সেতারের উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক মতভেদ আছে। কারও মতে আমীর খুসরো ‘সেহতাল’ নামে একটি যন্ত্র ইরান থেকে ভারতে নিয়ে আসেন। ফরাসী ভাষায় ‘সেহ’ কথাটির অথ ‘তিন’ এবং সেহতার অর্থাৎ তিন তার যুক্ত যার। এই মতবাদ অনুযায়ী সেহতার ভারতে এসে বিবর্তিত হয়ে সিতারের জন্ম হয়েছে। আবার প্রসিদ্ধ সঙ্গীত শিল্পী ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মতে, সপ্ততী বীনা থেকেই সপ্ততার, সত্তর বা সতার বা সিতার কথাটি এসেছে।
সেতারের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ আলােচনা করে একটি বিষয় লক্ষ করা যায় যে, আঠেরােশাে শতাব্দীর আগে সেতারের উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। আলাউদ্দীন খিলজীর (তেরােশাে শতাব্দী) সময়কালীন আমীর খুসরু তাঁর দুটি বই ‘নূর সিলহর’ এবং ‘কিরা সসাদেন’-এ সঙ্গীত সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্তু ‘সিতার’ বা ‘সেতার’-এর কোন উল্লেখ করেননি। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ব্রিটিশদের কাছে নতিস্বীকার করে কলকাতায় নির্বাসিত হয়ে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এলেন বাইজী, গায়ক, বাদক, কত্থক নাচিয়ে ইত্যাদিদের। আর সেই সময় থেকেই কলকাতায় শুরু হল সঙ্গীতের এক নতুন পরম্পরা। যদিও কলকাতায় সঙ্গীতের চর্চা তার আগে থাকতেই ছিল। কালীকীর্তন, কক্সকীর্তন ও পল্লীসঙ্গীতেও প্রচুর রাগ-রাগিনী লুকিয়ে ছিল। সাংস্কৃতি মনষ্ক বাঙালি খাঁটি ধ্রুপদী সঙ্গীতকেও আপন করে নিয়েছিল সেই সময় থেকে। রাজা, মহারাজা, জমিদারেরা নিমন্ত্রণ করে আনতেন তানসেন বংশীয় সঙ্গীত শিল্পীদের। কলকাতায় এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে সব সঙ্গীত পৃষ্ঠপােষক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিলেন রাজা স্যার সৌরীন্দ্রমােহন ঠাকুর ও তাঁর ভাই যতীন্দ্রমােহন ঠাকুর। সৌরীন্দ্রমােহন প্রকৃত সঙ্গীত রসিক ছিলেন। তিনি ওস্তাদ মহম্মদ খান বাদকারের পুুত্র সাজ্জাদ মহম্মদকে কলকাতায় আমন্ত্রণ করে আনেন। সাজ্জাদ মহম্মদ সেতার ও সুরবাহার উভয় বাজনাতেই দক্ষ ছিলেন। ইনি সুরবাহারে।
সাজ্জাদ মহম্মদের শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর, বামাচরণ ভট্টাচার্য ও তাঁর সুযােগ্য পুত্র লক্ষণ ভট্টাচার্য। তরুণ ইমদাদ খানের দক্ষতা দেখে সৌরীন্দ্রমােহন সাজ্জাদ মহম্মদকে অনুরােধ করেন ইমদাদকে শেখানাের জন্য। কিন্তু সাজ্জাদ মহম্মদ শেখাতে নারাজ হন। বাধ্য হয়ে আড়াল থেকে সাজ্জাদের বাজনা শুনে ইমদাদ তা শিখে নিতেন। সেই সময়ের অনেক সঙ্গীতশিল্পীদের কাছে শুনে শুনে শিখে তিনি এক নতুন বাদনশৈলী সৃষ্টি করেন যা ‘ইমদাদখানি বাজনা’ বলে প্রচলিত হয় এবং এক বিরাট প্রভাব ফেলে তখনকার সঙ্গীত মহলে, বিশেষ করে সেতার বাদকদের মধ্যে। ইমদাদ খাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন ডা. কল্যানী মল্লিক, প্রকাশচন্দ সেন ও মৈমনসিংহের জমিদার ব্রজকিশাের রায়চৌধুরী।
ইমদাদ খাঁর প্রতিভাবান পুত্র ইনায়েত খাঁকে আমন্ত্রণ করে বাংলায় নিয়ে আসেন মৈমনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রকিশাের। বীরেন্দ্রকে শেখাবার জন্য ইনায়েত খাঁ প্রথমে বিডন স্ট্রিট, পরে রাজাবাজার এবং তারও পরে পার্কসার্কাস অঞ্চলে বসবাস করে প্রচুর বাঙালি শিষ্য-শিষ্যাকে তালিম দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য, জিতেন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত, বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী, জন গােমেস, মনােরঞ্জন মুখােপাধ্যায়, রেনুকা সাহা প্রভৃতি। এঁদের শিষ্যদের মধ্যে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বেঞ্জামিন গােমেস, কল্যান রায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাগবাজারের প্রখ্যাত তবলিয়া অনাথনাথ বসু নিজে শিল্পী তো বটেই, পাশাপাশি সঙ্গীতের পৃষ্ঠপােষকও ছিলেন। জয়পুর সেনীয়া ঘরানার শিল্পী আশিক আলি খাঁর পুত্র মুস্তাক আলি খাঁকে দ্বারভাঙ্গা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন অনাথবাবু। ১৯৩৮ সালে ইনায়েত খাঁর অকাল মৃত্যুর পর মুস্তাক আলি বেশ কিছু দিন কলকাতার সেতার জগতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। ওঁর শিক্ষা ছিল খুবই উচ্চমানের। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শিক্ষাজীবনের গােড়ার দিকে মুস্তাক আলি খাঁ সাহেবের কাছেই শেখেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম দেবু (দেবব্রত) চৌধুরীর। এ ছাড়া অরুণ চট্টোপাধ্যায়, নির্মল গুহঠাকুরতা ও নিতাই বসুর নাম উল্লেখযোগ্য।
অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে যে দুজন বিখ্যাত সেতারী ছিলেন তাঁরা হলেন ভগবানচন্দ্র দাস ও তার ছােট ভাই শ্যামচন্দ্র দাস। ভগবানচন্দ্রের বাবা রতনচন্দ্র দাস ঢাকায় যেসব সঙ্গীতশিল্পীরা আসতেন, তাঁদের সকলের কাছেই শিখতেন। বাবার মৃত্যুর পর ভগবানচন্দ্র রবাবী কাশিম আলি খাঁ, সরােদী ইনায়েত হসেন খাঁ, বণকার মুশিদ আলি খাঁ প্রভৃতির কাছে তালিম নেন এবং সেই সময়ের ঢাকার একচ্ছত্র সেতার বাদক বলে পরিগণিত হন। পরবর্তীকালে ইনি কলকাতায় চলে এসে সৌরীন্দ্রমােহন ও যতীন্দ্রমােহন প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠানে সেতারের শিক্ষক হিসাবে যােগদান করেন। এঁর পুত্র মঙ্গল দাস তাঁর পুত্র কার্তিককুমার দাসকে ইনায়েত খাঁর শিষ্য মনােরঞ্জন মুখােপাধ্যায়ের কাছে শিখতে পাঠান। আকাশবাণীর সঙ্গীত প্রতিযােগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন কার্তিক দাস। কলকাতার আর এক গুণী সেতার বাদক ছিলেন এলবাম পাঠক। এনার ঠাকুরদাদা রামেশ্বর পাঠক সেতারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বলরাম পাঠক অত্যন্ত সুরেলা সেতারী ছিলেন এবং নানা ধরনের ঝালা বাজাতেন। ইনি কলকাতায় অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে তৈরি করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায় ও রাজকুমারী দেবিকা দেবী উল্লেখযোগ্য। খয়রাগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকাকালীন ইনি বর্তমান প্রজন্মের বিখ্যাত সেতারী বুধাদিত্য মুখােপাধ্যায়কেও বেশ কিছুদিন সেতার শেখান।
আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যে হেতু মধ্যপ্রদেশের মইহার শহরে থাকতেন তাই তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের মইহারে গিয়েই শিখতে হত। রবিশঙ্করের সঙ্গীত জীবন শুরু হয় কলকাতায় কিন্তু সেই সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কাউকে বিশদে সঙ্গীত শিক্ষা দেবার সুযোগ পাননি তেমন। পরবর্তীকালে মুম্বই ও দিল্লিতে থাকাকালীন কিছু শিষ্য-শিষ্যা তৈরি করেন। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কার্তিককুমার, উমাশঙ্কর মিশ্র, জয়া বিশ্বাস, দীপক চৌধুরী প্রভৃতি। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে ভাবে শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা ছিল না। তাই যাঁরা তাঁর শৈলী অনুসরণ করে বাজান তাঁরা অধিকাংশই শুনে বাজান।
১৯৫৬ সালে আলি আকবর খান তার কলেজ অব মিউজিক খােলার পর অনেকেই মইহার ঘরানার বাদন শৈলী শেখার সুযোগ পান। বিষ্ণুপুর ঘরানার গােকুল নাগ ও লক্ষণ ভট্টাচার্যের শিষ্য অমরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে তৈরি করেছিলেন। তানসেন বংশীয় শেষ উস্তাদ মহম্মদ দবীর খান কলকাতায় বসবাস করতেন এবং সুরবাহার-সেতার-সরােদ শেখাতেন। ওঁর সেরা শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সন্তোষ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামলকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মায়া মিত্র। খুব সম্ভবত চারের দশকে কলকাতায় সঙ্গীত সম্মেলনী বলে একটি গানবাজনার স্কুল হয়। বাঙালির মেয়েরা বাড়ির বাইরে প্রথম গান বাজনা শেখে এই স্কুলেই। এছাড়া জ্ঞানপ্রকাশ ঘােষের ঝংকার, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির ক্লাস, শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায়ের গাঙ্গুলী স্কুল অব মিউজিক এবং আরও সংস্থা গান ও বাজনা শিখিয়ে কলকাতাকে সঙ্গীতের পীঠস্থান তৈরি করতে সাহায্য করে।
সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চলে পড়াশোনা ও লেখালেখি। 'আপনাদের সেবায়', 'প্রসঙ্গ ঠুমরি', 'সুরের গুরু' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। সরোদচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় করেন বাংলা ছবিতে।