একটা কোরাপ্টেড স্টেট মেশিনারি। আমরা দেখতে পাচ্ছি সে ল্যাংটো। লজ্জা নিবারণের প্রবৃত্তিটুকু উড়ে গেছে এক ফুঁয়ে। আশরীর ঘা। বদরক্ত। পুঁজ। ছিটকে ছিটকে লাগছে একটা বিশাল আয়নায়। প্রতিফলনে, শিক্ষকবিহীন সরকারি স্কুল। কখনও পরিযায়ী শ্রমিকের নির্ঘুম দুটো চোখ। কখনও কিশোরী অথবা চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ। যে পরিকাঠামো আমাদের ঘিরে রেখেছে, বাঁধা পড়েছে সাধের টিকি, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ। আপাদমস্তক। (Sports)
পরিকাঠামো প্রয়োজন। একটি পরিবারের। বাস্তুতন্ত্রের। একটি বাজারের পরিকাঠামো আমাদের চিনিয়েছে, কোনখানে চিংড়ি মাছ পাওয়া যাবে। কোথায় পাকা কুমড়ো। কোথায়ই বা মুসুরির ডাল। টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুপদী পরিকাঠামো ভেঙেচুরে বেন স্টোকস যখন আপার কাটে ছয় মারেন অবলীলায়! অথবা, আর্টের তাগিদে অনাদিকালের শৈল্পিক পরিকাঠামো ভেঙে ফেলার পরেও, শিল্পী যখন আশ্রয় নিয়েছেন একটি পরিকাঠামোতেই! তখনই জেগেছে বিস্ময়! কেন? আশ্চর্য কোনও নীল রঙের ব্যবহার সম্ভব হয়েছে তবেই। সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলে নিশ্চিত পেয়েছিল কেউ। তবে না রাশিয়া বিপ্লব!

হে পাঠক, মানুষের বেঁচে থাকারও বহুবিধ পরিকাঠামো আছে। শ্রেণী অনুসারে তা ভাগ হয়েছে অনেক অনেকদিন। ভারতবর্ষে বরং সে বিভাজন ধর্মের। অথচ ক্ষমতার চূড়ায় বসে যে, পৃথিবীটাকে চালাচ্ছে যারা, চাইছে অপরের বেঁচে থাকার সিস্টেম গুঁড়িয়ে দিতে। পৈশাচিক সুখ আছে। শেষমেশ কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? স্পষ্ট হচ্ছে যে কোনও পরিকাঠামোর অভ্যন্তরে একটা অনুচ্চারিত পাওয়ার গেম। আমাদের দেশের খেলাধুলোয় ফোকাস করি। ক্রিকেট এবং ফুটবলের প্রভাবমুক্ত থাকবে সে দৃষ্টি। তাহলেই হাড়ে হাড়ে টের পাবেন!
প্যারিস অলিম্পিক। কুস্তিগির ভিনেশ ফোগট। লড়ছিলেন। মহিলাদের ৫০ কেজি বিভাগে। ফাইনালে পৌঁছলেন। ভিনেশের পারফর্মেন্স বলছে, সোনা আসবেই। দেশ উল্লসিত। অথচ তিনি ফাইনাল খেলতেই পারলেন না।
প্যারিস অলিম্পিক। কুস্তিগির ভিনেশ ফোগট। লড়ছিলেন। মহিলাদের ৫০ কেজি বিভাগে। ফাইনালে পৌঁছলেন। ভিনেশের পারফর্মেন্স বলছে, সোনা আসবেই। দেশ উল্লসিত। অথচ তিনি ফাইনাল খেলতেই পারলেন না। ওজন বেড়ে গেছে। এ-মুহূর্তে দুঃখ, হতাশা, হাহাকার ছাড়া যেটা করার থাকে, তা হল দেশের বিগত বছরের রাজনীতিতে নজর দেওয়া। সুগভীরভাবে। দেখতে পাব, দেশের কুস্তি পরিকাঠামোয় ঠায় বসে রয়েছেন সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং। যার বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ অসংখ্য।
পৃথিবীর মঞ্চে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন যে ‘এলিট অ্যাথলিট’! সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ার মতো ভিনেশ ফোগটও একজন। এশিয়ান গেমসে সোনা পেয়েছেন। রুপো এবং ব্রোঞ্জের সংখ্যা সাত। এবং কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় মুখ। সকল কুস্তিগিরের সঙ্গে তিনিও নেমেছিলেন আন্দোলনে। দাবী, ব্রিজভূষণ সিং-এর গ্রেফতার। রাষ্ট্র তা মেনে নেয়নি কোনওমতেই। নেবেও না।
অথচ, কুস্তির ইতিহাস কী মুগ্ধকর আমাদের! উইকিপিডিয়া বলছে, মহাভারতের মল্লযুদ্ধ অভিযোজিত হয়ে কুস্তির জন্ম। সনাতন ভারতবর্ষের মাটির আস্বাদ আছে এ-খেলায়। প্রকট হয়ে। আর সেই সনাতন ভারতবর্ষের প্রতিপক্ষে রইল রাষ্ট্র। এ তো পরিকাঠামোর পাপ। মনে পড়ছে ২০০৮ সাল। বেজিং অলিম্পিক। সুশীল কুমার ব্রোঞ্জ পেলেন। তারপর থেকে ২০২৪। প্রত্যেক অলিম্পিকেই কুস্তি থেকে এসেছে পদক। তেরঙা পতাকা ঋজু হয়েছে। আর কী হয়েছে? একাধিক ব্রিজভূষণ সিং বেড়ে উঠেছে। স্বাচ্ছন্দ্যেই। বিরুদ্ধাচারণ করলে প্রিজনভ্যান। এবং ব্যান। এ তো গেল পরিকাঠামো যখন শয়তান! তার গল্প। তার সঙ্গে ক্ষমতার অবধারিত সম্পর্ক। যেখানে কুস্তি একটি উদাহরণ মাত্র। পরিকাঠামো কখনও হার্ডল। যা টপকানো সম্ভব হয় না কিছুতেই। ঠিক ধরেছেন, ক্রীড়ার অন্দরের বিচরণ করছি যেহেতু, তাই বলব হকির কথা।

একটা স্বর্ণযুগ। আক্ষরিক অর্থেই। ১৯২৮ থেকে ১৯৬০। অলিম্পিকে সোনার সংখ্যা ছয়। জাপানের বিরুদ্ধে ১০ গোলে জয়। আমেরিকাকে ২৪-১ গোলে কুপোকাত। হাঙ্গেরি। বেলজিয়াম। স্পেন। ফ্রান্স। যে এসেছে, ছিটকে গেছে। কিংবদন্তি হকি-খেলোয়াড় ধ্যানচাঁদ ক্রমেই পরিণত হয়েছেন বিধ্বংসে। সময়কালও অদ্ভুত। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায়নি। একইসঙ্গে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপ। হাতে হকিস্টিক। সবুজ মাঠ। আর গোওওওওল!
১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে প্রথম অলিম্পিক। অস্ট্রিয়া, আর্জেন্টিনা এবং স্পেনকে হারিয়ে ফাইনালে ভারত। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। প্রতিপক্ষ, ঔপনিবেশিক শক্তি—যে শক্তির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্বাধীনতা টলোমলো করছে। অতএব লড়াই যতটা মাঠে, ততটা মনে। শরীরে। রক্তে। কী হল সেই ম্যাচে? ৪-০ গোলে হেরে গেল ইংল্যান্ড।
১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে প্রথম অলিম্পিক। অস্ট্রিয়া, আর্জেন্টিনা এবং স্পেনকে হারিয়ে ফাইনালে ভারত। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। প্রতিপক্ষ, ঔপনিবেশিক শক্তি—যে শক্তির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্বাধীনতা টলোমলো করছে। অতএব লড়াই যতটা মাঠে, ততটা মনে। শরীরে। রক্তে। কী হল সেই ম্যাচে? ৪-০ গোলে হেরে গেল ইংল্যান্ড। ভারতের মুঠোয় স্বর্ণপদক। স্বাধীনতার রঙ মিশে ছিল সোনারঙে। মিশ্রিত সেই রঙ যেন একটা সূর্য। যেন স্বাধীন ভারতবর্ষে, ঘামে, রক্তে, শ্রমে, আর খিদের পরিকাঠামোয় অনন্ত আগুন। যেন এক দহনে একছটাক শ্বাসবায়ু! যেন ২০০৩-০৪ মরশুমে, আর্সেন ওয়েঙ্গারের সেই আর্সেনাল। প্রিমিয়ার লিগে দ্য ইনভিন্সিবল! তারপর? আমরা শুধুই চিৎকার করছি। এখনও চিৎকার করছি। ‘কামব্যাক’। ‘কামব্যাক’। হয়েছে আদৌ? আজ্ঞে না। মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে যখন কৃত্রিম ঘাসের মাঠে খেলা শুরু হল, ভারতীয় হকি দল থমকে গেল সেখানেই। থাকতে পারে সর্বনাশের আরও একশো একটি কারণ। তবু এ সত্য যে, ভারতীয় দল মানিয়ে নিতে পারেনি পরিকাঠামোর অমোঘ পরিবর্তন। তারপর অন্ধকার। সুদীর্ঘ। তার ভেতরেও পি. আর. শ্রীজেশের অসীম ডেডিকেশান আমাদের মুগ্ধ করে। টোকিও এবং প্যারিস অলিম্পিকে দুটো ব্রোঞ্জ আলোকবিন্দুসম। আশাবাদ ছাড়া আর কী-ই বা আছে আমাদের?
না মশাই। আমাদের শ্যুটিং নিয়ে গর্বের ক্ষেত্র রয়েছে। ক্রমে বিস্তারিত হচ্ছে। পরিকাঠামোই যেখানে মূল।

ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বলে, শ্যুটিং আসলে সাহেবদের খেলা। এ-দেশ তা ধারণ করতে পারে না। ধারণাটি ভ্রান্ত নয়। ভ্রান্তি মানসিকতায়। ক্রীড়া-আবহাওয়ায়। পরিকাঠামোয়। যদি উন্নত হয়, তবে রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর রুপো জিতে যান। সেই শুরু। ২০০৪। এথেন্স অলিম্পিক। পুরুষদের শ্যুটিং-এ, ডাবল ট্র্যাপ বিভাগে প্রথম পদক। অকল্পনীয় এক ইতিহাস! তারপর অভিনব বিন্দ্রা। স্ট্রেইইইইট স্বর্ণপদক। তারপর গগন নারাং। বিজয় কুমার। সম্প্রতি মানু ভাকের। বলতে চাইছি, গ্রাফটি ঊর্ধ্বগামী। কেন? যোগ্য পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম আমরা। ক্রিকেটের পরে, অন্তত একটি ক্রীড়াক্ষেত্রে। তেমনই, পদক পেলেন না অথচ প্রশংসনীয় পারফর্মেন্স—এহেন শ্যুটারের সংখ্যাও কম নয়! যেমন জয়দীপ কর্মকার। পুরুষদের ৫০ মিটার রাইফেল প্রোন বিভাগে, চতুর্থ স্থানের অধিকারী। ২০১২। লন্ডন অলিম্পিক। বর্তমানে যে অ্যাকাডেমিতে কোচিং করাচ্ছেন, তাঁরই হাত ধরেই উঠে আসছে নতুন নতুন তারা।
এই যে পরিকাঠামোগত একটা অবস্থান্তর! আলবাত মঙ্গলময়। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই যে অসংখ্য শ্যুটিং অ্যাকাডেমি এবং শ্যুটিং ক্লাব—সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় মানু ভাকের।
এই যে পরিকাঠামোগত একটা অবস্থান্তর! আলবাত মঙ্গলময়। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই যে অসংখ্য শ্যুটিং অ্যাকাডেমি এবং শ্যুটিং ক্লাব—সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় মানু ভাকের। প্রত্যেকটিই যে উন্নতমানের, আন্তর্জাতিক টেকনলজিতে ভরপুর, এমনটা বলছি না। তবে অভিনব বিন্দ্রা যেখানে শ্যুটিং-এর পাঠ দেবেন, নিশ্চয়ই তা বিশ্বমানের! ওইটা একধরণের বারুদ-ফুলকি। সম্পূর্ণ ক্রীড়া-আবহাওয়ার যে বদল, ক্রিকেট ছাড়াও যে একটি ক্রীড়ায় গায়ে স্পটলাইট—ফুলকির জন্যেই। আর আছে মিডিয়া। অর্থাৎ, সহজলভ্যতা। রেডিও, টেলিভিশান হয়ে যে কোনও খেলাই হাতের মুঠোয় পেয়েছি। আমাদের খেলা-কেন্দ্রিক দৃষ্টি এবং আগ্রহ—উভয়ই হয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ক্রীড়া-পরিকাঠামোয় এও এক সংযোজন বটেই। নইলে সুব্যবস্থা যেমন প্রকট হয় না, অব্যবস্থাও ঢাকা পড়ে যায় তেমন। অজান্তেই। যদি পরিকাঠামোর অস্তিত্বই মুছে যায়, তাহলে ক্যাওস তৈরি হতে পারে। ক্যাওস থেকেও জন্ম নিতে পারে সতেজ কাঁচা একটি পরিকাঠামো। আমাদের সিংহভাগ কাঠামো থেকেই মাটি খসে পড়ছে। শিক্ষা। স্বাস্থ্য। অর্থনীতি। এরপর হয় গোল্লায় যাব। পড়ে থাকবে কাঠ। নইলে এক পৃথিবী বাধা টপকে হিরো হব। জ্বলে থাকব ত্রিনয়নের মতো।

রোদ্দুর মিত্র
রোদ্দুর এমন একটা বই যার ফ্রণ্ট কাভারে সিনেমা আর ব্যাক কাভারে ঘুম। মধ্যে অনেকগুলো পাতা। লেখা ও না-লেখা। সসম্মানে অঙ্কে তৃতীয় বর্ষের পড়াশোনা শেষ করে স্নাতকোত্তরে প্রবেশ করলেও, হিসেবনিকেশ গুলিয়ে দেওয়াই রোদ্দুরের প্রধান কাজ।