১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হল গুলামগিরি। ‘দলিত’ শব্দ প্রথমবার বুকে নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদকে নস্যাত করা ‘গুলামগিরি’। পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ‘গুলামগিরি’। উচ্চবর্ণের মানুষের নিষ্পেষণ বা গুলাম বানিয়ে রাখার ধ্বংস চেয়ে ‘গুলামগিরি’, শেষ দেখতে চাওয়া ‘গুলামগিরি’।
সমাজ ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলের আত্মপ্রকাশ যে বৃথা যাবে না, তা বলাই বাহুল্য। আর বৃথা যাতে না যায়, তাই সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন জ্যোতিবা ও সাবিত্রী ফুলে। সংলাপের ধরনে লেখা ‘গুলামগিরি’ সকলের কাছে কত সহজবোধ্য ছিল, তা আমরা আগেই বলেছি। সেই সংলাপগুলিকেই সুন্দর করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পাঠ করতেন জ্যোতিবা, সবাইকে এর অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এইভাবে গুলামগিরিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক আন্দোলন, একত্রিত হবার মানসিকতা। এই মনোভাবকে সঠিক কার্যকরী রূপ দিতে জ্যোতিবা গড়ে তোলেন সত্যসোধক সমাজ। ব্রাহ্মণতন্ত্রের প্রতিবাদ, পুরোহিত তন্ত্রের প্রতিবাদ ও দলিতদের শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষা ছিল সত্যসোধক সমাজের মূল লক্ষ্য। ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিত করে, দলিত ছেলে এবং মেয়েদের সরকারি চাকরির উপযুক্ত করে তোলাই ছিল জ্যোতিবা ফুলের লক্ষ্য। একমাত্র এভাবেই উত্তরণ সম্ভব, বলে মনে করতেন জ্যোতিবা।
সত্যসোধক সমাজের প্রতিষ্ঠার সঠিক দিনকাল জানা যায় না। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ‘গুলামগিরি’ প্রকাশের কাছাকাছি সময়, অর্থাৎ এক দু’বছরের মধ্যে। এই সময়ের কাছাকাছি আরও কথা ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে- ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত বাংলার ব্রাহ্মসমাজ ও ১৮৭৫ সালে মহারাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজ, উভয়ই হিন্দুধর্মের জাতপাত ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে মুখর ছিল এবং ধর্মের নামে সঙ্কীর্ণতার বিপরীতে এক বৈষম্যহীন, শ্বাশ্বত হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সত্য, সুন্দর ধর্মাচরণের বিধি প্রনয়ণই ছিল উভয়ের লক্ষ্য।

কিন্তু বাস্তবে তা হল না। প্রাতিষ্ঠানিকতা আক্রমণ করল ব্রাহ্মধর্মকেও। পুরোহিতের পরিবর্তে আচার্য, মূর্তিপুজোর পরিবর্তে উপাসনার বিধিনিষেধ এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে ভেদাভেদের প্রবণতা দেখা দিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের বিরোধ ও নব্য ব্রাহ্মসমাজ সৃষ্টি এই সমস্যার সমাধান করল না। দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজের ক্ষেত্রে অবশ্য তা ভিন্ন রূপ নেয়। ব্রাহ্মসমাজের মতোই প্রথমে আর্যসমাজ হিন্দু ধর্মের বর্ণভেদ, পুরোহিত তন্ত্রের বিরোধিতায় সরব হলেও পরে তার অভিমুখ ও কেন্দ্র উভয়ই পরিবর্তিত হয়। আর্যসমাজের নিজস্ব নিয়মকানুন খুব বেশি তীব্র রূপ ধারণ করে, অনেকসময় তা হিন্দুধর্মকেও ছাপিয়ে যায়। আর্যসমাজের কেন্দ্রও মহারাষ্ট্র থেকে পরিবর্তিত হয়ে গোবলয়ের দিকে স্থানপরিবর্তন করে, যা আর্যসমাজের প্রতিক্রিয়াশীল রূপকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
জ্যোতিবা ফুলের সত্যসোধক সমাজ এই ধরনের ধর্ম-সঙ্কীর্ণতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল। জ্যোতিবা ‘গুলামগিরি’ পড়ে শোনাবার সময়, ব্যাখ্যা করার সময় বারংবার বুঝিয়ে বলতেন পুরোহিততন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ত্রুটির কথা। আর সেই ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে তৈরি সত্যসোধক সমাজে কোনও পুরোহিত বা আচার্যের স্থান ছিল না। যেহেতু এই সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল দলিত নারী পুরুষকে শিক্ষিত, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষিত করে তোলা তাই ধর্ম বা ধর্মসংস্কার সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্ত ছিল এই সমাজ। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সরকারি চাকরি পেলে তবেই ‘দলিত’ অবস্থান থেকে মুক্তি সম্ভব। এই বোধই ছিল সত্যসোধক সমাজের আপ্তবাক্য।
এই বৃহত্তর মতাদর্শ স্পর্শ করে পুণে ও তার সংলগ্ন অঞ্চলকে এবং শ্রেণিনির্বিশেষে। দলিত সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ যেমন দলে দলে যোগ দেন সমাজে, তেমনই রাজপরিবারের কিছু সদস্যও সোৎসাহে যোগদান করেন জ্যোতিবার সঙ্গে। সত্যসোধক সমাজ উনবিংশ শতাব্দীর মহারাষ্ট্রের ধর্ম, সমাজ ও শিক্ষার এক বিশাল মাইলফলক হয়ে ওঠে। এবং তা শুধু দলিত নয়, সমগ্র সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা সত্ত্বেও সত্যসোধক সমাজের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা ছিল। জ্যোতিবা সাবিত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও তা ছিল মূলত পুণে শহর ও তার সংলগ্ন গ্রামেই সীমাবদ্ধ। যতদূর জ্যোতিবা গিয়ে প্রচার করতে পারতেন বা সাবিত্রী বা ফতিমা শেখ বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে সবাইকে বোঝাতে পারতেন, ততদূরই ছিল এর বিকিরণ।

এর কী উপায়? এই সমস্যার নিরসনে প্রথমে ছাপার অক্ষরের সাহায্য নিলেন সাবিত্রী-জ্যোতিবা। প্রকাশ করলেন সংবাদপত্র, নাম দীনবন্ধু। এই সংবাদপত্রে সমাজের আদর্শ, তার কার্যকলাপ নিয়মিত রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। সংবাদপত্রের অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল সাবিত্রীবাঈয়ের কবিতা। নিজেদের আদর্শ প্রচারের উদ্দ্যেশ্যে সাবিত্রীবাঈ যে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, তা আমরা আগেই বলেছি। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সাবিত্রীর কবিতা আরও নিয়মিত ভাবে লিখিত, প্রকাশিত ও প্রশংসিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে প্রায় তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত হবে সাবিত্রীর কবিতা, নাম ‘কাব্যফুলে।’
এর মধ্যে একটি কবিতা তুলে ধরা যাক।
‘Go, Get Education.
Be Self Reliant, be industrious,
Work – gather wisdom and riches,
All gets lost without knowledge
We become animal without wisdom,
Sit idle no more, go, get education
End misery of the oppressed and forsaken,
You’ve got a golden chance to learn
So learn and break the chains of caste,
Throw away the Brahman’s scriptures fast.’
সংবাদপত্র, কবিতা, জ্যোতিবা-সাবিত্রীর প্রচারের মাধ্যমে অনেক মানুষের কাছে পৌছনো গেল ঠিকই, তবু এই আন্দোলন যে শেষপর্যন্ত তার শহরকেন্দ্রিক রূপ থেকে বেরতে পারছে না তা বুঝতে পারছিলেন সাবিত্রী-জ্যোতিবা। কী মাধ্যম হতে পারে যাতে সত্যসোধক সমাজের কঠিন ধারণাগুলিকে, গুলামগিরির ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধিতাকে আরও অজস্র মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়? বিশেষত সেইসব মানুষ, যাঁরা পুণে থেকে দূরে, মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছেন? হয়তো তাঁরা নিরক্ষর, হয়তো স্বল্পশিক্ষিত, হয়তো বা আর্থিকভাবে অনগ্রসর, কর্মক্লান্ত জীবনে সংবাদপত্রের সুবিধা বা অবসর নেই।
এইসব ভাবতে ভাবতে এক দারুণ বুদ্ধি খেলে যায় সাবিত্রীর মাথায়। একটা উপায় আছে। এমন এক গণমাধ্যম আছে যা মহারাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ, শহরে গ্রামে, ধনীদরিদ্র, নারীপুরুষ নির্বিশেষে ভীষণ উপভোগ করে। তা হল ‘তামাশা’। বাংলার বুকে যে ধরনের যাত্রাপালা দেখতে অভ্যস্ত ছিল গ্রামের মানুষ, অনেকটা সেই ধরনের এক নাট্যরঙ্গ হল ‘তামাশা।’ এর ধরন, অভিনয়, প্রদর্শন সবকিছুই ছিল মহারাষ্ট্রের একান্ত নিজস্ব। গান গেয়ে, নেচে, পুরুষ অভিনেতারা মহিলা সেজে বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্রদের মাধ্যমে তুলে ধরত। পৌরাণিক পালা, সামাজিক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল এর মূল উপজীব্য। প্রয়োজন অনুসারে ‘তামাশা’র অভিনয়ের ধরন ছিল উচ্চকিত, চড়া দাগের। অনেকটা আমাদের যাত্রাপালা বা উত্তরভারতের ‘নৌটঙ্কি’র সঙ্গে তুলনীয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা, গল্প এই ধরনের অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব ছিল। আলোচনা লেখালেখির আপাত কাঠিন্যের জগত থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উপায় ছিল এই মাধ্যম।

জ্যোতিবারা এই সুযোগই কাজে লাগালেন। গল্প, চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করলেন তামাশায় অভিনয়ের জন্য। অভিনয়ের দলও গড়ে তুললেন। এইসব নাটকে ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, দলিতদের দুরবস্থা, আর্থিক শোষণ জীবন্ত রূপে উঠে এল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় প্রায় একই সময়ে লিখিত, অভিনীত দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পন’ নাটকটির কথা। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা দীনবন্ধু মিত্র আগেই লিখেছিলেন ‘নীলদর্পন’ নাটকে, ১৮৫৮ সালে। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষ এর অভিনয় শুরু করতে নীলকর তথা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে।
একইরকম প্রতিক্রিয়া হয় জ্যোতিবা সাবিত্রীর লিখিত তামাশার ক্ষেত্রেও। সত্যসোধক সমাজের পক্ষে, দলিতশিক্ষা ও উন্নতির পক্ষে, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব দেখা দেয়। প্রসঙ্গত: এই প্রভাব এত সুদূরপ্রসারী ছিল যে ফুলে-যুগের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও এই তামাশা’র চিত্রনাট্য ব্যবহার করে, সত্যসোধক সমাজের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে মহারাষ্ট্রের এক বিশাল কৃষক আন্দোলন। তার নেতৃত্বে ছিলেন ছত্রপতি সাহু।

জ্যোতিবা সাবিত্রী যখন আপ্রাণ লড়াই করছেন আদর্শকে প্রাণ দেওয়ার জন্য, তাকে জীবিত রাখার জন্য, তখনও তাঁরা জানেন না তাঁদের পতাকা বহন করার জন্য ভব্যিষৎ তৈরি হচ্ছে মহারাষ্ট্রের বুকে। জ্যোতিবা সাবিত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম, অপমানের কালিমা মুখ বুঝে সহ্য করা, দলিতদের, কৃষকদের নতুন জীবন দেবার স্বপ্নের ভোরকে সার্থক করতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই গড়ে উঠবে কৃষক আন্দোলন। আর সেই ধারা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ঐতিহ্য ক্রমাগত চলতেই থাকবে।
আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭]
*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ, bbc, Wikipedia, theprint.in, Facebook
* তথ্যঋণ:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।