পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে পৌঁছনোর কিছু বছর বাদেই ব্রিটিশরা আসে এ দেশে। অন্যান্য দেশের মতো এখানেও পর্তুগিজদের দেখানো পথেই প্রথম প্রথম হাঁটাচলা শুরু করে তারা। পর্তুগিজরা ততদিনে গোয়া কবজা করে দেশের অন্যান্য জায়গায় হাত বাড়িয়েছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে— ব্রিটিশরাও নিঃশব্দে তাদের চলা রাস্তায় অনেক দূর থেকে অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু বাদ সাধল পর্তুগিজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর লোভ। মোঘল বাদশাদের বিশ্বাস হারিয়ে এদেশে নিজেদের জমি হারালো তারা, ফলে কোণঠাসা হয়ে পর্তুগিজ সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিতে হল দেশের পশ্চিম আর পূর্ব কোণে। কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস। এই সুযোগে ফাঁকা জমি পেয়ে এদেশে তাদের মৌরসিপাট্টা কায়েম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রিটিশরা। পশ্চিমে গোয়া আর চারপাশের অঞ্চল পর্তুগিজদের শক্ত ঘাঁটি, সেখানে দাঁত ফোটাতে গেলে যুদ্ধ লাগবে আর মোঘল বাদশাদের নজরে পড়ে যাবে— তাই সেই ঝুঁকি না নিয়ে বাংলা আর পূর্ব ভারতে নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তার করার দিকে নজর দিলো তারা। দিল্লির বাদশার অধীনে থাকলেও এই অঞ্চল নিয়ে তাঁরা বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। রাজস্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। নজরদারি বিশেষ করতেন না। জাহাঙ্গীর টমাস রো’কে সুরাতে ফ্যাক্টরি খোলার অনুমতি ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছেন— আর শান্তিপ্রিয়তার জন্যে তাদের বিশ্বাসও অর্জন করেছে। ১৬৩২ এ শাহজাহান পর্তুগিজদের হুগলির ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়ায় তারা এই মুলুক ছেড়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়, আর তার কিছুদিনের মধ্যেই হুগলি থেকে বালেশ্বর দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে ব্রিটিশ বণিকের দল।

পর্তুগিজ, মোঘল বাদশা সব সামলালেও এই দেশের জলহাওয়া হয়ে উঠল ব্রিটিশদের গলার কাঁটা— বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা মরতে শুরু করল এখানে এসে। এখন যেখানে সেন্ট জন্স চার্চ, কলকাতার পত্তনের পর সেখানে একটা গোরস্থান (cemetery) বানানো হয়েছিল এখানে এসে প্রাণ হারানো ব্রিটিশদের জন্যে। ১৬৯২ থেকে ১৭৬৬— এই পঁয়ষট্টি বছরে অন্তত বারো হাজার ব্রিটিশের কবর দেওয়া হয়েছে সেই অল্প জায়গাতে। কিন্তু লোভ অতি বিষম বস্তু; অসুখ-বিসুখের চোখরাঙানিতেও এ দেশে ব্রিটিশদের আসা থামেনি, বরং ধনসম্পদের লোভে আরও ব্রিটিশ এসেছে। ১৭৮৪ থেকে ১৭৮৭-র মধ্যে যখন সেন্ট জন্স চার্চ বানানো হয়, সমস্ত কবর আর ফলক সরিয়ে ফেললেও কয়েকটা কবরের স্মৃতিফলক রেখে দেওয়া হয়েছিল কৃতজ্ঞতায়— যাদের হাত দিয়ে আজকের কলকাতার পত্তন হয়েছিল—যেখান থেকে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু। তার মধ্যে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক যেমন আছেন, তেমনই আছেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন। কে এই হ্যামিল্টন? ১৭১৫ সালে মোঘল বাদশাহ ফারুকশায়রের যোধপুরের রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে ভেস্তে যাচ্ছিল তাঁর ফিশ্চুলার জন্যে! হ্যামিল্টন সাহেব সে অসুখ সারিয়ে দিয়েছিলেন, আর বিনিময়ে পেয়েছিলেন আটত্রিশটা গ্রামের পাট্টা, যা জোব চার্নকের পত্তন করা কলকাতার সাথে জুড়ে আজকের কলকাতা তৈরি।

শহরে ব্রিটিশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সেন্ট জন্স চার্চ কবরস্থান ভর্তি হয়ে গেল। তাছাড়া সাবেক কলকাতার ব্যবসাকেন্দ্রের মাঝে একটা গোরস্থান দৃষ্টিকটুও বটে, তাই দরকার পড়ল নতুন গোরস্থানের। সিরাজদৌলার আক্রমণে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে কলকাতায় সাহেবদের দুর্গ নিরাপত্তা দিতে অপারগ— তাই চৌরঙ্গীর জঙ্গলের পশ্চিমে নতুন দুর্গ বানানো শুরু হয়ে গিয়েছে পলাশীর যুদ্ধের পরেই। সুরক্ষা আর সেনাবাহিনীর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে চৌরঙ্গীর জঙ্গল কেটে বিশাল জায়গা জুড়ে ময়দান বানানো হয়েছে। সাহেবদের বসতি গড়ে উঠতে শুরু করেছে ময়দানের পূর্বদিকে। তাই এমন একটা জায়গায় গোরস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, যেখানে সহজে যাওয়া যাবে আবার সাহেবদের বাড়ির উঠোনের পাশেই হবে না জায়গাটা। অচিরেই জায়গা নির্দিষ্ট করা গেল— সাবেক কলকাতার প্রান্তসীমায়, মারাঠা খালের তৈরি শহরের সীমারেখার মধ্যেই। সাহেবপাড়ায় বাংলার গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটাটের আবাসকে ডানদিকে রেখে কিছুটা পথ পেরিয়ে বিস্তৃত জায়গার ওপরে গড়ে উঠল গ্রেট খ্রিস্টান বারিয়াল গ্রাউন্ড, ১৭৬৭ সালে। শুধু ব্রিটিশ নয়, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদেরও কবরস্থ করার সুযোগ দেওয়া হল সেখানে। জীবিত অবস্থায় স্বীকৃতি না পেলেও মৃত্যুর পর অবহেলার সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচলো সেই সম্প্রদায়। তাই এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্সের পাশে স্থান পেলেন ইয়ং বেঙ্গলের প্রাণপুরুষ তরুণ ডিরোজিও।
চৌরঙ্গী রোড থেকে এই গোরস্থানে আসার পথের নাম হল বারিয়াল গ্রাউন্ড রোড। শববাহী গাড়ির তখনও প্রচলন হয়নি, তাই কাঁধে করে কফিন যেত গোরস্থানে আর পেছনে হাঁটত শবযাত্রীরা। রাস্তার দুপাশে বসবাসকারী ইউরোপিয়রা শঙ্কিত চোখে দেখত কোনও চেনা মানুষ শবযাত্রায় শামিল কিনা, বা পরিচিত কারও শেষযাত্রা কি না! এই শঙ্কা অমূলক ছিল না, যখন দেখতে পাই যে এই গোরস্থানে মাত্র ষাট বছরেই ১৬০০-র বেশি মানুষের কবর দেওয়া হয়েছে; গোরস্থানকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে সার্কুলার রোডের অপর প্রান্তে ১৮৩০ সালের পরে।

তাহলে পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে কি মাত্র ১৬০০ জনের কবর হয়েছিল? উত্তরটা হ্যাঁ এবং না। কারণ আমরা যে গোরস্থান এখন দেখি, সেটা সাউথ পার্কস্ট্রিট গোরস্থান, মূল গোরস্থানের একটা অংশ মাত্র। ফ্রেডরিক ওয়াল্টার সিম্সের ১৮৪৭ সালের কলকাতার মানচিত্রে দেখা যায় আরও কয়েকটা গোরস্থান ছিল এখানে, একটা গোরস্থান থেকে রাস্তার নাম বারিয়াল গ্রাউন্ড রোড হয়নি। গোরস্থান ছিল রাস্তার দুইপাশেই। সময়ের সঙ্গে বারিয়াল গ্রাউণ্ড রোড থেকে পার্কস্ট্রিটের বিবর্তনের মাঝে একপাশের গোরস্থান নর্থ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি হারিয়ে গিয়েছে, সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন কলকাতা। নর্থ পার্কস্ট্রিট গোরস্থানের জায়গায় গড়ে উঠেছে অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ হাসপাতাল। এই গোরস্থানের সমস্ত কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও একটা কবর থেকে গেছে এখনও— রবার্টসন পরিবারের স্মৃতিসৌধ। নর্থ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের মিশন সিমেট্রি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে— তার উল্লেখ শুধুই পুরনো ম্যাপে আর নথিতে। আরও সামান্য উত্তরে এক ফরাসি গোরস্থান ছিল, সেখানে আজকের এপিজে স্কুল। একটা স্মৃতিফলক সেখানে এখনও রয়ে গিয়েছে— বাংলায় প্রথম প্রটেস্টান্ট মিশনারি সুইডেনের জোহান জাকারিয়া কিয়েরনান্দারের স্ত্রী অ্যান কিয়েরনান্দারের, তাঁর কবর অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চের প্রাঙ্গণে। ফ্রেঞ্চ সিমেট্রির বেশ কিছু স্মৃতিফলক দেখা যায় সাউথ পার্কস্ট্রিট গোরস্থানের দেওয়ালে।

রবীন্দ্র সরোবরের পাশে নজরুল মঞ্চ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে ছিল এক মুসলিম গোরস্থান। কলকাতা গবেষক সোমনাথ ঘোষ এক স্ক্রল ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ‘ক্যালকাটা ইন ফরটি-ফাইভ সেকশন্স’ অ্যাটলাসের চল্লিশ নম্বর ম্যাপে এই গোরস্থানের উল্লেখ আছে। নজরুল মঞ্চের আর্টিস্টদের প্রবেশপথের ডানদিকে এক মস্ত গাছের পাশে যে মার্বেলের বেদিটা আছে, সেটা আদতে একটা কবর, একা দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতি বহন করে চলেছে। লেকের পাশের গোরস্থানে তো তবু একটা কবর পুরনো দিনের স্মৃতি বহন করে চলেছে— কাশিয়াবাগানের গোরস্থানের কোনও চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই; সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সাউথ ক্লাব।
থাঙ্কাপ্পান নায়ারের ‘হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটা স্ট্রিট্স’ থেকে জানা যায় অযোধ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সাদাত আলি খান বাহাদুর ৩৪ বিঘা জমি তাঁর সম্প্রদায়ের কল্যাণে দান করেন আর সেই জমিতে এক গোরস্থান গড়ে ওঠে। ১৮৫৮ সালে স্বাস্থ্যবিধির অজুহাতে এই গোরস্থান বন্ধ করে দেওয়া হয় আর বিনিময়ে তিলজলায় গোরস্থানের জমি দেওয়া হয় ৪২৭২ টাকার বিনিময়ে। গোরস্থানের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে দেখে ১৮৮৮ সালে মুসলিম বারিয়াল বোর্ড কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে গোরস্থান সংরক্ষণের অনুরোধও জানায়, কিন্তু ফল কিছুই হয় না। ১৯০৩ সালে এই জমির একাংশ করপোরেশন দখল নেয় আর বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর জন উডবার্নের সম্মানে উডবার্ন পার্ক নামকরণ করা হয়। কাশিয়াবাগান গোরস্থান হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরুর দিক থেকে কলকাতায় তৈরি হওয়া গোরস্থানগুলো সবই সার্কুলার রোডের পূর্বদিকে— অর্থাৎ যে মারহাট্টা খাল কলকাতার সীমানা ছিল, সেই সীমানার ওপারে। এই পূর্ব পাড়েই পার্কস্ট্রিটের কাছে শুয়ে আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মানিকতলা মোড়ের দক্ষিণে খ্রিস্টান গোরস্থানে তরুণী কবি তরু দত্ত, মানিকতলা মোড়ের উত্তরে মুসলিম গোরস্থানে মৌলনা আবুল কালাম আজাদের বাবা মৌলনা খৈরুদ্দিন। কিন্তু এখানেও গোরস্থান হারিয়ে গিয়েছে। সুকুমার সেন তাঁর ‘দিনের পারে দিন যে গেলো’ বইয়ে মানিকতলার মোড়ের অদূরে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির বিপরীতে হরিনাথ দে রোড আর যোগীপাড়া লেন মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিবিবাগান নামের মুসলিম গোরস্থানের উল্লেখ করেছিলেন, তার কোনও চিহ্ন নেই আর। সেখানে সুবিশাল এক বস্তি গড়ে উঠেছে। সোমনাথবাবু তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন এখানে বাড়ি তৈরির সময় মাটির নীচ থেকে দেহাবশেষ বের হওয়ায় যে ভয়ের পরিবেশ হয়েছিল, তার কথা। হজরত আলী শাহ্ বাবার মাজার সেই গোরস্থানের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে আজও হরিনাথ দে রোড আর যোগীপাড়া লেনের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছে। হারিয়ে গিয়েছে নারকেলডাঙা গোরস্থানও, তার ওপর দিয়ে রেললাইন পাতা হয়েছে।
কলকাতা বড় শহর হয়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক কিছু পেয়েছে, আবার হারিয়েছেও অনেক। যেমন এই গোরস্থানগুলো— যারা বেঁচে আছে শুধু সরকারি নথিপত্রে।
*ছবি সৌজন্য: Getarchive, Wikimedia, Wallpaperflare
পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।
4 Responses
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম অতীত এর শেষ নিশ্বাসের স্থানমাহাত্য।
Khub Valo Laglo
অনেক ধন্যবাদ।
নতুন লেখাটা(সপ্তম পর্ব) কেমন লাগলো জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
বাহ! খুব ভালো লাগল। শুধু এই লেখাটাই নয় সবগুলো লেখাই অসাধারণ। সপ্তম পর্বের লেখাটা তো পেলাম না। আপনার কাছে একটা অনুরোধ ছিল, শুনেছি কলকাতার চার-নম্বর ব্রীজের কাছে না কি একটা মুসলিম কবরখানা আছে আর সেই কবরখানায় শুয়ে আছেন দু’জন ‘জ্যান্তেমরা’ একজন আমির খান সাহেব অপরজন বিলায়েত খান সাহেব। এই কবরখানার বিষয়ে আপনি যদি কিছু লেখেন তো আমাদের মতো সাধারণ পাঠক খুবই উপকৃত হব।