ড্রাকুলার এই সব নারকীয় অত্যাচার এক লেখককে দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল। অষ্টাদশ শতকের সেই লেখকের নাম মার্কুই দি সাঁদ। যার বিচিত্র সব যৌনতা আর অত্যাচারের পদ্ধতি থেকে ‘স্যাডিস্ট’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। সাঁদ-র ডায়রিতে পাই, তিনি ড্রাকুলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
তবে হ্যাঁ, ড্রাকুলা অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেবার আগে তাঁর স্বীকারোক্তি শুনতেন। যদি সেই স্বীকারোক্তি তাঁর মনে ধরত, তবে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে তিনি শুধু ছেড়েই দিতেন না, তাঁকে পুরস্কৃতও করতেন। ঠিক যেমনটা সেই পোলিশ সাধুকে করেছিলেন। টারগোভিস্টে শহরের ঠিক নীচেই বেশ কয়েকটা বড় বড় হ্রদ আছে। মাঝে মাঝেই ড্রাকুলা সদলবলে সেখানে গিয়ে মাছ ধরতেন বা মহিলাদের সঙ্গে যৌনক্রীড়ায় মত্ত হতেন।
এমনই একটি দিনে দূত এসে ড্রাকুলাকে জানাল, ভ্যাটিকান থেকে খবর এসেছে। নতুন পোপ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন দ্বিতীয় পায়াস। কে জানে, খবর পেয়ে ড্রাকুলা ঠিক কী ভেবেছিলেন, কিন্তু এই ঘটনা ড্রাকুলার জীবনের খোলনলচে বদলে দিতে চলেছিল।
এনিয়া সিলভিও বারথলোমিও পিকলোমিনি ছিলেন এক সৈনিকের ছেলে। আঠেরো বছর বয়েসেই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য সিয়ানা আর ফ্লোরেন্সে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেন। অসাধারণ মেধাবী পিকলোমিনি বিভিন্ন বিশপের সচিব হিসেবে কাজ করতে থাকেন। স্বয়ং পোপ তাঁর কাজে খুশি হয়ে তাঁকে নানা বৈদেশিক আলাপ আলোচনায় পাঠাতেন, আর প্রায় প্রতিটাতেই তিনি সফল হয়ে ফিরতেন।
ব্যাক্তিগত জীবনেও পিকলোমিনি হার মানতে জানতেন না। যেটা প্রয়োজন, আদায় করে ছাড়তেন। এভাবেই ধীরে ধীরে পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাসের ডান হাত হয়ে উঠলেন তিনি। ১৪৫৮ সালের ৬ আগস্ট পোপের মৃত্যু হল। ১৯ আগস্ট পেপাল কনক্লেভের বিচারে নতুন পোপ হলেন পিকলোমিনি। নাম নিলেন দ্বিতীয় পায়াস।

অভিষেকের পরেই পোপের (এখন থেকে পিকলোমিনিকে আমরা পোপ হিসেবেই ডাকব) নজর পড়ল কনস্টানটিনোপলের দিকে। সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ তখন দখল করে রেখেছেন সেই শহর। পোপ বুঝলেন সুলতানের আগ্রাসী মনোভাব শুধু এখানেই থামবে না। তিনি দখল করবেন গোটা ইউরোপ। আর তাতে খ্রিস্টধর্ম আদৌ বাঁচবে কিনা সন্দেহ।
কিন্তু ইউরোপে তখন মাৎস্যন্যায় চলছে। রাজারা একে অপরের সঙ্গে লড়াইতে মত্ত। ১৪৫৯ সালে মানতুয়ার অধিবেশনে পোপ ইউরোপের গোটা খ্রিস্টান সমাজকে এক হওয়ার ডাক দিলেন। শুধু তাই নয়, বললেন, “ প্রতি ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানকে হাতে তুলে নিতে হবে ক্রুশ আর যোগ দিতে হবে খ্রিস্টধর্ম বাঁচানোর যুদ্ধ ক্রুসেডে।” এককথায়, প্রায় মরে যাওয়া ক্রুসেডকে আবার চাঙ্গা করে তুললেন পোপ। সঙ্গে আদেশ দিলেন যুদ্ধের খরচ হিসেবে প্রতি রাজা ও সামন্তকে ১০০,০০০ সোনার ডুকাট জমা করতে হবে। যেখান থেকেই হোক। গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত ইউরোপ এবার বাইরের শ্ত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাতে লাগল।
ড্রাকুলা তখন কী করছিলেন? ১৪৫৬-তে হুনিয়াদির মৃত্যুর পর হাঙ্গেরির সিংহাসন নিয়ে লড়াই বাধে। একদিকে হুনিয়াদির পরিবার, অন্যদিকে জার্মান হাপসবার্গরা। খুব স্বাভাবিকভাবেই ড্রাকুলা হুনিয়াদিদের পক্ষ নেন। ট্রানসিলভানিয়ার জার্মানরা হাপসবার্গের দলে ছিল, তাই তাঁদের সমর্থনের প্রশ্নই নেই। প্রথমে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হুনিয়াদির বড় ছেলে ল্যাডিসলাস।

তিনি নিহত হলে ছোট ছেলে ম্যাথিয়াস আর হুনিয়াদির শ্যালক মাইকেল যুদ্ধ চালাতে থাকেন। তখনকার পোপ নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে ট্রানসিলভানিয়ার এই গোলমালে ঢুকতে চাননি। ড্রাকুলা এই সুযোগে নিজে ক্ষমতা বাড়াতে থাকেন। যে সিবিউ শহর এককালে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল, জার্মান অধ্যুষিত সেই শহরে আক্রমণ করে রাতারাতি তাঁকে প্রায় ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন ড্রাকুলা। খুন আর নারীধর্ষণের সীমা রইল না।
১৪৫৮ -তে ম্যাথিয়াস হাঙ্গেরির সিংহাসনে বসলেন। ড্রাকুলা ভাবলেন যেহেতু তাঁর সাহায্য ছাড়া ম্যাথিয়াস রাজা হতেন না, তাই তিনি যা বলবেন ম্যাথিয়াস তা শুনতে বাধ্য। ১৪৫৯ সালে যখন পোপ ক্রুসেডের আহ্বান জানালেন, তখন পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডরিখ, বোহেমিয়ার রাজা জর্জ, পোল্যান্ডের রাজা ক্যাসিমির, মস্কোর তৃতীয় ইভান-সহ সবাই শুকনো সমর্থন করলেও একজনও এগিয়ে এলেন না। কেউই তখন শক্তিশালী তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাইছিলেন না।

ড্রাকুলা সবার আগে এই আহ্বানে সাড়া দিলেন। তিনি বুঝেছিলেন তুর্কি সুলতানের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবার এই একমাত্র উপায়। তিনি ম্যাথিয়াসকে বললেন তাঁর সঙ্গে যোগ দেবার জন্য। ম্যাথিয়াস এত কষ্ট করে সবে রাজা হয়েছেন। তিনিই বা এমন ঝামেলায় জড়াবেন কেন? একথা ওকথা বলে তিনি মূল যে কথা বললেন, তা হল তিনি যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত। এখন নতুন করে যুদ্ধ, তাও তুর্কিদের বিরুদ্ধে করার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই তাঁর নেই। ড্রাকুলাও এসব বদ চিন্তা ছাড়ুন।
রাগে জ্বলে উঠলেন ড্রাকুলা। তবু কিছু করার নেই। ভিতরে ভিতরে সুযোগ খুঁজছিলেন আগুনটাকে উসকে দেবার। সুযোগ এসে গেল। অবধ্য দূতের মাথায় পেরেক ঠূকে সরাসরি তুর্কি সুলতান মহম্মদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলেন ড্রাকুলা। আর মহম্মদ চুপ করে এই অপমান মেনে নেবেন, এমন বান্দা তিনি ছিলেন না। ১৪৬২ সালের বসন্তে মহম্মদ সরাসরি ওয়ালাচিয়া আক্রমণ করলেন। ড্রাকুলা ম্যাথিয়াসের সাহায্য চাইলেন। পেলেন না। এদিকে লাখে লাখে তুর্কি সৈন্য বসফরাস প্রণালী পেরিয়ে দানিয়ুব হয়ে ওয়ালাচিয়ায় ঢুকে গেছে।
বিপদ দেখে ড্রাকুলা ক্রমাগত উত্তরে সরতে লাগলেন। উত্তরের পাহাড়ের সরু পাকদণ্ডী তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, সেখানে একবার তুর্কি সৈন্যদের ঢোকাতে পারলে পিঁপড়ের মতো পিষে মারা যাবে। উত্তরে যাবার পথে আশেপাশের সব শস্যখেত, জমি, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিলেন ড্রাকুলা, যাতে শত্রুরা বিন্দুমাত্র সুবিধা না পায়। জলে মিশিয়ে দিয়েছিলেন বিষ। এরপর শুরু হল তাঁর গেরিলা আক্রমণ।

রাতের অন্ধকারে আচমকা আঘাত নেমে আসত তুর্কি সেনাদের উপরে। একে খাদ্য নেই, জল নেই, এদিকে এমন আক্রমণে তুর্কি সেনারা প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেল। অবশেষে ১৪৬২-র ১৭ জুন অন্তিম আঘাত নেমে এল। “আতঙ্কের রাত” নামে খ্যাত সেই গেরিলা যুদ্ধে আধা ঘুমন্ত তুর্কি সৈন্যদের ড্রাকুলা কচুকাটা করলেন। সুলতান মহম্মদের তাঁবু অবধি পৌঁছে গেছিলেন। তিনি কোনওমতে পালিয়ে বাঁচলেন। তবে ড্রাকুলাও বুঝলেন তাঁকে উত্তরেই ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে।
ড্রাকুলা উত্তরে বসে রইলেন আর তুর্কিরা দক্ষিণে ওয়ালাচিয়ার প্রাসাদ দখল করে রইল। ড্রাকুলার মতো মানুষের পক্ষে এ হারেরই সামিল। তিনি আবার ম্যাথিয়াসকে বললেন সৈন্য দিতে, আবার ম্যাথিয়াস উৎসাহ দেখালেন না। হতাশ ড্রাকুলা ছোট ভাই রাদুকে নিয়ে ওয়ালাচিয়া উদ্ধারে রওনা হলেন। ৫ ডিসেম্বর গোটা দল পৌঁছল পাহাড়ের উপরের কেল্লা কোনিগস্টাইনে। এখান থেকে নীচে উপত্যকায় নামার সবচেয়ে ভাল উপায় দড়ি আর পুলি। গাড়ি ঘোড়া, সৈন্যসামন্ত সমেত সবাইকে যখন উপত্যকায় নামানো হল, আচমকা কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল এক দল তুর্কি সেনা।

ড্রাকুলা কিছু বোঝার আগেই তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়ে গেলেন। এরপর ড্রাকুলার জীবন শুধু অবনমনের। ম্যাথিয়াস তুর্কির সুলতানের সঙ্গে সন্ধিপ্রস্তাবে সই করলেন, ছোট ভাই রাদু দল বদলে সুলতানের কাছে মাথা বিকিয়ে দিল। সুলতান তাঁকেই ওয়ালাচিয়ার রাজা বানিয়ে দিলেন। ১৪৬২ থেকে ১৪৭৪ অবধি ড্রাকুলা শুধু এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছিলেন। এর বেশি কিচ্ছুটি জানা যায় না। শোনা যায় কারাগারে থাকার সময়ও তাঁর স্বভাব বদলায়নি। তিনি ইঁদুর ধরতেন, আর তাঁদের মাথা ছিঁড়ে নিয়ে রক্তপান করতেন। ড্রাকুলার রক্তপানের গল্প সম্ভবত এখান থেকেই শুরু।
১৪৭৪ সালে ড্রাকুলার জীবনে আবার পরিবর্তন এল। শোনা যায় ম্যাথিয়াস তাঁকে দুটো পথের একটা বেছে নিতে বলেন। ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করা, অথবা জেলে পচে মরা। ড্রাকুলা নাকি কারাগারের জীবন আর সহ্য না করতে পেরে শেষ জীবনে ধর্মান্তরিত হন। শুধু তাই না, তাঁর সঙ্গে হাঙ্গেরির রাজপরিবারের এক কন্যার বিয়ে হয়। সেই বিয়েতে দুই সন্তান হয়েছিল, যাদের কেউ বেশিদিন বাঁচেনি।
এসব কাহিনির সত্যাসত্য বিচার করা মুশকিল। ১৪৭৬ সালের ডিসেম্বরে ড্রাকুলা মারা যান। হতেই পারে যে আদর্শ নিয়ে তাঁর সারা জীবনের লড়াই, তাতে কালি মাখাতেই এসব রটনা হয়েছিল। শুধুমাত্র কারাগারের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বারো বছর সহ্য করা মানুষ আচমকা ধর্ম বদলাবেন, শুনলেও কেমন কেমন লাগে। আবার হয়তো সত্যি হতেও পারে! হয়তো ড্রাকুলা সুযোগ খুঁজছিলেন। আপাত ধর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে যদি সত্যি ছাড়া পাওয়া যায় তাহলে আবার শক্তি সংগ্রহ করা যাবে। জীবন তাঁকে আর সেই সুযোগ দিল না।
*ছবি সৌজন্য: wikipedia, military.com, pinterest, dailynewshungary
*আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩] [পর্ব ৪], [পর্ব ৫]
তথ্যঋণ:
১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্যান্ড ভ্যামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্যাম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্যামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।