Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

হারিয়ে যাওয়া বাগান

কৌশিক মজুমদার

জুলাই ১১, ২০২২

Eden Gardens - Kolkata
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

১৬২২ সালের জুন মাস। পারস্যের সম্রাট শা আব্বাস কান্দাহারের দুর্গ মুঘলদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেন। শাহজাহান তক্কে তক্কে ছিলেন। শা আব্বাসের এক মীরজাফর ছিল (কিংবা বিভীষণ)। তাঁর নাম শা আলি মরদান। শাহজাহান তাঁকে পটিয়ে পাটিয়ে বিনাযুদ্ধে আবার দুর্গের দখল নেন। এই শা আলি মরদান দারুন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সিভিল আর আর্কিটেকচার। এমন লোককে কাজে লাগাতেই হবে। সম্রাট তাই তাঁকে দিয়ে কাশ্মীর আর লাহোরে দু’খানি দারুণ বাগান বানালেন। শা আলি মারের নামে সেই দুই বাগানের নাম হল “শালিমার বাগ”। 

সে তো হল। কিন্তু আমাদের এই বাংলায় শা আলি এলেন কেমন করে? চলে আসি দুশো বছর পর। কলকাতায় ইংরেজরা করেকম্মে খাচ্চে, কর্নেল রবার্ট কিড নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচা করে বোটানিক্যাল গার্ডেনের উত্তরে এক বাগান বানালেন। সেখানে বউ আর আন্ডা-বাচ্চা নিয়ে গুষ্টিসুখ উপলব্ধি করবেন। তিনি নাকি এদেশে থেকে দিব্বি দেশি হয়ে গেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন এক মুসলমান রমণী। কথা বলতেন চোস্ত উর্দুতে। নিজেকে নিষ্ঠাবান মুসলমান ভেবে তিন রোজ নামাজও পড়তেন। তাঁর বাগানের নাম তাই যে শাহজাহানের বাগানের নামে শালিমার গার্ডেন হবে তাতে আশ্চর্য কি? তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে ওই বাগানেই মাটি দেওয়া হয়, মুসলমান মতে। সে বাগান আর নেই। রয়ে গেছে গঙ্গার ধারে সেই বাগানের শেষ চিহ্ন “শালিমার পয়েন্ট” নামে… শালিমার পেইন্ট, শালিমার রোপ ওয়ার্কের ঘিঞ্জি বসতি আর রোজ শয়ে শয়ে ভিড় জমানো ক্যাপ্টেন কিডের নামটুকু না জানা যাত্রীরা…। 

এভাবেই সেকালের কলকাতার বহু বাগান শুধু প্রাচীন স্মৃতিকথা আর গল্প কাহিনিতেই রয়ে গেছে। লোয়ার সার্কুলার রোডে কলকাতার সবচেয়ে ধনী পার্সি সদাগর রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি এক বিরাট বাগান বানিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকার মতো বাড়ি। গৃহপ্রবেশের দিন বল নাচ, বাই নাচ হয়েছিল। এসেছিলেন স্বয়ং বড়লাট লর্ড অকল্যান্ড। এই বাগানবাড়িতেই ১৮৫২ সালে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর বড় ছেলে মানেকজি রুস্তমজি এই বাড়ি থেকেই ব্যবসা চালাতেন। ১৮৭৪ সালে তাঁকে কলকাতার শেরিফ করা হল। তিনিও এই বাড়ি, এই বাগান ছেড়ে উঠে এলেন সাহেবপাড়ায়। সেই বাগানবাড়ি ভাড়া নিয়ে হিন্দুমেলার আয়োজন শুরু হল। ১৮৭৬ সালে পটলডাঙার বসুমল্লিক পরিবারের দীননাথ এই বাগান কিনে নেন। কিন্তু আগের মালিকের নাম অনুসারে ‘পার্সিবাগান’ নামটুকু রয়ে যায়। আর আশেপাশের এলাকা মানেকজির নামে মানিকতলা নামে ডাকা হত। বসুমল্লিকরা এই বাগান ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর দুই ছেলে নগেন্দ্র আর যোগেন্দ্র মিলে এই বাগান যখন কালীকৃষ্ণ ঠাকুরকে বিক্রি করেন তখনই এর মৃতপ্রায় দশা। ১৮৯৮ সালেই ইন্দিরা দেবী প্রমথ চৌধুরীকে চিঠিতে লেখেন– 

কাল ওঁরা একদল… একটা কি প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন – পার্সিবাগান – নামটা অনেকদিন থেকে শুনে আসছি, কিন্তু কখনো দেখিনি। শুনলুম খুব জাঁকালো মস্ত ব্যাপার, যদিও অযত্নে পড়ে আছে ঘরের অবধি নেই, সর্বত্র মার্বেল পাথর বসানো, কেতাদুরক্ত বাগান, ফোয়ারা, ফুলের গাছ ইত্যাদি যেমন বাদশাহী কাণ্ড হতে হয়।

ধীরে ধীরে এই বাগান নষ্ট হয়ে বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যায়। প্রায় দশ বারো বছর এর নাম কেউ শুনল না। আচমকা ১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার দিন আদর্শের বিরোধে তারকনাথ পালিত মশাই কারিগরী শিক্ষার জন্য এক আলাদা সংস্থার প্রস্তাব দিলেন। ভোটাভুটি হল। তিনি তাঁর সমর্থকদের নিয়ে আলাদা ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল’ খুলবেন বলে ঠিক করলেন। করলেন তো বটে, কিন্তু খুলবেন কোথায়? সেই কাজেই ৩০০ টাকা মাসিক ভাড়া দিয়ে পার্সিবাগানের পড়ে থাকা বাগানবাড়ি ভাড়া করা হল। ১৯১২ সালের শেষের দিকে এটি পঞ্চবটি ভিলায় চলে গেলে আশুতোষ মুখুজ্জের সহায়তায় পার্সিবাগানের জমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়। সেখানে স্থাপন করা হয় সায়েন্স কলেজ। আর সেই টেকনিক্যাল স্কুলের কি হল? ১৯২৪ সালে সেটি স্থানান্তরিত হল যাদবপুরে, নাম হল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলোজি। স্বাধীনতার পরে সেটাই আজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

Jadavpur University
যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সূচনা হয়েছিল পার্সিবাগানে

মানিকতলায় আরও এক হারিয়ে যাওয়া বাগানের কথা পাই রবি ঠাকুরের জীবনস্মৃতি-তে। সে এক মজার বিবরণ।পুরোটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারা গেল না-

রবিবারে রবিবারে জ্যোতিদাদা দলবল লইয়া শিকার করিতে বাহির হইতেন। রবাহূত অনাহূত যাহারা আমাদের দলে আসিয়া জুটিত তাহাদের অধিকাংশকেই আমরা চিনিতাম না। তাহাদের মধ্যে ছুতার কামার প্রভৃতি সকল শ্রেণীর লোক ছিল। এই শিকারে রক্তপাতটাই সবচেয়ে নগণ্য ছিল, অন্তত সেরূপ ঘটনা আমার তো মনে পড়ে না। শিকারের অন্য সমস্ত অনুষ্ঠানই বেশ ভরপুরমাত্রায় ছিল— আমরা হত-আহত পশুপক্ষীর অতিতুচ্ছ অভাব কিছুমাত্র অনুভব করিতাম না। প্রাতঃকালেই বাহির হইতাম। বউঠাকুরানী রাশীকৃত লুচি তরকারী প্রস্তুত করিয়া আমাদের সঙ্গে দিতেন। ঐ জিনিসটাকে শিকার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইত না বলিয়াই, একদিনও আমাদিগকে উপবাস করিতে হয় নাই।

মানিকতলায় পোড়াবাগানের অভাব নাই। আমরা যে-কোনো একটা বাগানে ঢুকিয়া পড়িতাম। পুকুরে বাঁধানো ঘাটে বসিয়া বসিয়া উচ্চনীচনির্বিচারে সকলে একত্র মিলিয়া লুচির উপরে পড়িয়া মুহূর্তের মধ্যে কেবল পাত্রটাকে মাত্র বাকি রাখিতাম।

ব্রজবাবুও আমাদের অহিংস্রক শিকারিদের মধ্যে একজন প্রধান উৎসাহী। ইনি মেট্রোপলিটান কলেজের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট এবং কিছুকাল আমাদের ঘরের শিক্ষক ছিলেন। ইনি একদিন শিকার হইতে ফিরিবার পথে একটা বাগানে ঢুকিয়াই মালিকে ডাকিয়া কহিলেন, “ওরে, ইতিমধ্যে মামা কি বাগানে আসিয়াছিলেন।” মালি তাহাকে শশব্যস্ত হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “আজ্ঞা না, বাবু তো আসে নাই।” ব্রজবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, ডাব পাড়িয়া আন্‌।” সেদিন লুচির অন্তে পানীয়ের অভাব হয় নাই।

আমাদের দলের মধ্যে একটি মধ্যবিত্ত জমিদার ছিলেন। তিনি নিষ্ঠাবান হিন্দু। তাঁহার গঙ্গার ধারে একটি বাগান ছিল। সেখানে গিয়া আমরা সকল সভ্য একদিন জাতিবর্ণনির্বিচারে আহার করিলাম। অপরাহ্নে বিষম ঝড়। সেই ঝড়ে আমরা গঙ্গার ঘাটে দাঁড়াইয়া চীৎকার শব্দে গান জুড়িয়া দিলাম। রাজনারায়ণবাবুর কণ্ঠে সাতটা সুর যে বেশ বিশুদ্ধভাবে খেলিত তাহা নহে কিন্তু তিনিও গলা ছাড়িয়া দিলেন, এবং সূত্রের চেয়ে ভাষ্য যেমন অনেক বেশি হয় তেমনি তাহাঁর উৎসাহের তুমুল হাতনাড়া তাঁহার ক্ষীণকণ্ঠকে বহুদূরে ছাড়াইয়া গেল; তালের ঝোঁকে মাথা নাড়িতে লাগিলেন এবং তাঁহার পাকা দাড়ির মধ্যে ঝড়ের হাওয়া মাতামাতি করিতে লাগিল। অনেক রাত্রে গাড়ি করিয়া বাড়ি ফিরিলাম। তখন ঝড়বাদল থামিয়া তারা ফুটিয়াছে। অন্ধকার নিবিড়, আকাশ নিস্তব্ধ, পাড়াগাঁয়ের পথ নির্জন, কেবল দুইধারের বনশ্রেণীর মধ্যে দলে দলে জোনাকি যেন নিঃশব্দে মুঠা মুঠা আগুনের হরির লুট ছড়াইতেছে।

এ-ঘটনা ঘটেছিল মানিকতলার কোন বাগানে? রাধারমণ মিত্র এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন “মনে রাখতে হবে ফেরবার পথে সকলে এই বাগানে ঢুকেছিলেন। সুতরাং এ-বাগান থাকার কথা মানিকতলা মেন রোডের পূর্বপ্রান্তে নয়, পশ্চিমপ্রান্তে, কলকাতার কাছাকাছি। এখন এই বাগানের নাম ‘মল্লিক লজ’। প্রকাণ্ড বাগান। ম্যাকিনটস বার্ন-এর তৈরি বাড়ি। এঁরা চিৎপুরের বিখ্যাত ঘড়িওয়ালা বাড়ির মল্লিকের, অর্থাৎ বৈষ্ণবদাস মল্লিকের বংশ।” 

Kolkata-Botanic-Garden
সাহেবি আমলে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন

পার্সিবাগানের মতো আরও এক জমকালো বাগান ছিল দেওয়ান মানিকচাঁদের বাগান। বেহালায় ডায়মন্ডহারববার রোডে তাঁর বাগানবাড়ির কথা রেভারেন্ড লং সাহেব নিজে লিখে গেছেন। সিরাজদ্দৌলা বাংলার নবাব হলে ইনি ঢাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৭৫৬ সালের জুন মাসে নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে দখল করার পর রাজা মানিকচাঁদকে কলকাতার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। মানিকচাঁদ সিরাজদ্দৌলার সৈন্যবাহিনীতে সেনাপতি হয়ে এসেছিলেন। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে এসে কলকাতা পুনর্দখল করেন। সেই পর্যন্ত রাজা মানিকচাঁদ কলকাতায় শাসনকর্তা ছিলেন, কিন্তু তিনি কখনও কলকাতা শহরের ভেতরে থাকেননি। থাকতেন কলকাতার উপকণ্ঠে বেহালায়– ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর অবস্থিত চতুর্দিকে পরিখাবেষ্টিত এক প্রকাণ্ড বাগানবাড়িতে। সেই বাগানবাড়ি অনেক পরিবর্তিত হয়ে এখনও বর্তমান আছে। এইটিকেই লোকে দেওয়ান বা রাজা মানিকচাঁদের বাগান বলে।

কলকাতার এক হারিয়ে যাওয়া বাগানের সঙ্গে বিবেকানন্দের একটা সম্পর্ক আছে। নবাব মিরকাশিমের সেনাপতি গুর্গিনের বংশধর এক মহিলা এখনকার নারকেলডাঙার কাছেই বিরাট এক বাগানবাড়িতে থাকতেন। সেই বাড়ির নাম ছিল মোগলবাগান। বাড়ির আইনি সব কাজকর্ম করে দিতেন অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্ত। অনেক পরে এই বাগানের উপর দিয়ে বালিগঞ্জ- দমদম রেললাইন চলে গিয়ে এই বাগান নষ্ট হয়ে যায়। তবে নামটুকু রয়ে গেছে। 

দমদমের ক্লাইভ হাউসের পাশেই বিরাট বাগান ছিল আনন্দমোহন বসুর। র‍্যাংলার হলো গণিতশাস্ত্রের ওপর প্রদত্ত সর্বোচ্চ উপাধি, যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয়। আর এই র‍্যাংলার উপাধি পান কিশোরগঞ্জের আনন্দমোহন বসু। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ‘র‍্যাংলার’ উপাধি পাওয়া ভারতীয়। এই আনন্দমোহন বসু ৭০ বিঘে জমি-সমেত এক বাগানবাড়ি কেনেন। সেই বাগানবাড়ির নাম রাখলেন ‘ফেয়ারি হল।’ ১৮৪৮ সালে এই বাড়ি ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস লেসলি ফ্রিথ নামে এক সাহেবের। এই বাড়িতে আগে সিন্ধু দেশের হায়দ্রাবাদ, খয়েরপুর ও মীরপুরের তিন আমিরকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ১৮৪৩ সালে তাঁদের গদিচ্যুত করা হয়। একতলার একটি ঘরে লোহার গরাদে দেওয়া একটি ঘেরা জায়গা ছিল। সেখানে আমিরদের চিতাবাঘ বাঁধা থাকত। ১৯২০ সালের গোড়ার দিক থেকে এই বাগানবাড়ি ব্রিটিশ অ্যালুমিনিয়ম কর্পোরেশন লিমিটেডের সম্পত্তি হয়ে যায়। বাগানের আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। 

Gardenreach
গঙ্গার ধারের বন্দর-বাগান থেকেই নাম হল ‘গার্ডেনরিচ’

ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬। লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন।  কিন্তু কলকাতায় এসেও সেখানেই ছোট এক লখনৌ বানিয়ে নিয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। ছিল বিরাট এক বাগান, আর সেই বাগানে অদ্ভুত এক চিড়িয়াখানা। আবদুল হলিম শররের লেখায় একেবারে জীবন্ত হয়ে হয়ে উঠেছে তার কথা। সেখানে

“বিচরণ করত শত শত চিতা, হরিণ ইত্যাদি, অরণ্য পশুর দল ঠিক মাঝখানে, শ্বেত-পাথরে একটা পুকুর, সর্বদা ভরাভর্তি তার মধ্যে দেওয়া হয়েছিল শুতুরমুর্গ, কিশোরী, ফীলমুর্গ, সারশ, কায়া, বগলা, করকর, চকোর, ময়ূর, হাঁস নানান জাতের পাখি কচ্ছপ পুকুরের এক ধারে খাঁচায় থাকত বাঘ। চরণভূমির পাশে, লোহার রেলিংঘেরা জাতের এবং কোথাকার বাঁদর এনে রাখা হয়েছিল। এদের জলাধারের স্থানে পোষা হত। ইশারা করলেই জড়ো হত; খাবার নেচে কুঁদে বাহার দেখাত। শাহানশাহ মঞ্জিলের দীর্ঘ গভীর জলাশয়; পিছলা করে নেওয়া; ঠিক মাঝখানে সামনের দিকে ঝোঁকানো একটা কৃত্রিম পাহাড়। পাহাড়ের সংখ্যাহীন নালী; জলস্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার সাপ। দু’গজ তিন বড়ো বড়ো সাপ চব্বিশ দৌড়ত, ঘুরত, কিলবিল করত; পাহাড়ের উঠত, ব্যাঙ হলে দৌড়ে ধরত। পাহাড়ের আশেপাশে খালের মতো নালা; তার মধ্যেও সাপেরা এঁকেবেঁকে ছুটত, ব্যাঙের পিছু নিত; লোকেরা পাশে দেখত। পাহাড়ের দুটো খাঁচা, তাতে থাকত বড় বড় চিতা। এমনিতে চুপচাপ কিন্তু দেওয়া হত লাফ দিয়ে ধরে গোটাটাই ফেলত। সাপ পোষার ব্যবস্থা আগে কোথাও হয়নি। এটা ওয়াজিদ আলি আবিষ্কার। য়োরোপের পর্যটক অবাক হয়ে ছবি এঁকে ও যেত। এই জানোয়ার ছাড়া হাজার হাজার পাখি ছিল। তারা থাকত খাশ সুলতানখানার অন্দরে, পিতল-পিঞ্জরে লোহার জাল সুরক্ষিত গোটাকুড়ি বড় বড় ঘর ছিল, ‘গঞ্জ’। তার নানাধরনের অসংখ্য পাখি। বাদশাহর পশুপাখির যতো জাতি আছে, এখানে করবেন এবং এমন এক সম্পূর্ণ জীবন্ত চিড়িয়াখানা বানিয়ে যাবেন, দুনিয়ার কোথাও তার জুড়ি নেই। এদের সংগ্রহের তিনি বেপরোয়া অর্থব্যয়ও করেছেন। কেউ কোন পাখি বা আনলে যে চাইত যেত। শোনা যায়, বাদশাহ একজোড়া ‘রেশমপাখা’ পায়রা চব্বিশ হাজার টাকায় এবং এক ময়ূর এগারো টাকায় কিনেছিলেন। আফ্রিকার জিরাফও দুটো। কোহানের দুটো বাগদাদী উটও—যা হিন্দুস্থানের আর কোথাও চোখে পড়েনি কোনও জানোয়ারই যাতে বাদ না বাদশাহ সেজন্য গাধাও রেখেছিলেন চিড়িয়াখানায় তাঁর পায়রাই নাকি ছিল চব্বিশ পঁচিশ হাজারের মত”। 

ভাবা যায়! নবাবের মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই বাগান আর মিনেজারি একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। যেহেতু বাগানই আলোচনার প্রধান, তাই এই আলোচনায় বাদ গেল বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বাড়ি, যেখানে বাগানের স্থান নেহাত ফেলে দেবার মতো ছিল না। কিন্তু সেগুলোতে বাড়িই মুখ্য। তাই বাদ গেল ডিরোজিওর বাড়ি, রাজনারায়ণ বসুর বেনেটোলার বাড়ি, ব্রাহ্ম সমাজের শাঁখারিটোলার বাড়ি, পাথুরেঘাটার গোপীমোহন ঠাকুরের বাড়ি, মরকত কুঞ্জ এবং অবশ্যই যার নাম না করলেই নয়, দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলা আর নৈহাটির পাটের ব্যবসায়ী প্রিয়নাথ মিত্রের মোহনবাগান ভিলা, যার বিস্তীর্ণ মাঠে খেলতে খেলতে একটা ক্লাবেরই জন্ম হয়ে গেল, মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব। কিন্তু সে সব আলোচনা অন্যত্র করা যাবে।  

 

*ছবি সৌজন্য: Gardenvisit, Telegraph, Pinterest

Kaushik Majumdar author

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

Picture of কৌশিক মজুমদার

কৌশিক মজুমদার

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।
Picture of কৌশিক মজুমদার

কৌশিক মজুমদার

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com