(Putulnacher Itikatha)
পুতুলনাচের ইতিকথা নিয়ে ইতিমধ্যে সমাজমাধ্যমে নানা আলোচনা জারি। খারাপ সমালোচনার থেকে প্রশংসাই বেশি। সাহিত্য নির্ভর, বলা ভাল, ধ্রপদী সাহিত্য নির্ভর ছবি বাংলা সিনেমায় অনেকদিন পর। তাই কি এই অভাবনীয় প্রশংসা ছবিটির? কারণ ভাল সাহিত্যবিহীন রক্তাল্পতায় সিনেমা ভুগছে অনেকদিন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা নিঃসন্দেহে সেখানে ব্যতিক্রম। (Putulnacher Itikatha)
সপ্তাহান্তে যেদিন গেলাম ছবিটি দেখতে, প্রায় ভর্তি ছিল সিনেপ্লেক্স। ভাবছিলাম, গাওদিয়া গ্রামের শশী ডাক্তারকে দেখতে এত উন্মুখ কেন আজকের বাঙালি! তাঁদের ধর্ম না থাকলেও নেটফ্লিক্স আছে! এমন নয়, যে সুমন মুখোপাধ্যায় প্রতি বছর নিয়ম করে ছবি করেন, এমনও নয় যে বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানেও তাঁকে নিয়মিত দেখা যায়! তবু তাঁর ছবিতে কুসুম, মতি, কুমুদ, শশীদের জন্য কেন এত উত্তেজনা! (Putulnacher Itikatha)
‘শরীর শরীর তোমার কি মন নাই কুসুম!’ পুতুলনাচের ইতিকথা বললেই বাঙালি আজও অনায়াসে বলে ফেলে এই লাইনটি। এক রকম, প্রবাদই হয়ে উঠেছে এই লাইন। (Putulnacher Itikatha)

পরিচালক, সুমন মুখোপাধ্যায়ের দৃশ্যভাষা বরাবরই আধুনিক। সে বিসর্জনের কালী ঠাকুরের পা-হোক বা তিস্তাপারের দড়ির নদী! তাই, কুসুমের প্রবাদ হয়ে ওঠা এই লাইন কীভাবে পর্দায় দেখব, তা নিয়ে কৌতুহল ছিল বিস্তর। কামনাজর্জর নারীদের সুমন, পর্দায় বা মঞ্চে এনেছেন বারবার। চতুরঙ্গর দামিনীর সাদা বসনের অন্তরের দাউদাউ কামনা শচীশ বোঝেনি। কুমুসের জ্বলন্ত কামনাও যেমন বুঝতে পারছেন না আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত চিকিৎসক শশী। কাজেই কুসুম পানাপুকুরে ধীরে ধীরে বিসর্জন মেনে নিচ্ছেন… কাব্যিক এই মুহূর্ত সিনেমার ফ্রেমে যেভাবে ধরেছেন সুমন ও তাঁর চিত্রগ্রাহক, তার তুলনা নেই… (Putulnacher Itikatha)
“যাদব পণ্ডিতের বাড়ি, সূর্যোদয় দেখার টিলা, তালবন, গ্রামের খাল, বজ্রাহত হারু ঘোষের শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময়ের হরিবোল ধ্বনি… সবকিছুই যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে।”
উপন্যাসের নানা মুহূর্তই সিনেমার ফ্রেমে ফিরে ফিরে এসেছে কাব্যিক ব্যঞ্জনায়। চিত্রগ্রাহক সায়ক ভট্টাচার্যর জবাব নেই। যাদব পণ্ডিতের বাড়ি, সূর্যোদয় দেখার টিলা, তালবন, গ্রামের খাল, বজ্রাহত হারু ঘোষের শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময়ের হরিবোল ধ্বনি… সবকিছুই যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে। শুধু টিলার ওপরের শিয়ালটি সুমনের সংযোজন। কেন এই উপন্যাসেরনের চলচ্চিত্রায়ণ আজ এত জরুরি? উত্তরে পরিচালক বলেছেন বারেবারেই, সমকালের সাংস্কৃতিক ব্যংরাপ্সিকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তিনি, এই উপন্যাসের আধারে। এই শেয়াল হয়তো বা সেই ব্যাংকরাপ্সিরই আরেক প্রকাশ… উপন্যাসে যা শুধুই টিলা থেকে সূর্যোদয় না দেখার মুহূর্ত ছিল। (Putulnacher Itikatha)

গোটা সিনেমাটিই দেখতে একটু আবছায়ায় ভরা লাগে। উপন্যাসের অনুসঙ্গে এই আঁধারই দরকার ছিল। কারণ শশী যে অন্ধকারে লড়ছে, যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গাওদিয়া গ্রামবাসীদের সামনে যাদব পণ্ডিতের আফিম খেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাকেও তাঁর চেপে যেতে হয় ভয়ে, ইতিহাসজুড়ে গ্যালিলিও থেকে গণশত্রু ছবির সেই চিকিৎসক- যাঁদেরকে বারেবারে এইভাবে সত্য আড়াল করতে বাধ্য করা হয়েছে, মনে পড়ে যায় তাঁদের সবাইকেই। সেন দিদির পাথরের চোখ যেন-বা সব দেখে যায় নীরবে। খাল পেরিয়ে একে একে কুমুদরা চলে যায় আধুনিকতার দুনিয়ায়। শশীর নিয়তি তাঁকে এই যুক্তিহীন দুনিয়া পেরিয়ে কিছুতে এগোতে দেয় না, এগোলেও পিছু টানে বারবার নানান ভাবে। আজকের এই ঘাঁটা-অন্ত:সারশুন্য-বোধহীন সমাজের সঙ্গে এই সমাজের মিলও তাই বিস্তর। (Putulnacher Itikatha)
“এমন একটা সময়ে এ ছবি নির্মিত হল, যখন বাংলা ছবি নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা হারিয়েছে। বিশেষত, যখন অন্য ধারার ছবি প্রায় হয় না বললেই চলে।”
চিত্রগ্রহণের কথা আগেই বলেছি। এ ছবির চিত্রগ্রহণ আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। প্রত্যেকটা ফ্রেমই যেন উপন্যাসের পাতা থেকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে। তাই সাধুবাদ পাবেন সায়ক ভট্টাচার্য। চিত্রকলার দীর্ঘ অধ্যায়ন ছাড়া এ কাজ সম্ভব ছিল না। মূল চরিত্রে শশী ও জয়া এহসান অনবদ্য। কুমুদ, মতি প্রমুখ চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভাল লাগে। আবহ ও সম্পাদনাতেও প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তিন্নি মিত্র যথারীতি তাঁদের স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন। (Putulnacher Itikatha)

এমন একটা সময়ে এ ছবি নির্মিত হল, যখন বাংলা ছবি নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা হারিয়েছে। বিশেষত, যখন অন্য ধারার ছবি প্রায় হয় না বললেই চলে। মঞ্চে সুমন বারবার তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখেছেন। এবারে এক ব্যতিক্রমী, সাংস্কৃতিক ভাবে অসুস্থ এবং শূন্য সময়ে সাহিত্য ও সিনেমার তুলনামূলক ভাষ্যে আরও একটি নজির রাখলেন তিনি এই ছবিতে। এটি তাঁর সিনেমাযাত্রাকেও অনন্যতা দিল। সুমন আপনি সেলাম নিন। (Putulnacher Itikatha)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- আন্তর্জাল
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।