পুরুবংশজাত উপরিচর বসু চেদি দেশের রাজা ছিলেন। তাঁর পত্নীর নাম গিরিকা। গিরিকা ছিলেন কোলাহল পর্বত ও শুক্তিমতী নদীর কন্যা। এক বার মৃগয়ায় গিয়ে পত্নীকে স্মরণ করে উপরিচর বসুর শুক্র স্খলন হয়। সেই স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে অন্য আর একটি শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে শুক্র যমুনার জলে পতিত হয়। যমুনার জলে বাস করত এক মৎসী যে ছিল ব্রহ্মশাপগ্রস্থ অপ্সরা অদ্রিকা। অদ্রিকা গর্ভবতী হয়। দশম মাসে ওই মৎস্যরূপী অপ্সরা ধীবরের জালে ধরা পড়লে তার পেট চিরে একটি পুত্র ও এক কন্যা পাওয়া যায়। পুত্রটিকে উপরিচর বসু গ্রহণ করলেও কন্যাটিকে ধীবরের কাছে রেখে চলে যান। পুত্রের নাম মৎস্য আর কন্যাটি মৎস্যগন্ধা।
মৎস্যগন্ধা ধীবর দাসরাজের কাছে লালিত পালিত হয়। সে পিতার কাজে সাহায্য করত। যমুনায় খেয়া পারাপার করে পারানির কড়ি নিত তখনকার যুগে যা ছিল নিন্দিত। এক দিন পরাশর ঋষির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। পরাশরের ঔরসে তাঁর একটি পুত্র জন্মায়, যাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পিতা পরাশরের সঙ্গে চলে যান। মৎস্যগন্ধার গায়ের দুর্গন্ধ ঋষির আশীর্বাদে সুগন্ধে পরিণত হয়। তিনি যোজনগন্ধা নামে খ্যাত হন। তাঁর অন্য নামগুলি হল কালী, গন্ধকালী, গন্ধবতী, বাসবী এবং সত্যবতী। ঋষি পরাশরের আশীর্বাদে সত্যবতীর কৌমার্য অটুট থাকে।
এই সুগন্ধের কারণে হস্তিনার রাজা শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহ হয়। শান্তনু স্ত্রীপরিত্যক্ত। গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এক মাত্র পুত্র দেবব্রত হস্তিনার যুবরাজ। সত্যবতীর পালক পিতা দাসরাজ বিবাহের শর্ত হিসাবে বলেছিলেন, সত্যবতীর পুত্র যেন হস্তিনার রাজা হয়। দেবব্রতের সন্তানরা যাতে পরবর্তীকালে সিংহাসনের দাবি জানাতে না পারে, সে জন্য দেবব্রত আজীবন ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা করে ‘ভীষ্ম’ নামে খ্যাত হন। সত্যবতী সে সব মেনে নিয়েছিলেন।
তরুণী সত্যবতী বৃদ্ধ রাজা শান্তনুর মহিষী হলেন। শান্তনুর ঔরসে তাঁর দুটি পুত্র জন্মায়। বড়টির নাম চিত্রাঙ্গদ, ছোটোটি বিচিত্রবীর্য। পুত্রদের শৈশব কাটতে না কাটতে শান্তনু পরলোকগমন করেন। রাজমাতা সত্যবতী হলেন হস্তিনার শাসক, তাঁর আদেশে ভীষ্ম রাজকার্য পরিচালনা করতেন। ভীষ্ম বিমাতা সত্যবতীকে ‘দাসেয়ী’ নামে ডাকতেন। ‘দাসেয়ী’ কথার অর্থ হল দাসকন্যা। উপরিচর বসুর কন্যা হিসাবে তাঁর সমাদর ছিল না। সত্যবতী-শান্তনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রাঙ্গদ খুব অল্প বয়সে বলশালী বীর হয়ে ওঠেন। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। বিচিত্রবীর্য তখন নিতান্ত বালক। বিচিত্রবীর্যের নামে রাজত্ব চলছে ঠিকই কিন্তু তার পেছনে রয়েছেন রাজমাতা যোজনগন্ধা। যথাকালে বিচিত্রবীর্য যুবক হলে তাঁর বিবাহ হয় কাশীরাজকন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে। বিবাহের মাত্র সাত বছর পরে তিনি পরলোকগমন করেন। হস্তিনার রাজপ্রাসাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন বিধবা রাজমাতা সত্যবতী, তাঁর দুই বিধবা পুত্রবধূ আর ব্রহ্মচারী ভীষ্ম। ভীষ্ম ছাড়া কুরুবংশে জীবিত কোনও পুরুষ নেই। তিনি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী।
এক দিন কথার ছলে সত্যবতী তাঁর সৎ পুত্র দেবব্রতকে বললেন, তুমি যদি বিবাহ না করো, তা হলে কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। দেবব্রত তাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা বললে সত্যবতী নীরব হয়ে যান।
কয়েক দিন পর রাজমাতা পুনরায় দেবব্রতকে বললেন, তুমি শ্রুতি, স্মৃতি, বেদাঙ্গ প্রভৃতি সকল শাস্ত্রের তত্ত্ব অবগত আছ, শান্তনুর বংশরক্ষার ভার এখন তোমার উপর। অকালে পরলোকগত নিঃসন্তান বিচিত্রবীর্যের রূপযৌবনসম্পন্না দুই বধূই পুত্রকামা। হে মহাবাহো, তুমি আমার নিয়োগ অনুসারে তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে ধর্মরক্ষা করো। দেবব্রত আবারও সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সত্যবতীকে জবাব দেন, হে দাসেয়ী! আপনি যা বললেন তা ধর্মশাস্ত্রের অনুমোদিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি কি আমার শপথ জানেন না? আমি কিছুতেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারব না। আপনি বরং কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে অর্থ দ্বারা নিয়োগ করুন। ঋষি দীর্ঘতমার উপাখ্যান সবিস্তারে বললেন ভীষ্ম। অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমা বলি রাজার পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-পুণ্ড্র-সুহ্মের জন্ম দিয়েছিলেন।
নিয়োগের উপাখ্যান শুনে রাজমাতা সত্যবতীর মনে পড়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্যাসদেবের কথা, যাঁকে তিনি পরাশরের ঔরসে জন্ম দিয়েছিলেন। এক কালে নিয়োগ প্রথা বর্তমান ছিল। কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করে বিধবাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা যায়। এই ভাবে জাত পুত্রকে বলা হয় ‘ক্ষেত্রজ’।
কিন্তু মনুর নিয়ম অনুযায়ী, পরাশর হলেন অম্বষ্ঠ। অম্বষ্ঠপুত্র কি ব্রাহ্মণ! কে জানে! তবে পরাশর বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। সেই ঋষির পুত্র এবং সত্যবতীর গর্ভজাত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন চিরজীবী ঋষি। তাঁকে স্মরণ করলেন রাজমাতা। সে কথা জানালেন ভীষ্মকেও। ভীষ্ম সত্যবতীকে সমর্থন করলেন। হস্তিনার প্রাসাদে প্রবেশ করলেন পরাশর-সত্যবতীর পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। সত্যবতী তাঁকে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদন করতে বললেন। ব্যাসদেব বললেন, কন্যাদের মন প্রস্তুত করতে সময় দিন। এক বছর ধরে তারা ব্রত করলে তবেই আমাকে সহ্য করতে পারবে। সত্যবতী কালক্ষয় করতে চাইছিলেন না। তিনি এক রকম জোর করেই ব্যাসদেবকে পুত্রবধুদের কাছে পাঠালেন। পুত্রবধূরা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেন না ব্যাসদেবকে। যদিও তাঁরা সাজসজ্জা করে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে তাঁদের কাছে গঙ্গাপুত্র দেবব্রত আসবেন। ঋষি ব্যাসের রূপ-গন্ধ সহ্য হল না তাঁদের। যথাকালে দুই বিধবা ভ্রাতৃবধূর গর্ভে ব্যাসদেব উৎপন্ন করলেন ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুকে এবং শূদ্রা এক দাসীর গর্ভে বিদুরকে। সে কালে দাসীরা প্রভুর ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হতেন। রাজবধূদের গর্ভে উৎপন্ন পুত্ররা স্বাভাবিক নয়। এর জন্য ব্যাসদেব মাতা সত্যবতীর অধৈর্যকে দায়ী করলেন।
রাজমাতা সত্যবতীই হস্তিনার সমস্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি এক কালে দক্ষ হাতে তিনি যমুনায় নৌকা বাইতেন। তেমনই দৃঢ় হাতে হস্তিনা রাজ্যকে ধরে রইলেন, বেসামাল হতে দিলেন না। জ্যেষ্ঠ পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে অনুজ পাণ্ডুকে রাজসিংহাসনে বসানো হল। কিন্তু কালের পরিহাসে পাণ্ডুও পরলোকগমন করলেন। সন্তান-উৎপাদনে অক্ষম পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে চলে গিয়েছিলেন, সেখানেই তিনি মারা যান। কনিষ্ঠা স্ত্রী মাদ্রী সহমৃতা হন। পাণ্ডু ও মাদ্রীর মরদেহ নিয়ে কুন্তী পঞ্চপাণ্ডবকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনায় এলেন। পঞ্চপাণ্ডব পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র।
রাজমাতা সত্যবতী এখন কী করবেন, ভেবে পান না। পৌত্র বিদুর দাসীপুত্র, তাঁকে রাজপদে বসানো যাবে না। সত্যবতীর বয়স হয়েছে, সব কিছু ঠিক মতো ভাবতে পারেন না। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজপদে বৃত হয়েছেন। তাঁর শতাধিক পুত্র ও একটি কন্যা রয়েছে। সত্যবতী বুঝলেন, এই বার সত্যিই ঘোর দুর্দিন আসছে। ধার্তরাষ্ট্র ও পাণ্ডবদের মধ্যে শুরু হবে ক্ষমতার লড়াই। তাঁরা সকলেই তাঁর নাতিপুতি। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা ঔরসজাত কিন্তু পাণ্ডুর পুত্ররা ক্ষেত্রজ। অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠলেন সত্যবতী। এমন সময় তাঁর সামনে এলেন জ্যেষ্ঠ ও একমাত্র জীবিত পুত্র চিরজীবী ব্যাসদেব। তিনি মাকে জানালেন, কুরুবংশের ঘোর অমঙ্গল আসন্ন। এমতাবস্থায় অরণ্যে গিয়ে তপস্যা করা শ্রেয় কারণ সত্যবতী এই বয়সে ভীষণ অমঙ্গলের ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না। সত্যবতী পুত্রের কথায় সম্মতি জানিয়ে দুই বিধবা পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সঙ্গে নিয়ে বাণপ্রস্থে গেলেন। সেখানেই তাঁরা মারা যান।
সত্যবতীর চরিত্র মহাভারতে উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। কুরু বংশের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এই মহীয়সী নারী। জন্মকাল থেকে তাঁর জীবন অ-সাধারণ। মৎস্যগন্ধার জন্ম অলৌকিকতায় মোড়া। শৈশবে জৈবিক মাতাপিতা তাঁকে ত্যাগ করেন। মা ছিলেন অপ্সরা অর্থাৎ স্বর্গবেশ্যা। পিতা রাজা। স্বাভাবিক নিয়মে চেদি রাজ্যের রাজকুমারী হয়ে জীবন কাটানোর পরিবর্তে তিনি শূদ্রের ঘরে প্রতিপালিত হয়ে খেয়ানীর কাজ করেন। যৌবনের শুরুতে ঋষি পরাশরের সঙ্গে সম্পর্ক ও চিরজীবী এক পুত্রের জন্ম দেওয়ার জন্য তিনি অবস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। এই পুত্র মহাভারতের রচয়িতা ও কেন্দ্রীয় চরিত্র। জীবৎকালে দুই পুত্রের অকালমৃত্যু তাঁকে একটুও টলাতে পারেনি। অন্দরমহলে বসে হস্তিনার সমস্ত রাজকার্য তিনি পরিচালনা করেছেন। পুত্রবধূদের গর্ভে নিয়োগ প্রথায় সন্তান উৎপাদন করলেও সেই পুরুষের বীর্য গ্রহণ করা হয়েছে যিনি সত্যবতীর গর্ভজাত। সত্যবতীর সময় কালে হস্তিনার রাজনীতি-অর্থনীতি সব কিছু আমূল বদলে যায়। যৌথ সম্পত্তির মালিকানা রাজা তথা প্রজাদের, এই ধারণা বদলে গিয়ে ব্যক্তি-মালিকানা বৈধতা পেতে শুরু করে। মৎস্যগন্ধাকে সমাজে নন্দিত করে তোলার পেছনে যাঁর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি তিনি পরাশর—সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। তাঁর সংহিতা চালু হয় হস্তিনায়। পরাশর-সত্যবতীর পুত্র ঋষি ব্যাসদেব হয়ে ওঠেন হস্তিনার রাজনীতির অন্যতম কাণ্ডারী।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।