এতকিছু থাকতে হঠাৎ একটা বাংলো নিয়ে লেখা কেন! এ-প্রশ্ন নিজের মনেও যে আসেনি, তা নয়। তারপরও, হ্যাঁ, একটা বাংলো নিয়েই। এমন এক বাংলো, যা হয়ে উঠেছিল উনিশ শতকের শহরতলির গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা। কলকাতা থেকে বারাকপুর যাওয়ার পথে যে-ঠিকানা এড়ানোর উপায় ছিল না কারোর। অথচ, কালের নিয়মে সম্পূর্ণ অনালোচিত, বলা ভালো বিস্মৃত। তবে কি তত গুরুত্বপূর্ণও নয়? না-লিখলেও চলত?
এই দ্বন্দ্বের মাঝখানেই ভেসে ওঠে উনিশ শতকের কয়েকটি মানচিত্র। বিটি রোডের ধারে, বেলঘরিয়ার উত্তরে বাংলোটির উল্লেখ স্পষ্ট। নাম— Cox’s Bungalow. অথচ, মুখ্য গ্রাম তথা জনপদ ছাড়া অন্যান্য নামোল্লেখ মানচিত্রগুলিতে বিরল। তাহলে কক্সের বাংলোই কেন? কী এর পরিচয়?
বিটি রোডের ‘জন্ম’, শৈশব-কৈশোর ও অন্যান্য : তন্ময় ভট্টাচার্য
এখান থেকেই শুরু অনুসন্ধানের। বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন তথ্য জুড়ে-জুড়ে একটা রূপরেখা নির্মাণ করলে, সার্বিক পরিচিতি ফুটে ওঠে স্পষ্টতই। ‘বাংলো’ যখন, বাংলার দু-চালা বা চারচালা স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত— ধারণা করা যায়। কিন্তু যাঁর নামে পরিচিত, সেই কক্স সাহেবটি কে? ইতিহাস ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স (১৭৬০-১৭৯৯) নামের একজন ব্রিটিশ কূটনীতিকের হদিশ দেয়, যিনি বাংলায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর নামেই নামকরণ বাংলাদেশের কক্সবাজার-এর।

আলোচ্য বাংলোটির আদি মালিক হিরাম কক্সই কিনা, বলা মুশকিল। ফলে, পরিচয়ের ধোঁয়াশা সঙ্গে নিয়েই এগোনো যাক। কামারহাটির গ্রাহাম রোড যেখানে বিটি রোডে এসে মিশছে, তার ঠিক বিপরীতেই অবস্থান ছিল কক্সের বাংলোর (বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, সাগর দত্ত হাসপাতালের উল্টোদিকে)। আঠেরো শতকের শেষের দিকেই এটির ব্যবহার শুরু হয়, কেন-না উনিশ শতকের শুরু থেকেই উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন নথিপত্রে।
গোড়ার দিকে কক্সের বাংলোর মূল পরিচিতি ছিল আস্তাবল ও সরাইখানা হিসেবে। কলকাতা থেকে বারাকপুর অবধি দীর্ঘ রাস্তা বিটি রোড ধরে যাওয়ার পথে, প্রায় মাঝামাঝি (কলকাতা থেকে ৮ মাইল দূরে) অবস্থিত এই বাংলোয় ঘোড়া বদল করতেন যাত্রীরা। এছাড়াও যে-সমস্ত বগি (ঘোড়ায়-টানা গাড়ি) ব্যবহৃত হত যাতায়াতের জন্য, সেগুলিরও ঘোড়া বদলের অবশ্যম্ভাবী ঠিকানা ছিল এই বাংলো। বস্তুত, সে-আমলে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য ‘রিলে’ পদ্ধতিতে ঘোড়া পরিবর্তনের রীতি প্রচলিত ছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের এক নথি থেকে জানা যায়, কলকাতা থেকে কক্সের বাংলোয় যাওয়ার জন্য ঘোড়া এবং বগি ভাড়া দৈনিক ৫ টাকা খরচ, আর সেইসঙ্গে প্রাতরাশ ও রাতের খাবার ধরলে খরচ গিয়ে দাঁড়াত দৈনিক ১২ টাকায়।
চারপাশে ধানক্ষেত, কাদামাঠ। সি ফিঞ্চ নামের এক ব্রিটিশ ডাক্তারের মতে, বর্ষায় ও শীতের শুরুতে এই ধানক্ষেত থেকে পচা দুর্গন্ধ বেরোত, যার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়তেন মানুষজন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের ঘোড়া রাখার ঠিকানা হিসেবেও ব্যবহার করত বাংলোটির নাম। শুধু ঘোড়া-বদলের ঠিকানাই নয়, ব্যবস্থা ছিল রাত্রিবাসেরও। আর সেই সূত্রেই ঘটেছিল এক চুরির ঘটনা, যার মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। জনৈক উইলিয়াম ডেভিস বাস করতেন কক্সের বাংলোয়। ২৩ মে ১৮৫২-তে তাঁর ঘর থেকে ঘড়ি, কম্বল ও হুঁকো চুরি যায়। চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হয় দুই বাঙালি— বিশ্বনাথ ভেলকি ও গণেশ দাস। দোষ স্বীকার করে নেয় দুজনেই। আদালত ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে তাদের।
তৎকালে শিকার ছিল সাহেবদের অন্যতম বিনোদন। শুধু বিনোদনই নয়, রীতিমতো ‘স্পোর্ট’-ও। সকাল-সকাল ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ত তারা, জড়ো হত কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জায়গায়। তারপর, সঙ্গীসাথী জুটিয়ে শিকারযাত্রা। সঙ্গে থাকত শিকারি কুকুরও। তেমনই এক মিটিং-এর জনপ্রিয় ঠিকানা কক্সের বাংলো।
১৮০১ সালের ক্যালকাটা গ্যাজেটের একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, জনৈক স্যামুয়েল অ্যালেনের মালিকানাধীন ছিল কক্সের বাংলোর আস্তাবলটি। কলকাতার শেরিফের পক্ষ থেকে সেই আস্তাবল নিলামে তোলা হয়। তার পরবর্তী কার্যক্রম অবশ্য অজানাই। ১৮১৩ সালে ডব্লিউ ই মরিসনের মানচিত্রে বেলঘরিয়া ও আগরপাড়ার মধ্যিখানে Cox’s Stables চিহ্নিত। ১৮৪১-এ চার্লস জোসেফের মানচিত্র ও ১৮৫৩-র সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি মানচিত্রেও কক্সের বাংলোর উল্লেখ স্পষ্ট। বস্তুত, ততদিনে ঘোড়া-সংক্রান্ত পরিষেবার পাশাপাশি অন্যান্য ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছে বাংলোটি।
গঙ্গাবক্ষে আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা, সাক্ষী ছিল বালি-দক্ষিণেশ্বর : তন্ময় ভট্টাচার্য
তৎকালে শিকার ছিল সাহেবদের অন্যতম বিনোদন। শুধু বিনোদনই নয়, রীতিমতো ‘স্পোর্ট’-ও। সকাল-সকাল ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ত তারা, জড়ো হত কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জায়গায়। তারপর, সঙ্গীসাথী জুটিয়ে শিকারযাত্রা। সঙ্গে থাকত শিকারি কুকুরও। তেমনই এক মিটিং-এর জনপ্রিয় ঠিকানা কক্সের বাংলো। চারপাশের জলাজঙ্গল পরিবেশে পাওয়া যেত প্রচুর শিয়াল। সাহেবদের বন্দুকের লক্ষ্য হয়ে উঠত সেসব শিয়ালই। সাধারণত শীতকালে আয়োজিত হত এই ‘খেলা’। ফ্লোরিয়াট নামে এক সাহেবের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৪৫ সালের ডিসেম্বরে তেমনই উদ্দেশ্যে সবাই জড়ো হয়েছিলেন কক্সের বাংলোয়। সেই দলে ছিলেন লেখক স্বয়ং, কলকাতার বিখ্যাত শিকারী টম পিটস সহ অন্যেরা। ফ্লোরিয়াট বর্ণনায় জানাচ্ছেন, বাংলোর পাশের জমি থেকে নিজের-নিজের ঘোড়ায় চেপে সকলে রওয়ানা দিয়েছিলেন শিকারে। পথে আখক্ষেত থেকে আখ ভেঙে খেতে-খেতে চলেছিল সেই যাত্রা। খানিক এগোতেই সামনে বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি, আরও খানিকটা এগোলে জঙ্গল। টানা একঘণ্টা শিয়াল শিকার করে বেরিয়েছিলেন সকলে। তারপর আবার কক্সের বাংলোয় ফিরে আসা। এর পর, ওই বছরেই আরও দুদিন কক্সের বাংলোয় জড়ো হন ফ্লোরিয়াট ও তাঁর সহ-শিকারীরা।

এছাড়াও বিভিন্ন টুকরো-টুকরো ঘটনার হদিশ মেলে কক্সের বাংলোকে কেন্দ্র করে। ১৮৩৯ সালে একটি মিশনারি পত্রিকায় বাংলোটির প্রসঙ্গ উঠে আসে খানিক ভিন্নভাবে। ১৭৯৪ সালে চালু হওয়া বেলঘরিয়ার রথযাত্রা ততদিনে বেশ বিখ্যাত। বালির পাঠক পরিবার ও বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত রথযাত্রায়, বেলঘরিয়ার বিটি রোড ধরে এগোত রথ। মিশনারিদের মতে, প্রত্যেকবারই রথের চাকার নিচে চাপা পড়ে কেউ-না-কেউ আহত হত বা মারা যেত। সে-বছর রথের দিন (১২ জুলাই ১৮৩৯) কক্সের বাংলোর সামনে, বিটি রোডের ওপর পড়ে ছিল তেমনই এক মৃতদেহ। রথের চাকা পিষে দেয় সেই ব্যক্তিকে।
এক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে বাংলোটি। ১৮৫২ সালের এক সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, সে-বছর ২৭ ডিসেম্বর কক্সের বাংলো থেকে কলকাতায় ফিরছিল চার ইংরেজ। ফেরার পথে, রানিকুঠির (বনহুগলির নিকটবর্তী) কাছে একটা পথকুকুরকে ওদেরই দুজন গুলি করে। রানিকুঠির দারোয়ানরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে, এক দারোয়ানকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। অবশেষে ওই চার ইংরেজকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুর জেলে।
অনালোচিত ’৭১: বাংলাদেশের সমর্থনে প্রকাশ যে ‘হাংরি’ লিফলেটের : তন্ময় ভট্টাচার্য
বিটি রোডের ধারে অবস্থিত হওয়ায়, কলকাতা থেকে বারাকপুরের সেনানিবাসে যাতায়াতকারী ইংরেজ সৈন্যরা কক্সের বাংলোয় হাজির হত প্রায়ই। সেই সূত্রে অসন্তোষও জমেছিল বেলঘরিয়াবাসীর মনে। ১৮৫২-র ২৪ অক্টোবর, ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদককে বেলঘরিয়ার অধিবাসীরা লেখেন যে, সাম্প্রতিককালে কক্সের বাংলোয় হাজির-হওয়া ঘোড়সওয়ার বাহিনী স্থানীয় জমিদারদের থেকে দৈনন্দিন খাদ্য-সরবরাহ পাওয়া সত্ত্বেও, ঘোড়ার ঘাস-সংগ্রহের জন্য গরিব কৃষকদের ধানগাছের ক্ষতি করছে। বেলঘরিয়াবাসীদের আশঙ্কা, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই উপদ্রব আরও বাড়তে পারে। পত্রিকায় চিঠি পাঠানোর অর্থ, এই সংবাদ যেন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছোয় ও সুষ্ঠ সমাধান হয়। শেষমেশ কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়েছিল কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।
কলকাতা-বারাকপুর রেলপথ চালু হওয়ার (১৮৬২) ফলে, যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিটি রোড তথা কক্সের বাংলোর গুরুত্ব খানিক কমে আসে। অবশ্য তারপরও সৈন্যদের যাতায়াত ছিল সেখানে। তবে ১৮৯১ সালের একটি খবর থেকে অনুমিত হয়, উনিশ শতকের আশির দশকে কক্সের বাংলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বা প্রায়-অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল।
১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে কক্সের বাংলোর সংযোগের হদিশ পাওয়া যায় তৎকালীন সরকারি টেলিগ্রাফ থেকে। সে-বছর মার্চ মাসে মঙ্গল পাণ্ডে যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তখন বারাকপুর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর জেনারেল জন বেনেট হার্সি। সেই হার্সি-কেই ১৮ মে একটি টেলিগ্রামে ভারত সরকারের সেক্রেটারি আবেদন জানান যে, তিনি যেন তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে কক্সের বাংলোয় তোপশ্রেণি (battery) নিয়ে আসেন এবং তা দিয়ে পরবর্তীতে বারাকপুর পার্কে টহল দেওয়া হয়। আদেশ-অনুযায়ী, কক্সের বাংলোয় অবস্থান নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তোপশ্রেণি। বারাকপুর থেকে ভারতীয় সেনারা যদি কলকাতায় বিদ্রোহ করতে রওয়ানা দেন, তাঁদের প্রতিহত করার ব্যবস্থা হিসেবেই তোপের আয়োজন করা হয়েছিল এখানে।
এছাড়াও বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত খবর ও স্মৃতিচারণে কক্সের বাংলোয় সেনা-অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। কলকাতা-বারাকপুর রেলপথ চালু হওয়ার (১৮৬২) ফলে, যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিটি রোড তথা কক্সের বাংলোর গুরুত্ব খানিক কমে আসে। অবশ্য তারপরও সৈন্যদের যাতায়াত ছিল সেখানে। তবে ১৮৯১ সালের একটি খবর থেকে অনুমিত হয়, উনিশ শতকের আশির দশকে কক্সের বাংলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বা প্রায়-অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। খবরটি থেকে জানা যায়, কলকাতার জনৈক হোটেলমালিক মি. অ্যান্ড্রুজ কক্সের বাংলো পুনরায় খুলছেন এবং এর ফলে পথচারী, সাইকেলচালক, খেলোয়াড় ও বনভোজনকারীরা উপকৃত হবে। অ্যান্ড্রুজ সাহেবের সেই উদ্যোগ যে বাস্তবায়িত হয়েছিল, তা বোঝা যায় বছর ছয়েক পরের আরেক খবর থেকে। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে কাশীপুর থেকে বারাকপুরে মার্চ করে যাওয়ার পথে সেনারা দশ মিনিটের জন্য কক্সের বাংলোয় বিশ্রাম নিয়েছিল এবং তাদের কমলালেবু-সহ অন্যান্য খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল।
স্বাধীনতা : দু-বাংলার বিচ্ছেদের দ্যোতক যখন পাসপোর্ট-ভিসা : তন্ময় ভট্টাচার্য
এরকম বিচ্ছিন্ন কিছু খবর ও ঘটনা জুড়ে-জুড়ে কক্সের বাংলোর আভাস পাওয়া যায় গোটা উনিশ শতক জুড়েই। অথচ বিশ শতকের কোনও নথিতেই বাংলোটির উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯২২ সালে সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মানচিত্রে (৭৯বি/৬) কক্সের বাংলো উল্লেখহীন, বদলে সেই স্থানে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা ও ডিসপেনসারি (ঠিক বিপরীতে, বিটি রোডের অপর পাড়ে ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাগর দত্ত হাসপাতাল) চিহ্নিত। অর্থাৎ, বিশ শতকের প্রথম দু-এক দশকের মধ্যেই বাংলোটি পরিত্যক্ত হয় ও ভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায় ঐতিহ্যবাহী কক্সের বাংলো।

বাংলো-পরিচয় ছাপিয়ে ‘ঠিকানা’ হয়ে ওঠা সহজ নয়, অথচ তেমনটাই ঘটেছিল কক্সের বাংলোর সঙ্গে। তবে এ-পরিচিতির গণ্ডি ছিল ব্রিটিশদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোনও নথিতেই কক্সের বাংলোর সঙ্গে বাঙালি তথা ভারতীয়দের সম্পৃক্ততার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এর কারণও স্পষ্ট— বরাবরই সাহেবদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এটি; এমনকি সিপাহি বিদ্রোহের সময় হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আশ্রয়স্থলও। অবশ্য এসবের পরেও এর খ্যাতিতে ভাটা পড়েনি। চার্লস ডিকেন্স সম্পাদিত ‘হাউসহোল্ড ওয়ার্ডস’ পত্রিকায় রিচার্ড এস. হর্নের প্রবন্ধতেও (১৮৫১) উঠে আসে এর নাম। হর্ন লিখেছিলেন, বিটি রোড ধরে একটা মা-হাতি ও তার মেয়েকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল, কিন্তু কলকাতা শহরে হাতির প্রবেশাধিকার না-থাকায়, কক্সের বাংলোতেই রাখা হয় তাদের।
শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, ফিরে যাওয়া যাক গোড়ার প্রশ্নেই। কক্সের বাংলো নিয়ে চর্চা আজকের দিনে কতটা প্রয়োজনীয়, বিশেষত তা যখন সাম্রাজ্যবাদেরই চিহ্নবাহী? সে-বিচারের ভার পাঠকের। তবে কলকাতা-কেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার বিপরীতে শহরতলির (তৎকালীন গ্রামাঞ্চল) একটি ঠিকানা কীভাবে ‘বিশেষ’ হয়ে উঠেছিল, তার পর্যবেক্ষণ আদতে স্থানিক গুরুত্বকেই সূচিত করে— তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সর্বোপরি কক্সের বাংলো এক প্রতীক, যার মধ্যে লুকিয়ে শাসকের ক্ষমতার ইঙ্গিত। ফলে, অন্তিম পরিণতিতে অবলুপ্তিও ছিল অবশ্যম্ভাবী, ব্যতিক্রমহীন…
ঋণ:
Charles Dickens conducted, Household Words, 31 may 1851
Englishman’s Overland Mail, 23 December 1891
Englishman’s Overland Mail, 20 January 1897
Friend of India and Statesman, 28 October 1852
Friend of India and Statesman, 30 December 1852
J Carrau, Reports of Cases Determined in the Court of Nizamut Adawlut for 1851-[1859]: With an Index. India: Thacker, Spink and Company, 1853
Lewis Sydney Steward O’Malley, 24-Parganas. India: West Bengal District Gazetteers, Department of Higher Education, Government of West Bengal, 1998
Madras Weekly Mail, 12 November 1891
Mutinies in the East Indies: Presented to Both House of Parliament by Command of Her Majesty, 1857. Supplement to the papers presented July 1857. United Kingdom: Harrison and Sons, 1857
The Bengal Directory, Thacker, Spink and Co., Calcutta, 1877
The Calcutta Christian Observer. India: n.p., 1839
The Calcutta Gazette, 13 August 1801
The Indian Sporting Review, Calcutta, December 1946
W. S. Seton-Karr, Selections from Calcutta Gazettes, Vol. III, Calcutta, 1868
Transactions Of The Medical And Physical Society Of Calcutta, vol. IX part I, Calcutta, 1845

তন্ময় ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।