence)

কী করে ভুলে যাব ভাগলপুরের ঘটনা? আমাদের দেশের লজ্জা ওটাও। ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় হাজার খানেক লোক মারা যান। ৫০ হাজার মানুষের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২৫০ গ্রাম ধ্বংস। এইভাবে দাঙ্গার রেশ আমাদেরকে রক্তাক্ত করেছে বারবার। এখন কলকাতার ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার কথা বলা হয় বিজেপি সমর্থক পরিচালকের সিনেমায়। আড়ালে চলে যায় অসমের নেলি (১৯৮৩), গুজরাট (১৯৬৯ ও ১৯৮৫), ভিওয়ান্ডি (১৯৭০), মিরাট (১৯৮৭), মুম্বই (১৯৯২-১৯৯৩), মুজফফরনগর (২০১৩)।
“২০০৬ সালে মহারাষ্ট্রেরই খেরলাঞ্জি গ্রামে এক দলিত পরিবারের ৪ জনকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ৫০ জনের মব। মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটায় গ্রামের রাস্তায়। ২০১৫। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর।”
আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বড় হয়ে উঠেও শিক্ষিত হইনি, বারবার বুঝিয়ে দিয়েছি বারবার। সেখানে হিন্দুরাও হিন্দুদের আক্রমণ করেছে। ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল। মহারাষ্ট্র-গুজরাট সীমান্তের গ্রাম গাডচিনচালেতে দু’জন হিন্দু সাধু এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁদের ড্রাইভার। তখন কোভিডের সময়। হোয়াটসঅ্যাপের খবরে রটে যায়, এঁরা চোর। একদল হিন্দু এসে তাঁদের পিটিয়েই মেরে ফেলে। তারপর এর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিতর্ক টেনে এনে রটানো হয়, মুসলিমরাই দায়ী। শুরু হয় ধর্মীয় উত্তেজনা। মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন অনিল দেশমুখ। তিনি বাধ্য হন সাধু খুনে জড়িত অপরাধীদের নামের তালিকা প্রকাশ করতে। দেখা যায়, খুনে অপরাধীরা সবাই হিন্দু। (Mob Violence)
২০০৬ সালে মহারাষ্ট্রেরই খেরলাঞ্জি গ্রামে এক দলিত পরিবারের ৪ জনকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ৫০ জনের মব। মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটায় গ্রামের রাস্তায়। ২০১৫। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর। সাত আট হাজারের একটি মব জেল ভেঙে নিয়ে যায় ধর্ষণে অভিযু্ক্ত একজনকে। মেরেই ফেলে তারপর।
আরও পড়ুন: আমেরিকার ‘মেসি এফেক্ট’, সৌদির ‘রোনাল্দো এফেক্ট’
বিবিসিতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কানপুরের এক ঘটনা নিয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন বেরোয়। সেখানে এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক মুসলিম রিকশাচালককে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে একদল হিন্দু। মুসলিম ভদ্রলোককে জড়িয়ে রয়েছে শিশুকন্যা। সে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, বাবাকে মেরো না। কেউ শুনছে না। চারদিক থেকে বারবার আওয়াজ আসছে জয় শ্রীরাম, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ। রিক্সাচালককে সেটা বলতে বলা হচ্ছে। সে বলছে। কিন্তু মারধর আর থামছে না। অনেক পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করছে।
কদিন পরে ইন্দোরে তসলিম আলি নামে এক চু়ড়ি বিক্রেতাকে পাঁচ-ছয় জনের মারধরের ভিডিও ভাইরাল হয়। তাঁকে গালাগাল দিয়ে বলা হচ্ছিল, হিন্দু এলাকায় চুড়ি বিক্রি করতে যাওয়া যাবে না। তসলিম পুলিশে অভিযোগ করে বলে, তাঁর টাকা, জিনিসপত্র লুট হয়ে গিয়েছে। পরের দিন তসলিমই অ্যারেস্ট হয়ে যায়। কারণ অদ্ভুত। বলা হয়, আক্রমণকারীদের ১৩ বছরের মেয়ে তসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে শ্লীলতাহানির। বিবিসির সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ, এই অভিযোগ পুরোটাই বানানো। (Mob Violence)

মব কালচার বেড়ে যাওয়ার কারণটা কী? হিটলারের আদর্শ, প্রুশিয়ার রাজা, নামী মিলিটারি শাসক ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট কবে বলেছিলেন, ‘ধর্মই হচ্ছে মবের কাছে আদর্শ। মব সেটাকেই সবচেয়ে পছন্দ করে, যা সে একেবারে বোঝে না।’ স্পষ্ট কথা, ধর্মই এখানে সব অশান্তির মূলে। ১৫৭২ সালে একবার ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা আক্রমণ চালায় ফরাসি প্রোটেস্টান্টদের ওপর। সেবার দাঙ্গা চলেছিল অগস্ট থেকে অক্টোবর। ৫ হাজার থেকে, ৩০ হাজার লোক মারা যান। ভাবা দরকার, ফ্রেডেরিকের শাসনকাল ছিল ১৭৪০ থেকে ১৭৮৬। কত বছর আগে তাঁর সেই অমোঘ স্বীকারোক্তি।
মুসলিমদের শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে ঝামেলায় বহু মব অ্যাটাক দেখেছে বিশ্ব। পাকিস্তানের গিলগিটে, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে তুলকালাম হয় শিয়া ও সুন্নিদের। শিয়াদের আক্রমণ করেন সুন্নিরা। কত লোক মারা গিয়েছিল, হিসেব নেই। কেউ বলেন ১৫০ জন, কেউ বলেন ৭০০। বেশিদিন দূরের ঘটনা নয় এটি। ১৯৮৮ সালের। (Mob Violence)
“বর্তমান আমেরিকায় যে এমন আক্রমণ হতে পারে, তা কল্পনা করেনি কেউ। ৫ জন মারা গিয়েছিলেন। সংখ্যাটা বড় কথা নয়। ব্যাপ্তিটাই বড়। ১৪০ জন পুলিশকর্মী আহত হন মব সামলাতে।”
এমন শিয়া-সুন্নির ঝামেলায় কারবালা থেকে কাশ্মীর, কাশ্মীর থেকে কায়রো— কোথায় না কোথায় দাঙ্গা হয়েছে। কারণগুলো অধিকাংশ জায়গায় তুচ্ছ। ধর্মীয় শোভাযাত্রা নিয়ে লেগে গিয়েছে ঝামেলা। এখন সবচেয়ে ঝামেলা হয়, ধর্মকেন্দ্রিক কোনও মন্তব্য নিয়ে। সেখানে আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় নানারকম গুজব। অকারণেই প্রাণ হারান অনেকে।
ধর্মের পাশাপাশি মানুষের শরীরের রঙও যে মব অ্যাটাকের একটা কারণ, তার প্রমাণ মিলেছে বহুবার। ১৯২১ সালে ১৮ ঘণ্টা ধরে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা আক্রমণ করেছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর। ওকলাহামার তুলসায়। জায়গাটায় ধনী কৃষ্ণাঙ্গরাই থাকতেন বেশি। প্রায় তিনশো জনকে খুন করা হয়। কয়েক হাজার লোক গৃহহারা হয়ে পড়েন। এত দূরের ব্যাপার ছেড়ে দিন। ওই ঘটনার একশো বছর পরে, ২০২১ সালে আমেরিকার ক্যাপিটলে যে ট্রাম্প সমর্থকরা আক্রমণ করল, তা ছিল ভয়ঙ্কর। (Mob Violence)

বর্তমান আমেরিকায় যে এমন আক্রমণ হতে পারে, তা কল্পনা করেনি কেউ। ৫ জন মারা গিয়েছিলেন। সংখ্যাটা বড় কথা নয়। ব্যাপ্তিটাই বড়। ১৪০ জন পুলিশকর্মী আহত হন মব সামলাতে।
সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, যে যেসব দেশে প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, সেখানেই এরকম মবের মুলুক। এমন প্রশাসনহীন জায়গায় তিনটে কারণ কাজ করে মবের দাপটের পেছনে। ১) বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ন্যায্য বিচার পায় না অনেকে! ২) পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও অনেক জায়গায় লাভ হয় না। ফলে ক্ষোভ এবং উত্তেজনা মানুষকে ওই পথে নিয়ে যায়। ৩) রাজনীতিবিদরা নিজেদের কাজেই মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগান তাদের তাতিয়ে দিয়ে। (Mob Violence)
এর সঙ্গে রয়েছে মানুষে মানুষে ঘৃণা। সেখানে ধর্ম-জাতি-বর্ণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দু’পক্ষের মারামারিতে। দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা আরও দুটো কারণ। যুক্তি, তর্কের ধারে কাছে না গিয়ে মারমুখী হয়ে ওঠে অশিক্ষিতরাই। এই ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে বেকার তরুণরাই বেশি।
মব কালচার এখনই যে সবচেয়ে ভয়াবহ জায়গায় তা বলাটা ভুল।
“ভারত এবং বাংলাদেশের তুলনায় আমাদের আর তিন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় ধর্মকেন্দ্রিক মব অ্যাটাক অনেকটা কম। সেখানে মুসলিম, হিন্দু বা বৌদ্ধরা সংখ্যায় অনেকটা বেশি বলে।”
কেরলের মালাপ্পুরমের এক তরুণ লেখক সাহারু নুসাইবা কান্নানারি তাঁর প্রথম উপন্যাসেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কান্নানারির পড়াশোনা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁর ‘ক্রোনিকল অফ অ্যান আওয়ার অ্যান্ড হাফ’ উপন্যাসে তিনি এক উত্তর কেরলের গ্রামের কথা লিখেছেন। সেখানে দেড় ঘণ্টার এক মব আক্রমণের ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে উপন্যাস। সেখানে দেখানো হয়েছে, মবে জড়িত মানুষগুলো কতটা বোকা। কতটা অশিক্ষিত। (Mob Violence)
ভারত এবং বাংলাদেশের তুলনায় আমাদের আর তিন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় ধর্মকেন্দ্রিক মব অ্যাটাক অনেকটা কম। সেখানে মুসলিম, হিন্দু বা বৌদ্ধরা সংখ্যায় অনেকটা বেশি বলে। তবু একেবারেই যে কম, সেটাও নয়। অনেকে ধর্মকে অস্ত্র করে লুটপাট চালানোয় বিশ্বাসী। এখানে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ একাকার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: রাজেশ খান্না, শশী কাপুরের প্রথম নায়িকা সেই বাঙালিনী
এই তো গত বছর মে মাসে পাকিস্তানে পাঞ্জাবের সারগোদায় খ্রিস্টান মহল্লায় হামলা চালান মুসলিমরা। অনেক বাড়ি দোকান ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পুলিশ এসে দশজন খ্রিস্টানকে উদ্ধার করে। হামলাকারীদের অভিযোগ সেই এক, ধর্মগ্রন্থকে অপমান করেছে ৭৩ বছরের এক জুতো ব্যবসায়ী। ২০২৩ সালে এমনই অভিযোগে জারানওয়ালায় ২৬ চার্চ ভেঙে দেওয়া হয়। লুট করা হয় ৮০ বাড়ি। পরে জানা যায়, অভিযোগ মিথ্যে। সেই অভিযোগে ক’দিন আগে সুলেমান নামে এক মুসলিম পর্যটককে জীবন্ত জ্বালিয়ে মারা হয় সোয়াত জেলার মাদিয়ানে।
কয়েক জনের আবার মবের অংশ হওয়াতেই আনন্দ। ধর্মের মোড়কও লাগে না। এবার এপ্রিলেই যেমন করাচিতে কেএফসির দোকান জ্বালিয়ে দেয় চল্লিশ জনের এক মব। ভাঙচুর করে। কীসের জন্য শুনবেন? আক্রমণকারীরা নাকি গাজ্জায় হামলার প্রতিবাদ করছিল। মবের পিছনে রাজনৈতিক দলও থাকে। করাচিতে একই সময় তেহরিক ই লাব্বাইক পাকিস্তানের ৪০০ জন সমর্থক এসে জ্বালিয়ে দেয় ৪৭ বছরের আহমাদির গাড়ি সারানোর দোকান। লোকটিকে মেরেও ফেলে। টিএলপি পার্টির সমর্থকরা এসবে ওস্তাদ। (Mob Violence)

শ্রীলঙ্কায়, সিংহলি বনাম তামিল টানাপোড়েন লেগেই থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে সেখানে বা নেপালে যে মব অ্যাটাক হয়েছে, অধিকাংশ রাজনীতি কেন্দ্রিক। ক্ষমতাসীন পার্টির বিরুদ্ধে ক্ষোভই সেখানে বড় হয়ে উঠেছে মব অ্যাটাকের ক্ষেত্রে।
আবার আমাদের দেশের দিকে তাকালে কেমন অস্থির-অস্থির লাগে। খুব সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই বলি।
“যারা মারধর করল, তাদের কিছুই করা হল না। বরং অশান্তি করা হয়েছে বলে দুই মুসলিম বন্ধুকে তুলে নিয়ে গেল, সঙ্গে কাফের এক কর্মীকে।”
একেবারে দক্ষিণে, কেরলে পালাক্কাডের কাছে ছত্রিশগড়ের পরিযায়ী রামনারায়ণকে বাংলাদেশি সন্দেহে এমনভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, তাঁর শরীরে ছিল আশিটি ক্ষত। পশুকেও এভাবে মারে না কেউ। মারধরের সময় একজন আচমকা বলে, তুই কি বাংলাদেশি? কোনও উত্তর না পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আক্রমণকারীরা। ঠিক যেভাবে ওড়িশায় মেরে ফেলা হয়েছে বাঙালিদের, ওভাবেই মারা হয় রামনারায়ণকে। (Mob Violence)
উত্তর-পূর্বের অসমের লখিমপুরে আবার একদল বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম, বহুদিনেরই বাসিন্দারা থানা থেকে তাদের এক সতীর্থকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। ওই সতীর্থকে পুলিশ ধরেছিল পহলগামের ঘটনাকে সমর্থন করে ফেসবুক পোস্ট করায়।

উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে, এক বছর কুড়ির নার্সিং ছাত্রী জন্মদিন পালন করছিলেন স্থানীয় কাফেতে। সেখানে অনেক বন্ধু হাজির। দু’জন মুসলিম বন্ধুও ছিলেন। আচমকা ২৫ জন উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রবেশ। মুখে লাভ জিহাদের স্লোগান। ভাঙচুর করে তছনছ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এল। যারা মারধর করল, তাদের কিছুই করা হল না। বরং অশান্তি করা হয়েছে বলে দুই মুসলিম বন্ধুকে তুলে নিয়ে গেল, সঙ্গে কাফের এক কর্মীকে। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে লেখালেখির পর দুষ্কৃতিদের নামে এফআইআর নিল তারা। (Mob Violence)
এসব পড়ি, আর ভাবি, একেবারে নিরীহ বলে পরিচিত ওড়িশার লোক এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে কীভাবে। ক’দিন আগে দেখছিলাম, ভুবনেশ্বরের রাস্তা থেকে সান্তা ক্লজ বিক্রেতাদের সরিয়ে দিচ্ছে একদল তরুণ। এটাও তো কার্যত মব অ্যাটাকের মতোই। চোখেমুখে হিংস্রতা।
আরও পড়ুন: ঘোড়াদের গ্রামে ঘটনার ঘোর ঘনঘটা
ইউরোপের ‘মব’দের এক এক রকম হিংস্রতা দেখা যায়। ইতালিয়ান, ইহুদি, পোলিশ, রাশিয়ান, রোমানিয়ান, গ্রিক, আইরিশ, আর্মেনিয়ান, সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান মব এক-এক রকম। এদের অনেকে ফুটবল মাঠে সক্রিয়। আমেরিকান মাফিয়া বলতে আবার ইতালিয়ান-আমেরিকানদেরই বোঝায় বেশি। সুসংগঠিত ক্রিমিনাল এরা। অন্তত ১৬৪ বছর আগে এদের জন্ম। মাফিয়া এবং মব একাকার হয়ে যায় এদের দৌরাত্ম্যে। কতরকম দাদাগিরি দেখিয়েছে এরা, তালিকা বানাতে বসলে একঘেয়ে হয়ে যায়। (Mob Violence)
এসব দেখলে বারবার মনে হয়, মবের মুলুক গোটা বিশ্বে চলবেই। শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিশিষ্ট সাংবাদিক। এই সময় সংবাদপত্রের প্রাক্তন সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদক। উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রাক্তন কার্যনির্বাহী সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কভার করেছেন একাধিক বিশ্বকাপ ফুটবল ও অলিম্পিক গেমস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, খেলা, গান, সিনেমা, ভ্রমণ, খাবারদাবার, মুক্তগদ্য— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।
