(Dhumketu)
চলচ্চিত্র: ধূমকেতু
মখ্য ভূমিকায়: দেব (দীপক) অধিকারী, শুভশ্রী গাঙ্গুলী, রুদ্রনীল ঘোষ, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, দুলাল লাহিড়ী, অলকানন্দা রায়, পরমব্রত চ্যাটার্জী প্রমুখ
পরিচালক: কৌশিক গাঙ্গুলী
প্রযোজক: রানা সরকার রাসা, দেব অধিকারী
সঙ্গীত পরিচালনা: অনুপম রায়
সিনেমাটোগ্রাফি: সৌমিক হালদার
এডিটর: শুভজিৎ সিংহ
সাউন্ড ডিজাইন: আদিপ সিং মানকি
সাউন্ড মিক্সিং: অনিন্দিত রায়
“তারা খসে পড়ে তবু, নীহারিকা প্রসবিনী হয়”, কারও চেনা এবং কারও অচেনা এই গানের লাইন। দুটি বিষয় এই লাইনের ভিতর চলেছে সমান্তরালে। এক, তারার খসে পড়া, দুই, নীহারিকার প্রসবিনী হওয়া। অর্থাৎ কোথাও তারার খসে পড়ার সঙ্গে নীহারিকার প্রসবিনী হওয়া সম্পর্কিত। একটি তারার মৃত্যু থেকে তৈরি হয় সম্ভাবনা। জন্ম নিতে পারে এক নতুন আলোকবর্ষ, সম্ভাবনা তৈরি হয় বহু। সেইসব সম্ভাবনার গল্পরা অন্তহীন, অসমাপ্ত। (Dhumketu)
তাই নীহারিকার প্রসবিনী হওয়ার সঙ্গে গভীর সংযোগ ওই খসে পড়া তারাদের। খসে পড়া তারা, যাকে বলা যেতে পারে Falling Stars কিংবা প্রকারান্তরে ধূমকেতু। এক অমিত সম্ভাবনা, যার অবসানের ভিতর লুকিয়ে থাকতে পারে। আদৌ কি অবসান হয়? (Dhumketu)
আরও পড়ুন: “ভালবাসা বৈধ না অবৈধ”
ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে কেটে যাবে দীর্ঘ সময়। যদি প্রেক্ষাগৃহের হিসেবে ঘড়ির কাঁটা মেলানো হয়, তাহলে মোট ১৩১ মিনিট। নানান অপেক্ষার পর অবশেষে ২০২৫-এর ১৪ অগাস্ট মুক্তি পেল চলচ্চিত্র ‘ধূমকেতু’, পরিচালনায় কৌশিক গাঙ্গুলী। দীপক অধিকারী, যিনি দেব নামে জনপ্রিয় তিনিই এ ছবির Protagonist. তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় এবং বলা চলে এটিই যৌথভাবে তাঁদের অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র, যদিও এরপর তাঁরা একত্রে কাজ করতেও পারেন। পপুলার বাংলা সিনেমা-ইন্ড্রাস্টিতে দেব-শুভশ্রীর জুটি নব্বইয়ের বলিউডে শাহরুখ-কাজল জুটিকে মনে করায় কারও কারও কাছে। সেই যূথবদ্ধতার কাহিনি দেখতে মাল্টিপ্লেক্সেও ভিড় নেহাত কম হয়নি এবং বহু সিঙ্গল স্ক্রিন হলে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ হয়েছে অনেকদিন পর। কিন্তু এইসবের মাঝে ঠিক কীসের জন্ম দিল এক খসে পড়া তারা? (Dhumketu)

কেউ কেউ বলেন পরিচালক অভিনেতাকে নির্মাণ করেন বা উলটোদিকে একজন অভিনেতা তাঁর সেরা কাজ তৈরি করতে পারেন পরিচালকের তত্ত্বাবধানে। এই সিনেমায় দেব যে অভিনয়টি উপহার দিয়েছেন তা অন্তত এ পর্যন্ত তাঁর শ্রেষ্ঠ অভিনয় বলা চলে। যে উচ্চারণের জন্য বারবার তিনি সমালোচনার পাত্র হয়ে দাঁড়ান, সেই তিনিই কী পরিশীলিত এবং যথাযথ উচ্চারণ করেছেন! চরিত্রে তাঁর জন্য নির্ধারিত সময়টুকুকে যতটা ব্যবহার করা যায় ঠিক ততটাই ব্যবহার করেছেন দেব। আর চরিত্রটির উচ্চারণ ভঙ্গিমাগুলি, যেন তাঁর কথা মাথায় রেখেই তৈরি করেছিলেন কৌশিক। কেবল উচ্চারণ নয়, নিজের প্রতিটি অনুভূতি, যন্ত্রণা, আবেগের মুহূর্তগুলি প্রায় নিখুঁত ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন দেব। কোথায় থামা উচিত, কতটা করবেন এবং কতটা করবেন না, তার অদ্ভুত সংমিশ্রণ ধরা পড়েছে ভানু সিংহ ওরফে দেব অভিনীত চরিত্রটির মধ্যে। (Dhumketu)
“স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সমস্ত আকর্ষণ নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন দুলাল লাহিড়ী ও অলকানন্দা রায়। দুই সন্তানহারা বাবা-মা, নিজেদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় এবং ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারে না সন্তানস্মৃতি।”
দ্বিতীয়ত শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। শেষ কবে তাঁর এমন পরিশীলিত অভিনয় দেখেছি মনে পড়ছে না। কী পরিমাণ নিজেকে পরিমার্জন করেছেন শুভশ্রী! এই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে ফুটে ওঠে রূপসা ওরফে শুভশ্রীর পরিশ্রম। এখানেও বোধহয় পরিচালকের ভূমিকা উপেক্ষা করা যাবে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুভশ্রীর মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিয়েছে অনেক কথা। সেখানে তাঁকে অতিরিক্ত কিছু করতে হয়নি। যেটুকু উচ্চারণ বা কথার প্রসঙ্গ এসেছে, তাও চরিত্রপযোগী। (Dhumketu)

স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সমস্ত আকর্ষণ নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন দুলাল লাহিড়ী ও অলকানন্দা রায়। দুই সন্তানহারা বাবা-মা, নিজেদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় এবং ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারে না সন্তানস্মৃতি। তাঁদের প্রতি পদক্ষেপে সেই অদ্ভুত অব্যক্ত যন্ত্রণার নানান ছবি ধরা পড়ে। ভবিতব্যকে মেনে নিয়েই নিজেদের পুত্রবধূর পুনরায় বিয়ের বন্দোবস্ত করে নেওয়ার ভিতর থাকা চাপা কান্নাকে, এমন নিখুঁত ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ কাজ ছিল না। বর্ষীয়ান এই দুই অভিনেতা-অভিনেত্রী সেখানে বহু মুগ্ধতা এনেছেন। স্বল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী কিন্তু কোথায় যেন অনেক অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ভানু কীভাবে মিলিট্যান্ট হয়ে উঠল, কোন আদর্শের সামনে নিয়ে গেল তাকে চিফ ওরফে চিরঞ্জিৎ, তা ধোঁয়াশাতেই রয়ে গেল। (Dhumketu)
“এই চলচ্চিত্রে দেব পরিচিত হিরো নয়, বরং অ্যান্টিহিরো। যে হিরোইক ইমেজ দেব তৈরি করেন প্রতি চলচ্চিত্রে, এখানে সচেতনভাবে সেই ইমেজকে ভাঙতে হয়েছে।”
এই চলচ্চিত্র ঠিক যতটা ভানুর, ততটা যোগেশের। রুদ্রনীল ঘোষ ওরফে যোগেশ এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে দেননি। যতটা সময় ছিলেন, সমানভাবে নিজের দিকে সমস্ত আকর্ষণ টেনে রেখেছিলেন। সম্ভবত এমন ভার্সাটাইল অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কমই এসেছে। দুই বন্ধুর নিরবিচ্ছিন্ন জার্নি, সমস্ত বুঝতে পেরেও এক মিলিট্যান্ট বন্ধুকে নিজের ঘরে আশ্রয় দেওয়া, ইন্দ্রনাথ খাসনবীশের মুখোশ পরে ভানুর দ্বৈতসত্তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি ফেলা এবং শেষপর্যন্ত তাঁকে দেশদ্রোহী বলে নিজের চোখের জল ফেলা; প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের অভিব্যক্তি দিয়ে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রুদ্রনীল তা অবিশ্বাস্য। প্রয়োজনে যেমন কমিক রিলিফ দরকার, তেমনটাও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেছে। (Dhumketu)

চলচ্চিত্রে বিশেষ গুরুত্বের জায়গায় থাকে সঙ্গীত, আলো এবং কিছু দৃশ্য। এই প্রসঙ্গে সঙ্গীতের জায়গাটি তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়েছে। সঙ্গীত পরিচালনা বা সুর নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই কিন্তু যে খাতে সিনেমার কাহিনি বা গতি এগিয়েছে তাতে সঙ্গীতের বারংবার প্রয়োগ অতিরিক্ত বলেই মনে হয়েছে। আলোর ব্যবহারে ‘ধূমকেতু’ রীতিমতো নজর কেড়েছে। বহু দৃশ্য রয়েছে যা স্বল্প আলোতে বা প্রায় অন্ধকারে। কিন্তু সেই আলোর ব্যবহারে চরিত্রদের চাহনি, মুখের বিভিন্ন এক্সপ্রেশন, রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা সমস্তকিছু এক অদ্ভুত নীরবতা এনেছে। দর্শকদের দেখার ধরনকে এই আলোর ব্যবহার পরিবর্তন করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। শুধু তাই নয়, আলোর বিভিন্ন কৌণিক প্রয়োগে তৈরি হয়েছে অপূর্ব কিছু দৃশ্য, একইসঙ্গে দৃশ্যকল্পও বটে। যেমন মুখোমুখি ভানু এবং যোগেশের কিছু দৃশ্য কিংবা অনিন্দ্য এবং ভানুর মুখোমুখি কিছু দৃশ্য। (Dhumketu)
“বারবার যেভাবে ফিরে ফিরে আসে কিছু মৃত তারা, এই কাহিনিও সেই মৃত্যুর ভিতর থেকে পুনর্জন্মের এক অমিত সম্ভাবনা সূত্র ছেড়ে রেখে যায়।”
দেব ও শুভশ্রীর একত্রে তৈরি হওয়া কিছু ফ্রেম দর্শক মনে রেখে দেবে অনেকদিন। তেমনই মনে রেখে দেবে শুভশ্রী ও পরমব্রতের কিছু ফ্রেমও। অনিন্দ্যরূপী পরমব্রত-র উপস্থিতি এই চলচ্চিত্রে খুবই সামান্য কিন্তু তার ভিতরেও রয়ে গেছে বহু মায়াবী আখ্যান। আদতে ‘ধূমকেতু’ এক তারার মৃত্যু নয়, বরং অসংখ্য ভাবনার জন্ম। সেই ভাবনারাশির ভিতর কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া দর্শকদের মনে, তার উত্তর খোঁজার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ দর্শকের। (Dhumketu)
এই চলচ্চিত্রে দেব পরিচিত হিরো নয়, বরং অ্যান্টিহিরো। যে হিরোইক ইমেজ দেব তৈরি করেন প্রতি চলচ্চিত্রে, এখানে সচেতনভাবে সেই ইমেজকে ভাঙতে হয়েছে। তেমনই শুভশ্রী এই চলচ্চিত্রে কেবল নায়িকা নন, তাঁর চরিত্রে রয়েছে একাধিক উত্থানপতন। প্রথম প্রেমজীবন, তারপর বিয়ে, স্বামীর পালিয়ে যাওয়া। আবার নতুন বিবাহের ভাবনা এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ। কেবল দেব বা শুভশ্রী নন, এই সিনেমার কাহিনি বা প্রতিটি চরিত্রই এই অসংখ্য দ্বন্দ্ব এবং একাধিক স্তরের সমন্বয়ে তৈরি। বারবার সেই স্তরগুলি দর্শকদের ভাবাবে, অস্থির করবে। (Dhumketu)

আতঙ্কবাদী কারা, তাদের চোখে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, আদর্শের প্রতি চিরকাল সৎ থাকার মূল্যবোধ ঠিক কতটা মনের গভীরে কার্যকরী হতে পারে, নিজের পরিবার আগে, না দেশ আগে, পরিবারের উপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি পথে কিছু করা কি আদৌ সম্ভব, আইন কাদের জন্য, মৃত্যুর ঠিক আগে মানুষের ভিতর পিছুটান কতটা কার্যকর হতে পারে, কোন সত্তাকে আপনি সমর্থন করবেন, মুখ আর মুখোশের মাঝের সমীকরণটি কেমন হতে পারে, ফিরতে চেয়েও ফিরতে না পারার অস্থিরতা ঠিক কতটা, নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি যদি ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে ওঠে তাকে ভালোবাসতে পারবেন, অতীতের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে নাকি ভবিষ্যৎ আমাদের প্রতিমুহূর্তে নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করবে— এমন অসংখ্য সূক্ষ্ম, দৃঢ় প্রশ্ন তৈরি হল একটি চলচ্চিত্র থেকে। (Dhumketu)
আরও পড়ুন: স্বপ্নের চারাগাছে জল দেওয়ার গল্প ‘অঙ্ক কি কঠিন’
এর কাহিনি চির পরিচিত সেই দুইয়ে দুইয়ে চার নয়, বরং এক অনির্দেশ্য পথের উপর দর্শকদের ছেড়ে দেওয়া। রাস্তা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাঁদের। বারবার যেভাবে ফিরে ফিরে আসে কিছু মৃত তারা, এই কাহিনিও সেই মৃত্যুর ভিতর থেকে পুনর্জন্মের এক অমিত সম্ভাবনা সূত্র ছেড়ে রেখে যায়। (Dhumketu)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।