অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের কিছু নির্বাচিত অংশ – পর্ব ২
১৭৮৮ — আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার যাত্রা শুরু
১৭৮৭ সালের মে মাসে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ৭৫০ জন দ্বীপান্তরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি এবং ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ৫০০ নাবিক, নৌ-সেনা এবং অসামরিক অফিসারকে নিয়ে এগারোটি জাহাজের একটি নৌবহর বটানি বে’র উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।
বর্তমান অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের এই বটানি বে’তেই ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক পা রেখেছিলেন। জায়গাটার নাম রেখেছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলস এবং সেটিকে রাজা তৃতীয় জর্জের সাম্রাজ্যের অঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই অভিযাত্রী দলে নাবিকরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীও ছিলেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ জোসেফ ব্যাংকস।
সে বছর এই বটানি বে ছিল গাছপালায় সবুজ। এই শ্যামল সৌন্দর্যের কারণেই স্থানটির নামকরণ হয়েছিল ‘বটানি বে’।
আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এই সফরের গুরুত্ব অপরিসীম।

কেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? শুধুমাত্র কয়েক হাজার কয়েদিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াটাই অন্যতম কারণ ছিল কি?
ইতিহাসবিদদের এই বিষয়ে নানা মত। সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ— ইউরোপের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ।
সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই একঝাঁক পণ্ডিত ইউরোপে বৌদ্ধিক নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। যুগটিকে বলা হয় ‘Age of Enlightenment’ বা ‘[age of reason’। এই আলোকময়তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের বোধের বিকাশ ঘটিয়ে প্রথাগত বিশ্বাস এবং কুসংস্কারের শাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করা। সমাজকে মানবিকতার পথে পরিচালনা করাও ছিল আলোকময়তার অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষকে বিজ্ঞানচর্চা, সংশয়বাদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শনের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে এই আলোকময়তার যুগ।
আলোকময় যুগের বিজ্ঞানচর্চার ফল অষ্টাদশ শতাব্দীর Industrial Revolution বা শিল্প বিপ্লব। এই শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ইংলন্ডে এবং পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে, আমেরিকায় এবং ক্রমে সারা দুনিয়ায়। এই প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পবিপ্লব কিন্তু অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। বহু যুগ ধরে গড়ে ওঠা কৃষিনির্ভর গ্রাম-ভিত্তিক সমাজের কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল কয়েক দশকের মধ্যেই।
নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে কৃষিকার্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষকদের শ্রমের চাহিদা কমল। বহু মানুষ রুজির প্রয়োজনে পাড়ি দিল লন্ডন এবং অন্যান্য দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলির কারখানায় কাজ করতে।
এই কারখানার শ্রমিকদের জীবন কিন্তু সহজ ছিল না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বস্তিতে থাকা, অল্প বেতনে লম্বা কাজের দিন। শহরে গিয়ে পড়লেও সবার কাজ জুটত না— অনেকেই গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ত।

সেই সময়ে, মানে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, ইংলন্ডে শ’খানেক অপরাধের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। খুন ছাড়াও ধর্ষণ, দেশদ্রোহিতা, ডাকাতি, জালিয়াতি, এমনকি ছোটখাটো চুরির অপরাধেও মানুষকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হত। তৎকালীন আইনি বিশ্বাস ছিল সুশৃঙ্খল সমাজ বজায় রাখার জন্য দৃষ্টান্তমূলক চরম দণ্ড জরুরি।
একই সময়ে নব্য আলোকিত অনেক মানুষ এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারকরা। এঁরা প্রাণদণ্ডের নৈতিকতা এবং অপরাধ–প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে লাগলেন। দাবি করলেন আইনের সংস্কারের, অপরাধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাস্তির। এঁদের মতে শাস্তির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সংশোধন এবং পুনর্বাসন— প্রাণনাশ নয়।
***
এই প্রতিবাদের ফল হল উপচে পড়া জেলখানা। আমেরিকাতে ততদিনে ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছে— থেকে থেকেই কিছু কয়েদিকে আটলান্টিকের ওপারে ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড এবং জর্জিয়াতে চালান করে দেওয়া হত। সঠিক হিসাব নেই, তবে সংখ্যাটা কমপক্ষে দশ হাজার। ১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের পর কলোনিগুলো ব্রিটিশ কয়েদি নিতে অস্বীকার করে।
এই পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন কুকের কয়েক বছর আগের অস্ট্রেলিয়া অভিযানে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে কয়েদি চালানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার নাম উঠে আসে। পূর্বোক্ত জোসেফ ব্যাংকস এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বছর দশেক নানা রকম চিন্তাভাবনা, টালবাহানা এবং বিতর্কের পর অবশেষে First Fleet দক্ষিণ গোলার্ধের প্রায় অজানা দেশটির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল।

দীর্ঘ আট মাসের সমুদ্রযাত্রার পর প্রথম নৌবহর নিউ সাউথ ওয়েলসে এসে পৌঁছল। ক্যাপ্টেন ফিলিপের বোটানি বে সেরকম পছন্দ হয়নি, কিছুটা দূরে পোর্ট জ্যাকসন নামে একটি স্থানে তিনি নোঙর ফেলেন।
দিনটা ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৭৮৮। আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার যাত্রা শুরুর দিন। দিনটি বর্তমানে ‘অস্ট্রেলিয়া দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। আদিবাসীদের কাছে অবশ্য এটি একটি কালো দিন— Invasion Day।
ভারতের গত তিনশো বছরের ইতিহাসে যেমন ১৭৫৭, ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ সাল, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসেো তেমনই ১৭৮৮ সাল একটি মাইলফলক।
কিছুদিন আগে এক পুরনো বইয়ের মেলা থেকে ‘1788’ নামে একটি বই কিনেছিলাম। লেখক পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে এই প্রথম নৌবহরের অধিকাংশ যাত্রীদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করেছেন— রীতিমত কৌতূহলোদ্দীপক কিছু মানুষের কাহিনি।
***
ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনতাম অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে Land of milk and honey. জানতাম ক্যাঙারু সহ নানা রকম বিদঘুটে জন্তু থাকে দেশটায়। দেশটা দারুণ ক্রিকেট খেলে। এটাও শুনেছি ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপন করতে করতে আদিবাসীদের প্রায় খতম করে দিয়েছে। সবগুলিই কম বেশি সত্যি।
আর একটা প্রচলিত ধারণা ছিল, দেশটার অধিকাংশ মানুষই কয়েদিদের বংশধর। এই তথ্যটা সঠিক নয়। কেন নয়, সেটা বোঝার জন্য ঐ ১৭৮৮-র পরবর্তীকালের ইতিহাস জানতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার সমৃদ্ধির ভিত্তি কিন্তু এই কয়েদিদের বিনা মাইনের শ্রম। আফ্রিকা থেকে আমদানি করা slaveদের সঙ্গে দ্বীপান্তরিত কয়েদিদের জীবন এবং সামাজিক অবস্থানের খুব একটা ফারাক ছিল না। শুরুর দিকের চাষবাস, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বানানো— সবই হয়েছে ওই কথায় কথায় চাবুক খাওয়া, পায়ে শিকল বাঁধা মানুষগুলোকে শোষণ করে।

উনবিংশ শতাব্দীতে ইংলন্ডে দাসপ্রথার অবসানের দাবি জানাতে শুরু করেন বেশ কিছু সংস্কারকামী মানুষ। একই সঙ্গে দ্বীপান্তরিত কয়েদিদের শোষণের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ চলতে থাকে। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ অস্ট্রেলিয়াতে নতুন কয়েদি পাঠানো প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শেষ কয়েদি–জাহাজ এসেছিল ১৮৬৮ সালে।
এই আশি বছরে মোট ১ লক্ষ ৬২ হাজার মানুষ কয়েদি হিসাবে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিলেন। আনুমানিক বর্তমান জনসংখ্যার কমবেশি ২০ শতাংশ মানুষের (৫০ লক্ষ) ধমনিতে আজও সেই কয়েদি–রক্ত বইছে।
শুরুর দিকে দেশটা ছিল এক উন্মুক্ত জেলখানা। সাত বা চোদ্দ বছরের মেয়াদের শাস্তির অবসানে মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষগুলির ইংলন্ডে ফিরে যেতে কোনও আইনি বাধা ছিল না। তবু অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি নানা কারণে। জন্মভূমির থেকে বহু দূরের, একদম অন্যরকম এই দেশটাতেই রয়ে গেছেন বাকি জীবন। এঁদের সন্তান–সন্ততিদের কাছে কিন্তু দেশটা জন্মভূমি। জীনা য়ঁহা, মরনা য়ঁহা, ইসকে সিওয়া জানা কঁহা!
ইংলন্ডের class system দক্ষিণ গোলার্ধের উপনিবেশটিতে ভালো রকমই জাঁকিয়ে বসেছিল। নানা দিকে সাফল্য পেলেও সমাজের ওপরতলায় এই কয়েদি রক্তবাহীদের জায়গা হত না। পরবর্তীকালে এই শ্রেণীর অনেকেই নথিপত্র নষ্ট করে বা নাম বদলে অবাঞ্ছিত convict stain মুছে ফেলার চেষ্টা করতেন।
দিন বদলায়। বর্তমানে অনেকেই গর্বের সঙ্গে বলেন: “আমার এক পূর্বপুরুষ কয়েদি হয়ে এদেশে এসেছিলেন।” প্রথম নৌবহরের যাত্রী হলে তো কথাই নেই!

১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সিডনিতে ছিলাম। যেখানে প্রথম আর্থার ফিলিপ পা রেখেছিলেন সেটি বর্তমানে সিডনি বন্দরের দক্ষিণ প্রান্তে Circular Quay নামে পরিচিত। জমজমাট প্রাণচঞ্চল এক জায়গা— বহুবার গেছি। সিডনি হারবার ব্রিজ, ফেরিঘাট, অপেরা হাউস, বটানিকাল গার্ডেন— সবই এই অঞ্চলে।
কল্পনা করেছি, আজকের এই ঝাঁ চকচকে স্থানটির কোথাও এক তাঁবুতে ক্যাপ্টেন ফিলিপ থাকতেন। দেশটিতে পা রাখার ক’দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন জোসেফ ব্যাংকস–এর অনেক তথ্যই ভুল ছিল। ১৭৭০ সালে হয়তো ভালো বৃষ্টির জন্য অঞ্চলটি গাছপালায় ভরা ছিল। ১৭৮৮-এ সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। বেশ কয়েকবছরের অনাবৃষ্টির ফলে মাটি রুক্ষ, চাষবাসের অযোগ্য।
প্রথম কয়েক বছর জীবন একেবারেই সহজ ছিল না। নানা সমস্যায় জর্জরিত নবীন উপনিবেশটিকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ফিলিপকে বহু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সময়ে সময়ে রীতিমত নিষ্ঠুরও হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি — নিজের দায়িত্বে অবিচল ছিলেন।
পরের পর্বে শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা লিখব।
পরবর্তী পর্ব প্রকাশ পাবে ২৬ জুলাই ২০২৩
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।