(Homestay)
মূলত পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হোমস্টের রমরমা আজ চূড়ান্ত। শুরুতেই বলে রাখা প্রয়োজন, হোমস্টেগুলি জনপ্রিয় করে তুলেছে মূলত বাঙালি। বাঙালি ছাড়া ভারতের পর্যটন যেমন মুখ থুবড়ে পড়বে, তেমনই বাঙালি ছাড়া হোমস্টে বেমানান। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী বাঙালি যেমন বাইরের পরিবেশ-রাস্তাঘাট-মানুষজন ভালবাসেন, ভালবাসেন সফরের শেষে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা। যে জায়গায় তিনি একটা হোমলি অ্যাটমোস্ফিয়ার পাবেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বন্ধু-বান্ধব ছড়িয়ে থাকার দরুণ কিছু অভারতীয় অর্থাৎ আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান কিংবা ব্রিটিশ মানুষদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তাদের সঙ্গে কথা বলে এটুকু বুঝেছি, অ্যাডভেঞ্চার মানে দিনরাত এক করে অ্যাডভেঞ্চার, সেখানে বাড়ি নামক কোনও কনসেপ্ট বা বাড়তি সুবিধা তাঁরা চান না। কিন্তু বাড়ির টান বাঙালির জীবনে সম্বল। ঠিক এখানেই এদিক-সেদিক গজিয়ে ওঠা হোমস্টেগুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: এসো আমার ঘরে এসো
আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। আমাদের ছিল লম্বা উঠোন, উঠোন ভর্তি গাছ, বাড়ির পাশে আস্ত পুকুর। দ্বিপ্রাহরিক আহার বা নৈশভোজে বাড়ির সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল দেখার মতো। আজ আমাদের পরিবারের যৌথতা নেই আগের মতো। পরিবার হয়ে গেছে নিউক্লিয়ার। ভেবে দেখার বিষয়, আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগেও জনপ্রিয় ডেস্টিনেশনে হোমস্টে গড়ে ওঠেনি। ছিল হোটেল অথবা রিসর্ট। (Homestay)

কিন্তু হোটেল বা রিসর্টের যে কর্পোরেট স্ট্রাকচার, তা কখনওই বাড়ির পরিবেশ বা সেবা দেবে না সেটাই স্বাভাবিক। যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে পড়া মানুষগুলোই অনেক বছর একা থাকতে থাকতে আজ আবার যৌথতার পিছনে ছুটতে লাগল। সে চাইল হারিয়ে যাওয়া অলৌকিক সব দিনগুলো রাতগুলো। ঘুরতে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল হোমস্টে। কী অদ্ভুত সমাপতন! পুরোনো সেই আবেগ ঘিরে শুরু হল ব্যবসা। ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসা ওই সময়গুলোকেই আবার আমরা আঁকড়ে ধরতে লাগলাম অর্থমূল্য দিয়ে। এক রাত্তিরের জন্য হাজার দুয়েক-তিনেক-পাঁচেক দিলেই বাড়ির মতো খাবার আর প্রিয় মানুষের মতো আতিথেয়তা। টাকা দিয়ে সময়কে ফিরে পাওয়ার আর্তি। (Homestay)
আমাদের কেয়ারটেকার দরজায় টোকা দিলেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়। এক গাল হাসি আর উত্তেজনা নিয়ে বললেন, ‘স্যার, কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেটনে কো লাগি চলনু হোস’
সে যাই হোক ইতিহাস-ভূগোল। হোমস্টেতে থাকা এককথায় অসাধারণ। একবার হোমস্টের স্বাদ পেলে পাঁচতারা-ছয়তারা তখন তুচ্ছ হয়ে যায় নিমেষে। হোমস্টের আতিথেয়তা একজন আত্মীয়ের চেয়েও কত আপন হতে পারে তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল আজ থেকে পনেরো বছর আগে কাশ্মীরে গিয়ে। আমার তখন স্কুল। (Homestay)

শ্রীনগরের লাল চকের কাছে শেঠি’স হোমস্টেতে কেটেছিল আমাদের তিন রাত। থাকা-খাওয়া-ঘুরে দেখানোর সুবন্দোবস্ত ছাড়াও ছিল হোমস্টের মালিকের অমায়িক ব্যবহার আর উষ্ণ অভ্যর্থনা। সে বাড়িরই নিজস্ব ড্রাইভার আমাকে শিখিয়েছিলেন, ‘আমি ভাত খাব’-র কাশ্মীরি অনুবাদ, ‘ম্যাহ টসোল খানি চ’। সেই ড্রাইভার হয়ে উঠেছিলেন আমার অসমবয়সী বন্ধু। আজও অ্যালবামে তাঁর সঙ্গে আমাদের ছবি যত্ন করে রাখা আছে। শুধু হোমস্টের আতিথেয়তাই নয়, ওই গোটা জার্নিটাতেই স্পষ্ট হয়ে ছিল গাড়িতে তাঁর পাশের সিটে বসে কাশ্মীরের সুউচ্চ উপত্যকা দেখা। খানিকটা নেশার মতো ছিল আমাদের পাশাপাশি বসা। তার অনেক বছর পর লিখেছিলাম একটি কবিতা (২০১৮ সালে যা গ্রন্থবদ্ধ হয় ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’ বইয়ে):

দূরন্ত এই ব্যালেরিনা ঢং। খিল্লিবাজ, সার্কাস্টিক।
ঠান্ডা আবহাওয়া চিনিয়ে দিচ্ছে হাইওয়ে… ড্রাইভারের ওভারটেক।
একটা লংজার্নিতে নাকি ড্রাইভারের পাশে বসলে ঘুমোনো যায় না।
ঘুরে চলেছি একটা বৃত্তের মাঝ বরাবর। কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে-
দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি, ড্রাইভার আর তার ওভারটেক।
একমাত্র এই স্বপ্নটার রং ছিল। কারণ ঘুম ভাঙতেই আমার মাথা
ড্রাইভারের কাঁধে রাখা ছিল যত্নে।
আর সেই থেকেই আমাদের সন্ধিচুক্তির শুরু… (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: পর্যটনের নয়া ঠিকানা হেরিটেজ হোমস্টে
এই তো কিছু বছর আগেও দার্জিলিং বিএনবি হোমস্টে-তে কেটেছিল দুই রাত। প্রবল ঝঞ্ঝার পর শেষদিন সকালে মায়াময় রোদ উঠল খাদের ধারে জানলা ঘেঁষে। আমাদের কেয়ারটেকার দরজায় টোকা দিলেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়। এক গাল হাসি আর উত্তেজনা নিয়ে বললেন, ‘স্যার, কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেটনে কো লাগি চলনু হোস’ (বাংলা অর্থ: স্যার, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবেন চলুন)। হাসি হাসি মুখ করে ঘুমচোখে আমরা বারান্দায় গিয়ে রাজকীয় সে কমলা দৃশ্য দেখে স্বস্তির হাসি হাসলাম। (Homestay)

কেয়ারটেকার চা দিয়ে গেলেন তৎক্ষনাৎ। প্রায় দশ-বারোদিন তুমুল বৃষ্টির পর একটা অপূর্ব আকাশ, যাঁরা নিয়মিত পাহাড় যান তাঁরা জানবেন বর্ষা পরবর্তী পাহাড়ের আকাশ আসলে কতখানি মায়ায় ঘেরা। অপরূপ সে দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে। কেয়ারটেকার হাসিহাসি মুখ নিয়ে যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়: আসলে জানেন স্যার, ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ডেকে দিলে অনেকেই বিরক্ত হন। তাই সবাইকে ডাকি না। আজ চল্লিশ বছর পাহাড়ে আছি। আজও প্রতিদিন ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি। কিন্তু নিজে দেখার চেয়ে অন্যদের দেখানোয় বেশি আনন্দ, তাই না? আপনাদের ঘুম থেকে তুলে দিলাম বলে কিছু মনে করবেন না। (Homestay)
“ওঁর মুখেই শোনা, উত্তরবঙ্গের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে গিয়ে হোমস্টে থেকে প্রতি সন্ধেয় তাঁদের দেওয়া হত কলমি শাকের ফুলের বড়া আর আগুন জ্বালিয়ে ছাং।”
আমি আর আমার বন্ধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। আর কেয়ারটেকার কাকাকে বললাম, ঘুম থেকে ডেকে বেশ করেছেন। তাহলে হোমস্টে-র অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? আমাদের মতো অনেক পর্যটকের কাছেই শুধু ভাল বিছানা পেলাম কিনা, ভাল বাথরুম পেলাম কিনা ইত্যাদি না দেখে মানুষজনের ব্যবহার, প্রকৃতি এবং আন্তরিকতা দেখেন, তাঁদের জন্য এই সামান্য কথাগুলোই আসল আন্তরিকতা। যারা প্রতিদিন ওই একই জিনিস দেখেও তাকে নবরূপে আবিষ্কার করেন আর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান অচেনা কারোর সঙ্গে, তাঁদের যেন আমরা আজীবন মনে রেখে দিতে পারি। ক্ষুদ্র জীবনের থেকে এটুকুই চাওয়া। (Homestay)

পরিচিত এক পিসির কথা মনে পড়ছে। প্রচুর হোমস্টেতে থেকেছেন তিনি, সবই পাহাড়ি মানুষের নিজস্ব হোমস্টে অথবা তাদের বাড়ি। তিনচুলের এক হোমস্টে ছিল পিসির দ্বিতীয় বাড়ি। প্রায় আট-দশবার গেছেন। এমনকী পিসির মেয়ের অন্নপ্রাশনে নেমন্তন্ন ছিল তিনচুলের সেই হোমস্টের পাঁচজন সদস্যের। শুধু তাই নয়, সেখানকার অন্যান্য বাসিন্দারাও আমন্ত্রিত ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে পিসির পরিচয় হয়েছিল মর্নিং ওয়াক করতে করতে। (Homestay)

আত্মীয়তা যে এতদূর গড়াতে পারে, তা পিসির কাছে না শুনলে বোঝাই যেত না। ওঁর মুখেই শোনা, উত্তরবঙ্গের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে গিয়ে হোমস্টে থেকে প্রতি সন্ধেয় তাঁদের দেওয়া হত কলমি শাকের ফুলের বড়া আর আগুন জ্বালিয়ে ছাং। হোমস্টের মালকিন অতিথিদের জন্য খাবার কখনও রিপিট করতেন না। একেকদিন একেকরকম পাহাড়ি পদ রেঁধে খাওয়াতেন। পিসির মুখে এ-ও শুনেছি তাঁরা ঘুরতে ঘুরতে যেকোনও বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। কেউ চা-কফি না খাইয়ে ছাড়তেন না। এতটাই হৃদ্যতা ছিল নাম না জানা সম্পূর্ণ অচেনা পাহাড়ি মানুষগুলোর সঙ্গে। (Homestay)
আরও পড়ুন: আলো: আলো: ফেলে আসা দেশের বাড়ি, হস্টেল, মেস জীবনের আলো
এমন অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ হোমস্টেতে আমরা দিন কাটাই। কিছু মনে রাখি, কিছু রাখি না। আমরা বাড়ির আনন্দ খুঁজে নিই যে যার মতো। এরপরেও কিছু কথা থেকে যায় তিক্ততার। সহজ কথায় চুরি করা। এমন বহু ঘটনার কথা কানে আসে হোমস্টেতে গেলে। কেউ ঘরে পরা চটি নিয়ে পালান, কেউ গৃহসজ্জার টুকিটাকি জিনিস। সে যতই টাকা দিয়ে রাত কাটানো হোক না কেন, কারোর বাড়িতে থাকা মানে, কিছু দায়িত্বও থেকে যায়।
গৃহকর্তা/কর্ত্রীর সঙ্গে অতিথির সুন্দর আদানপ্রদানই কাম্য। সম্পর্কে ফাটল ধরে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনায়। এমনও দেখেছি, হঠাৎ কোনও অতিথির প্যানিক অ্যাটাক ওঠায় হোমস্টের মালিক মধ্যরাতে ডাক্তার খুঁজতে বেরিয়েছেন। যে সাময়িক নিরাপত্তা হোমস্টে কর্তৃপক্ষ দেন, একজন অতিথির উচিত তার মর্যাদা রাখা। দুই দিনের বিশ্বাস গাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়– এভাবে নতুন বন্ধু পাতানোর দরজা আমরা খোলা রাখতেই পারি। পারি না? (Homestay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
একজন কবি, গদ্যকার এবং সাংবাদিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘গওহর জান’, ‘উড়তে চললাম কমরেড’, ‘ঘুম হও অজস্র অপরাজিতা’, ‘বিলম্বিত দুপুর’, ‘ও ডার্লিং তুমি শুধু দৃশ্যমান হাওয়া’। একটি দৈনিক অনলাইন মিডিয়ার সহযোগী সম্পাদক ও বিষয়বস্তু প্রধান।
