বীরভুমের সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী দুর্গাপুজোর কথায় সর্বপ্রথম মনে আসে সুরুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা (Durga Puja at Surul Rajbari)। জেলার অন্যতম সেরা শারদোৎসব বললেও অত্যুক্তি হয়না। রাজবাড়ির সামনের মহলটাই দুর্গামন্দির। সাবেকি আমলের রাজবাড়ির নাটমন্দিরগুলো যেমন — সেই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। মন্দিরের স্তম্ভগুলোর বিশাল বপু। বট-অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির মতো গড়ন। এরকম ১৬টা থামের উপরে দালান কোঠার ছাদটা মানানসই উঁচু। সেই দালানে ওঠার জন্যে বরাবর চওড়া সোপান রয়েছে।
দুর্গামন্দিরের গর্ভগৃহে বছরভর কাঠামোতে জড়ানো খড়ের প্রতিমা দেখা যায়। এই বাঁশ-কাঠের কাঠামো হচ্ছে নিরঞ্জনের পরে জল থেকে তুলে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই অবস্থাতে নিত্যপূজ্যও। প্রতি বছর রথযাত্রার দিন ওই কাঠামোতে পুরানো বিচালি ফেলে দিয়ে নড়বড়ে অবয়ব সযত্নে মেরামতি করে আসন্ন শারদীয় দুর্গামাতার মৃণ্ময় মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়।

পুজোর ক’দিনের পরিবেশটাই অন্যরকম। আটপৌরে রাজবাড়ির আদলটা বদলে যায়। বাইরে মেলা বসে। ফুচকা, পাপড়ি চাট, ঘুগনি, আলু কাবলি থেকে হরেক ফাস্ট ফুড। ছোটদের খেলনা থেকে মেয়েদের সাজের জিনিসের দোকান। তার সঙ্গে নাগরদোলা ও অন্যান্য রাইডের সমাহার। পুরোহিতরা যখন পূজারতি করেন, তখন রঙিন বিশালাকায় নকশা করা তালপাতার হাত পাখায় বাতাস দেওয়ার রীতি। তারপরে চামর দুলিয়ে আরতি। পঞ্চপ্রদীপ-ধুনুচি ক্ষণবদলে হাতে আসে আরতিরত পুরোহিতের। নানান আঙ্গিকে পুজো ও আরতি, পুষ্পাঞ্জলি বা সন্ধি পুজোর পর্ব চলে মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমীর দিন পর্যন্ত। পরিবারের নারীরাও সঙ্গত করেন সেবাইতদের সঙ্গে।
মহানবমীর রাত আটটার সময়ে ঢোল-সানাইয়ের তালে নাচে ছোটরা। পরে মহিলাদের নৃত্য। সেই সঙ্গে অপর প্রান্তে পুরুষদের সম্মিলিত নৃত্যে মুখর হয় পুজোমণ্ডপ। কেউবা ধুনুচি নৃত্যে আলাদাভাবে নজর কাড়েন। এলাকার টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হয়। ক্যুইজ প্রতিযোগিতা হয়। বাছাই করা হয় সেরা দুজন শারদসুন্দরী। চলে পুরষ্কার প্রদান পর্ব। এসব মিটে গেলে শুরু হয় যাত্রাপালা। রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটা বেজে যায় যাত্রানুষ্ঠান শুরু করতে। নবমীতে যাত্রাপালার তৃতীয় তথা শেষ রজনী।

দশমীর দিন বেলার দিকে বেলপাতার মধ্যে খাগের কলমে ‘শ্রীশ্রীঁদুর্গামাতা সহায়’ লিখে এক টাকার মুদ্রা সমেত মুড়ে ওই পাতা পুরোহিতের হাতে দেওয়ার চল। এতে প্রচুর মানুষের উৎসাহের কারণে নারী-পুরুষের আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় খানিক। পুরুত ঠাকুরেরা দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে সেই মুদ্রা ফেরত দিলে মাঙ্গলিক বস্তু হিসেবে সেটা ঘরে রেখে দেওয়া রীতি। লতা সহ অপরাজিতা ফুলগাছের পাতা পুজো দিয়ে বিতরণ করা হয়ে থাকে। ওই লতা-পাতা কব্জিতে বাঁধা শুভ। তারপরেই শান্তি-জল ছিটিয়ে দেওয়া ও তা মাথা নত করে শরীরে ধারণ করা। এই অনুষ্ঠানের নামও ‘যাত্রা’। শুরু হয় দশমীর দিন বেলা দশটা নাগাদ।
দুর্গোৎসবের অবসান ভাসানে। ভাসানের শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয় বিকেল ৫টা নাগাদ। ডজন খানেক ঢাকির একটা দল থাকেই। সঙ্গে ময়ূর আর অন্যান্য পাখির পালকে সাজানো মাদল ও নানান বাদ্যযন্ত্র। তারা জমিদার বাড়ির শরিকদের প্রত্যেকের বাড়ির সদরে ও অন্দরে নেচে নেচে বাজিয়ে চলে। অভূতপূর্ব সেই নৃত্যবাদ্যের স্বতন্ত্র মথিত পরিমণ্ডল আর অদ্ভুত সৌরভ মণ্ডিত এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রতিটা বাড়ি থেকেই অর্থ ও বস্ত্রদান করা হয়। সন্ধে আটটা নাগাদ বেদি নামানোর তোড়জোড়ের পালা দুর্গামূর্তির। একে একে খুলে নেওয়া হয় দেবীর অলঙ্কার। কূলবধূদের বরণপর্ব, প্রণাম, সিঁদুরখেলা চলে। পুরুষদের আলিঙ্গন পর্ব। সতর্কতার সঙ্গে মূল ফটকটা পেরিয়েই দুর্গামূর্তি তোলা হয় ভাসানের গাড়িতে।

সবার ডাক পড়ে ভোগমণ্ডপে। বোঁদে, মিহিদানা, নারকোল নাড়ু আর লাড্ডু সহযোগে খাঁটি সুগন্ধী গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সিদ্ধির লুচি। আহ্ অমৃত! স্থানীয় ময়রার তৈরি সুস্বাদু ভোগ। মশাল জ্বালিয়ে ভাসানের শোভাযাত্রার আগে প্রতিমাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হয়। রাত সাড়ে দশটা বেজে যায় কখন! হাজার খানেক দর্শনার্থীর সমাবেশ। তার অর্ধেকের বেশিই চলতে থাকেন বিসর্জনের বাজনার তালে তাল মিলিয়ে।
মশালের আলো, আতসবাজির ঝিলিক, বাজনার মাদকতা আর সিদ্ধির মদিরতায় ঘোর লেগে যায়। দুর্গামূর্তি নিয়ে সুরুল পরিক্রমা করে চলে আসা হয় কালীসায়রের তীরে। এর বিপরীতেই কালীমন্দির। কীর্তনের খোল-করতাল বেজে ওঠে। নৃত্য-মুখর এলাকা। সমস্ত বাজির মজুদ শেষ করার পালা যেন এবার। আলোর রোশনাই আর ঝলকানিতে আর বারুদের ধোঁয়ায় অতিপ্রাকৃত পরিবেশ গড়ে ওঠে। বিশাল জনসমাগমে চরাচর মুখর। সুযোগ বুঝে ব্যবসা করতে কিছু দোকান বসে পসরা সাজিয়ে। এখানে এলাকার সব প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। তাই সন্ধের পর থেকেই মানুষ ভিড় করেন। কীর্তনগান আর বিসর্জনের বাজনার মাদকতার তুঙ্গে উঠে কোমর সমান জলে নেমে তিন বার ঘুরিয়ে উপরের দিকে প্রতিমার মুখ রেখে পিছন পানে নিরঞ্জিত দেবী চোখে আড়ালে চলে যান। ‘আসছে বছর আবার হবে’ — ধ্বনির মধ্যেই শান্তি-জল ছিটিয়ে বিসর্জন পর্বের সমাধান। পরদিনই বিসর্জিত মূর্তি ভক্তিভরে তুলে এনে প্রথামত রাখা হয় বছরভর ওই একই বেদিতে। তার পরের কথা আগেই জানিয়েছি।

এই মন্দিরের একটু ভিতরের দিকে খানিকটা তফাতে রয়েছে নারায়ণ মন্দির। সেই দেবতারও নিত্যপুজো হয়ে থাকে। এই দেবতার উৎসব হয় জন্মাষ্টমী তিথিতে। এই তিথিতেই শারদোৎসব পুজো কমিটি কিছু অগ্রিম অর্থ ধরিয়ে বায়না করে যাত্রাপালার। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী আর মহানবমীর রাতে যাত্রাপালার আসর বসে।
একটা কথা আগেই বলা দরকার ছিল। তা হল, সুরুল রাজবাড়ি তথা জমিদার বাড়িটা দুই ভাগে বিভক্ত। এত সব যা জানানো হল, তা বড়র বাড়ির ব্যাপার স্যাপার। এর পাশে রয়েছে ছোটর বাড়ির ঘর-দালান ও মন্দির। এই বড় আর ছোটর বাড়ি স্থানীয় লোকমুখে প্রচারিত। আদতে জমিদার বংশের দুই সমান্তরাল উত্তরাধিকারীর সম্পত্তি। এক সময় ভীষণ রেষারেষির কথা শোনা গেলেও এখন তা স্তিমিত। ছোটর বাড়ির কথায় পরের দিকে আসছি। দুই ভাইয়ের দুই বাড়ির পুজো মিলিয়েই সুরুলের রাজবাড়ির তথা বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো।

এই জমিদার বংশের প্রধান পুরুষ ভরতচন্দ্র সরকার। এঁদের আদি বাসস্থান অখণ্ড বর্ধমান জেলায়। বাঁকা নালার তীরে নীলপুর গ্রামে। তখন অষ্টদশ শতাব্দী। সরকার এঁদের উপাধি— আদি পদবী ঘোষ। জাতিতে কোঙার সদগোপ। সুরুলে আসার কারণ হল, তাঁদের পারিবারিক গুরুদেব ছিলেন সুরুল নিবাসী বাসুদেব ভট্টাচার্য । শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দরের কৃপালাভে ভরতচন্দ্রের বংশরক্ষা হয়েছিল। তারপরেই সুরুলে গুরুকুলধামে পাকাপাকি ভাবে বসবাস। পুত্রর নাম কৃষ্ণহরি। কৃষ্ণহরি সরকার (ঘোষ)-এর তিন পুত্র— যাদবেন্দ্র, মাধবেন্দ্র আর কালীচরণ। এই যাদবেন্দ্রর প্রজন্মের আর মাধবেন্দ্রের প্রজন্মের মধ্যেই বড়র আর ছোটর বাড়ির ভেদাভেদ। কেননা, কালীচরণের বংশধরেরা কেউ নেই ষষ্ঠপুরুষের পরে। থাকলে মেজোর প্রজন্মের ধারা ‘ছোটর’ বলে পরিগণিত হত না। বড়র প্রজন্মের হরিমোহন সরকর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম‘-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বড়র বংশের মনমোহন সরকারের উদ্যোগের ফসল – বোলপুর (বাঁধগড়া) হাইস্কুল। বড়র বাড়িতে একটা শিবমন্দির রয়েছে। বড়র উত্তরসুরীরা যেখানে বসবাস করেন সেখানেই শিবালয়। ভেতরে প্রচুর বসতবাটি। মনে হবে যেন একটা ছোটখাট পাড়া। কিছু বাড়ি বন্ধ থাকে সারা বছর। তবে পুজোর সময়ে ভরে ওঠে।
ইংরেজ আর ফরাসি কুঠিয়ালদের সঙ্গে সমান্তরাল ব্যবসা চালিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন কৃষ্ণহরির পুত্রত্রয়ী। তবে যাদবেন্দ্রের পুত্র ব্রজবল্লভের পাঁচ পুত্রের মধ্যে খ্যাতিমান ছিলেন শ্রীনিবাস সরকার। তাঁর আমলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা আর দুর্গামণ্ডপের স্থাপনা। পূর্ববর্ণিত মনমোহন এঁদের-ই। তবে ধারণা করা হয় দুর্গাপুজোর সূচনা কৃষ্ণহরির আমলে অষ্টদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। পঞ্চরত্ন মন্দির স্থাপনা আর শ্রীশ্রীলক্ষ্মীজনার্দনের মূর্তির প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। শ্রীনিবাস আর রামনিবাস সরকারের প্রচেষ্টায় জমিদারী সম্প্রসারিত হয়েছিল বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের দিকে। নীলচাষের পাশাপাশি চাল, চিনি, বস্ত্র ব্যবসায়ে এদের প্রতিষ্ঠার শীর্ষে আরোহণ। ১৯৩৩ (বঙ্গাব্দের ১২৪০) সালে শ্রীনিবাসের ইহলোক ত্যাগের পরে অবতরণের শুরু। একদা ২৩০০০ বিঘে জমির মধ্যে ২০০০ বিঘে অবশিষ্ট। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে যেত এদের বাণিজ্যপোত। বিস্ময়করভাবে সুরুলের গায়ে লাগেনি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ছোবল। যখন বীরভূমের এক চতুর্থাংশ গ্রাম আর এক তৃতীয়াংশ মানুষ রেহাই পাননি দুর্ভিক্ষে।

ছোটর বাড়ির স্বতন্ত্র দুর্গাপুজোর সূচনা দেবন্দ্রনাথ সরকারের সময় থেকে। বড়র বাড়ি ঢুকতে বামপাশে অনতিদূরে ছোটর পরম্পরা। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন বর্ধমানের নামজাদা উকিল। ছোটর বাড়ির পরবর্তীকালের একজন বর্তমান দুর্গামন্দিরটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিও ওকালতিতে নাম করেছিলেন। একদা বর্ধমান পৌরসভার সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর আরও খ্যাতি ‘রয়্যাল বেঙ্গল ক্লাব’-র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তাঁর নাম প্রণবেশ্বর সরকার। তবে ছোট ও বড়র বাড়ির মধ্যে এখন রেষারেষি না থাকলেও বড়র আর ছোটর পুজোর আড়ম্বড়ের প্রভেদটা ধরা পড়ে আক্ষরিক অর্থে বড় আর ছোট-র নামের মতোই।
তবে ছোট-বড় যাইই হোক, সুরুলের রাজবাড়ির দুর্গা পুজোয় সামিল হওয়া মানে ঐতিহ্যশালী একটা দর্শন-পর্ব সমাধা করা। এমন সুযোগ খুব কম অতিথির ভাগ্যে ঘটে।
ছবি সৌজন্য: অভিনব সরকার
তথ্য সহায়তা : আগমনী রায় ও দেবাশিস রায় (বড়র বাড়ির কন্যা-জামাতা), বড়র বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের অচিন্ত্য সরকার, প্রয়াত লেখক দেবব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ।
প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখা প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে। আপাতত এক কুড়ি গ্রন্থের প্রণেতা। বাংলা গ্রন্থ জগতে ভ্রমণ, রেল, রেল-ভ্রমণ, রহস্য-ভ্রমণ ও অরণ্য-ভ্রমণের ওপরে নজর কেড়েছেন । প্রণীত করেছেন ভ্রমণ কাব্যগ্রন্থও।
2 Responses
বিস্তারিত বিবরণ। ভালো লাগল।
অপূর্ব!