১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের এক পড়ন্ত বিকালে একটা স্যুটকেস, বছর দশেকের অভিজ্ঞতা এবং খানকয়েক ডিগ্রি সঙ্গে করে সিডনির কিংসফোর্ড স্মিথ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। পুঁজি কেবল পাঁচশ ডলার মতো।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে যা দেখলাম, যা বুঝলাম আর যা জানলাম তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ১৯৭৮-এ খড়গপুর থেকে পাশ করার মাস ছয়েক আগেই ঊষা মার্টিন ব্ল্যাক গোষ্ঠী প্রায় জামাই আদর সমেত নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর যে কোনও জায়গাতেই অল্পদিনের মধ্যেই নিজের অধীত বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা ভাঙিয়ে পছন্দসই চাকরি পেয়ে যাব।
নিউ হ্যাম্পশায়ারে এম বি এ পড়ার সময়ে ম্যাক্রোইকনমিক্স বিষয়টিতে পাগলাটে অধ্যাপক ডোয়েন রাইট্সম্যান কিছুটা উৎসাহ সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বুঝেছিলাম কোনও ধনতান্ত্রিক দেশের সুদের হারের কমা–বাড়ার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি (GDP Growth), বিদেশি মুদ্রার হার (exchange rate), বেকারত্বের হার (unemployment rate) এবং মুদ্রাস্ফীতি (inflation) প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়াতে শনি রবিবারের খবরের কাগজগুলিতে সরকারি বেসরকারি চাকরির অনেক বিজ্ঞাপন খাকত। সেই দেখে চাকরির দরখাস্ত করে চলেছি। দুটি কাগজ কিনতাম— The Australian এবং The Sydney Morning Herald। প্রতি সপ্তাহেই খবরের শিরোনামে এবং বিভিন্ন নিবন্ধে ১৭% সুদের হার এবং ১১% বেকারত্বের হার। অর্থনৈতিক মন্দা ব্যাপারটা নিয়ে পুঁথিগত বিদ্যা ছিল, বাস্তবে Economic Recession এর সংজ্ঞা এবং রূপের বিষয়ে কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। জানলাম পর পর দুটি Quarter-এ (মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর) যদি GDP growth নেগেটিভ হয়, তাহলে সেই পরিস্থিতিকে technical recession হিসাবে গণ্য করা হয়। (সঙ্গের ছবিটি দেখলে হয়তো পরিস্থিতিটা বুঝতে সুবিধা হবে। উল্লেখযোগ্য— পরবর্তী ৩২ বছরে অস্ট্রেলিয়তে কখনও পর পর দুটি quarter-এ negative GDP Growth হয়নি।)

পাঠক মনে হয় এই কলাম স্রেফ বিনোদনের জন্য পড়েন, এইসব তাত্ত্বিক আলোচনাতে বিরক্ত হচ্ছেন। সাফাই গেয়ে রাখছি — বিদ্যে জাহির করার জন্য নয়, সেই সময়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বোঝানোর জন্যই প্রসঙ্গটির উত্থাপন করলাম।
***
যাইহোক এই recession-এর ভুক্তভোগী চাকরি যাওয়া এবং চাকরি খোঁজা মানুষরা। বলাই বাহুল্য, আমি শেষোক্ত দলে ছিলাম। মানে সরকারিভাবে বেকার। প্রতিদিনই পোস্টবক্সে এক তাড়া চিঠি আসে— বাঁধা গতে লেখা “আবেদন করার জন্য ধন্যবাদ। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি এইবার আপনি সফল হননি।” অহংবোধকে ভালরকম ধাক্কা দিত এই rejection letterগুলো।
এসেছিলাম সেপ্টেম্বরে, দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে এল। নতুন আসা অভিবাসীদের কাজ পেতে সাহায্য করার জন্য কিছু সংস্থা ছিল। সেই সংস্থার কর্মীরা আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করতেন নানা ভাবে। একদিন আমাকে বেশ বিমর্ষ দেখে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক সরলভাবেই বলেছিলেন: “দেখুন বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই অস্বাভাবিক। আমার বিশ্বাস, কিছুদিনের মধ্যেই অবস্থার পরিবর্তন আসবে। কিছু মনে করবেন না, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনাদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাবার মতো সাহায্য করছে। মনে রাখবেন, ভালোর জন্যই হোক বা মন্দের জন্যই হোক— আপনি একটা নতুন দেশে এসে পড়েছেন। যেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সামাজিক আদবকায়দা ভীষণ অন্য। তাই বলব, এই সাময়িক বেকারত্বকে ইতিবাচকভাবে দেখুন। দেশটাকে, দেশের মানুষকে জানার–বোঝার চেষ্টা করুন।”
ভদ্রলোকের কথার মধ্যে একটা আন্তরিকতা ছিল। একেবারেই মনে হয়নি জ্ঞান দিচ্ছেন। ভেবে দেখলাম, দেশের অধিকাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজিভাষী। সারাজীবন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও এদের উচ্চারণ বুঝতে এত অসুবিধা হচ্ছে কেন? জানতাম সাহেব মেমরা কথাবার্তা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ভীষণরকম এটিকেট মেনে চলে— এরা তো সেরকম নয়। যার যেমন ইচ্ছা পোশাক, কথায় কথায় চার অক্ষরের শব্দ ব্যবহার। পরিচয় হওয়া মানুষদের সবাই আবার ইংরেজ বংশোদ্ভূতও নয়— পদবি দেখে ধারণা হয় এঁদের পূর্বপুরুষ ইতালীয়, গ্রিক বা পূর্ব ইউরোপীয়। কীভাবে এলেন এঁরা? কেন-ই বা এলেন দক্ষিণ গোলার্ধের এই দেশটাতে?

থাকতাম Top Ryde নামে একটি পাড়ায়।
দু মিনিটের হাঁটা পথে স্থানীয় লাইব্রেরি। দু’বছর আমেরিকা বাসের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখ ধাঁধানো লাইব্রেরির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পুরো সময়টাই ক্যাম্পাসে থাকার জন্য কোনও পাড়ার মধ্যে এই ধরণের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার দেখিনি।
ভদ্রলোকের কথা মাথায় রেখে অস্ট্রেলিয়া বিষয়ক কিছু বই খুঁজছিলাম। এক মহিলা প্রশ্ন করলেন: বিশেষ কোনও বই খুঁজছেন কি? আপনাকে সাহায্য করতে পারি কোনওভাবে? বললাম নতুন এসেছি, অনেক ব্যাপারেই বেশ দিশাহারা লাগছে। দেশটাকে একটু বুঝতে চাই।
ভদ্রমহিলা বললেন: “বেশ তো! অনেক বই পাবেন এই লাইব্রেরিতে। যত ইচ্ছে বই নিতে পারেন একসঙ্গে, কোনও ঊর্দ্ধসীমা নেই। আমার মতে দেশটার ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করুন শুরুতে। আপনার accent শুনে আন্দাজ করছি আপনি ভারতীয়। আপনার দেশের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস। নতুন পৃথিবীর এই দেশটার বয়স কিন্তু সবে দুশো পেরিয়েছে, আমাদের ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম। হয়তো ইতিহাস যত্ন করে পড়লে মানুষজনকে বুঝতে পারবেন কিছুটা— নতুন দেশে থিতু হয়ে বসাটা একটু হলেও সহজ হবে।”
বেশ কয়েকটা বই খুঁজে দিলেন। সব কটির নাম মনে নেই, একটি ছিল Manning Clark-এর ছয় খণ্ডের অস্ট্রেলিয় ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন। পাতানো দেশটাকে সচেতনভাবে জানার প্রচেষ্টার সেই শুরু। তেত্রিশ বছর বাদে আজও সেই প্রয়াস চলেছে।

লাইব্রেরির ভদ্রমহিলা শ্বেতাঙ্গিনী ছিলেন। ওঁর পারিবারিক ইতিহাস জানা নেই। বইগুলি পড়ে জানতে পারলাম উনি কেন বলেছিলেন দেশটার ইতিহাস কেবল দুশো বছরের।
১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারী ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপ এগারোটি জাহাজ নিয়ে সিডনির বন্দরে এসে নোঙর বেঁধেছিলেন। সাথে ছিল সাতশো কয়েদি এবং চারশ সামরিক ও অন্যান্য অফিসার। এই নৌবহরটিকে আজও বলা হয় First Fleet বা প্রথম নৌবহর।
অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ মানুষ এই দিনটিকে Australia Day হিসাবে উদযাপন করে। আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার যাত্রা–শুরু ধরা হয় ঐ দিন থেকেই।
আনুমানিক ষাট হাজার বছর আগে আসা আদিবাসীদের কাছে কিন্তু ২৬ জানুয়ারি একটি কালো দিন। এঁরা দিনটিকে invasion day হিসাবে উল্লেখ করেন।
***
পরবর্তী জীবনে অবসর সময়ে অস্ট্রেলিয় ইতিহাস নিয়ে কিছু পড়াশুনা করেছি। পরিণত বয়সে বছর দুয়েক ছাত্র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসও করেছি।

দেশটার ইতিহাস কিন্তু একদমই অন্যরকম। রাজা গজা নেই, পাশের রাজ্যের সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধও নেই। এগারোশো ব্রিটিশ মানুষ লটবহর নিয়ে এসে একটা রুক্ষ দেশে উপনিবেশ স্থাপন করল। ১৭৮৮তে বিশাল দেশটায় ছড়ানো ছেটানো আদিবাসীদের জনসংখ্যার কোনও সঠিক হিসাব নেই, ইতিহাসবিদদের নানা আন্দাজের ভিত্তিতে করা হিসাব অনুযায়ী তা ছিল তিন লক্ষ মতো (আন্দাজের ঊর্দ্ধসীমা দশ লক্ষ)। এদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের সংঘাত লাগাটা প্রত্যাশিতই ছিল, বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
সিডনিতে থাকাকালীন মাঝেমাঝেই সিডনি অপেরা হাউসের আশেপাশে সময় কাটাতাম। প্রাণচঞ্চল অঞ্চলটায় গিয়ে মনে হত আজকের এই ঝাঁ চকচকে জায়গাটাতেই আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার যাত্রা শুরু।
কেমন ছিল শুরুর দিনগুলো এবং পরবর্তী বছরগুলো? এত দূর দেশে বিপজ্জনক নৌ-যাত্রার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল ইংরেজ সরকার? প্রশ্নগুলোর উত্তর এক কথায় দেওয়া যাবে না। অন্তর্নিহিত কারণগুলি জটিল এবং কৌতূহলোদ্দীপক।
কয়েক পাতা ইতিহাস পড়ে নিজেকে ইতিহাসবিদ ভাবার ধৃষ্টতা আমার নেই। এই কলামে টিকা–টিপ্পনি বাদ দিয়ে দেশটার ইতিহাসের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে লেখার চেষ্টা করব ধীরে ধীরে। ধারাবাহিকতা রাখার জন্য লেখাগুলির শিরোনাম ‘অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের কিছু নির্বাচিত অংশ’ রাখলাম। কিছু অজানা কথা হয়তো পাঠকদের জানাতে পারব।
পরবর্তী পর্ব প্রকাশ পাবে ১১ জুলাই ২০২৩
ছবি সৌজন্য: Pixabay, Picryl, Freedomainphoto
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।
One Response
A perfect start to a long innings, hopefully.