(Homestay)
১
“এই জমিটা তো আমারই আছে। তিরিশ বছরের লিজে দিয়েছি। চাইলেই যখন খুশি নিয়ে নিতে পারব। আপাতত এই হোম-স্টেতে ট্যুরিস্ট এলে আমি ম্যানেজারি করি।”
কুরমাই নদীর গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া সেই ‘হোমস্টে’র বারন্দায় বসে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি দেখছি কুরমাইয়ের পাড়ে ময়ূরের ঝাঁক, খান চার-পাঁচেক হরিণ। নভেম্বরের বিকেল, চারপাশে কমলালেবুর মতো রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে। হোমস্টে প্রায় ফাঁকা। মাত্র একঘর ট্যুরিস্ট। আমি সুন্দরের বন্ধু বলে কথা! তাই জমির ‘আসল’ মালিক তথা হোমস্টের ম্যানেজার ট্যুরিস্টদের বাসনপত্র মেজে, রাতের খানাপিনার বন্দোবস্ত করার ফাঁকে আমাদের আপ্যায়ন করছেন। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: ঠিক বাড়ি নয়, আবার বাড়িও
আমি প্রথমবার গ্রামে এসেছি, তাই সুন্দর, সুন্দর সিং রাভা আমাকে ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ দেখাতে বদ্ধপরিকর। বিকেলে কুরমাই নদীর পাড়ে গেলে হরিণ আর ময়ূর দেখা যাবেই। ভাগ্য ভাল থাকলে বাইসন বা গণ্ডারও ঢুঁ মারতে পারে। কিন্তু ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ তো চাইলেই ধরা দেবে না। অপেক্ষা করতে হবে। অতএব, সুন্দর আমাকে ধরে আনল এই হোমস্টে-তে। এক্কেবারে জঙ্গল-লাগোয়া এই কটেজ নাকি চিলাপাতার ওয়াইল্ড লাইফ দেখার সেরা জায়গা। জমির মালিক গ্রামের প্রধান। সুন্দরের অতি নিকটজন। ফলে, বিনা পয়সায় হোমস্টের বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতেই ওয়াইল্ড লাইফের অপেক্ষা করা গেল। (Homestay)

হরিণ-ময়ূর দেখতে-দেখতেই নানা কথা হাওয়ায় বিলি কাটে। কুরমাই গ্রামের কথা। রাভা ও ঝাড়খণ্ডি মানুষদের একত্রবাসের কথা। রেভেনিউ ভিলেজ কনভার্সন নিয়ে বনদপ্তর ও সরকারের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বাদানুবাদের কথা। গ্রামের প্রধানও ঝাড়খণ্ডি। আমি সুন্দরের বন্ধু শুনেই হয়তো তাঁর নানা স্মৃতি উজিয়ে ওঠে। “আমি না থাকলে তো সুন্দরকে পুলিশ তুলেই নিয়ে যেত।” চিলাপাতা জুড়ে তখন বনাধিকার আন্দোলন চলছে। বনাধিকার আইন পাশ হয়ে গেলেও তা নিয়ে বনদপ্তর বা প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। উলটে কোদালবস্তিতে গ্রামসভার বোর্ড লাগানো হয়েছে কেন, তা নিয়ে ঝামেলা। সুন্দর আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল, আইন নিয়ে ওর পড়াশোনাও বাকিদের চাইতে বেশি। তাই হয়তো ওকে গ্রেপ্তার করতে এসেছিল পুলিশ। আর তখনই গ্রামের প্রতিটা বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে এসে পুলিশের পথ আটকায়। সুন্দরকে সে-যাত্রায় আর শ্রীঘরে যেতে হয়নি। কিন্তু গ্রামের লোকজনের মধ্যে সেই মিলমিশ এখন আর নেই। গ্রামটাও কেমন বদলে যাচ্ছে। সবাই এখন নিজেরটাই দেখে খালি। (Homestay)
প্রধান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সুন্দরও। ওই যে বললাম, কথায় কথা বাড়ে। সেই বাড়তি কথার ঝোঁকেই আমি জিজ্ঞেস করে ফেলি, গ্রামটা বদলে যাচ্ছে কেন? সুন্দর চকিতে বলে বসে, “এই যে বাইরে থেকে লোক ঢুকছে। সব শহরের লোক। কলকাতার, শিলিগুড়ির। টাকা ঢালছে, জমি নিচ্ছে, হোমস্টে বানাচ্ছে। গ্রামের নানা বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। এতে গ্রামটাও আর আগের মতো থাকছে না। এই জায়গাটাও তো আগে প্রধানের ছিল। চাষের জমি। বছরে দু’বার চাষ হত। এখন কলকাতার বাবুরা নিয়ে নিয়েছে। আমি তো রোজ বলি, তুমি দিলে কেন! তোমার দেখাদেখি আরও দশজন দেবে।” (Homestay)
“পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে কুরমাইয়ের চেহারা আরও অনেকটাই বদলে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। গ্রামে কাঁচা টাকা আসার লক্ষণও চোখে পড়ল। বাইক আর চারচাকার সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনীতির বদল।”
গল্পের তাল কাটে। ইতিউতি কথার পর আমরা উঠে আসি। অন্ধকারে বনের পাশ দিয়ে ফেরা বিপজ্জনক, ফলে ঘুরপথে গ্রামের ভিতর দিয়েই ফিরতে হয়। আমি দেখি, গ্রামের সরু রাস্তার পাশে সারি সারি ‘হোমস্টে’ আর রিসর্ট। সুন্দর বলে চলে, প্রায় সবকটারই আসল মালিক শহরের। গ্রামের লোকদের যৎসামান্য টাকা দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে জমি লিজ নিয়ে এসব বানানো হয়েছে গত দু-তিন বছরে। কাউকে কাউকে তো নাকি টাকাও দেওয়া হয়নি। তার বদলে হয়তো দেওয়া হয়েছে সেকেন্ড হ্যান্ড রাজদূত বাইক। সামান্য বাইকের লোভে জমিজমা অনির্দিষ্টকালের জন্য লিজ দিয়ে দিয়েছেন অনেকে! ভাবলে কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। প্রধান বলছিলেন, তিনিই এখনও জমির মালিক, আপাতত হোমস্টেতে ম্যানেজারি করেন। চাইলেই জমি ফিরিয়ে নেবেন। শুনে সুন্দর হাসে, অত সোজা নাকি! ম্যানেজারকে কি ঘর পরিষ্কার, বাসনপত্র মাজা, রান্না সব করতে হয়! এসবের বিনিময়ে সামান্য টাকা মেলে অবশ্য। সার্ভিস দেওয়ার পারিশ্রমিক। প্রধান এখন নিজের জমিতেই সস্তার শ্রমিক হয়ে গেছেন, সেটা মানতে পারেন না বা চান না, এটাই যা। (Homestay)
এরপর পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে কুরমাইয়ের চেহারা আরও অনেকটাই বদলে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। গ্রামে কাঁচা টাকা আসার লক্ষণও চোখে পড়ল। বাইক আর চারচাকার সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনীতির বদল। গ্রামের মুখে নতুন নতুন দোকান, হলুদ টিমটিমে আলোর দুনিয়াটা যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। প্রধানের মতো সবাই সম্ভবত আর নিজভূমে সস্তার শ্রমিক হয়ে নেই। সুন্দর শুনে বলল, গ্রামের ফাঁকা জায়গাও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। টাকা তো আসবেই। পাশের রাভাগ্রাম আন্দুবস্তিতেও ক্রমে হোমস্টের আগমন হল। নড়াইদা, নড়াই রাভা আমাদের নিয়ে গেল তাঁর নতুন হোমস্টেতে। সেও একদম জঙ্গলের সীমায়। পাশেই হাতি-গণ্ডার-হরিণের জল খাওয়ার জায়গা। হাতি রোজই ঢুকে আসে বলে তার দিয়ে ঘেরা কটেজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা তুমি বানালে? নড়াইদা সরল মানুষ, হাসতে হাসতে বলে, “আমারই জমি, আমি আর কলকাতার পার্টনার মিলে বানালাম। ওর টাকা। আমি দেখাশোনা করব।” (Homestay)
“বিগত দশ-বারো বছর ধরে লাভাকে আপাদমস্তক বদলে যেতে দেখলাম। গাদাগুচ্ছের কংক্রিট-ট্যুরিস্ট-গাড়ি-ধোঁয়ার এক বিরক্তিকর ককটেল। কমবেশি একই অবস্থা রিশপ, কাফের বা লোলেগাঁওয়েরও।”
গতবছর, এমনই ডিসেম্বরে, বিকেলে নড়াইদার হোমস্টেতে গিয়ে দেখি নড়াইদা তাঁর বউয়ের সঙ্গে মিলে ট্যুরিস্টদের জন্য রান্না করছে। হোমস্টের দাওয়ায় বনফায়ারের আয়োজন চলছে। সামান্য পানাহার আর হইচই হবে। ট্যুরিস্টদের মধ্যে কেউ একজন রাতে মোমো খাওয়ার আবদার করেছেন। একা একা মোড় থেকে মোমো আনতে ভয় পাচ্ছিল নড়াইদা। অতএব আমাদের ধরল, “সঙ্গে নিয়ে যাবি? সকাল থেকে জঙ্গলের মধ্যে হাতিটা কাঁদছে।” এই অবস্থায় একা যাওয়াটা ঠিক নয়। আমরা অবশ্য হাতির কান্না শুনতে পেলাম না। কিন্তু নড়াইদাকে সঙ্গ দিতেই হল। রাস্তায় যেতে যেতে শুনলাম, সম্প্রতি অনেক টাকা চোট গেছে। নড়াইদার বোকামিতেই। কয়েকজন ট্যুরিস্ট আগাম বুকিং না করেই এসে থেকেছিল কয়েকদিন। তারপর হুট করে টাকা না দিয়েই পালিয়েছে। ‘পার্টনার’-কে তো এসব বলা যাবে না, তাই সেই টাকা নড়াইদাই গচ্চা দিয়েছে। এতে বাজারে দেনা হয়েছে খানিক, পরের বছরের আগে শোধ করা চাপ। কিন্তু হয়ে যাবে, ট্যুরিস্ট তো আসছে। যত ট্যুরিস্ট তত টাকা। রান্না আর অন্যান্য কাজের দাম দেয় পার্টনার। বাইরের লোক রাখলে খরচা বেশি, তাই বর-বউ মিলেই আপাতত সব কাজ করতে হচ্ছে। মাঠের কাজ, ঘরের কাজ সামলে একটু বেশিই পরিশ্রম। নড়াইদা আমাদের বলল, “ট্যুরিস্ট পাঠাবি। এখান থেকে খুব ভাল ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ দেখা যায়।” (Homestay)

২
কোলাখাম থেকে নামার সময়ে লাভায় চা খেতে নেমেছি। গরুবাথান, ডামডিম হয়ে নেমে যাব রাজাভাতখাওয়ায়। বিগত দশ-বারো বছর ধরে লাভাকে আপাদমস্তক বদলে যেতে দেখলাম। গাদাগুচ্ছের কংক্রিট-ট্যুরিস্ট-গাড়ি-ধোঁয়ার এক বিরক্তিকর ককটেল। কমবেশি একই অবস্থা রিশপ, কাফের বা লোলেগাঁওয়েরও। হোটেল-রিসর্ট আর হোমস্টের জঙ্গল খাতায়-কলমে থাকা ফরেস্টের অনেকটাই হাপিশ করে দিয়েছে। সৌমিত্রদা, সৌমিত্র ঘোষ একটা করুণ রসিকতা করেছিল একবার। বলেছিল, “লাভার জঙ্গল বাঁচাতে গিয়ে লাভার জঙ্গলটাই উবে গেল মাইরি!” (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: এসো আমার ঘরে এসো
নানা সূত্রে শুনেছি, নয়ের দশক অবধিও লাভায় ট্যুরিস্টের দেখা বিশেষ মিলত না। চারপাশে জঙ্গল, ঝিঁঝির ডাক। চড়াই ঠেলে ফরেস্ট বাংলোয় উঠলে বাইরে টাঙানো ম্যাপে তিব্বতে ঢোকার প্রাচীন পথ। রাজ্যের বন উন্নয়ন নিগম বা ফরেস্ট কর্পোরেশন তখন দেদার গাছ কাটত। কালিম্পং ও দার্জিলিঙের আনাচে-কানাচে কোনওমতে বেঁচেবর্তে থাকা কিছু পুরনো জঙ্গল তাদের স্পর্শে উধাও হয়ে যায়। পাহাড়িরা নাকি তাদের ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন না বলে বলত ফরেস্ট ডেস্ট্রাকশন কর্পোরেশন। এর সঙ্গে ছিল চোরকাঠুরের দল। ফলে, জঙ্গল দ্রুতই সাফ হচ্ছিল। এমন সময়ে, সৌমিত্রদার মাথায় একটা পরিকল্পনা আসে, এমন সুন্দর সব জায়গায় যদি ইকো-ট্যুরিজম চালু হয়, তাহলে স্থানীয়রা হোমস্টে বানাবেন, রোজগার হবে। এতে চোরাই কাঠ কাটাও বন্ধ হবে। হয়তো অন্য একটা ভাবনাও কাজ করেছিল, রাজস্ব ও রোজগারের নতুন উপায় বেরোলে ফরেস্ট কর্পোরেশন আর এত গাছ কাটবে না। (Homestay)

সৌমিত্রদার লেখা থেকেই বাকিটা উদ্ধৃত করা ভাল- “পরিচিত কনজার্ভেটরটি তখন রাজ্যের বন উন্নয়ন নিগম (শাদা বাংলায় ফরেস্ট কর্পোরেশন)-এর সর্বময় কর্তা, তাঁকে খুব করে বোঝালাম, লাভা ও পাশের লোলেগাঁ অতি উত্তম পর্যটনবন্ধু জায়গা, এখানে ইকো-ট্যুরিজম চালু করা অবশ্যকর্তব্য, এতে করে স্থানীয় চোরকাঠুরেরা সব চোরাই কাঠ কাটা ছেড়ে ইকোবন্ধু ট্যুরিস্ট সেবায় মন দেবে। বনের খাঁজেখাঁজে তাঁবু বসানো হল, নতুন লগ-কেবিন আর ডরমিট্রি তৈরি হল। ব্যাস। ধিকধিক করে ইকো-উন্নয়ন চলতে থাকল, মানে আরও বাংলো, আরও কটেজ, শেষে থিকথিকে হোটেল, লজ রিসর্ট। দু’একদিন ফোঁসফোঁস করে আমরা গত্তে ঢুকে পড়লাম, দুনিয়ার ইকো-ব্যবসায়ীরা তামাম লাভালোলেগাঁ অঞ্চলটি কবজা করে নিল।” (বনজঙ্গল ও অন্যান্য: সৌমিত্র ঘোষ, পৃঃ ৮৮-৮৯) (Homestay)
অতঃপর যা ঘটল, তাকে ডার্ক কমেডির উপাদান বলা চলে নিশ্চয়ই। ফরেস্ট কর্পোরেশন আর চোরাকাঠুরেরা যা সহজে পারেনি, ট্যুরিজম সেটাই দ্রুত করে ফেলে। লাভা-রিশপ-লোলেগাঁর অনেকখানি জঙ্গল পরিবেশবান্ধব পর্যটনের অবশ্যম্ভাবী খাদ্য হয়ে রাতারাতি উবে যায়।
সেই মহিলা উত্তরে বলেছিলেন, “অসুবিধে তো হয়ই। সে তো নানাকিছুতেই হয়। এই যে আপনারা অনায়াসে রান্নাঘরে ঢুকে আসেন, গল্প জোড়েন, এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেন, এতেও তো অসুবিধে হয়। সবসময় ইচ্ছে না হলেও কথা বলতে হয়, কারণ আপনারা ট্যুরিস্ট। আমাদের কাঠের রান্নাঘর, কাঠের উনুন, সবটা দেখতেই তো এসেছেন।”
৩
হোমস্টে মানে বাড়ির মধ্যেই অতিথিরা থাকবেন। বাড়ির রান্নাই খাবেন। স্থানীয় সংস্কৃতির আঁচ নিতে নিতে কয়েকটা দিন কাটাবেন। সেখানে আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি না হলেও হোটেল বা লজের বিলাসবাহুল্য মিলবে না, অর্ডারি খাবার মিলবে না। মোদ্দায় এই। অথচ, রাজাভাতখাওয়ার এক হোমস্টেতে আসা ট্যুরিস্টকে আমি জেনারেটর না থাকা নিয়ে চিৎকার করতে দেখেছি। রাতে পাঁঠার মাংসের দাবি জানাতেও দেখেছি। সিলেরিগাঁওতে অন্তত পনেরো বছর আগে চ্যাংমা-র নতুন হোমস্টেতে এক ট্যুরিস্ট পার্টিকে বলতে শুনেছিলাম, কালিম্পং-এর হোটেলে গিজার আছে, এখানে নেই কেন? এত এত পয়সা নিচ্ছ, পরিষেবা কই! পরিষেবা শব্দটা পর্যটন-ব্যবসার ধ্রুবপদ হিসেবে পাহাড়-তরাইয়ের গ্রামে-গ্রামে ঢুকে যাবে এরপর। গ্রাম্য পরিবেশ, থাকার ঘর, ঘরের পাশে এলাচ-ক্ষেত সবই ওই পরিষেবার প্যাকেজে ঢুকে পড়বে। ট্যুরিস্টদের ক্রমবর্ধমান দাবি আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার শর্ত মেটাতে এখন প্রায় সব হোমস্টেতেই গিজার। ওয়াইফাইও আছে। সঙ্গে বনফায়ার, ইচ্ছেমতো খানাপিনার সুযোগও। ভিউরুমের চাহিদা মেটাতে গ্রামের টঙে, উঁচুতে বন বা গাছ সাফ করে নতুন ঘর উঠছে। ক্রমে শহুরে বাবুদের আবিষ্কার করা ‘অফবিট’ গ্রামের হোমস্টেগুলো এভাবেই সস্তায় পুষ্টিকর হোটেলে পরিণত হয়ে যায়। (Homestay)

মনে পড়ে যাচ্ছে, চটকপুরের এক হোমস্টেতে বনফায়ারের নামে উদ্দাম নাচাগানা হচ্ছে, সেই বাড়ির ছোটোমেয়ে তারই মধ্যে কোনওমতে পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দু’দিন পরে তার স্কুলের পরীক্ষা। যে-মহিলা রান্না করছিলেন, ওই মেয়েটির মা, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এভাবে থাকতে অসুবিধে হয় না? এই যে বাইরে থেকে এসে লোকজন মদ খেয়ে চেল্লামেল্লি ফুর্তি করছে! সেই মহিলা উত্তরে বলেছিলেন, “অসুবিধে তো হয়ই। সে তো নানাকিছুতেই হয়। এই যে আপনারা অনায়াসে রান্নাঘরে ঢুকে আসেন, গল্প জোড়েন, এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেন, এতেও তো অসুবিধে হয়। সবসময় ইচ্ছে না হলেও কথা বলতে হয়, কারণ আপনারা ট্যুরিস্ট। আমাদের কাঠের রান্নাঘর, কাঠের উনুন, সবটা দেখতেই তো এসেছেন।” (Homestay)
“পাহাড়-ডুয়ার্সে নানা ধান্দায়, নানা কাজে ঘুরতে ঘুরতে বুঝেছি, হোমস্টে আসলে প্রহেলিকা। হোমস্টে তো বেআইনি নয়। ঘরে পর্যটক আসবেন, থাকবেন, দু-পয়সা রোজগার হবে, এতে কোনও অনৈতিক কোণ সত্যিই আছে কি?”
সেই কথাটা কানের পাশে ভনভন করে— পরিষেবা। ঘরের অন্দরমহলেও পর্যটকের কৌতূহল থাবা বসাবে, সেটাও পরিষেবার অঙ্কে মাপা হবে। শেষাবধি তো ব্যবসা। কড়ি ফেললে তেল তো মাখবই। সহজ কথা।
কুড়মাইয়ের প্রধান দুঃখ করে বলছিলেন, গ্রামটা বদলে যাচ্ছে। গ্রামের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাচ্ছে, রুচি-পোশাক সব বদলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের অভ্যেস বদলে যাচ্ছে, উঠতি ছেলেমেয়েদের লোভ বদলে যাচ্ছে। হোমস্টের মালিকানা কার হাতে থাকল, তা নিরপেক্ষভাবেই এই বদলটা কিন্তু ধ্রুব। টাকা এলে, বাইরের জগতের উগড়ে দেওয়া বমির দাগটাও বাড়ির উঠোনে লেগে থাকে। শত চেষ্টা করলেও মোছে না। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: পর্যটনের নয়া ঠিকানা হেরিটেজ হোমস্টে
৪
পাহাড়-ডুয়ার্সে নানা ধান্দায়, নানা কাজে ঘুরতে ঘুরতে বুঝেছি, হোমস্টে আসলে প্রহেলিকা। হোমস্টে তো বেআইনি নয়। ঘরে পর্যটক আসবেন, থাকবেন, দু-পয়সা রোজগার হবে, এতে কোনও অনৈতিক কোণ সত্যিই আছে কি?
অথচ, হোমস্টে থেকে আসা মুনাফার সঙ্গে আরও অনেককিছুই গ্রামে এসে ঢোকে। সেগুলো তিলে-তিলে বা দ্রুতই গ্রামের নানাকিছু বদলে দেয়। গ্রাম-সংলগ্ন নিসর্গ, গ্রামের জীবনের ছন্দ, মূল্যবোধ সব। গ্রামের প্রায় সবটাই তখন পণ্য। এগুলোকে আটকে বা বাঁচিয়ে হোমস্টে বানানোর চেষ্টাও যে কখনও কোথাও হয়নি, তা নয়। হয়েছে। গ্রামের মানুষরা যেভাবে থাকেন, সেভাবেই ট্যুরিস্টরা এসে থাকবেন। কিন্তু সেখানে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাথরুম বা টয়লেটের সমস্যা। গ্রামের সর্বত্রই টয়লেটের ব্যবস্থা ঘরের বাইরে। শহরের ট্যুরিস্টদের পক্ষে সেটা অসুবিধেজনক। ফলে, নতুন করে ঘর বানাতে হয়েছে। তাতে যে-টাকা লাগবে, তা আসবে কোথা থেকে? এই প্যাঁচে পড়ে অনেকেই অন্য পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। টাকা ধার করে হোমস্টে বানালে আর নিজস্ব সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বেশিদিন চলে না। তাছাড়া পর্যটকদের বয়ে আনা অভ্যেস আর দাবির পলি অচিরেই গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি-যাপনের জমিকে ঢেকে ফেলে। তারপর যা হওয়ার, তাই হয়। (Homestay)
“সিকিমের নানা গ্রামে সমবায় তৈরি করে হোমস্টে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। একদম নিয়ম মেনে নিজস্ব সংস্কৃতিকে লঘু না করে হোমস্টে বানানোর পরিকল্পনা হয়েছে। সেসব এখনও চলছে। কিন্তু তাতেও রুচির অনুপ্রবেশ সবটা ঠেকানো যায়নি।”
কুড়মাই বা আন্দুতে, পাহাড়ের নানা প্রান্তে শহুরে বাবুদের বিনিয়োগে যেভাবে হোমস্টে তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে অবশ্য সাদা চোখেই দাগিয়ে দেওয়া যায়। সেখানে দৃশ্যত লিজের নামে একজাতের জমিদখল চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাগজের বালাই নেই। সবটাই মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে চলছে। সঙ্গে হয়তো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার নজরদারি ও রক্ষাকবচ। পাহাড়ে অবশ্য এখন অন্য একটা মডেল বেশ জনপ্রিয়। জায়গা বুঝে বছরে আশি হাজার থেকে দেড় লাখে হোমস্টে লিজ নেওয়া যায়। চালাতে পারলে চালাও, না পারলে আমাদের দায় নেই। এটায় দখলের নামমাত্রও নেই। কিন্তু শহুরে লোকের চালানো ‘পাহাড়ি’ হোমস্টেতে স্থানীয় সংস্কৃতির গন্ধ-পণ্যটাও খানিক যেন আলগা। (Homestay)
“এই ঘটনায় কোন পক্ষ নেব? স্থানীয় মানুষদের একমাত্র উপার্জনের পথ হোমস্টে চালু রাখার পক্ষে, নাকি পরিবেশের প্রশ্নে ‘রিসর্ট’ হিসেবে দাগিয়ে হোমস্টে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে?”
সিকিমের নানা গ্রামে সমবায় তৈরি করে হোমস্টে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। একদম নিয়ম মেনে নিজস্ব সংস্কৃতিকে লঘু না করে হোমস্টে বানানোর পরিকল্পনা হয়েছে। সেসব এখনও চলছে। কিন্তু তাতেও রুচির অনুপ্রবেশ সবটা ঠেকানো যায়নি। সেটা সম্ভবও না। হিমাচলের এক স্থানীয় বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, একাধিক গ্রামের মানুষরা তাঁদের স্থানীয় রান্না ও খাবারের চর্চাটাই ভুলে গেছেন শুধু পর্যটকদের রসনাসেবা করতে করতে। পর্যটকদের জন্য রাঁধার পর উদ্বৃত্ত অংশ নিজেরা খেলে খরচ কমে। ক্রমে সেটাই ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েদের প্রিয় খাবারে পরিণত হয়েছে। ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত বনগ্রামেও এখন দেদার বিকোয় ম্যাগি আর আলুর চিপস। স্থানীয় ধান, পিঠে, নানারকম পদ উপার্জনের কো-ল্যাটারল ড্যামেজ হিসেবে স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। (Homestay)
অথচ, হোমস্টে তৈরির আকাঙ্ক্ষার সামনে এসব যুক্তি ও তথ্য এঁটে উঠতে পারে না। পর্যটন যে-মাত্রায় অতিকায় হয়েছে, হোমস্টের গল্পটাও সেই মাত্রায় বহরে বেড়েছে। ‘অফবিট’ গ্রামে, বিশেষ করে বনসংলগ্ন জমিতে তো হোটেল বানানো কঠিন, তাই হোমস্টেই আপাতত একমাত্র অবলম্বন। উত্তরবঙ্গের বহু অংশে যেখানে পর্যটনই একমাত্র জীবিকা মানুষের, সেখানে হোমস্টে তো হবেই।

ওই যে বলছিলাম, হোমস্টে প্রহেলিকা। কারণ, স্থানীয় মানুষরা উপার্জনে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, নৈতিক পথে নিজেদের অর্থনীতি নিজেরাই পোক্ত করছেন, এটায় সমস্যা খুঁজে পাওয়া চাপ। সমস্যা খুঁজে পেলেও একটা মোক্ষম প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে, বিকল্প কী? তাই হোমস্টে নিয়ে নানা সমালোচনা, অস্বস্তি সত্ত্বেও একরৈখিক নেতিতে দাঁড়ানোও যায় না। অন্তত স্থানীয়দের পরিচালিত হোমস্টে নিয়ে। মাঝে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের একটা বড় অংশে রিসর্টের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে আদালতে মামলা হল। বনদপ্তর জয়ন্তী-সহ বক্সা-সংলগ্ন নানা গ্রামের স্থানীয় মানুষদের ছোট-ছোট হোমস্টে দিল বন্ধ করে। সেগুলোও নাকি ‘রিসর্ট’। এই পদক্ষেপের অন্যতম কারণ, জয়ন্তী গ্রামটাকে খালি করতে হবে। স্থানীয় মানুষদের সবাই যেহেতু পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, তাই হোমস্টে বন্ধ করে দিলে উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে গ্রাম খালি করার জন্য চাপ দেওয়া যাবে। আদালতে হোমস্টের সংজ্ঞা নিয়েও দীর্ঘ সওয়াল-জবাব চলল। আপাতত সেই মামলা হিমঘরে। (Homestay)
আরও পড়ুন: আলো: আলো: ফেলে আসা দেশের বাড়ি, হস্টেল, মেস জীবনের আলো
কিন্তু এক্ষেত্রে সেই প্রহেলিকার সামনে এসেই দাঁড়াতে হয়। এই ঘটনায় কোন পক্ষ নেব? স্থানীয় মানুষদের একমাত্র উপার্জনের পথ হোমস্টে চালু রাখার পক্ষে, নাকি পরিবেশের প্রশ্নে ‘রিসর্ট’ হিসেবে দাগিয়ে হোমস্টে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে? যে-সরকার, প্রশাসন, যে-রাষ্ট্র নিসর্গকে, জঙ্গলকে মুনাফাভাণ্ডার হিসেবে দেখল এযাবৎ, জঙ্গল সাফ করল নানা প্রয়োজনে, তারা হঠাৎই ঠিক করে দিচ্ছে এই এই অঞ্চলে কয়েকটা হোমস্টে আসলে ক্ষতিকর! আবার তারাই পর্যটন প্রসারের স্বার্থে শয়ে-শয়ে একর বনভূমি, বণ্যপ্রাণ ধ্বংস করে পাহাড় ফুঁড়ে রেলপথ বানাচ্ছে! এই দ্বিচারিতার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে স্থানীয় মানুষদের তৈরি হোমস্টের পক্ষ নিয়ে ফেলতেই হয়। (Homestay)
তাতে কি সব অঙ্ক মিলে যায় বিলকুল! নাহ, ভাগশেষে পড়ে থাকে পর্যটকের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট এবং উবে যাওয়া সংস্কৃতি আর নিসর্গের ভূত।
চিত্রঋণ- উইকিমিডিয়া
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অনিতেশ চক্রবর্তী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। গবেষক। পড়ানো ছেড়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ। অত:পর আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজস্ব সংস্থা। ভালোবাসেন তথ্যচিত্র বানাতে। বনগ্রাম ও বনাধিকার নিয়ে কাজের সূত্রে উত্তরবঙ্গ তথা ভারতের নানা বনাঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক দুটি বই। কবিতার বইও আছে একটি।
