
ছয় ও সাত-এর দশকের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যরকম কবিতা ও যাপনের কথা ভেবেছিলেন শম্ভু রক্ষিত ও অনন্য রায়। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের একসময়ের অন্যতম মুখ হলেও প্রকৃত এক কবির জীবনই ছিল তাঁর। ছয়ের দশকের শেষ থেকেই সাড়া জাগানো কবি শম্ভু রক্ষিতের ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ এক অভিনব কাব্যভাষার নিজস্ব স্বাক্ষরযুক্ত কাব্যগ্রন্থ। আজীবন এক নির্বাসিত কবিতাযাপন করেছেন এই কবি। স্পর্ধার সঙ্গে মিশেছিল কাব্যভাবনার এক নিমগ্ন অভিযাত্রা। আজ সকালে তিনি মহাপৃথিবী থেকে চলে গেলেন। রেখে গেলেন ভাষা ও ভাবনার মধ্যবর্তী এক ধূসর অঞ্চল। এক সীমানাবিহীন নো ম্যানস ল্যান্ড। তাঁকে নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন কবি দীপক রায়। বন্ধুর স্মৃতিচারণ এবং কবিতা নিয়েই তাঁর এই নিবন্ধ।
ওই ছোটো খাটো মানুষটা যাকে আমি চার দশক ধরে চিনি, সে ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে আমার কাছে। কী বলব আমরা তাকে? লিটল ম্যাগাজিনের যুবরাজ? লিটল ম্যাগাজিনের রাজা? নাকি সম্রাট? নাকি রাজাধিরাজ? কী বলব তাকে?
২০১৫-র সেপ্টেম্বরে আমাদের কাগজের জন্য তার কাছে টেলিফোনে একটা লেখা চেয়েছিলাম। লেখার ফরমাশ ছিল, ‘আমার কবিতা’- এই বিষয়ে কবির ভাবনা। ব্যাখ্যা করে বলেওছিলাম, নিজের কবিতা নিয়ে যা খুশি লেখার স্বাধীনতা থাকবে তার। যুবরাজ শম্ভু রক্ষিত মন দিয়ে শোনে সব কথা, বলে কম। একমাস সময় দিয়েছিলাম। মাঝখানে একবার তাগাদা দিয়ে অক্টোবরে পুজোর ঠিক আগে আগে কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে বিকেল তিনটেয় লেখা দেবার সময় ধার্য হয়েছিল।
যে কোনও জায়গায় সময়মতো হাজির হওয়ার ব্যাপারে আমার খুব দুর্নাম আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে না পৌঁছলে ঠিক মর্যাদা থাকে না, এটাই অনেকে ভাবেন। এটাই এখন দস্তুর হয়ে গেছে। শম্ভু আমার ডাকে সুদূর মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানার বিরিঞ্চিবেড়িয়া থেকে ট্রেনে বাসে হেঁটে পাঁচ ছ’ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আসছে। শম্ভুর মতো মানুষ যদি তিনটের জায়গায় পাঁচটায় এসে পৌঁছয়, তাকে আমি সানন্দে গ্রহণ করব।

কলেজ স্ট্রিট থেকে বসন্ত কেবিন যাওয়ার পথে কলেজ স্কোয়ারের সুইমিং পুল পার হতে হয়। তিনটের ক’মিনিট আগেই ওখানে পৌঁছে গেছি। আকাশে শরতের মেঘ। সারা চত্বর জুড়ে কলেজ স্কোয়ারের পুজোর আয়োজন চলছে। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। ও কি সময় মতো আসতে পারবে? ঠিক তিনটে বাজলে ফোন করি ওকে। আমাকে অবাক করে শম্ভু জানাল- সে কফি হাউস পার হচ্ছে। অপেক্ষা না করে এক মিনিটের মধ্যে বসন্ত কেবিনে ঢুকে পড়ি আমি। অনেক দিন পরে ওকে চোখে দেখার আনন্দে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে সেই চিরদিনের চেনা মলিন পোশাকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সে বসন্ত কেবিনে ঢুকল।
মুখোমুখি বসালাম ওকে। টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসের জল এগিয়ে দিলাম। ডান হাতে গ্লাসটা ধরে ঢক ঢক করে সমস্ত জলটা খেয়ে নিল সে। ওর ছোটো খাটো মায়াবি চোখ আর অমলিন হাসির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকি আমি। ১৯৭৭ সালে শম্ভুকে নিয়ে কবি-সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তর গানের তিনটে লাইন ভেসে আসে।
আমার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট
পায়ে ছেঁড়া চটি
বার করি নানা কবিতার বই
কম্পোজ করি নিজেই ছাপাই…
আমার ভেতরে একট আলোড়ন তৈরি হচ্ছে। আজ আমি শুধু আমাদের কাগজের জন্য লেখা নিতে আসিনি। আমি ওর কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। কী ভাবে তা বলব। শম্ভু তা কী ভাবে নেবে, তা ভেবে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছি আমি। এসব কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি তাকে কী খাবে জিজ্ঞাসা করি। শম্ভু বলল, যা খাওয়াবে। এমনই উত্তর হবে জানতাম। আমি প্রথমে চা দিতে বলি। তারপর টোস্ট আর ওমলেট।
আমি অপেক্ষা করছি। সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে সে। আমি বলি, খুব নিচু গলায় সন্তর্পণে তাকে বলি – “এখন তো সরকার অনেক কবি শিল্পী আর গায়কদের একটা মাসিক ভাতা সাম্মানিক অনুদান হিসেবে দেয়, তা তুমি তো সঙ্গত কারণেই তা পেতে পারো। তুমি কি সরকারের কাছে একটা আবেদন করবে? আমি জানি আমার কোনও বন্ধু তা করেছেন। আর হয়তো তিনি তা পেয়েও যাবেন। আর তিনি পেলে তুমি তো অবশ্যই পাবে। তোমাকে শুধু একটা আবেদন করতে হবে। আর আমি সে আবেদন নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেব।”
প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, আমি এই সরকারের কেউ নই। কী ভাবে এসব পথে যাতায়াত করতে হয়, তাও জানা নেই আমার। কিন্তু ওই সময় কোনো দৈববলে প্রভূত এক ক্ষমতাবান কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল আমার। কথাপ্রসঙ্গে শম্ভুর কথা তাকে সামান্য বলেও রেখেছি। সেই ভরসায় আমি আজ কথা বলছি শম্ভুর সঙ্গে। কিন্তু আমার কথা শেষ হবার আগেই খুব সোজাসুজি শম্ভু বলল – “না, করব না।”
তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলে ওর কাছ থেকে আমার ফরমায়েশি লেখা চেয়ে নিই। ব্যাগ থেকে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া চারটে সাদা পাতা সে বের করে দেয়। সামান্য বয়েসের ভারে নিপুণ ছাঁদের হাতের লেখা শম্ভু হারিয়ে ফেলেছে। অনেক অসম্পূর্ণ বাক্যে শম্ভু যে লেখাটা আমাদের জন্য নিখে এনেছে তা ওর সামনে পড়তে থাকি। কোনও অস্পষ্ট শব্দ বুঝে নিই তার কাছে। কোনও অসম্পূর্ণ বাক্যকে ওর সম্মতি নিয়ে সংশোধন করে নিই। শম্ভু চেয়ারে একটা পা তুলে আয়েস করে খেতে থাকে। অনেক দূর থেকে আমাকে একটা লেখা দেবার জন্য সে এসেছে। খুব খিদে পেয়েছে ওর, অনুমান করে আরও একটু খাবারের ফরমাশ দিই। আরও এক কাপ চা।
আমি চারটে পাতা পড়তে থাকি আর ওর লেখার মণিমুক্তো আর হীরকখণ্ড পার করতে থাকি। বাইরে অপরাহ্ণের আলো কমে আসে। আমি ওর লেখার পাঠ উদ্ধার করি। কিন্তু মনের ভিতরে একটা তরঙ্গ বইতেই থাকে। আমাদের দ্বিতীয় কাপ চা পান শেষ হয়। এবার আমাদের ওঠার পালা। আমি মরিয়া হয়ে ওর হাতটা দু’হাতে চেপে ধরে ওকে আবার বলি – “শম্ভু তোমাকে বলতে হবে না, এই মুহূর্তে আমার বলার একটা জায়গা আছে, তুমি শুধু রাজি হও, আমি যা বলার বলব।” শম্ভু খুব ঠান্ডা আর নিঃস্পৃহ গলায় আবার বলল- “না।”

পকেট থেকে একটা খাম বের করে ওর জামার পকেটে দিই। আমি জানি আমার এই বন্ধুত্বটুকু গ্রহণ করবে সে। আমি জানতাম সে ভালোবাসা গ্রহণ করে। কিন্তু সে কোনওরকম অনুগ্রহ চাইবে না এতটা ভাবিনি। দারিদ্র তার নিত্যসঙ্গী, কিন্তু জীবনে কারও কাছে হাত পাতেনি সে। যে ভাবাবেগ নিয়ে এক শরৎকালে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তা সফল হয়নি। আমার ঘনিষ্ঠ একজনকে একথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, শম্ভু এরকম অনুদান কারও কাছে চাইবে না। এটা সকলেই জানে। শুধু আমি তা জানতাম না। ওই ভাঙা গাল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ওই মলিন পোশাকের ভেতর এক দৃঢ়চেতা মানুষ, আমার সব হিসেবকে তছনছ করে ক্রমশ কত বড়ো হয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। । পাঠকের জন্য এই মুহূর্তে আমার কাছে থাকা শম্ভুর লেখার মলিন পাতা থেকে দশটি পংক্তি তুলে দিই, যা কবিতার সাম্রাজ্যে দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক –
১। যে কবি পুরোহিতদের আঁকড়ে ধরে তার দ্বারা কবিতা লেখা সম্ভব নয়।
২। পৃথিবীর যেমন মৃত্যু নেই, কবিতার তেমনি বিনাশ নেই।
৩। কবির কাজ দাম্ভিক মূর্খদের সঙ্গে লড়াই করা নয়। লড়াই ও হারজিতের খেলায় কবি তাই কখনও জড়িয়ে পড়েন না।
৪। কবিতা শব্দের ঝংকার নয়। শব্দপ্রয়োগের কারুকলাও নয়।…সমুদ্রের মতোই বিস্তৃত তার অধিকারের সীমা।
৫। কবিতাকে বিরাট দেওয়ালের মতো উঁচু হয়ে উঠতে দেখার চোখ চাই।
৬। কবি সূর্য–তারকার মতো এই ব্রহ্মাণ্ডকে আজও নিয়ন্ত্রিত করছে।
৭। আমি উচ্ছ্বাস থেকে সংযমে, কোমলতা থেকে রুক্ষতায়, রোম্যান্টিকতা থেকে ক্লাসিকাল রীতির দিকে কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
৮। আজ আমরা আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। মানুষ যেন বয়স্ক এক উদ্বাস্তু; নতুন এবং অপরিচিত কোনও দেশে এসে বাস করছেন…
৯। আমরা দাঁড় টেনে চলছি প্রাচীন নির্দেশিকা লক্ষ্য করে। আমরা সত্যি চলেছি এক নতুন সমুদ্রপথে।
১০। কবি হবেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ। এক পরিপূর্ণ দার্শনিক যার মধ্যে সত্তা এবং বিষয় হবে অবিচ্ছেদ্য। তাকে ইন্দ্রিয়বাদী বললে যেমন ভুল হবে, অধ্যাত্ববাদী বা বিজ্ঞানী বললেও ঠিক বলা হবে না।
শম্ভু রক্ষিতের কাছে আমরা তাঁর নিজের কবিতা ভাবনার কথা চেয়েছিলাম। তার বদলে সে যে লেখা দিল তা তো কবিতা বিষয়ে তার ভাবনার কথা, যা কবিতার দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া দরকার। তার থেকে পছন্দ মতো ছোট অংশ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম। আর দেখলাম সাড়ে পাঁচ ফুট মানুষটা পাহাড়ের মতো উঁচু আর অস্পষ্ট হয়ে ‘বসন্ত কেবিন’ ছেড়ে কলেজ স্ট্রিট পার হয়ে কলকাতা মহানগরী পার হয়ে আমাদের সব হিসেব তছনছ করে, অনেক দূরে আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সেই ঘাসওয়ালা
শম্ভু রক্ষিত
সেই ঘাসওয়ালা
তার ভাষায়, ‘ঠিকমত কালো, পাতলা’
‘বুজুকুশাস’
জীবানু গজাবার উপায় খুঁজছিল
সেই ঘাসওয়ালা
তিনপায়ে দ্রুত ছুট লাগিয়ে
ভূঁই-এর প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছিল
বিস্ময় ০০০ তার দেহ থেকে গজাচ্ছে
তিনটি অপ্রতিহত দ্গদগে লালচে মাথা
সংলাপঃ নিয়তির বচনের সঙ্গে জ্বলতে থাকছে
পদহীন শিশু
ভিখিরি ও মাছির তাড়া খেয়ে
কখনো ছুটে
ঘন ঘিঞ্চি বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ছে
কখনও আওড়াচ্ছে;
আলাউকম আবশো আমহারাঞ্চা আউকাল্লে
সেই ঘাসওয়ালা
আর হাতির শূঁড় যাদের গলায়
যাদের কাছে শিলমোহরের কোন গরু নেই
তাঁবুর আচ্ছাদন বিছিয়ে
তাদের জন্য ছায়ায় আশ্রয় তৈরী করছে
সেই ঘাসওয়ালা
সেই ঘাসওয়ালা
টুকরো টুকরো মেঘেদের ভর করে মরিয়া রহস্যে ফুলছে
ষাঁড়ের চামড়ায় তৈরী শাদা ঢাল নিয়ে
অনেক জলাশয়কে ঘিরে ধরছে
দীপক রায় সত্তর দশকের কবি। তখন থেকেই নিজেকে ব্যক্ত করে চলেছেন নিরাভরণ কবিতার আঙ্গিকে। শুরুর দিনগুলোয় তাঁর পদ্য বাসা বাঁধতে চেয়েছিল রূপকথার ফুলভাসা জলের পুকুরপাড়ে। কিন্তু ক্রমাগত ভয় ও সন্তাপে শেষমেশ তাদের স্থান হয় কালো কুচ্ছিত নাগরিক ল্যাম্পপোস্টের তলায়। 'দৈনিক কবিতা' ও 'অণুমাত্রিক' নামে দুটি ছোট কাগজের সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত রেখেছেন নিজেকে। কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা চার। বাংলায় ছোট কবিতা চর্চার ইতিহাস রক্ষার কাজ তাঁর অন্যতম ব্রত।
5 Responses
ভাল লাগল বললে, স্পর্ধা দেখানো হয়। কেঁপে গেলাম – “আধুনিকতা থেকে দূরে এক বয়স্ক উদ্বাস্তুর মতো”।
শম্ভূ রক্ষিতের না কোনও পূর্বসূরী, না কোনও উত্তরসূরী। অনুসরণকারীও নেই। আমি এক অনুরাগীমাত্র।
অসংখ্য ধন্যবাদ কবি দীপক রায়কে
মাঝেমধ্যে কিছু কিছু কবিতার পাঠক আমি। চিন্ময় বাবুর জন্যই শম্ভু রক্ষিতের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলাম। মন্তব্য করার ক্ষমতা আমার নেই।
সেই চিরচেনা শম্ভুদাকে দেখতে পেলাম। শম্ভুদার মতো কখনও কেউ ছিলেনও না, হবেনও না।
অসাধারণ ।”আমরা সত্যি চলেছি এক নতুন সমুদ্রপথে।’প্রণাম।