(Sky Lanterns)
উৎসবকে আলাদা পর্যায়ে নিয়ে যেতে ফানুসের বিকল্প নেই। অনেকেই বলে ফানুসে নিজের মনের ইচ্ছা লিখে উড়িয়ে দিলে, সেই ইচ্ছা পূরণ হয়। ‘আকাশ লণ্ঠন’, নামটি একটি চীনা শব্দের অনুবাদ, কিন্তু এটিকে ‘আকাশ মোমবাতি’ বা ‘অগ্নি বেলুন’ নামেও উল্লেখ করা হয়। আর বৌদ্ধ পরিভাষায় এর নাম হল, ‘আকাশ-প্রদীপ’। কথিতও আছে, “গৌতম বুদ্ধ অর্থাৎ রাজকুমার সিদ্ধার্থ, জাগতিক সকল দুঃখ মুক্তি লাভের আশায় রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ-বিলাস, ধনকুম্ভ সব ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ করেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। রাজ-আবরণ ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সন্ন্যাস-ব্রত গ্রহণ করার পর ভাবলেন, ‘আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয় বাহারি চুল আমার কি প্রয়োজন?” (Sky Lanterns)
আরও পড়ুন: দাস বাড়ির ১৫ দিন ব্যাপী দুর্গা পুজো
যেমন ভাবা তেমন কাজ, সঙ্গে সঙ্গে ধারালো তরবারি দিয়ে চুলের গোছা কেটে নিয়ে মনে মনে সংকল্প করলেন, ‘যদি বুদ্ধ হওয়ার মতো সকল গুণ আমার মধ্যে থাকে তাহলে ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষিপ্ত চুলের গোছা মাটিতে না পড়ে আকাশে স্থিত থাকুক।’ এই সংকল্প করে তিনি চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, একটি চুলও মাটিতে পড়ল না। (Sky Lanterns)

বৌদ্ধধর্ম মতে, স্বর্গের ইন্দ্ররাজা চুলগুলো হীরা, মণি, মানিক্যখচিত স্বর্ণপাত্রে ধারণ করে তাবতিংস স্বর্গে উক্ত কেশ-ধাতু স্থাপন-পূর্বক একটি চৈত্য নির্মাণ করেন এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় ‘চুলামনি চৈত্য’। স্বর্গের দেবতারা এখনও এর পূজা করেন। (Sky Lanterns)

কিন্তু পৃথিবীর বুদ্ধভক্ত পূজারীরা তো আর পূজার জন্য স্বর্গে যেতে পারেন না। তাই তারা পরম শ্রদ্ধায় কাগজের ফানুস তৈরি করে একটি বিশেষ দিনে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশ্যে আকাশ-প্রদীপ হিসেবে ফানুস উড়িয়ে থাকেন। ধর্মীয় গাথা বা মন্ত্রপাঠ করে খালি পায়ে বৌদ্ধরা ফানুস উড়িয়ে দেন। (Sky Lanterns)
“মিত্র বাড়ি, ছাতু বাবুর বাড়ি এবং উত্তর কলকাতার শিমলা স্ট্রিট অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ি থেকেও ফানুস ওড়ানো হত, শোনা যায় এক সাথে ২০টিরও বেশি ফানুস এক সাথে উত্তর কলকাতার আকাশে ছেয়ে যেত।”
কলকাতার ফানুসের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই লিখিত রেকর্ড রয়েছে। কিছু মৌখিক রেকর্ড অনুসারে, ১৯১০-এর দশকে উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ার ‘দে’দের দ্বারা কলকাতায় ফানুস ওড়ানোর প্রচলন শুরু হয়েছিল। এটি ছিল স্কটিশচার্চ কলেজের গণিতের অধ্যাপক গৌরী শঙ্কর দে-এর উদ্যোগে। (Sky Lanterns)

এছাড়াও মিত্র বাড়ি, ছাতু বাবুর বাড়ি এবং উত্তর কলকাতার শিমলা স্ট্রিট অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ি থেকেও ফানুস ওড়ানো হত, শোনা যায় এক সাথে ২০টিরও বেশি ফানুস এক সাথে উত্তর কলকাতার আকাশে ছেয়ে যেত। অভিজাত পরিবারগুলি একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফানুস তৈরি করার জন্য, যা জনসাধারণের দ্বারা প্রশংসিত হত। এটি ছিল একটি ব্যয়বহুল শখ যা কেবল ধনী শ্রেণীর লোকেরাই অবসর বিনোদনের জন্য বহন করতে পারত। ফানুস তৈরি করা একটি কঠিন কাজ ছিল, যার জন্য উজ্জ্বল কারিগরি এবং চমৎকার নান্দনিক বোধের প্রয়োজন ছিল। (Sky Lanterns)

বছরের পর বছর ধরে, ফানুস তৈরির শিল্প বিকশিত হয়েছে, কারিগররা বিভিন্ন আকার এবং ফ্রেম তৈরিতে তাঁদের দক্ষতা নিখুঁত করেছেন। প্রচলিত বেলুনের আকৃতি ছাড়াও, ফানুস তৈরি করা হত কলস, তারা, ফুটবল, হাঁস, কেটলি এমনকি শনি গ্রহের আকৃতিতেও। ধীরে ধীরে, বেশিরভাগ ধনী বনেদি পরিবার বিনোদনের অন্যান্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করে এবং ফানুস সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে। (Sky Lanterns)

মূলত কালীপূজোর দিন দুপুরে নিজেদের হাতে তৈরি ফানুস ওড়ানোর রীতি আজও উত্তর কলকাতা অঞ্চলের গুটিকয়েক বাড়িতে চালু আছে। তেমনই একজন হলেন, গোয়াবাগানের প্রদ্যোতকুমার মল্লিক, যিনি পিকে মল্লিক নামেই বেশি পরিচিত। প্রদ্যোতকুমার মল্লিক এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। শহরে ফানুস তৈরির ম্লান শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন বিগত ৬৫ বছর ধরে। (Sky Lanterns)

ফানুস করা বেশ পরিশ্রমের কাজ, ফানুস তৈরি করতে করতেই প্রদ্যোতকুমার মল্লিক জানালেন কীভাবে আর কীকী উপকরণ লাগে ফানুস তৈরি করতে। ফানুসের জন্য ব্যবহৃত কাগজ মূলত ঘুড়ি তৈরির কাগজ, কলকাতার চিনে বাজারেই মূলত পাওয়া যায়, ১২ থেকে ১৪ রকমের রঙের কাগজ হয়। (Sky Lanterns)
কিছু ফানুসের ডিজাইন করতে ফর্মা যেমন ব্যাবহার হয় আবার কিছু ফানুসের জন্য নিজস্ব ভাবনা থাকে। ফানুস তৈরিতে বিজ্ঞানের ভূমিকা অস্বীকার করলে কিন্তু ফানুস উড়তে পারবে না তাই, ইউনিফ্রম সেপে তৈরি করাও আরেক চ্যালেঞ্জ। ফর্মা দিয়েই হোক বাঁ নিজের মনের ভাবনাকে ইউনিফ্রম সেপে তৈরি করা এবং বিভিন্ন আকারে জোড়ার জন্য আঠা ব্যবহার করে তারপর ফানুসের নিচের অংশে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করা বেড়কে যুক্ত করা হয়। এই ক্ষেত্রেও ফানুসের মাপের সঙ্গে বেড়ের মাপের সামঞ্জস্য রাখা হয়। (Sky Lanterns)

এরপরে ওই বেড়ের সাথে কোনাকুনি দুটি তার বাঁধা হয়। এই তার দুটির মধ্যভাগেই বাধা হয় স্পিরিট দিয়ে ভেজা ন্যাকড়ার বল স্থানীয়ভাবে লুটি বা নুটি নামে পরিচিত। ওড়ানোর ঠিক আগে প্রথমে হাত মশাল জ্বালিয়ে ফানুসের ভিতরে গরম বাতাস দেওয়া হয়। স্পিরিট দিয়ে ভেজা লুটি ফানুসের গোড়ার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তাতে অগ্নিসংযোগ করে ধীরে ধীরে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ফানুস বা কাগজের তৈরি বেলুন যা গরম বাতাসের বেলুনের মতো একই নীতিতে কাজ করে। (Sky Lanterns)

নতুন প্রজন্ম ফানুস তৈরি এবং ওড়ার হারিয়ে যেতে চলা শিল্প শিখতে সেইভাবে আগ্রহী নয়, তবু তিনি বিনা পারিশ্রমিকেই নতুন প্রজন্মকে উত্তর কলকাতার এই ঐতিহ্য বাচিঁয়ে রাখতে আগ্রহীদের শিখিয়ে রাখতে চান। কিছু তরুণ প্রদ্যোতকুমার মল্লিকের কাছে ফানুস তৈরি শিখতে আসে এবং তাঁরা এখন ওঁর সঙ্গেই নিজেদের তৈরি ফানুস ওড়ায়। মল্লিক বাবুর হাতে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ফানুস দেখতে হলে আগামী ২০ অক্টোবর আপনারাও চলে আসতেই পারেন গোয়াবাগান স্ট্রিটের ধর ভিলা’য় দুপুর ২.৩০ নাগাদ। (Sky Lanterns)
ছবি ঋণ: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
নেশা ও পেশা ফটোগ্রাফি। ডকুমেন্টারি স্টোরি টেলিং, স্ট্রিট ও ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী।