শীত চলে গিয়েছে কিন্তু গ্রীষ্ম আসেনি, এমন একটি সময়কাল হল বসন্ত । আমাদের দেশে ঠিক সেই ভাবে বোঝা না গেলেও পৃথিবীর বহু জায়গাতেই শীত হল মৃত্যুর মতো সাদা ও নিথর। তখন গাছের সব পাতা ঝরে যায়। ছোটো ছোটো পাখিরা বরফের মধ্যে খাবার এবং আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে পিঠের পালকে মুখ গুঁজে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর এর ঠিক পরেই বসন্ত এসে যেন নতুন জীবনের কথা বলে । এই সময় শূন্য ডালে নতুন পাতা গজায়। ফোটে নানা ধরনের চমৎকার ফুল। পলাশ, শিমুল, বকুল, পারুল, শাল, মহুয়া — এমন গাছেরা ফুলেফুলে ভরে ওঠে। পাখি-মা জন্ম দেয় তুলোর বলের মতো ফুটফুটে কচি বাচ্চাদের । গিরগিটি-মা তার সন্তানকে নিয়ে বসে থাকে পাতার ছায়ায়।
বসন্ত নিয়ে পৃথিবীর নানান ভাষায় অজস্র গান বাঁধা হয়েছে। বাংলাতেও এই সম্ভার চোখে পড়ার মতো।
বাংলা ভাষায় বসন্তকে নিয়ে যাঁরা গান বেঁধেছেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাম সবার আগে। না না, বয়সের জন্যে, নোবেল প্রাইজের জন্যে বা তাঁর বিশ্বজোড়া পরিচিতির খাতিরে নয় মোটেই। উৎকর্ষের দিক দিয়ে, প্রাণময়তার দিক দিয়ে এবং একটি ঋতুকে শব্দ ও সুরের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত করে তোলার দিক দিয়ে সত্যি সত্যিই তিনি আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গান নিয়ে বিদগ্ধজনেরা প্রচুর আলোচনা করেছেন। আজ তাই বসন্তকাল নিয়ে সেইসব লোকগানের কথা মনে করতে চাইব, যারা আমাদের খুব কাছের হলেও তাদের নিয়ে কাগজে-কলমে বড়ো একটা আলোচনা হয় না।
প্রাচীন বাংলায় দোল উৎসবকে ঘিরে বেশ কিছু লোকগান তৈরি হয়েছিল। দোল যেহেতু বসন্তকালের উৎসব, তাই সেই গানগুলির মধ্যেও বসন্তের ছোঁয়া রয়েছে। এই গানগুলির মূল চরিত্র ছিলেন রাধা ও কৃষ্ণ। গানগুলির মিষ্টি সুরের মধ্যে কোথাও কোথাও কীর্তনের নেশা মিশে ছিল। যার একটি হল —
বসন্ত সময়ে কৃষ্ণ কোথায় গো প্রাণ-ললিতে
যৌবন রাখিব রাধার কী মতে ?
বসন্ত সময়ে হরি, হইয়া রইল মধুকরী
ওগো ধৈরয না মানে রাধার, চিত্তে গো প্রাণ ললিতে ।।
এর পরে যে বসন্তের গানটির কথা বলব সেটি পুববাংলার সিলেট অঞ্চলের একটি ধামাইল গান। ধামাইল হল সেই বিশেষ ধরনের গান, যা অনেক মহিলা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গেরস্তবাড়ির কোনো শুভ অনুষ্ঠানের আগে, সেই বাড়ির ‘ধামা’ অর্থাৎ ‘উঠোনে’ নেচে নেচে গেয়ে থাকেন। এই গানটির কথা হল–
আজ হোলি খেলব রে শ্যাম তোমার সনে
একেলা পাইয়াছি তোমায় নিধুবনে
একেলা পাইয়াছি হেথা, পলাইয়া যাবে কোথা
ঘেরিয়া রাখিব আমরা সব সখীগণে।
এই গানটিই পরে ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছায়াছবিতে (১৯৫২) গেয়েছিলেন আমাদের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিন্তু তাঁর গায়কীতে মূল গানটির উচ্ছ্বাসের বদলে, প্রেম ও বিষাদে ভরা এক আশ্চর্য আকুতি ঝরে পড়েছিল।
বসন্তকালের আরেকটি জনপ্রিয় লোকগান হল–
পিন্দারে পলাশের বন, পালাব পালাব মন
ন্যাংটা ইন্দুরে ঢোল কাটে
বতরে পিরিতের ফুল ফোটে ।
এটি একটি ঝুমুরগান এবং এর পদকর্তা পুরুলিয়ার ঝুমুর-কবি সুনীল মাহাতো। এই সত্যটি আমি জেনেছি প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী এবং গবেষক শ্রদ্ধেয় শুভেন্দু মাইতির কাছ থেকে। পদকর্তা হিসেবে সুনীলবাবুর নাম, এই গানটির মতো তাঁর লেখা অনেক ঝুমুরগানের সঙ্গেই কিন্তু দেওয়া নেই। এর কারণ, তিনি নিজের নামটি জাহির করতে পছন্দ করেন না। তাঁর কাছে গান তৈরির আনন্দটাই আসল। কালে, শহুরে গায়কদের গলায় এই গানটির আসল মেজাজ অনেকটাই হারিয়ে যায় এবং সেইভাবেই তা আমাদের কানে আসে।
ওপরের গানটিতে যেমন পলাশের কথা আছে, তেমনি আছে অজস্র টুসু এবং ভাদু গানে। যদিও টুসু কিংবা ভাদু পরবের কোনওটাই বসন্তকালে নয়, তবু এর নানা গানে বসন্তকালের মায়াময় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ভালোবাসা বা বিরহের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিশিয়েও যে চমৎকার একটি বসন্তকালের গান গড়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ নিচের গানটি —
বনে বনে ফুটেছে মহুয়া রে
গাছে গাছে ফুটেছে মহুয়া
পলাশ-শিমুল মউবনে
ভাঙা মনে যৌবনে
বনে বনে ফুটেছে মহুয়া রে।।
এরপর বসন্তকালের আরেকটি ঝুমুরগানের কথা বলি, যার প্রথম দুটি পংক্তি হল —
বসন্ত আসিল সখী, কুকিলো ডাকিল রে
এমন সময় প্রিয় সখা বিদেশে রহিল রে !
আসলে, বসন্ত যেমন ভালোবাসার এবং মিলনের কাল, তেমনি তা বিরহেরও বটে। এই গানটিতে যেমন দূর দেশে থাকা প্রিয় সখার জন্যে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার বিরহ প্রকাশ পাচ্ছে। কোকিলের ডাকে উদাস হয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়। এই গানটির পদকর্তার নাম কিন্তু জানা নেই । ঠিক এমনই বিরহ ভাবের আর একটি ভাওয়াইয়া গান হল –
আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি
প্রাণ কোকিলা রে
নিভা ছিল মনের আগুন
জ্বালাইয়া গেলি, প্রাণ কোকিলা রে
আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি
এই গানে যদিও রাধাকৃষ্ণের বিরহই প্রধান, কিন্তু তার মধ্যে বসন্তকালের নানা অনুষঙ্গ এসেছে। গভীর রাতে মিলনের আকাঙ্খায় ডেকে উঠেছে বসন্তের কোকিল আর সেই ডাকে মন উচাটন হয়েছে রাধার। এই গানটিকে সবাই পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর লেখা বলেই জানেন এবং সুরকার হিসেবে জানেন গানটির গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সাহেবকে। কিন্তু আব্বাসউদ্দিন সাহেবের পুত্র, সুগায়ক, মুস্তাফা জামান আব্বাসী সাহেব তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আব্বাসউদ্দিনের গান’ গ্রন্থটিতে জানিয়েছেন, এই গানটির কথা সংগৃহীত এবং এর সুরকার ঢাকার প্রখ্যাত দোতারাবাদক কানাইলাল শীল (পৃ ২১০), যাঁর বাজনার সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে রয়েছে বন্ধু আব্বাসউদ্দিনের ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’-র মতো অজস্র লং প্লেইং রেকর্ডে।
পুববাংলার প্রবাদপ্রতিম বাউল শাহ আবদুল করিম বাংলা লোকগানের একটি মাইলফলকের মতো। তাঁর সৃষ্টি করা গানগুলির মধ্যে এমন একটা ব্যাপার আছে, যা সচরাচর অন্য কারোর গানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এই ব্যাপারটা যে ঠিক কী, সেটা কেউই খুব পরিষ্কার করে বোঝাতে পারেন না। কিন্তু অনুভব করতে পারেন অন্তর থেকে। আসলে করিম সাহেবের দেখাটাই ছিল অন্যরকম। সকলের চেয়ে আলাদা এবং অনন্য। আর সেই অন্যরকম দেখাটাকে তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করতে পারতেন শব্দ আর সুরের মিশেলে। করিম সাহেবের অনেক গানেই বসন্তের স্পর্শ আছে। যেমন –
বসন্ত বাতাসে, সই গো বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।
এখানে যে বন্ধুটির কথা শাহ আবদুল করিম বলছেন, সেই বন্ধুটি কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষের বাড়ির পাশটিতেই থাকে না। আর থাকে না বলেই না-পাওয়ার, না-দেখার একটা দূরত্ব ও শূন্যতা তার মধ্যে তৈরি হয়। বসন্ত বাতাস যেন সেই বন্ধুর বাড়ি থেকে ফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছে তার এই বন্ধু তথা প্রেমিকাটির বাড়ি। এখানে গানটি রমণী কণ্ঠে গীত হওয়াই বাঞ্ছনীয় কারণ মেয়েরাই সাধারণত তাদের বান্ধবীকে ‘সই’ বলে ডাকে । শাহ আবদুল করিমের বসন্তের গানের মধ্যে আর একটি হল —
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
দিলে চায়, মনে চায়
প্রাণে চায় তারে
বসন্ত সময় কোকিল ডাকে কুহু স্বরে
যৌবনের বসন্তে কোকিল
থাকতে চায় না ঘরে …
এখানেও বসন্তকালের হাওয়ায় রাধা-কৃষ্ণ তথা চিরন্তন প্রমিক-প্রেমিকার বিরহ । শ্রীকৃষ্ণের আসবার কথা। তার আসবার জন্যে কত সাজ-সজ্জা-রূপমালা-অলংকার। কিন্তু সে যে আসবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর তার প্রতীক্ষার মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠেছে রাধার প্রচ্ছন্ন বিরহ। এখানেও কোকিলের ডাকটিকে বিরহের রূপক হিসেবেই ব্যবহার করেছেন পদকর্তা।
একটা ব্যক্তিগত কথা হঠাৎ বলতে ইচ্ছে করল। বর্তমানে টালিগঞ্জের যে বাড়িটিতে আমরা থাকি, তার লাগোয়া একটি ছোটো বাগানে বছর দেড়েক আগেও একটা সরিখাস ল্যাংড়া আমের গাছ ছিল। যেমন সুমধুর আম তাতে ফলতো, তেমনি বলিষ্ঠ আর ঝাঁকড়া ছিল তার রূপ। ছিটগ্রস্ত বাগানমালিকের এক দুপুরের খেয়ালে গাছটিকে সমূলে কেটে ফেলা হয়। আমরা সন্ধেবেলায় যে যার কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম জায়গাটা ফাঁকা। গাছটা যেন বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়েছে। ক’দিন পরে ঠিক ফিরে আসবে। সেই গাছটিতে নানাধরনের পাখি আসত। কাঠবেড়ালিরা খেলা করত সারাদিন। মাঝেমাঝে আসত একটা কোকিল। কোনও কোনও দিন দুপুরে এলেও বেশিরভাগ সময়ই আসত ভোর রাতে। তারপর একটানা ডাকত। আর সে-ডাক এতই জোরে এবং এমনই স্পষ্ট ছিল যে আমাদের গভীর ঘুম খানখান হয়ে ছড়িয়ে যেত গোটা বিছানায়। না, সেই কোকিলটিকে আমরা কেউই কোনওদিন দেখতে পাইনি। দেখতে পাইনি তার মায়াবি প্রেমিকাকেও। কিন্তু তার ডাক শুনে সেই আধো ঘুমের মধ্যেও মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট হত। যে কষ্টটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেবল প্রকাশ করা যায় কয়েক ফোঁটা অব্যক্ত চোখের জলে।
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, পড়াশুনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লেখালেখির শুরু নয়ের দশকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছোটগল্প, কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতার বইয়ের সংখ্যা দশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিরিশেরও বেশি বইয়ের। পেশায় চাকরিজীবী।