স্বর্গীয় সুকুমার রায়ের লেখা ‘গোঁফচুরি’ কবিতার শেষের সেই বিখ্যাত লাইনদু’টি মনে পড়ে?
গোঁফকে বলে তোমার আমার— গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।
নামিবিয়া দেশের হিম্বা জনজাতির কথা বলতে গেলে ওই লাইনদু’টি একদম যথাযথ। রায়মশাই সৃষ্ট হেড আপিসের বড়বাবুর কাছে তাঁর গোঁফের গুরুত্ব যতখানি ছিল, হিম্বা জাতির মানুষের কাছেও তাঁদের চুলের গুরুত্ব ঠিক ততখানি। আক্ষরিক অর্থেই সেদেশে চুল দিয়ে মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করা হয়।
আজকাল পৃথিবীর কমবেশি সব দেশেই মানুষ তাদের চুলের সৌন্দর্য্য সম্পর্কে অতি সচেতন। নামীদামি কসমেটিক্স উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলি প্রতি বছর লক্ষকোটি ডলার উপার্জন করে শুধুমাত্র তাদের শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এবং নানারকম হেয়ার প্রডাক্ট বিক্রি করে। বস্তুতঃ, আধুনিক যুগে মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি অন্যতম বড় অংশ হল তাদের মাথার চুল এবং চুলের স্টাইল; এবং সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্রাউনিং গ্লোরি বলে কথা! কিন্তু তবুও একথা হলফ করে বলা যেতে পারে যে পৃথিবী জুড়ে এই চুল নিয়ে চুলোচুলির অবসেশনকে গুনে গুনে দশ গোল দিতে পারেন নামিবিয়ার হিম্বা প্রজাতির মানুষজন।

আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এই নামিবিয়া দেশটি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। হিম্বা জনজাতির মানুষ এই নামিবিয়াতেই বাস করেন। হিম্বাদের সমাজে চুলের গুরুত্ব অপরিসীম। চুলের যত্ন এবং ঐতিহ্যবাহী কেশবিন্যাস করতে গিয়ে হিম্বা মেয়েরা দৈনিক প্রচুর সময় খরচ করেন এবং সে চুলের সাজও হয় সত্যিই দেখার মতো। চুলে গোছা গোছা লম্বা বিনুনি বেঁধে তাতে পাকাপাকি মাটির প্রলেপ দেওয়ার মতো অদ্ভুত কেশসজ্জার উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া গেছে বলে এখনও জানা যায়নি।
অবশ্য মাটি বলতে আবার কাদামাটি ভেবে বসবেন না। রক্তবর্ণের এই রূপটানটির আসল নাম “ওজিস্” (Otjize)। পাথুরে লাল ফেরুজিনাস মাটি, মাখন ও স্থানীয় ওমুজুমবা (Commiphora multijuga) গাছ থেকে প্রাপ্ত আঠালো রসের মিশ্রণে তৈরি এই রূপটান হিম্বা নারীদের অঙ্গসজ্জার প্রধান উপকরণ। হিম্বা সমাজে রক্তবর্ণের এই মিশ্রণটিকে মাটি ও রক্তের পবিত্র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। শুধু চুলেই নয়, হিম্বা মহিলারা সূর্যের আলোর হাত থেকে ত্বক বাঁচাতেও লাল এই মিশ্রণটির প্রলেপ তাদের গোটা শরীরে লাগিয়ে রাখে। এই কারণে তারা “Red women of Africa” হিসেবেও পরিচিত।

হিম্বাদের মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে চুল বাঁধার নির্দিষ্ট নিয়মকানুন। এই সমাজের নিয়মমতো প্রতিটি মানুষের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের চুল বাঁধতে হয়। অবশ্য সামাজিক অবস্থান বলতে মূলত বিবাহ-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবনই বোঝায়। এক্ষেত্রে নিয়মকানুন বেশ জটিল এবং অত্যন্ত কড়াও বটে। যেমন মেয়েদের ক্ষেত্রে শৈশবে চুলে দুটি বিনুনি বেঁধে রাখার নিয়ম রয়েছে। তবে যমজ কন্যাসন্তান হলে শিশুর মাথায় একটিই বিনুনি বাঁধা হয়।

শিশুকন্যার বেণিদু’টি মাথার পেছনে নয়, বরং সামনে, কপালের কাছে বাঁধা হয়। এরপর মেয়েরা একটু বড় হলে, অর্থাৎ কৈশোরে তাদের চুলে একগোছা লম্বা বিনুনি বেঁধে, চুলে ওজ়িসের প্রলেপ লাগানো শুরু হয়। এরপর বেণির শেষে জুড়ে দেওয়া হয় গোছাখানেক ছাগলের লোম বা সম্ভব হলে দেশীয় হেয়ার এক্সটেনশন। কিশোরীদের কেশসজ্জা এমনভাবে করা হয় যাতে তা মুখের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখে। উদ্দেশ্য একটাই, অবাঞ্ছিত রোমিওদের দৃষ্টি থেকে মুখ আড়াল করে রাখা।
তবে যৌবন-সমাগমে হেয়ারস্টাইল আবার বদলে ফেলা হয়। তখন বিনুনির সংখ্যা বাড়িয়ে, তাতে আরও পুরু ওজিসের আস্তরণ লাগানো হয়। সদ্যযুবতীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য বিনুনি করা হয় মাথার পেছনে। এভাবে আশপাশের মানুষকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে মেয়েটি এখন বিবাহযোগ্যা। বিয়ে এবং সন্তানলাভের পরে মেয়েদের কেশবিন্যাস একইরকম থাকে, তবে বিবাহিতা মেয়েরা নিজেদের গৃহিণী এবং জননীসত্বার স্বীকৃতি হিসেবে মাথায় ছাগলের চামড়ার তৈরি ছোট মুকুট পরে থাকেন। এই মুকুটের নাম “এরেম্বে” (Erembe)।

চুল বাঁধার ব্যাপারটা হিম্বা নারীদের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কাজ। সঠিকভাবে ওজিস্ তৈরি করতে এবং একে অপরের চুল বাঁধতে এরা দৈনিক কয়েকঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। পুরুষদের বেলায় নিয়মটা একটু অন্যরকম। তাদের ক্ষেত্রে বয়স তেমন গুরুত্ব পায় না। শিশু, কিশোর এবং অবিবাহিত যুবকদের চুলের ফ্যাশন একইরকম। মাথার মাঝখানে একটা বিনুনি, যেটা মাথার পেছনে ঝুলিয়ে রাখা। বিনুনির অংশটুকু ছাড়া মাথার বাকি অংশ পরিষ্কার করে কামানো।

বিবাহিত ছেলেদের জন্য নিয়ম আবার অন্য। তারা বিয়ের পর মাথায় পাগড়ি ধরনের ছোট টুপি পরে থাকে সবসময়। জনসমক্ষে এই টুপি খোলার নিয়ম নেই। এই কারণে প্রকাশ্যে মাথা চুলকোনোর জন্য বিবাহিত পুরুষরা ধাতুর তৈরি কাঠি ব্যবহার করেন। একমাত্র গ্রামে কারও মৃত্যু হলে, সেই শোকসভায় যোগ দেওয়ার সময় শুধু তারা পাগড়ি খুলে রাখে।
হিম্বা সমাজে কারও স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে অপরজন নিজের মাথার মুকুট বা পাগড়ি খুলে রা্খে। এবং দ্বিতীয়বার বিয়ে হলে তবেই আবার সেটা মাথায় পরার অনুমতি মেলে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই, যে “বিবাহ” সম্পর্কে এতখানি যত্নবান হওয়া স্বত্তেও হিম্বারা বহুগামিতায় বিশ্বাস করেন। কাজেই পুরুষদের একাধিক স্ত্রী থাকা যতটা স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি বিবাহিতা মেয়েদের ক্ষেত্রে একাধিক প্রেমিকের উপস্থিতিও ততটাই। বস্তুত হিম্বা সমাজে একাধিক যৌনসঙ্গী থাকাটাই নিয়ম। শুধুমাত্র বিবাহিত সম্পর্কে আবদ্ধ থাকাকে হিম্বারা যৌনক্ষমতার অপচয় বলে মনে করেন। তাছাড়া বিয়ের আগে কোনও মেয়ে গর্ভবতী হলে সন্তান তার ভাই বা বোন হিসেবে পরিচিত হয় এবং বিয়ের পর স্বামীর পরিবর্তে প্রেমিকের দ্বারা গর্ভসঞ্চার হলেও সেই সন্তানের পিতৃত্ব গর্ভবতী মহিলার স্বামীই পান।

এখানে আরও একখানা মজার ব্যাপার জানিয়ে রাখি, যে হিম্বা সমাজে চুল ও গয়নাগাটির ওপরে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়, ঠিক ততখানিই অপ্রয়োজনীয় জামাকাপড়ের ব্যবহার। হিম্বা নারী এবং পুরুষ উভয়েই শরীরের ওপরের অংশে কিছু পরেন না, বরং নানারকম গয়না দিয়ে উর্দ্ধাঙ্গ সাজিয়ে রাখেন। শরীরের নিম্নাঙ্গে এরা পশুর চামড়ার তৈরি কটিবস্ত্র পরেন। এমন আশ্চর্য সাজগোজ আমাদের চোখে অদ্ভুত দেখালেও হিম্বা জীবনদর্শনে এমনটা স্বাভাবিক।

নারী শরীরের স্বাভাবিক অংশ স্তন, তাই তা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে বলে হিম্বারা মনে করেন না। আর তাছাড়া নামিবিয়া রুক্ষ মরুভূমির দেশ। তাই সেদেশে চামড়ার পোশাক পরার আইডিয়াটা প্র্যাক্টিকালও বটে। প্রথমত, তুলো জাতীয় কোনও শস্যের চাষ সেখানে হয় না এবং বয়নশিল্পের সঙ্গেও তাদের পরিচয় নেই। আরও একটা বড় ব্যাপার হল জলের অভাব। যেখানে পরিষ্কার পানীয় জলই প্রায় বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে, সেখানে জামাকাপড় ধোয়ার জন্য জল খরচ করা চিন্তারও বাইরে। মূলত এসব কারণেই হিম্বারা জামাকাপড় পরেন না।
আর এই একই কারণে হিম্বাদের স্নানের পদ্ধতিও অন্যরকম। তারা নানারকম ভেষজ গাছগাছড়া পুড়িয়ে বদ্ধ জায়গায় গরম ধোঁয়া তৈরি করে। তারপর ওজিসের প্রলেপ মেখে দীর্ঘসময় সেই ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে শরীর পরিষ্কার করেন। উত্তাপের ফলে ঘাম হয়, এবং ঘামের মাধ্যমে শরীরের রোমকূপ সাফ হয়ে যায়। ভেষজের গুণে দুর্গন্ধও দূর হয়। এই স্নানপদ্ধতিকে “স্মোক বাথ” (smoke bath) বলা হয়। হিম্বা উপজাতি ছাড়াও মরুভূমির দেশে থাকা অন্য অনেক উপজাতি এই পদ্ধতিতে শরীর পরিষ্কার রাখেন। নেই জল, তো ওজিসই সম্বল! নইলে অন্য উপায়ই বা কী!
*তথ্যসূত্র:
BBC – Namibia’s Himba People caught between Tradition and Modernity – Pumza Fihlani
Kinship, Ritual and Landscape among the Himba of Northwest Namibia, Book by Michael Bollig
ifrc.org
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Franco Cappellari, Dailymail
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।