Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: হঠাৎ দেখা – বিদ্যুৎ দে

বিদ্যুৎ দে

এপ্রিল ২১, ২০২৪

story by bidyut dey
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

রাতের ট্রেনে চলেছি ভ্রমণে। একলাই। পছন্দসই সাইড লোয়ার বার্থে আরাম করে শুয়ে পড়েছি। খোলা জানলায় হুহু হাওয়া। কাস্তের মতো মাখনরাঙা চাঁদটা পাল্লা দিয়ে ছুটছে সমান গতিতে। কখনও কখনও গাছপালার আড়ালে, কখনও আবার মাথার ওপর দিয়ে হাপিস হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার মাঠের মধ্যে অপ্রাকৃতিক সব ছায়া দেখছিলাম বিভোর হয়ে। স্লিপার ক্লাসের অন্যরা সবাই ঘুমে অচৈতন্য।

আপার বার্থ থেকে একজন বয়স্ক মানুষ নেমে এলেন। হাতে পুরনো আমলের স্টিলের এভারেডি টর্চ। চলে যাচ্ছেন বাথরুমের দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার! ইনি কখন এলেন, কখনই বা আপারে উঠলেন খেয়ালই করিনি। হবে হয়ত, নিজের ভাবনায় বিভোর ছিলাম তাই। চমকে উঠলাম এক শিশুর চিল চিৎকারে। ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠার মত। ওর মা চাপড়াতে চাপড়াতে বলে- 

-কিছু না মানা, কিছু না। স্বপ্ন দেখছিলি। এই তো আমি আছি সোনা। ঘুমো ঘুমো।

বাচ্চাটা চুপ করে গেল। একটু বাদে আবার কঁকিয়ে ওঠে। দেখি টর্চের আলোর বৃত্তটা মেঝে বরাবর এদিকেই এগিয়ে আসছে। ভদ্রলোক ওপরে উঠতে গিয়ে কি মনে করে নিচু হয়ে আমায় ফিসফিস করে বললেন-
-কি ঘুম আসছে না বুঝি? অন্ধকারের শোভা দেখছেন তো। ভালো ভালো। আমারও ঘুম আসছে না ভাই। একটু বসি?

পা সরিয়ে ওঁকে বসার যায়গা দিয়ে বলি- বসুন, পা তুলে আরাম করে বসুন। 

ভদ্রলোক বাবু হয়ে পিছনে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন মুখোমুখি। ঠিক তখনি একটা টানেলে ট্রেনটা ঢুকে পড়ল গুম গুম শব্দে।
-কোথায়? অরণ্য ভ্রমণে। একলাই? বাঃ বাঃ ভালো ভালো খুব ভালো। খুব ঘুরে বেড়ান বুঝি? এই একা ঘোরার মত আনন্দ আর কিছুতে হয় না। আমি বলি –
-আপনিও কি একলা? বনভ্রমণে?
-বনে জঙ্গলেই তো সারাটা লাইফ কেটে গেল। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসর নিয়েছি বছর সাত আট হবে।
উৎসাহে আমার চোখ চকচক করে ওঠে। আমার আক্ষেপ নানা পেশার নানা বন্ধু বান্ধবের মধ্যে একজনও বন দপ্তরের বন্ধু জোটেনি আমার কপালে। তেমন কেউ থাকলে অজানা অচেনা বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো যেত। বিশেষত, যেসব অরণ্য সাধারণের নাগালের বাইরে। নড়ে চড়ে কোলে বালিস নিয়ে সোৎসাহে বলি –
-চাকরি জীবনে তেমন কিছু রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা থাকলে বলুন না।
– বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। তবু বলি?
– হ্যাঁ হ্যাঁ মন খুলে বলুন।

আপার বার্থ থেকে একজন বয়স্ক মানুষ নেমে এলেন। হাতে পুরনো আমলের স্টিলের এভারেডি টর্চ। চলে যাচ্ছেন বাথরুমের দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার ইনি কখন এলেন, কখনই বা আপারে উঠলেন খেয়ালই করিনি। হবে হয়ত নিজের ভাবনায় বিভোর ছিলাম তাই। চমকে উঠলাম এক শিশুর চিল চিৎকারে। ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠার মত। ওর মা চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, “কিছু না মানা কিছু না। স্বপ্ন দেখছিলি। এইতো আমি আছি সোনা। ঘুমো ঘুমো।" বাচ্চাটা চুপ করে গেল। একটু বাদে আবার কঁকিয়ে ওঠে। দেখি টর্চের আলোর বৃত্তটা মেঝে বরাবর এদিকেই এগিয়ে আসছে।

ভদ্রলোক উদাস নজরে জনলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। একটা নিঝুঃম শুনশান স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা টিমটিমে বাতির আলো ওঁর মুখের ওপর দিয়ে পিছলে যায়। দেখি টিকালো নাক, কর্মঠ মুখমণ্ডলে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পুরু ঠোঁট, শক্ত চোয়াল, চোখ দুটো উঁচু হয়ে বাইরে ঠেলে এসেছে। অসম্ভব চকচকে দৃষ্টি। গম্ভীর স্বরে বলতে থাকেন –

– ডিপার্টমেন্টে ডাকাবুকো বলে আমার সুনাম ছিল। চোর-ডাকাত, জানোয়ার, অফিসার কাউকেই রেয়াত করতাম না। ফিল্ডওয়ার্ক আমায় বেশি টানত। কর্মসূত্রে অনেক অরণ্যে ঘুরেছি, বহু বনবাংলোতে রাত কাটিয়েছি। কিন্তু একটা বাংলোর অভিজ্ঞতা আমার সাহসে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল। নামটা আমি বলব না। আজ সেখানে পাকা রাস্তা হয়েছে, ট্যুরিষ্টদের বিলাসবহুল নতুন বাংলো হয়েছে । জানি না আর সেই ব্রিটিশ আমলের কাঠের পোড়ো বাংলোটা টিঁকে আছে কিনা।

ghost story bidyut dey
কিন্তু একটা বাংলোর অভিজ্ঞতা আমার সাহসে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল।

তখন আমার বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ হবে। সার্ভের কাজে প্রায় বিশ কিমি হেঁটে সেই বাংলোতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। বেয়ারা আর আদিবাসী চৌকিদার দুজনে মিলে কাঠের আঁচে ঝপাঝপ খাবার বানিয়ে ফেলল। আমার সঙ্গী বিশু উসখুস করে। ওর চঞ্চলতা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না হাঁড়িয়ার নেশা চাগাড় দিয়েছে। চৌকিদার মংলুকে বলি, ওর জন্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। মংলুদের গ্রাম প্রায় পাঁচ কিমি দূরে। সেখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই রাতে গিয়ে আবার ফেরা অসম্ভব। তাই ওদের দুজনকেই চলে যেতে বলি গ্রামে। আমি একাই বেশ এনজয় করব রাতটা। মংলু অদ্ভুত নজরে আমায় দেখে বার বার। যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। দুহাত কচলে কাঁচুমাচু হয়ে যা বলে, তাতে বুঝি ও আমায় বাইরে বেরতে বারণ করছে। আর রাতে যেন কোনও কারণেই আর দরজা না খুলি। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে আরও কাঠকুটো রেখে যায়। পাতকুয়ো থেকে পর্যাপ্ত জল তুলে রাখে চানঘরে। জলের জগও ভর্তি করে দেয় কাঁচের গেলাসসহ, যাতে রাত্রে আর কোনও কারণেই আমায় বাইরে না যেতে হয়। যাওতার আগে বলে- বাবু দোরটা এঁটে নিন। 

গ্রামের মানুষদের ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, কুসংস্কার এসব আকছার দেখেছি। ওকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। যেতে গিয়েও মংলু বলে যায়- আমার কথাটা রাখেন। দোর না দিয়ে শোবেননিকো।

বলে হ্যারিকেনটা সেন্টার টেবিলে রেখে ওরা চলে গেল।

আমি আপিসের কাজ নিয়ে বসে পড়ি। একমনে কাজ করতে করতে ঘণ্টা দেড়েক পার হয়ে যায়। যত রাত বাড়ে, অরণ্য ততই জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। নানান শব্দ ভেসে আসতে থাকে। এসব আমি খুব উপভোগ করি। নতুন নতুন শব্দের কারণ বোঝার চেষ্টা করি। বনের সাথে এ আমার এক খেলা, নেশার মত। কানে এল দূরে একটা ঝরনার আওয়াজ, যেন পাথরের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাটা মংলু তো বলেনি এটার কথা। হয়ত হুড়োহুড়িতে ভুলে গেছে। অবশ্য আমিও শুধোইনি। গায়ে চাদরটা জড়িয়ে গাদা বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। জ্যোৎস্নায় থই থই করছে বানভাসির মত। কদিন আগেই পূর্ণিমা পার হয়েছে। কাজের চাপে আর চাঁদের হিসেব রাখা হয়ে ওঠেনি। কান খাড়া করে ঝরনার দিকটা বোঝার চেষ্টা করি। ডাইনে বাঁয়ে কাছে দূরে ছোট বড় টিলা। একবার মনে হচ্ছে ডানদিকের টিলার ওপারে। পরক্ষণেই সামনের খাদের নিচে। ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। যেখানেই হোক এই দুধসাদা আলোতে খুঁজতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। আর এমন আলোতে ঝরঝর ঝরনার রূপ, নিশিডাকের রোমাঞ্চ রক্তের স্রোতে।

কয়েক কদম এগিয়েছি কী এগোইনি, হঠাৎ এলোমেলো বাতাস বয়ে গেল গ্রীষ্মের দুপুরে ছোট্ট ঘূর্ণির মত। ঝরনা চুপ করে গেছে, সমস্ত নৈস্বর্গিক শব্দ থমকে গেল কোন এক মন্ত্রবলে। শরীরে শিরশিরানি অনুভব করি। পা দুটো কাঁপছে কেন? আমি কি ভয় পেয়েছি? নাঃ একটুও না। অনেক সময় হিংস্র শ্বাপদ কাছাকাছি এলে এমনটা হয়। কিন্তু তখন একটা উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়। তেমন কোনও গন্ধও তো পাচ্ছি না। মনে পড়ল মংলুর বার বার সাবধান করে যাবার কথা। সেটাই কি তবে মনের অবচেতন থেকে আমাকে প্রভাবিত করছে? লোকাল লোকেদের মান্য করে অনেক বিপদ এড়িয়ে যেতে পেরেছি বহুবার। সেই অভিজ্ঞতা আমায় ঘরের ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সত্যি বলছি, আমি কিন্তু একটুও ভয় পাইনি।

ঘরের দরজা বন্ধ করতে যেতেই আবার সেই রকম বাতাসের স্রোত। কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ল ঘরের ভেতরে। দরজার খিল এঁটে হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে চৌকিতে ওঠার সময় পায়ের নিচে একটা শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে উঠল। হাতে তুলে দেখি, তার একটা পিঠ লাল অন্য দিকটা খয়েরি। কোন গাছের বুঝতে পারলাম না। পরে স্টাডি করা যাবে ভেবে দোমড়ানো পাতাটা পার্সোনাল ডায়েরির পাতার ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলাম।

ghost story by bidyut dey
কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ল ঘরের ভেতরে।

যত রাত গড়ায় জঙ্গলে তত ঠান্ডা বাড়ে। তাই কম্বল্টা গায়ের ওপর ফেলে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তি হুড়মুড় করে হড়পা বানের মত আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল নিদ্রার অন্ধকারে।

রাত তখন কত গভীর জানি না। টিনের চালে বৃষ্টির ধারাপাতে ঘুম আলতো হয়ে এসেছে। কেমন গুমোট ভাব। জানলা দরজা সব বন্ধ। ফায়ার প্লেসের আগুনটা নিভিয়ে নিলে ভাল হয় ভেবে দেখি, ফায়ার প্লেসের সামনে কার্পেটের মেঝেতে তিনজন বসে আছে মুখোমুখি গুটিসুটি হয়ে। আগুনের দিকে পিঠ দিয়ে একটি মেয়ে। ভিজে খোলা চুল ছড়ানো পিঠের ওপর। গায়ে বাটিকের পাতলা চাদর। তার সামনে মুখোমুখি দুটি ছেলে। তিনজনই সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। নিচু স্বরে ফিসফিস করে গল্প করছে ওরা। কান খাড়া করে কী বলছে শোনার চেষ্টা করি। ভেসে আসা টুকরো কথা জুড়ে বুঝতে পারি অ্যাডভেঞ্চারে এসে পথ হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে না জানিয়ে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘুম ভাঙ্গাতে চায়নি বা পারেনি। যাতে আমার অসুবিধা না হয় তাই নিচু স্বরে কথা বলছে। কিন্তু ওরা এ ঘরে এল কী করে? আমি তো ঠিকঠাক দরজা বন্ধ করেছিলাম। তবে কি জানলা টপকে? নাঃ সাবধানী মংলু প্রত্যেকটা জানলা বন্ধ করেছে। হবে হয়ত কোন একটা আলগা ছিল। কিন্তু যাওয়ার আগে শেষবারের মত মংলু সব জানলা টেনে টেনে দেখছিল। তবে হয়ত চানঘরের বাইরের দিকের দরজাটা মংলু খেয়াল করেনি। থাক না ওরা ওদের মত। আমার তো কোন ক্ষতি করছে না ওরা। এই তো বয়স আনন্দ করার। কোনও অসংযম বা অসভ্যতার আভাস নেই ওদের আচরণে। বেশ ভালো লাগে। আমিও যেন ওদের বয়সি হয়ে মনে মনে সামিল হয়ে পড়ি এই নৈশ উপভোগে।

ঘরের দরজা বন্ধ করতে যেতেই আবার সেই রকম বাতাসের স্রোত। কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ল ঘরের ভেতরে। দরজার খিল এঁটে হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে চৌকিতে ওঠার সময় পায়ের নিচে একটা শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে উঠল। হাতে তুলে দেখি তার একটা পিঠ লাল অন্য দিকটা খয়েরি। কোন গাছের বুঝতে পারলাম না। পরে স্টাডি করা যাবে ভেবে দোমড়ানো পাতাটা পার্সোনাল ডায়েরির পাতার ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলাম।

কিন্তু একটি ছেলে বলে- তুই তো ঠাণ্ডায় কাঁপছিস তুলি। কম্বলটা এনে দিই।

তুলি, এই নামটা তীরের মত ধেয়ে এল আমার দিকে। তুলি বলে-

-যদি ঘুম ভেঙে যায়। থাক না।

তুলি, তুলি, তুলি এই নামটা আমায় নিয়ে চলল সেই পুরনো সময়ে। তখন সবে কলেজের ফাইনাল দিয়েছি। চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছি যত্রতত্র। হাতখরচের জন্যে টিউশানি করছি। তারই একজন তুলি। ক্লাস এইটের ছাত্রী। অঙ্ক করাই। ফুটফুটে লাবণ্যময়ী। বর্ণ কাঠগোলাপের মত। নিষ্পাপ সরল মুখমণ্ডল, লম্বা পাতলা চেহারা, বেশ চুপচাপ। কিন্তু ভেতরে একটা চাপা তেজের আঁচ আছে। সেটা বুঝলাম যেদিন বলল-

-তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে পড়াবে না। ব্যাস, এ নিয়ে আর কোনও কথা নয়।

ক’দিন পর পুজো। তুলির মা ডেকে বলল-

-বাবা তুলির দেখছি পড়াশোনায় বেশ মন এসেছে। প্রতি পুজোতে তো আমাদের সবাইকে দেশে যেতে হয়, পারিবারিক পুজো বলে কথা। কিন্তু ও যে কিছুতেই যেতে চাইছে না। বলছে, পড়ার ক্ষতি হবে। এই ছুটিতে ও অঙ্কটা এগিয়ে নেবে। বুঝতেই তো পারছো, একলা মেয়েটাকে রেখে কী ভরসায় যাই বল তো। অনেক বুঝিয়েছি। ওর ওই এক গোঁ। তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে? যদি না মানে তবে বোলো পুজোর ক’দিন তুমি পড়াতে পারবে না। তাহলে তো আর দেশে যাবার আপত্তির কারণ থাকবে না।

ghost story by bidyut dey
ফায়ার প্লেসের সামনে কার্পেটের মেঝেতে তিনজন বসে আছে মুখোমুখি গুটিসুটি হয়ে

আমি বুঝতে পারি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সে গন্ধে মজার আগে সরে পড়া ভাল। কারণ আগে আমার কেরিয়ার। আমার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। তাড়াতাড়ি একটা চাকরি আমায় পেতেই হবে। তাই ছেড়ে যাবার একটা ছুতো খুঁজছিলাম। একদিন সামান্য একটা কারণে রাগ করে বেরিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম, আর কোনোদিন মুখোমুখি হব না। সেদিন ও হয়ত আন্দাজ করেছিল যে সত্যি আজই সব শেষ। তাই নিজের চাপা তেজি স্বভাবের আবরণ ছিঁড়ে বলে উঠেছিল-

-আমার কথাটা একবার শুনে যাও। একটিবার শুনে যাও। আমার যে কিছু বলার ছিল। না শুনেই চলে যেও না।

আমি জানতাম লতার বাঁধন ছেঁড়ার এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। মাস কয়েক বাদে আমার চাকরির কাঁচা খবর ছড়াবার পর ওর মা একদিন ডেকে বললেন- আমি তো মা। মেয়ের মনটা আগে আমিই দেখতে পাই। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো জেনো, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। এবার তুমি যেমন বোঝ।

তারও দু’-এক মাস পর ওর দাদার থেকে পেলাম তুলির একটা চিঠি। লাইন টানা বাংলা খাতার পাতা ছিঁড়ে লেখা- তুমি জান, মা ছেলেবেলাতেই দিদিদের বিয়ে দিয়েছে। তারা সুখী হয়েছে। সেই যুক্তিতে আমারও বিয়ের ব্যবস্থা করছে গ্রামের ছেলের সাথে। কিন্তু আমার কী ইচ্ছে তুমি জান। মা আমার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তুমি যদি মাকে কথা দাও, তবে হয়ত আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। আমি তোমার কথা শুনে চলব। আমি তোমাকে খুব খুব . . . . ।

আমি তখন অরণ্যের প্রেমে মশগুল। বিয়ে করে জীবনের সবুজকে ধূসর হয়ে দিতে রাজি নই। আর যে মুক্ত জীবন আমার পছন্দ, তার দোরগোড়া থেকে ফিরতে চাই না। অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার হাতে এসে গেছে। দিন পনেরো পর ট্রেনিং শুরু হবে অরণ্যের পাঠশালায়। তুলির অনুরোধ শুকনো পাতার মত মাড়িয়ে চুরমার করে চলে গেলাম সবুজ অরণ্যে।

বছর দেড়েক পর বন্ধুদের চিঠিতে খবর এল, তুলি বিয়ে করেছে আমাদেরই এক বন্ধুকে। বাবা-মার অমতে প্রেম করে। ঠিকেদারি করে প্রচুর পয়সার মালিক সুবীর। যাক ভালই হয়েছে। ভেবেছি আপদ বিদেয় হল তাহলে। তার বছর খানেক পর ঘুর্ণির মত খবর পেলাম, দেনার দায়ে সর্বশান্ত সুবীর মান সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করেছে তুলি। কারও কারও সন্দেহ তুলিকে খুন করা হয়েছে।

সেই হারিয়ে যাওয়া তুলি আজ রাতে স্বপ্নের মধ্যে ভেসে এসেছে। এ মনে হয় আমার অবচেতনার প্রকাশ। কিন্তু স্বপ্ন কি এত জীবন্ত হতে পারে? এরপরের ঘটনা প্রবাহ যে পথে গড়িয়ে চলল তাতে স্বপ্নকে আর স্বপ্ন বলে এড়ানো অসম্ভব।
ওরা তিনজন রাত কাটাবার জন্যে এক খেলায় মেতে উঠল। খেলাটা হল, যে কথা কাউকে কোনওদিন বলা হয়নি তা নিয়ে। যখন তুলির টার্ন এল, আমি তখন উৎকর্ণ হয়ে শুনছি ওর প্রতিটি শব্দ, যা সেই দূরাগত ঝরনার প্রতিটি ফোঁটার মত আমার ইন্দ্রিয়ে কেটে কেটে বসে যাচ্ছে। তুলি প্রায় নিস্পৃহ অথচ তেজোদীপ্ত দৃঢ়তায় প্রথম প্রেমের কথা বলে যাচ্ছে আবেগহীন স্পষ্টতায়। অশ্রুহীন বেদনার মত গভীরতম ওর অনুভব। যার প্রতিটি বাক্য আমার ভুলে যাওয়া ঘটনার বিবরণ। ছেলে দুটি চোখ মুছছে বারবার।

তুলি বলে- আজও আমি ওকে খুঁজে বেড়াই। যদি একবার একবার চোখের দেখা পাই, তাতেই আমার শান্তি, আমার মুক্তি।

লম্বা চুলের গোছা মুখের থেকে সরিয়ে মাথাটা সামান্য হেলাতেই ছেলেটির মাথার আড়াল থেকে ওর মুখটা এই প্রথম আমার দৃষ্টির সোজাসুজি। তুলি সোজাসুজি তাকিয়ে আছে আমার চোখে চোখ রেখে।। না কোনও দুঃখ নয়, কষ্ট নয়, শুধু আগুন জ্বলছে ওর চোখে। ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত কাঠকয়লার মত গনগনে আগুন। তা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে না, দহনও করছে না। আকর্ষণও নয়। সেই আগুন যেন জ্যোৎস্নার মত স্নিগ্ধ, সুন্দর।

ghost story by bidyut dey
নিচু স্বরে ফিসফিস করে গল্প করছে ওরা। কান খাড়া করে কী বলছে শোনার চেষ্টা করি।

মংলু আর বিশুর জলসিঞ্চনে আমার চেতনা এসেছিল পরদিন। মংলু গজগজ করছিল, এত করে বলে গেলাম দরজা বন্ধ করে শোবেন, বন্ধ করে শোবেন, তাও সেই দরজা হাট করে খুলে রাখলেন? আপনারা শহরের মানুষ, তাই গেঁয়ো লোকের কথা শুনবেন কেন।

একটা ছোট্ট স্টেশনে এসে সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। কেমন যেন সব ভূতুড়ে বলে মনে হচ্ছে চারিদিক। ভদ্রলোক বললেন- কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

এতক্ষণের নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর আটকে আসে। উনি বলেন- বাইরের ঠাণ্ডা লাগছে। জানলাটা বন্ধ করে দিন। দেখি একটু গরম চা পাওয়া যায় কিনা।

আমার না বলার ক্ষমতা ছিল না ওঁর আন্তরিকতার জোরে। তন্ময় হয়ে ভাবছি, কাঁচের জানলায় টোকা পড়ল। দেখি, আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া এক চাওয়ালা ধূমায়িত চায়ের খুরি জানলার ধাপিতে বসিয়ে দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে চলে গেল। ট্রেনের হুইশিল, চাকা গড়ানোর শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে দরজায় দাঁড়ালাম। কিন্তু লো লেবেল প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই। সেই চাওয়ালাও হাওয়া হয়ে গেছে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাথরুমের দরজায় টোকা দিলাম। নাহ! ভেতরে কেউ নেই। আপার বার্থে ব্যাগপত্তর নেই। ট্রেনটা একটা লোহার সেতু পার হচ্ছে ঝমঝমিয়ে। নিচে শুকনো নদী খাত। জানলা দিয়ে দেখি মরা নদীখাতের ওপর দিয়ে একটি টর্চের আলোকবৃত্ত এগিয়ে যাচ্ছে বালি-পাথর ডিঙ্গিয়ে। কিন্তু মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না।

জানলা বন্ধ করে শোয়ার আয়োজন করছি। কী যেন খচমচ করে উঠল বালিসের পাশে। দেখি একটা শুকনো পাতা! যার একটা পিঠ লাল, অন্যদিকটা খয়েরি।

অলঙ্করণ: মোহনা কাঁড়ার

Bidyut Dey

ভ্রামণিক, আড্ডাবাজ মানুষ। বেড়াতে ভালোবাসেন, আর ভালবাসেন শব্দে গেঁথে রাখতে সেই ভ্রমণকাহিনি

Picture of বিদ্যুৎ দে

বিদ্যুৎ দে

ভ্রামণিক, আড্ডাবাজ মানুষ। বেড়াতে ভালোবাসেন, আর ভালবাসেন শব্দে গেঁথে রাখতে সেই ভ্রমণকাহিনি
Picture of বিদ্যুৎ দে

বিদ্যুৎ দে

ভ্রামণিক, আড্ডাবাজ মানুষ। বেড়াতে ভালোবাসেন, আর ভালবাসেন শব্দে গেঁথে রাখতে সেই ভ্রমণকাহিনি

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com