Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ফ্লার্ট করতে গিয়ে মৃণাল সেনের নজরে, নকশাল তকমা মুছে দিল রুপোলি পর্দা

Feature on Mithun Chakraborty on his Birthday
Feature on Mithun Chakraborty on his Birthday
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আদর করে বাবা-মা ছেলের নাম রেখেছিলেন গৌরাঙ্গ। ছোট করে গৌর। কিন্তু ছেলের গায়ের রং গৌরবর্ণ ছিল না। ভীষণ কালো গায়ের রং। একদম শ্রীকৃষ্ণের মতো। সেই ছেলেই বড় হয়ে হলেন কিংবদন্তি সুপারস্টার নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী। কিন্তু গৌর থেকে হিরো মিঠুন হবার লড়াইটা নেহাত কম ছিল না। তাই মিঠুন বলেন “আমার জীবন নিয়ে ছবি হোক আমি চাই না। আমার স্ট্রাগল কাউকে সুখ দেবে না। বম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি রোলের জন্য। মনে হত আর পারছি না। থাকার জায়গা নেই, খাবার ঠিক নেই, হাতে পয়সা নেই। মনে হত আত্মহত্যা করে ফেলব। কিন্তু শেষ অবধি ভগবান আমাকে জিতিয়ে দেন। প্রতিভার থেকেও বড় হল ভাগ্য। ভাগ্যের জোরেই আজ আমি মিঠুন।”

জীবনের শুরুতেই গায়ে পড়ে গেছিল ‘নকশাল’ তকমা। উত্তর কলকাতার ছেলে গৌর তখন জড়িয়ে পড়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের চক্রব্যূহে। কলকাতার অলিতে-গলিতে পড়ে আছে মানুষের লাশ, বন্দুকের নল তাক করে আছে চারদিকে, সঙ্গে পুলিশি অভিযান। মিঠুন এমন একজন বিরল নায়ক, নকশাল আন্দোলনের আগুনের ভিতর দিয়ে জন্ম হয়েছিল যার। স্কটিশ চার্চ কলেজের রসায়নের ছাত্র ছিলেন মিঠুন। কিন্তু নকশাল বলে ছাপ পড়ে যাওয়ায় মুম্বাই পালিয়ে যান। কলকাতা ফেরার অবস্থায় ছিলেন না। পুলিশি প্রহরার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালানো নাহয় সম্ভব হল, সেই মিঠুন দেখলেন তাঁর দ্বারা চাকরি-বাকরি অসম্ভব। নিজের প্যাশন অভিনয়। কিন্তু সেখানেও প্রধান বাধা গায়ের কালো রং। তখন মুম্বাই নগরীতে কাপুর পরিবারের রমরমা। তাঁরা সবাই শ্বেতাঙ্গ হিরো। এমনকী রাজেশ খান্না থেকে ধর্মেন্দ্র— তাঁরাও ফর্সা। নিজের গায়ের রং কালো হওয়াতে মিঠুন ধরেই নেন তাঁর দ্বারা নায়ক হওয়া আর হল না। কিন্তু অভিনেতা তো হওয়াই যায়। সেই আশা নিয়েই ভর্তি হলেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। আর ছিল নাচের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। কে জানত এই নাচ-ই তাঁকে একদিন বলিউডের ‘ডিস্কো ডান্সার’ বানিয়ে দেবে!

Disco Dancer Mithun

বলিউডে মিঠুন চক্রবর্তীর আরেক নাম আজও ‘ডিস্কো ডান্সার’। আশির দশকে বাপ্পি লাহিড়ি ভারতীয় সিনেমায় ‘ডিস্কো’ মিউজিকের প্রচলন ঘটিয়ে আনলেন এক বিপ্লব। আর সেই ‘ডিস্কো’কে আল্টিমেট ডান্স নাম্বারে যিনি নিয়ে এলেন তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। বাপ্পি-মিঠুন জুটি যেন আশির দশকের আইকনিক জুটি। বাপ্পির গান আর সুরকে পর্দায় হিট করাত মিঠুনের নাচ। বলিউডে মিঠুনের আগে প্রথাগত শিক্ষিত ডান্সার নায়ক আসেনি। তাই একের পর এক নাচের ছবি মিঠুনকে নিয়ে হতে লাগল। আর তা সুপারহিট। কিন্তু অভিনেতা মিঠুন? নাচ না থাকলে কি মিঠুনের অস্তিত্ব থাকত ভারতীয় ছায়াছবিতে?

অবশ্যই থাকত। স্টার মিঠুন, ডান্সার মিঠুনের থেকে অনেক বড় অভিনেতা মিঠুন। ভালো অভিনেতা না হলে এভাবে দিনের পর দিন ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা ধরে রাখতে পারতেন না মিঠুন। কিন্তু তাঁর সেই পরিচয় অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে তাঁর ডান্সার সত্ত্বা আর স্টারডমের আড়ালে। আজ মিঠুন চক্রবর্তী-র জন্মদিনে আমরা যাব সেই সফরে, যেখানে স্বল্পচর্চিত হলেও নানা বয়সের অভিনেতা মিঠুনকে খুঁজে পাব।

গায়ের রঙের জন্য মিঠুনকে একসময় প্রচুর কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল। কিন্তু এই শ্যামবর্ণই মিঠুনের ভাগ্যচক্র ঘুরিয়ে দেয়। সালটা ১৯৭৪। তখন মিঠুন পুনে এফটিআইআই থেকে অভিনয় শিক্ষার কোর্স পাশ করার দোরগোড়ায়। সেদিন সমাবর্তনে নিজেদের ডিপ্লোমা ডিগ্রি গ্রহণ করছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত মৃণাল সেন, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টজনেরা। হঠাৎ-ই ‘পদাতিক’-এর পরিচালক মৃণাল সেনের চোখে পড়ে যায় একটি ছেলে, যে সেদিন উপস্থিত মেয়েদের সঙ্গে মজার ছলে নানা কথায় ফ্লার্ট করে যাচ্ছিল। কোনও ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে সিনেমার নামীদামি অভিনেতা-পরিচালকদের মাঝখানে কি এমনটা করা যায়? কিন্তু সেই ছেলেটি ভ্রুক্ষেপহীনভাবে বেহায়ার মতো ফ্লার্ট করেই চলেছে। মৃণাল সেনের মনে হল, বেশ তো ছেলেটি। ফিল্মে তো এমন অভিনেতাই দরকার, যেকোনও পরিস্থিতিতেই যে বেহায়ার মতো নিজের কাজটা করতে পারে। মৃণাল সেনের পাশে বসা আরেক কিংবদন্তি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় সেদিন মৃণাল সেনকে বলেছিলেন, ওই কালো ছেলেটার নাম মিঠুন। ছেলেটা বাঙালি।

Mrinal Sen and Mithun

এর কিছুদিন পরের কথা। মৃণাল সেন তখন তাঁর ‘মৃগয়া’ ছবির কাজ শুরু করেছেন। লিড রোল ঘিনুয়া আদিবাসী যুবকের চরিত্রে অভিনেতার কথা ভাবতেই মৃণাল সেনের মনে এল লম্বা কৃষ্ণকায় ছেলেটির মুখ। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে মুম্বাইতে নিজের ক্যামেরাম্যানকে পাঠিয়ে দিলেন মৃণাল সেন। দিন তিনেক পর তাঁর কাছে সেই ছেলে এসে হাজির। মৃণাল সেনের মনে ছিল ছেলেটির নাম এম দিয়ে। সাক্ষাতে মনে পড়ল মিঠুন। কিন্তু মিঠুন এসেই মৃণালের কাছে গলাবাজি করে বলতে লাগল, সে কত ভালো ডান্সার! ইতিমধ্যেই সে হেলেনের সঙ্গে নেচে ফেলেছে। মৃণাল সেন কোন ধারার পরিচালক সে সম্পর্কে একেবারেই অবগত ছিলেন না মিঠুন। মৃণাল সেন মিঠুনের বোলচাল অনেকক্ষণ সহ্য করে বললেন “আর বেশি কথা বললে তোমায় গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেব।”

চুপচাপ এরপরে পরিচালকের কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো সিনেমায় কাজ করতে রাজি হলেন মিঠুন। তবে একটা জায়গায় বেঁকে বসলেন। সিনেমার জন্য লম্বা চুল কাটতে হবে। আদিবাসী যুবকের চরিত্র, তাই মিঠুন-ছাঁট চলবে না। লম্বা চুল কেটে ফেলতে সেদিন বাধ্য হন মিঠুন। পরে মিঠুন ‘মৃণালদা’ সম্পর্কে বলেছিলেন “আমি বিশ্বাস করি আমার প্রতিভা ছিল, তবে মৃণাল সেন আমাকে এই রোল অফার না করলে অন্যান্য স্ট্রাগলারদের ভিড়ে আমিও হারিয়ে যেতাম। আমার চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য মৃণাল সেন আমাকে যা যা বলেছিলেন, আমি তাই করেছিলাম। তালডাঙা নামে যে গ্রামে সিনেমার কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল, সেই গ্রামের আদিবাসীদের সাথে আমি এক মাসেরও বেশি সময় থেকেছিলাম শুধুমাত্র তাদের ম্যানারিজম রপ্ত করতে।”

‘মৃগয়া’ দিয়েই মিঠুনের ফিল্মে প্রথম অভিষেক। নামের পাশ থেকে থেকে নকশাল ছাপ মুছে এক অভিনেতার জন্ম, অনেকটা যেন রত্নাকরের বাল্মিকী হবার পরিক্রমা। কালো পাথরে খোদাই করা দেহসৌষ্ঠব, তীক্ষ্ণ চোখ, ছোট ধুতি পরা অনাবৃত শরীরে মিঠুনের আবেদন চরম। সেসময় আর কোনও হিরোই অনাবৃত দেহে অমন যৌন আবেদন তুলতে পারেননি। সবার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন মিঠুন। মিঠুনের সেই খালি গায়ের সুযোগ পরে বলিউড নিয়েছিল। যেখানেই যেতেন জামা খুলতে বলত সিনেমার দৃশ্যে, অথচ সেখানে অভিনয়ের কিছু নেই। লড়াই করে সেসব অধ্যায়ও পার করেছেন মিঠুন। 

Mrigaya mithun

মৃগয়াতে মিঠুনের বিপরীতে ছিলেন মমতা শংকর। মমতা শংকরকে বালিকাবেলায় অনেকবার ছবিতে আসার অফার দেন মৃণাল সেন। মমতার বাবা উদয় শংকর ও মা অমলা শংকরের সঙ্গে পরিচয় ছিল মৃণাল সেনের। মৃণালের ছবিতে তার আগে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন মমতার দাদা আনন্দ শংকর। কিন্তু স্কুলে পড়াকালীন সময়ে মমতাকে ফিল্মে দিতে চাননি উদয় শংকর। তবে আশ্বস্ত করেছিলেন, মমতা প্রথম ছবি করলে মৃণাল সেনকেই বলবেন। কলেজে উঠতেই মমতা ফোনে মৃণাল সেনকে বলেন, তিনি আপাতত পড়াশোনার ভার কমিয়েছেন। মৃণাল সেন বলেন “একটা সাঁওতালের রোল করতে পারবে?” কালো রং মাখিয়ে মমতার লুক টেস্ট নেন মৃণাল সেন। এক শটেই ফাইনাল। কিন্তু মমতা তাঁর মৃণালদাকে বলেছিলেন “মেকআপে কালো রং আমি মাখব না। তাতে হাতের তালু কালো হয় না। আমি ভরা গ্রীষ্মে সারা গায়ে বোরোলীন মেখে গায়ের রং সত্যি কালো করব।” ভাবতেও পারেননি মৃণাল সেন মমতা এতখানি ডেডিকেশন দেখাবেন। সেভাবেই সাধনা করে কালো হন মমতা শংকর ‘মৃগয়ায় অভিনয়ের জন্য।

মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ হিন্দি ছবি দিয়েই মিঠুন-মমতা জুটির শুরু। কিন্তু পরবর্তী চার দশকে তাঁরা আর একসঙ্গে ছবি করেননি। মৃগয়ার জুটিকে ফেরানোর সাহস কেউ পায়নি। মিঠুন-মমতা শেষমেশ ফিরলেন ২০২২ সালে ‘প্রজাপতি’ ছবিতে ভালবাসার প্রজাপতি উড়িয়ে।

প্রথম ছবি ‘মৃগয়া’-তেই মিঠুন জিতে নেন সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে বছর মিঠুনকে সেরা অভিনেতার পুরস্কার দেয় রবীন্দ্র সদনে। সেই অনুষ্ঠানে সেরা শিশু অভিনেতার পুরস্কার পান অরিন্দম গাঙ্গুলি ‘হংসরাজ’ ছবির জন্য। দেশ ও রাজ্য দুয়েতেই পুরস্কৃত হন মিঠুন। রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলেও স্ট্রাগল কিন্তু কমলো না। তথাকথিত হিরোর রোলে তাঁর কালো পেশিবহুল চেহারা মিসফিট হয়ে পড়ছিল। কয়েকটা ছবি করতে করতে শেষমেশ এল ‘ডিস্কো ডান্সার’, যে ছবি থেকেই মিঠুনের হিরো হয়ে ওঠার জয়যাত্রা শুরু। বলিউডে ওয়েস্টার্ন ডান্সের ট্রেন্ডসেটার হলেন মিঠুন।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর দশ বছর পর ঋতুপর্ণ শুধুই কি সমকামের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর? 

কিন্তু অন্যধারার ছবির টানে বারবার বাংলায় ফিরে এসেছেন তিনি। কমলকুমার মজুমদারের কাহিনি অবলম্বনে ১৯৯২ তে ছবি বানালেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ‘তাহাদের কথা’। মিঠুন আবার বহুদিন পর ছকভাঙা আর্ট ফিল্মে। মিঠুনের চরিত্রের নাম শিবনাথ, যিনি একজন স্বদেশী। স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকা জেলার তাহেরপুরে ছিল শিবনাথের বাড়ি। সেখান থেকে সে ধরা পড়ে ১১ বছর জেল খেটেছে। সে উচ্চশিক্ষিত হয়েও টাকা উপার্জনে অক্ষম। এই ১১ বছরে দেশের ভূগোল পাল্টে গেছে। দেশভাগ হয়েছে। তার উদ্বাস্তু পরিবার এখন থাকে গড়শিমলা।

Mithun in National Award ceremony
জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে মিঠুন

জেল থেকে ফেরার পর শিবনাথের সঙ্গে নতুন বাসস্থানে দেখা হচ্ছে তাঁর স্ত্রী হেমাঙ্গিনী, মেয়ে অন্নপূর্ণা, ছেলে জ্যোতির। হেমাঙ্গিনীর চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার। হেমাঙ্গিনী স্বাধীনতা সংগ্রামীর বউ বলে দেশের সরকারের থেকে পঞ্চাশ টাকা ভাতা পায়। কিন্তু তাতে আর সংসার চলে না। ‘শিবনাথ’ মিঠুনের গায়ে কাঁটা দেওয়া সংলাপ “স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে জেল খাটলাম, সংসার ছাড়লাম, মারের চোটে আজও যখন তখন হাগা সামলাতে না পেরে যেখানে খুশি হয়ে যায়! স্বদেশি হওয়ার পুরস্কার মোটে পঞ্চাশ টাকার ভাতা!”

‘তাহাদের কথা’র শিবনাথ যেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জ্বলন্ত সমস্যা তুলে আনে। যে মানুষগুলো প্রাণপাত করল দেশের স্বাধীনতার জন্য, তারা অভাব, দারিদ্র্য আর রোগভোগ ছাড়া কী পেলেন! শিবনাথের মতো মানুষদের সব সংগ্রামই ব্যর্থ স্বাধীন ভারতে। সুবিধাভোগী মানুষদের ভিড়ে বাইরের পৃথিবীটাও তার কাছে জেলখানা। এমনকী ঘরেও শিবনাথের স্ত্রী তার অচেনা স্বামীর আদর চায় না। জেল-খাটা স্বামীকে সে ভয় পায়। শুধু শিবনাথের ছেলে জ্যোতি বাবাকে আদর্শ মানে। কিন্তু জেলেই যেন শিবনাথের মুক্তি। এ ছবির শেষটা বড় করুণ। শিবনাথ লুকে মিঠুন যেন এক অন্য মিঠুন। এই চরিত্রে অভিনয় করে আবার জাতীয় পুরস্কারে সেরা অভিনেতা হন মিঠুন।

Tahader_Katha

২০০৫ সালে আবার মিঠুনকে নিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তৈরি করলেন ‘কালপুরুষ’ ছবি। বাবা-ছেলের গল্প। রাহুল বসু ও মিঠুন চক্রবর্তী। কিন্তু বাবা ও ছেলের উপস্থিতি বাস্তব জীবনের থেকে মনজগতে বেশি। এই ছবিতে মিঠুনের সহ-অভিনেত্রী ছিলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। সুদীপ্তার থেকে শুনেছিলাম এই ছবির কিছু কথা। সুদীপ্তা চক্রবর্তী-র কথায় “মিঠুনদার সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য ছিল ‘কালপুরুষ’ ছবিতে, আর জানলা দিয়ে লাবণীদি (সরকার) দেখবেন। আমি ভীষণ ঘাবড়ে ছিলাম, কারণ জীবনে প্রথম মিঠুন চক্রবর্তীকে সামনে থেকে দেখছি। তার ওপর অত সাহসী দৃশ্য এবং সেটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিতে। সব মিলিয়ে আমি ঘাবড়ে ছিলাম। কিন্তু বুদ্ধবাবু খুব শান্ত হয়ে আমায় দিয়ে কাজটা করিয়ে নেন। উনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু আমি ভয় পেতাম ওঁর ব্যক্তিত্ব ও গাম্ভীর্যকে। কারণ ওই সময়ে ভারতবর্ষের সবথেকে বেশি স্বর্ণকমল যাঁর কাছে ছিল, তিনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বুদ্ধবাবু অন্য পরিচালকদের মতো অভিনয় করে দেখাতেন না। কী করতে হবে অভিনেতা অভিনেত্রীদের, সেটা উনি কখনওই নিজে করে দেখাতেন না। ছবির দৃশ্যায়নকে উনি বেশি গুরুত্ব দিতেন। ধরা যাক, আকাশ ওঁর নীল চাই, কিন্তু সেদিন যদি আকাশ ধূসর থাকে তবে উনি শ্যুট করবেন না। সে ক্যামেরার সামনে মিঠুন চক্রবর্তী থাক বা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত থাক। শট নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনও ওঁকে কম্প্রোমাইজ করতে দেখিনি।”

Kalpurush

দুটি বাংলা ছবিতে মিঠুনের অভিনয় বেশ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ছবি দুটি একেবারেই অনালোচিত। ‘চাকা’ এবং ‘ফেরারি ফৌজ’। ‘চাকা’ ছবিতে মিঠুনের নাম মানিক, এক বাউন্ডুলে লোক হঠাৎ বেশ্যাপল্লিতে ঢুকে পড়েন। সেখানেই ভালবাসা এক পতিতার (দেবশ্রী রায়) সঙ্গে। সেই লোকটি পতিতাটিকে নিষিদ্ধপল্লি থেকে বার করে এনে নতুন জীবন দেয়। শেষমেশ এই মেয়েটি কীভাবে মিঠুনের জীবনের অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় তাই দেখার। মিঠুনের রোলটি ছবিতে যত এগোতে থাকে, অভিনয়-দীপ্তি তত উন্মোচন হতে থাকে। রাজনৈতিক নেতা নেপাল দেব ভট্টাচার্য এই ছবি বানান। হল-মুক্তির আগেই ২০০০ সালের দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন টেলিভিশনে প্রিমিয়ার শো হয় ছবিটির। পরে বেশ কিছু হলে রিলিজ করলেও, ছবিটি চলেনি। দেখবার দর্শক ছিল না। 

উৎপল দত্তর বিখ্যাত কাহিনি নিয়ে প্রশান্ত বল ছবি করেছিলেন ‘ফেরারি ফৌজ’। লিড রোল অশোকের ভূমিকায় মিঠুন। সঙ্গে দেবশ্রী, ইন্দ্রাণী, সৌমিত্র, সব্যসাচী, লিলি— মাল্টিস্টারার ছবি। ছবির সংগীত-পরিচালক ছিলেন ভি বালসারা ও এডিটর দুলাল দত্ত। ২০০২ সালে মুক্তি পায়। সাফল্য পায়নি, কিন্তু মিঠুন অনবদ্য।

এতদিন অন্যধারার বাঙালি পরিচালকদের ছবিতে মিঠুন যতবার অভিনয় করেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাম্য রোলে অভিনয় করেছেন। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ‘তিতলি’ ছবিতে মিঠুনকে আনলেন একেবারে আধুনিক শহুরে মোড়কে। মিঠুন নিজেই নিজের চরিত্রে অভিনয় করছেন। ছবিতে তাঁর নাম রোহিত। যে মিঠুনের মতোই উত্তর কলকাতার অন্ধগলি থেকে বম্বে গিয়ে সুপারস্টার হয়েছে। এই রোহিতকে ঘিরেই মা ও মেয়ের গল্প। যেখানে একই পুরুষকে ভালবেসে মা মেয়ে দুজন দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক রোহিত আর মেয়ের ফ্যান্টাসির হিরো পর্দার রোহিত। মা ও মেয়ের ভূমিকায় ছিলেন অপর্ণা সেন ও তাঁর মেয়ে কঙ্কনা সেনশর্মা। মা-মেয়ের প্রতিযোগিতা এক সময় বিলীন হয়ে যায় যখন তাঁদের কাছে আসে রোহিতের বিয়ের খবর। 

এ ছবিতে ঋতুপর্ণ এমন ঝকঝকে সফিস্টিকেটেড লুক দিয়েছিলেন মিঠুনের, যা বাংলা ছবিতে আগে পাননি অভিনেতা। হয় মারদাঙ্গার গুন্ডা, নয়তো ডান্সার-প্রেমিক রোলে বারবার কাস্ট হতেন মিঠুন। কিন্তু তিতলির রোহিত একেবারেই অন্যধারার চরিত্র। এ প্রসঙ্গে, ছোট্ট গল্প আছে। মিঠুনের চুলের বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর কোনও জুলপি ছিল না। সেই মিঠুন-ছাঁট কত ছেলেই না রেখেছে যুগের পর যুগ। কিন্তু ঋতুপর্ণ চাইলেন তাঁর নায়ক রোহিতের জুলপি থাকবে। মিঠুন তো নিজের এতদিনের স্টাইল ছাড়তে নারাজ। কিছুতেই তিনি কানের পাশে বড় জুলপি রাখবেন না। শেষমেশ লুক টেস্টে যখন সবাই বলল ভালো লাগছে, তখন মিঠুন রাজি হলেন জুলপি রাখতে। ফলস জুলপিতেই মিঠুনের রূপ পাল্টে দিলেন ঋতুপর্ণ। ঋতুপর্ণ ওঁর বেশিরভাগ অভিনেতার কণ্ঠ ডাবিং করলেও মিঠুনের কণ্ঠ ডাবিং করেননি। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কারের তালিকাভুক্ত হয়েছিল মিঠুনের নাম। পুরস্কার না পেলেও এ ছবিতে মিঠুন সেরা। পাহাড়ি রাস্তার মাঝে কুয়াশার ভিতর দিয়ে হিরো রোহিত রায়ের এন্ট্রি আজও আইকনিক। 

এরপর বেশ কিছু বছর মিঠুন আবার মেনস্ট্রিম বাংলা ছবিতেই সুপারহিট দেন। বাঙালিবাবু, যুদ্ধ, এম এল এ ফাটাকেষ্টর মতো ছবি। এক দশক পর মিঠুন আবার অন্যধারার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন ‘শুকনো লঙ্কা’ ছবিতে। শুকনো লঙ্কা ফোড়ন সব রান্নায় লাগে, কিন্তু তার একক উপস্থিতির কোনও দাম নেই। ঠিক সেরকমই সিনেমার জুনিয়র আর্টিস্টরা। কিছুটা তুলসী চক্রবর্তী-র জীবনকে কেন্দ্র করে ছিল ছবিটি। ‘পরশপাথর’ ছবিতে লিড রোল পেয়ে তুলসী চক্রবর্তী যেমন নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি, ঠিক সেইরকম এক চরিত্র ছিল মিঠুনের, চিনু নন্দী। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অঙ্গনা বসু। সঙ্গে সব্যসাচী, দেবশ্রী। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শুকনো লঙ্কা’ পরিচালক গৌরব পান্ডের হিট ছবি ছিল। মিঠুনের অভিনয় বিপুল প্রশংসিত হয়। তিনি যে কত বড় অভিনেতা আরও একবার প্রমাণ করে দেন মিঠুন। 

Shukno Lanka Poster

শেষ করব মিঠুনের অভিনয় সমৃদ্ধ আরেকটি ছবির কথা বলে‘নোবেল চোর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি গেল। খোঁজ… খোঁজ… আলোড়ন উঠল চারদিকে। যদিও নোবেল আর মিলল না। সেই রাজনৈতিক দোলাচলকেই কেন্দ্র করেই ২০১২ সালে সুমন ঘোষ তৈরি করেন ‘নোবেল চোর’ ছবি। ভানু এক গ্রাম্য অশিক্ষিত মানুষ যে এই নোবেল চুরির ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর হাত এসে পড়ে নোবেল। সকালবেলা সেই দরিদ্র কৃষক ভানু নিজের বাড়ির কুয়োর পাশে সোনার মতো চকচকে একটি বস্তু কুড়িয়ে পায়। জিনিসটা কী, এটা ভানু ও তার স্ত্রীর বোধগম্যতার বাইরে। তাই এর পরিচয় জানতে ভানু ছুটে যায় গ্রামের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। যে চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মাস্টারমশাই নিশ্চিত করেন, এটি কবিগুরুর হারিয়ে যাওয়া নোবেল পদক। ভানু নিজের সংসারের হাল ফেরাতে নোবেল শহরে গিয়ে বেচতে চায়। নোবেল কী জিনিস, তা সে জানে না। শহরে এসে একের পর এক ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে গোবেচারা লোকটা। মিঠুনের ব্যতিক্রমী ছবির তালিকায় ‘নোবেল চোর’ থাকবেই। 

তবে এ কথা ঠিক, মিঠুন চক্রবর্তী যে মাপের অভিনেতা তাঁকে নিয়ে সেই মাপের আরও পরীক্ষামূলক চরিত্র করানো যেত। নকশাল আন্দোলনের ভিতর মিঠুনের কেরিয়ার শুরু বলেই যেন বারবার ছবিতে নকশাল চরিত্রেই তাঁকে কাস্ট করা হয়েছে। নকশাল ইমেজ ছেড়ে মিঠুন কমই বেরতে পেরেছেন অন্যধারার ফিল্মে।

 

 

 

*তথ্যঋণ- মৃণাল সেনের বিবিধ সাক্ষাৎকার 

*ছবি সৌজন্য- লেখক, Wikipedia, Facebook, Youtube,

Author Subhadip Bandyopadhyay

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।

Picture of শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।
Picture of শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com