Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

যাঁদের মনে রেখেছি, যাঁদের মনে রাখিনি: পর্ব ৭- ‘গুলামগিরি’– দাসত্বের ইতিকথা

ঈশা দাশগুপ্ত

এপ্রিল ২৪, ২০২১

Jyotiba Phule
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬]

একটা পৌরাণিক গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। দক্ষিণ ভারতের এক রাজার গল্প, নাম বালি। রামায়ণে যে বালির কথা আমরা জানি, তিনিই এই বালি কিনা– তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তাই সেসবের মধ্যে না গিয়ে আমরা বালির রাজ্য, বালির শাসনের দিকে যাই? কেমন রাজা ছিলেন বালি? কেমন ছিল শাসন? জানার উপায় কী? একমাত্র উপায়, অক্ষর পরিচয় আছে, সামান্য লিখতে পড়তে পারে এমন মানুষের কাছে শুনতে পাওয়া পুরাণপাঠ কেউ পড়ে বলবে, তবে তো শুনতে পাবে সবাই।

কে পড়ে বলবে? কেন, গ্রামের পুরোহিত, বা গ্রামের মাস্টারমশাই, বা মোড়ল ধরনের কেউ। কারণ তারাই তো শুধু পড়াশুনোর সুযোগ পায়, কারণ তারা ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণের বলা গল্পে তাদের মতো হয়ে যাবে গল্প, স্বাভাবিক সেটাই। যেমন, ব্রাহ্মণদের শ্রুতিতে প্রচলিত গল্প অনুযায়ী বালি ছিলেন এক অত্যাচারী রাজা, যে অত্যাচারের নাশ করেন বিষ্ণুর অবতার বামন। বালির অত্যাচারের শাসনের শেষ হয়, বালি উপযুক্ত শাস্তি পায়। 

এ কাহিনী সত্য নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্টি। এমনটাই বলেন এবং প্রথমবার বলেন, জ্যোতিবা ফুলে। মরাঠি প্রবাদ উল্লেখ করে বলেন যে, এ কথা লোকমুখে প্রচলিত যে বালি, আসলে অত্যাচারী ছিলেন না। ‘বালির শাসন আসুক, সব দুঃখকষ্টের শেষ হোক’– এমনটাই বলে এই প্রবাদ। ‘ইদা পিদা জাভো, বালি কা রাজ্য আভো।’ দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে চলে আসা এই কথন মিথ্যে হতে পারে না। মিথ্যে হতে পারে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, পুরোহিতদের তৈরি করা ইতিহাস, লোককে বিভ্রান্ত করার গল্প। 

১৮৭৩ সালে রচিত ‘গুলামগিরি’ বইতে এই দাবি করেন জ্যোতিবা। শুধু এই দাবি নয়, দলিতদের উপর হওয়া ব্রাহ্মণদের সব ব্যবহার, অত্যাচার খুঁটিয়ে তুলে ধরেন। লেখার পদ্ধতিটিও ছিল অবাক করা। সম্পূর্ণ বইটিই সংলাপের ধরনে লেখা। একজন বক্তা জ্যোতিবা নিজে, আর তিনি কথা বলছেন বন্ধু ঢোন্ডিবার সঙ্গে। কথোপকথনের মাধ্যমেই বোঝাবার চেষ্টা করছেন জাতীয় ইতিহাস,স্থানীয় ইতিহাসের সঙ্গে আর্য-আধিপত্যের ইতিহাসের পার্থক্য।

১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘গুলামগিরি’– রানির শাসন তখন স্থাপিত, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের সূচনা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ যেমন বর্ণহিন্দুত্বের পক্ষে বিকৃত করেছে ইতিহাসের সব উপাদান, এর পরে দেখি ইতিহাসের সব মোড়ে ঔপনিবেশিক শাসনের শিলমোহর। পরবর্তীকালে ইতিহাসের এই ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে বহু বিখ্যাত ঐতিহাসিক সরব হন, যেমন ইরফান হাবিব। কিন্তু দেড়শো বছর আগে ইতিহাসের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে কথা বলেন প্রথম জ্যোতিবা ফুলে। 

মরাঠি প্রবাদ উল্লেখ করে বলেন যে, এ কথা লোকমুখে প্রচলিত যে বালি, আসলে অত্যাচারী ছিলেন না। ‘বালির শাসন আসুক, সব দুঃখকষ্টের শেষ হোক’– এমনটাই বলে এই প্রবাদ। ‘ইদা পিদা জাভো, বালি কা রাজ্য আভো।’

তবে ‘গুলামগিরি’ বইটির অবদানের তালিকায় ইতিহাসের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ বা আর্য-অনুপ্রবেশের তত্ত্বের প্রথম ভারতীয় সমর্থনই প্রধান নয়। ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর সমাজতত্ত্বের ইতিহাসে ‘গুলামগিরি’ সম্ভবত প্রথম দলিত-কথন। ‘দলিত’ শব্দটিও চয়ন করেন জ্যোতিবা নিজে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, দলিত অত্যাচার, দলিত জীবন, সম্পর্কে আলাদা করে ভাবা, তাদের কথা তুলে ধরার সমগ্র কৃতিত্ব জ্যোতিবা ফুলের। 

সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষদের কথা লিখতে গিয়ে অনুভব করেন, তাদেরকে বোঝাতে ‘নিচু জাত’ ধরনের অপমানকর শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। তাই নিষ্পেষিত, শোষিত অর্থে ‘দলিত’ শব্দটি চয়ন করেন। আর লিখতে শুরু করেন দলিত নিষ্পেষনের সত্য, ইতিহাস। শুধু লিখেই ক্ষান্ত হন না, সেই বই নিয়ে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে দলিতদের কাছে পৌঁছন, যারা পড়তে পারে না তাদের পড়ে শোনান। সংলাপের আকারে রচিত হওয়ায় সবার পক্ষে শুনতে, বুঝতেও সুবিধে হয়। ‘গুলামগিরি’ গ্রন্থটির মূল লক্ষ্য ছিল ‘গুলাম’ বা দাস-জীবনের কথা তুলে ধরা। সেই উদ্দেশ্যে ক্রমশই সার্থক হতে থাকে। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে তারা যে দাস, শৃঙ্খলিত মানুষ তা তুলে ধরতে পারেন জ্যোতিবা। 

শিক্ষার আলোক, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষাই পারে দলিতদের এই অন্ধকার থেকে বের করে আনতে – এ কথাটা বার বার বলতে থাকেন জ্যোতিবা। মনে রাখা ভাল, ১৯৭৩-৭৫ সালে জ্যোতিবা সাবিত্রীদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের সংখ্যা সাতটি। এই স্কুলগুলির সবই পুণে ও তার আশপাশে। মহাবিদ্রোহের ফলে অনুদান বন্ধ হয়ে পুণের বাইরে যে স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের আবার করে খোলা সম্ভব হয়নি জ্যোতিবা-সাবিত্রীর। কিন্তু পুণের স্কুলগুলি, বিধবা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য আশ্রম, ফতিমা শেখের বাড়িতে তৈরি হওয়া ছাত্রী-আবাস নিয়ে দলিতশিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষার আন্দোলন জোর কদমে চলছিল। এর মধ্যেই আসে ‘গুলামগিরি’। তাকে আঁকড়ে ধরে আরও উৎসাহ পায় জ্যোতিবা সাবিত্রী, ফতিমা শেখদের এই প্রচেষ্টা।

Kavya Phule
সাবিত্রী ফুলের লেখা কাব্যগ্রন্থ

‘গুলামগিরি’ বইয়ের প্রকাশ, প্রচারকে কেন্দ্র করে আরও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কবিতা লিখতে শুরু করেন সাবিত্রী। বই সম্পর্কে, দলিত ও নারীশিক্ষা সম্পর্কে ছোট ছোট কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতাদের প্যামফ্লেটের আকারে সবার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হত, দেওয়ালে আটকে দেওয়া হত। জনপ্রিয় হয় কবিতাগুলি, সংকলিত হয় ‘কাব্যফুলে’ নামে। 

এখানেই শেষ নয়। ‘গুলামগিরি’-র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, দেশের বাইরেও। বই সম্পর্কে সকলের উৎসাহ দেখে, তার ইংরেজি তর্জমা করেন জ্যোতিবার এক বন্ধু। সেই অনুদিত পাঠের প্রশংসা হয় সর্বত্র।

Gulamgiri
জ্যোতিবার লেখা বই

জ্যোতিবা ফুলের ‘গুলামগিরি’র প্রায় একশো বছর পরে প্রকাশিত হয় বি আর আম্বেদকরের ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’- দলিত ন্যায়ের আর এক দিকফলক। ইতিহাস ঋণী থাকে ‘গুলামগিরি’র কাছে, ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’-এর কাছে, জ্যোতিবার কাছে, বাবাসাহেবের কাছে। সেই ঋণ শুধু বেড়েছে সময়ের সঙ্গে, ভারতের সংবিধান সে ঋণের হিসেবনিকেশে, দলিত রাজনীতিতে ক্লিষ্ট হয়েছে, গবেষনায় ক্লান্ত হয়েছে। জমাখরচ থেকে গেছে ভবিষ্যতের গর্ভে।

আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬]

*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ, bbc, Wikipedia, theprint.in, Facebook
* তথ্যঋণ:

‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্‌ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬

‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২

‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্‌’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯

‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌ অফ্‌ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১

Author Isha Dasgupta

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Picture of ঈশা দাশগুপ্ত

ঈশা দাশগুপ্ত

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
Picture of ঈশা দাশগুপ্ত

ঈশা দাশগুপ্ত

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস