অতঃপর ব্যাসদেব বললেন, “হে পাণ্ডবগণ, তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছ ঠিকই কিন্তু ঐ জয়মাল্যের মধ্যে প্রাণীহত্যাজনিত বিস্তর পাপকণ্টক বর্তমান। এই পাপ হইতে মুক্তি পাইতে গেলে তোমাদিগকে মহাদেবের বরপ্রাপ্ত হইতে হইবে। অতএব তোমরা শীঘ্র তাহার সন্ধানে ব্রতী হও।” এই কথা শোনা মাত্র পঞ্চপাণ্ডব মহাদেবের সন্ধানে দিগবিদিকে ধাবিত হলেন। এদিকে মহাদেবের কান ভারী করলেন নারদমুনি। বললেন, “ওহে ভোলানাথ, প্রচুর পাপকর্ম করে পাণ্ডবেরা তোমায় খুঁজে মরছে, তুমি বর দিলেই তারা পাপমুক্ত হবে। এখন তুমি এই পাপমুক্তির বরদান করে পাপের ভাগী হবে কিনা ভেবে দেখ।” মহাদেবকে গররাজি দেখে তিনিই প্রস্তাব দিলেন যে মহাদেব যদি ছদ্মরূপ ধারণ করে লুকিয়ে থাকেন তাহলে পাণ্ডবেরা তাঁর সন্ধানই পাবেন না। প্রস্তাব ভোলানাথের মনে ধরল এবং তিনি একটি মহিষের রূপ ধরে নির্বিঘ্নে বিচরণ করতে লাগলেন।
ওদিকে মহাদেবকে খুঁজতে খুঁজতে পাণ্ডবরা যখন হতাশ, তখন নারদ এসে তাদের বললেন, “ওই যে দেখছ গোরু-মোষের দল, ওরই মধ্যে মহাদেব আত্মগোপন করে আছেন। পারো তো ধরে বর আদায় করে নাও।” কিন্তু মুশকিল হলো অত গো-মহিষের মধ্যে থেকে মহাদেবকে খুঁজে পাবে কী করে? ভীম তখন দুই পাহাড়ে দুই পা দিয়ে দাঁড়ালেন আর ভাইদের বললেন ঐ গো-মহিষের দলকে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে চালনা করতে। যেমন কথা তেমন কাজ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল একটি মহিষ কিছুতেই পায়ের ফাঁক দিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। ভীম বুঝলেন ইনিই হলেন তাদের অভীপ্সিত দেবাদিদেব। এক লাফে ভীম জাপটে ধরলেন সেই ছদ্মমহিষকে। আর মহিষও প্রবল আক্রোশে পাথরের ভিতর গুঁজে দিলেন মাথাশুদ্ধ সমস্ত শরীর। কিন্তু ভীমের কবল থেকে মুক্ত হলো না তাঁর পশ্চাদ্দেশ। সেই প্রস্তরীভূত পশ্চাদ্দেশেরই তপস্যায় পাপমুক্ত হলেন পাণ্ডবগণ। স্থাপিত হলো মন্দির- কেদারনাথ। আর ঐ মহিষের দেহের বিভিন্ন অংশ হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে প্রকটিত হলো এবং প্রত্যেকটি স্থান একএকটি শৈবতীর্থরূপে গণ্য হলো। মুখমন্ডল-রুদ্রনাথ, ঊর্দ্ধাঙ্গ-মদমহেশ্বর, বাহু-তুঙ্গনাথ এবং জটাজুট-কল্পেশ্বর। পঞ্চকেদার-সবমিলিয়ে বিস্তীর্ণ কেদারখন্ড বা কেদারক্ষেত্র।
মনে মনে কেদারক্ষেত্র পরিক্রমা করবো স্থির করে হরিদ্বারে এসে পৌঁছলাম আমরা তিন সঙ্গী। গাড়ি ঠিক করে রওনা হলাম। গন্তব্য- গৌরীকুণ্ড। হরিদ্বার ছাড়িয়ে হৃষিকেশ, পাশে পাশে অনেক নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। হৃষিকেশের পরই মসৃণপথ ধীরগতিতে ঊর্দ্ধমুখী। আসে দেবপ্রয়াগ-অলকানন্দা আর ভাগীরথীর সঙ্গম। গাড়ি দাঁড়ায়, উপর থেকে প্রাণভরে দর্শন করি। নীলবর্ণা সুন্দরী অলকানন্দা আর গৈরিকবসনা ভাগীরথী, মিলেমিশে গঙ্গা হয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়। পথ চলে, এবার সঙ্গী অলকানন্দা। আসে এই পথের দ্বিতীয় প্রয়াগ- রুদ্রপ্রয়াগ। অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম। ওপর থেকে দেখেই বোঝা যায় নামকরণের সার্থকতা। মধ্যাহ্ণভোজনের বিরতির সুযোগে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসি। দুই পাশে দুই পর্বতপ্রাচীর ভেদ করে প্রবল বিক্রমে নেমে আসে দুই স্রোতস্বিনী- কেদার থেকে মন্দাকিনী ও বদ্রী থেকে অলকানন্দা। ওপাশের পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পথ চলে যায় পাহাড় ডিঙিয়ে। সেতু পেরিয়ে মানুষজন যাতায়াত করে দেখি। দেখতে ভুলি না ছোটোবেলায় পড়া জিম করবেট সাহেবের হাতে মানুষখেকো চিতাবাঘের মৃত্যুস্থল।
বিরতিশেষে আবার পথে নামি। বদ্রীর পথ চলে যায় অন্যদিকে, আমরা কেদারের পথ ধরি। পেরিয়ে যাই ছোটোবড় জনপদ- তিলওয়াড়া, অগস্ত্যমুনি কুণ্ড, গুপ্তকাশী, শোণপ্রয়াগ। অবশেষে গাড়ি এসে থামে গৌরীকুণ্ডে। গাড়ীর রাস্তা শেষ এখানেই। এখন অবশ্য এই জায়গাটির কোন চিহ্ণ নেই। ২০১৩ সালের বিধ্বংসী বন্যায় মুছে গেছে এই ব্যস্ত জনপদটি। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এক বিশাল চাতাল। ধারে ধারে নানা দোকানপাট, তারই মাঝে সিঁড়ি উঠে গেছে। একটু উঠে আমরা আস্তানা খুঁজে নিই। আমাদের ঘরের সামনের সংকীর্ণ বারান্দাটি একেবারে মন্দাকিনীর ওপর ঝুলছে। ওপারে ঘন জঙ্গল। নদীর তীব্র গর্জনে ঘুম আসেনা। সকালে উষ্ণকুণ্ডে স্নান সেরে হাতে লাঠি নিয়ে জয় কেদার ধ্বনি দিয়ে পথে নামি।
পাথর বাঁধানো পথ। ধারে ধারে লোহার রেলিং, মাঝে মাঝে আবার বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা। কিছুদুর উঠে প্রথম দর্শন হয় হিমালয়ের বরফ ঢাকা শৃঙ্গের সাথে। রোমাঞ্চিত হই, পা থেমে যায়। কিন্তু এ পথ চলার পথ। আবার এগোতে থাকি- মাঝে মাঝে বিশ্রামের জায়গা। অস্থায়ী দোকান। গরম কিংবা ঠান্ডা পানীয়তে গলা ভিজিয়ে আবার এগিয়ে চলি। আজকের আস্তানা রামওয়াড়া চটির কালীকমলী ধর্মশালা। সেথায় রাত্রিবাস। পরদিন সকালে দেখি পাহাড়ে নেমেছে বৃষ্টি। কিন্তু উপায় কী। তার মধ্যেই রাস্তায় নামি। আজই পৌছতে হবে কেদার। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে পথ চলি-নিজের চেষ্টায় নয়, কে যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে। পেরিয়ে যাই গড়ুরচটি, আসে দেও-দেখনি অর্থাৎ প্রথম দেব দর্শন। এইখান থেকেই প্রথম দেখা যায় কেদারশৃঙ্গ। অবাক হয়ে দেখি -বিশ্বাস হয় না। তৃপ্ত মনে অনির্বচনীয় আনন্দধারায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলি।

আর চড়াই নেই। মন্দাকিনীর ওপর পুল পার হয়ে আসি- বাড়িঘর, হোটেল, ধর্মশালা, দোকানপাটে ঠাসা এক জনপদ কেদারক্ষেত্র। ডান্ডি, কান্ডি, পদযাত্রী, খচ্চরের ভিড়ে ভারাক্রান্ত। আমাদের নির্ধারিত পুরোহিত পুরুষোত্তম শুক্লার ঘর ঠিক করে রেখেছিলেন। সেখানে গিয়ে বসি। বিশ্রাম চাইছে পা। কিন্তু মন মানছে না। কেদার তাকে ডাকছে। আয় আয়! সামান্য বিশ্রামের পর ছুটে চলে যাই মন্দিরের দিকে। সরু পাথর গাঁথা পথ, তার দুদিকে কলকাতার কালীঘাটের মতো ঘিঞ্জি দোকানপাটের সারি। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা উঠে আসি প্রশস্ত চাতালে। বিশাল নন্দীকে প্রণাম করে তাকিয়ে থাকি মন্দিরের দিকে- এই সেই কেদারতীর্থ। বরফাবৃত সুউচ্চ হিমশৃঙ্গের পটভুমিকায় পঞ্চপাণ্ডব নির্মিত মন্দির। উষ্ণ আবেগ অশ্রু হয়ে নামে। পরদিন পুজো দিই। পরম ভক্তিভরে দৈবমহিষের প্রস্তরীভূত ত্রিকোণাকৃতি পশ্চাদংশে পঞ্চগব্যমার্জনা করে, পুষ্পবিল্বপত্রার্ঘ্য অর্পণ করি। পূজাশেষে দুহাত দিয়ে নিবিড় আলিঙ্গন করি কেদারনাথকে। পরবর্তী গন্তব্য মদমহেশ্বর বা মধ্যমহেশ্বর। সে কাহিনি শোনাব পরবর্তী পর্বে।
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। নেশা বহুল। গ্রুপ থিয়েটার, পাখির ছবি তোলা আর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ তার মধ্য়ে তিন। খেপে ওঠেন সহজে। হেসে ওঠেন গরজে! খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর পছন্দ টেলিভিশন দেখা!
One Response
অসাধারন, তন্ময়দা.