কৃষি সংস্কারের সার্থক রূপায়ণের ক্ষেত্রে একটি ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিম্নতম স্তর থেকে এই পরিকল্পনাকে সফল করতে প্রতিটি রাজ্য সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি। চুক্তিভিত্তিক কৃষির ক্ষেত্রে কৃষক ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বৈদ্যুতিন নিবন্ধীকরণ নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
সর্বাগ্রে দরকার ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়ার সরলীকরণ। এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শস্যগুদামের রসিদ দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে সহজে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর ফলে ছোট চাষিরাও নিজেদের উৎপাদিত শস্য গুদামে রাখার কথা ভাবতে পারেন এবং পরে দাম বাড়লে তা বিক্রি করতে পারেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি পরিকাঠামো তহবিলের সুবিধা ছোট চাষিরাও পেতে পারবেন। তাঁরা সহজে এবং সরাসরি সর্বভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবেন, চুক্তি-চাষের সুবিধা পেতে পারবেন। এর জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন কারিগরি কুশলতার বিকাশ, বাজার অর্থনীতি এবং দর কষাকষির পাঠ।
এই প্রস্তাবিত কৃষি সংস্কার সংক্রান্ত নতুন বিলগুলি খতিয়ে দেখতে রাজ্য এবং কেন্দ্র, উভয় সরকারকেই একটি যথাযথ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে।
পাঞ্জাব সরকারের বর্তমান আইন অনুযায়ী, সরকারের শস্য কেনার পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, চাষিদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) না-দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। এর বিপ্রতীপে কেন্দ্রীয় সরকারও এই মর্মে একটি বিল বা অর্ডিন্যান্স আনতে পারে, যাতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টিতে আইনি শীলমোহর পড়ে। এবং এই আইনের রূপায়ণের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে কৃষি দফতরের উপর।
সরকারি বাজারগুলিতে (APMC মান্ডি) ই-ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বিনিয়োগ এবং বিনিময় মূল্য কম থাকে। এইসব বাজারগুলিতে যে ফড়ে বা দালালরা সক্রয়, তাদেরই কৃষক এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। এর ফলে শহর এলাকায় যে সব সংস্থারা রয়েছে, যারা প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে অনেক সময়ই চুক্তি করে উঠতে পারে না, সে পথও সুগম হবে। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে এই মধ্যবর্তী শ্রেণিই।
বহু সরকারি বাজারেই চাহিদার তুলনায় শস্যের জোগান কম। ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেই একই শস্য বাইরে খোলা বাজার থেকে অনেকটা কম দামে কিনছেন, কারণ সেখানে সরকার নির্ধারিত রাজস্ব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। সরকার যদি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে আইনি শীলমোহর দেয়, তাহলে বেসরকারি বিকিকিনি যাতে অন্যায়ভাবে ফুলে ফেঁপে না-ওঠে, সেই দায়িত্বও বর্তাবে সরকারের উপরেই। এখন প্রশ্ন হল, সমস্ত কৃষকের উৎপাদিত শস্য কিনে নেওয়ার মতো অর্থবল কি সরকারের আছে?
আদতে ক্রেতারাই কৃষকদের সাহায্যকারী শক্তি হয়ে উঠতে পারে, সরকার নয়। কৃষকদের উচিৎ নিজেরা সমবায়, এফপিও বা ওই জাতীয় একাধিক সংগঠন তৈরি করে সরকারি বাজারে (এপিএমসি মান্ডি) এসে ব্যবসা শুরু করা, যাতে তাঁরা সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেন করতে পারেন। অন্য দিকে, রাজ্য সরকারের উচিৎ সরকারি বাজারের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে কৃষকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। এতে বাজারের দামের উপরেও কৃষকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই ব্যবস্থা ছাড়া কখনওই কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত শস্যের দামের লভ্যাংশ সঠিক হারে পাবেন না।
চুক্তিচাষের প্রয়োগ বাড়ানো দরকার। বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে কৃষকদের সঙ্গে লেনদেন ও দরদস্তুরের ক্ষমতা দিতে সরকারি হস্তক্ষেপ একেবারে কমিয়ে আনতে হবে, যাতে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। তবে চুক্তিচাষের নিবন্ধীকরণ প্রক্রিয়া অবশ্য সরকারি দেখভালের মাধ্যমেই করতে হবে। কিন্তু তার আগে সরকারি দফতরগুলিকে রাজনীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। ব্লক বা মহকুমা-স্তর থেকে একেবারে জেলাস্তর পর্যন্ত আবেদন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক জটিলতামুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রাদেশিক ভাষায় লিখিত হতে হবে। জটিল আইনি পরিভাষা বর্জন করে সরল ভাষায় লিখতে হবে, যাতে ন্যূনতম শিক্ষিত একজন কৃষকের কাছেও তা অর্থবহ হয়। ছোট চাষিদের ক্ষোভ জানানোর জন্য ক্রেতাসুরক্ষা আদালতের আদলে কৃষক সুরক্ষা আদালত তৈরি করতে হবে, যারা কৃষকদের দাবিদাওয়া খতিয়ে দেখবে এবং সংস্থাগুলি কোনও রকম বেনিয়ম করছে কিনা, তার উপরেও নজর রাখবে। এই আদালতের হাতে নিয়ম লঙ্ঘনকারী সংস্থাকে জরিমানা করার ক্ষমতাও থাকতে হবে।
সর্বাগ্রে দরকার ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়ার সরলীকরণ। এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শস্যগুদামের রসিদ দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে সহজে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
প্রস্তাবিত কৃষি সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য বিপুল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজন। এই উন্নয়ন খতিয়ে দেখতে জরুরি বিশেষজ্ঞদের মতামত। কারণ বাজারগুলিকে পুষ্ট রাখতে যেমন দরকার হবে প্রযুক্তি, কৃষকের আয় বাড়াতেও হাতিয়ার হয়ে উঠবে সেই প্রযুক্তিই। ঠিকাদার বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলিকে ভারতের সনাতনী কৃষিব্যবস্থা ও কৌশল বুঝতে হবে, কারণ তা না বুঝলে মাটির বা শস্যের স্বাস্থ্যরক্ষা করা এবং পোকামাকড়ের বাড়বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। কাজেই দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে মাথায় রাখতে হবে যে, বাজারমুখী কৃষি বা চুক্তিচাষ যেন উপরোক্ত ব্যবস্থায় কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করতে না পারে। এর ফলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (Sustainable Development Goal) পূরণেও সফল হবে ভারত।
এই প্রস্তাবিত কৃষি সংস্কার সংক্রান্ত নতুন বিলগুলি খতিয়ে দেখতে রাজ্য এবং কেন্দ্র, উভয় সরকারকেই একটি যথাযথ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে। ২০২০ সালে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দামের সারণী তৈরি করে তাকে এই প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। এর থেকেই বোঝা যাবে আগামী বছরগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে কতটা উন্নয়ন হচ্ছে বা সংস্কারের কতখানি প্রভাব পড়ছে।
ছবি সৌজন্যে Pixabay
ড. সুমনকুমার মুখোপাধ্যায় একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। সুদীর্ঘ ৪৬ ধরে তিনি অধ্যাপক এবং গবেষক হিসেবে বিভিন্ন দেশী বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে এক্সএলআরআই, আইআইএসডব্লুবিএম, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কলকাতা, আইআইটি দিল্লি, উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সুমন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একাধিক উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলকাতা, সেন্ট স্টিফেনস দিল্লি ও দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসের প্রাক্তনী। বর্তমানে অ্যাডভাইসরি বোর্ড অন অডুকেশন, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের সদস্য, চেয়ারম্যান ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস কমিউনিটির সদস্য, ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়ম ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইকনমিকস সাব কমিটি, বিসিসিঅ্যান্ডআই, এমসিসিঅ্যান্ডআই, অ্যাসোচ্যাম ইত্যাদি বোর্ডের সদস্য। তিনি সেনার্স-কে নামক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের গবেষকদের সংগঠনের আজীবন সদস্য। বর্তমানে ভবানীপুর গুজরাটি এডুকেশন সোসাইটি কলেজের ডিরেক্টর জেনেরাল।