(Migraine)
আজকাল সব রোগকেই বাঙালি “গ্যাস” হয়েছে বলে ধরে নেন। প্রত্যেক রোগীরই এক বক্তব্য। পেটের ব্যথা মানেই গ্যাস হয়েছে। পিঠের টান মানেও গ্যাস জমেছে পিঠে। মাথায় যন্ত্রণা মানে নির্ঘাত গ্যাস জমেছে ব্রেনে। এমনকি পায়ের পেশিতে টান ধরলেও গ্যাসই হল ‘নন্দঘোষ’। (Migraine)
কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বুঝেছি, স্বঘোষিত ভুঁইফোড় গ্রামীণ চিকিৎসকেরা নিজেদের রোগ নির্ণয়ের অপারগতাকে ‘গ্যাস হয়েছে’র মোড়কে পরিবেশন করেন। আর আলুভাতে বাঙালি, অতশত কঠিন রোগের নাম মনে রেখে নিজেদের বিব্রত করতেও চান না। বরং সহজবোধ্য “গ্যাস হয়েছে” ধরে নিয়ে বীরদর্পে লম্ফঝম্প করে দক্ষিণভারতের নামীদামী চিকিৎসকের কাছে যান। সেখানে অবশ্য সঠিক ডায়াগনোসিস করেই ফিরে আসেন। কিন্তু তারপর আবার গ্রামের ভুঁইফোঁড় চিকিৎসককে দিয়ে নামী চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনটি যাচাই করে অবশেষে সব ওষুধ বাদ দিয়ে শুধু গ্যাসের ওষুধটুকুই খেতে থাকেন। পেটরোগা বাঙালির এহেন বুদ্ধিদীপ্ত কাজে গ্যাসের মহামারী, ধীরে ধীরে আকারে প্রকারে ঢাউস হয়ে মাথা ছুঁয়ে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়েছে। (Migraine)

বছর পঁচিশের এক ভদ্রমহিলা সেরকমই ‘গ্যাস’ হয়েছে বলে চেম্বারে এলেন। বহু চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। কোনওকিছুতেই গ্যাস আর বাগে আসছে না। কলকাতা, ভুবনেশ্বর, কটক, ভেলোর, পন্ডিচেরী, চেন্নাই সব ঘুরে কী মনে করে আমার হতদরিদ্র চেম্বারে সেদিন উপস্থিত। হাতে করে আনা প্রেসক্রিপশনের মোটা ফাইলগুলো পাশে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, গ্যাস হলে বোঝেন কী করে? ভদ্রমহিলা চটজলদি উত্তর দিলেন, প্রথমে দুর্গন্ধ যুক্ত বায়ুনিঃসরন হয়। তারপরেই গ্যাস টা চট করে মাথায় উঠে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। কিছুতেই কমতে চায় না। বমি বমি ভাব হয়। একটা ঘুম না হওয়া অবধি নিস্তার নেই। (Migraine)
আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাথার যন্ত্রণাটা কি কোনও একদিক ধরে হয়? মানে ধরুন, বামদিক বা ডানদিক? ভদ্রমহিলা চোখগুলো গোলগোল করে বললেন, হ্যাঁ। (Migraine)
“উৎকট গন্ধ, তীব্র আওয়াজ বা আলোর ঝলকানিতে অথবা মানসিক দুশ্চিন্তা হলে কি বেড়ে যায়?”
রোদে বেরোলে বা ঘুম কম হলে, বেড়ে যায়?
উৎকট গন্ধ, তীব্র আওয়াজ বা আলোর ঝলকানিতে অথবা মানসিক দুশ্চিন্তা হলে কি বেড়ে যায়?
ভদ্রমহিলা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম, আপনারও কি এ ধরণের মাথাব্যথা হয়?
তিনি বললেন, আমার তো সেই ছোটবেলা থেকেই গ্যাসের জন্য মাথা ধরে যায়। আমার ধাতটাই ও পেয়েছে। আমাদের সবারই গ্যাসের রোগ। (Migraine)
“পাশে থাকা প্রেসক্রিপশনগুলিতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সবজায়গাতেই সঠিক রোগনির্ণয় হয়েছে। সবাই মাইগ্রেন বলেই উল্লেখ করে চিকিৎসা দিয়েছেন। তাহলে কমল না কেন?”
ওঁদের গ্যাসীয় বুদবুদের ভেতর থেকে আমি তখন আমার উত্তর পেয়ে গেছি। একদিকের মাথাযন্ত্রণা, রোদ, অনিদ্রা, গন্ধ, তীব্র আলো- আওয়াজে বেড়ে যাওয়া। বমি ভাব। ঘুমোলে কমে যাওয়া। প্রধানত মহিলাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় রোগের এগিয়ে চলা। (Migraine)

এ সবই আসলে মাইগ্রেনের লক্ষণ। অতি সহজ এই রোগে এতদিন চিকিৎসা হয়নি?
পাশে থাকা প্রেসক্রিপশনগুলিতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সবজায়গাতেই সঠিক রোগনির্ণয় হয়েছে। সবাই মাইগ্রেন বলেই উল্লেখ করে চিকিৎসা দিয়েছেন। তাহলে কমল না কেন? (Migraine)
ভদ্রমহিলাকে একটা প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই ওষুধ খেয়ে কমেনি?
“ফ্লুনারিজিন, অ্যামিট্রিপটাইলিন, ভ্যালপ্রোয়েট, টপিরামেট এধরণের মাইগ্রেনের ওষুধে একটু ঘুম পায় বইকি। কিন্তু তা বলে তাকে ‘ঘুমের ওষুধ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে উনি কখনও সঠিক চিকিৎসা করাননি।”
ভদ্রমহিলা সরলচোখে জবাব দিলেন, আমরা সব প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসে গ্রামের এক কোয়াক চিকিৎসককে দেখাতাম। তিনি এসব ওষুধের মধ্যে থেকে শুধু গ্যাসের ওষুধটা বেছে দিতেন। বাকি ওষুধের মধ্যে ঘুমের ওষুধ থাকত বলে তিনি খেতে বারণ করতেন। তাই বাকি ওষুধপত্র কখনোই খাইনি। (Migraine)
ওঁর উত্তর শুনে নিজের চিকিৎসকসত্ত্বা গোঁত্তা খেয়ে বাঙালির মগজাস্ত্রের কাছে মাথা মুড়োলো।
ফ্লুনারিজিন, অ্যামিট্রিপটাইলিন, ভ্যালপ্রোয়েট, টপিরামেট এধরণের মাইগ্রেনের ওষুধে একটু ঘুম পায় বইকি। কিন্তু তা বলে তাকে ‘ঘুমের ওষুধ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে উনি কখনও সঠিক চিকিৎসা করাননি। বরং পাড়ার স্বঘোষিত চিকিৎসকের অপচিকিৎসার ফাঁদে পড়ে এতদিন ধরে মাইগ্রেনের অসহনীয় কষ্টকে ‘গ্যাস হয়েছে’ ভেবে চালিয়ে যাচ্ছেন। (Migraine)
“সাধারণত ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়স অবধি এ রোগের ভয়াবহতা শরীরে থাকে। ওষুধ খাওয়ানো হয়, যাতে এর তীব্রতা ও পৌনঃপুনিকতা কমে যায়। তার মানে এই নয় যে মাইগ্রেনের অ্যাটাক পুরো চলে যাবে।”
প্রায় মিনিট পনেরো লাগল মাইগ্রেনের সম্বন্ধে বোঝাতে। টানা তিন মাসের ওষুধ খেতেই হবে, এই নিদান দিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে বিদায় দিলাম। (Migraine)
কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই তিনি ওষুধপত্র পুনরায় বন্ধ করে ফিরে এলেন। বললেন, গ্যাস টা আবার মাথায় উঠেছিল গতকাল। তাই শুধু গ্যাসের ওষুধটা খাচ্ছি। বাকি সব বন্ধ। (Migraine)

সাধারণত ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়স অবধি এ রোগের ভয়াবহতা শরীরে থাকে। ওষুধ খাওয়ানো হয়, যাতে এর তীব্রতা ও পৌনঃপুনিকতা কমে যায়। তার মানে এই নয় যে মাইগ্রেনের অ্যাটাক পুরো চলে যাবে। তবে যখন যন্ত্রণা হবে, তখন এই দু’টো ওষুধ খেলেই কমে যাবে। এই বলে এস.এস.আর.এ গ্রুপের ট্রিপটান গোত্রের ওষুধ লিখে ও আগের প্রেসক্রিপশনের ওষুধ চালিয়ে যেতে নিদান দিলাম। (Migraine)
মাস দু’য়েক পরে হাসিমুখে ফিরে এলেন ভদ্রমহিলা। রোগের প্রভাব অনেক কমেছে। তবে মাঝেমধ্যে ‘গ্যাসটা মাথায় উঠলে’ এমারজেন্সি ওষুধটা খেয়ে নিলেই কমে যায়। (Migraine)
সবই বুঝলাম। কিন্তু ‘মাইগ্রেন’কে গ্যাসের মায়াজাল থেকে বের করতে না পেরে অসহায় চোখে বিপন্ন মুখে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি। (Migraine)
প্রতিবেদনটি ডক্টর্স ডায়ালগ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
বানান অপরিবর্তিত
ডাঃ শুভেন্দু বাগ সিনিয়র রেসিডেন্ট, ফিজিওলজি, MMC&H