বর্ণমালার কাছে কবিতা বা গল্পের যে কৃতজ্ঞতা, পুতুল (doll) খেলার সঙ্গে বোধহয় সংসারের সূত্রটা একইরকম। বলা যায় ওখান থেকেই হাতেখড়ি। অথচ বলার সময় আমরা বলে থাকি, ‘সংসার তো আর পুতুল (doll) খেলা নয়!’
মানুষ অভ্যাসের দাস। আর তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেকোনও বিষয়ের প্রথম পাঠ। গ্রাম অনেকখানিই টিকিয়ে রেখেছে এই ঐতিহ্য। এখনও বাংলার ছড়াগানে পাওয়া যায় পুতুল বিয়ের কথা!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় যেকোনও অভ্যাসেরই রূপ, যেমন বদলে গেছে এই খেলাও। মাটির পুতুল নরম হয়েছে। মেলার ফুটপাথ থেকে বাক্সে উঠে এসেছে ঝাঁ চকচকে দোকানে। কিন্তু তারপরও যা রয়ে গেছে সেটুকুই উত্তরাধিকার। হ্যাঁ, শহরের দরজা বন্ধ প্রাসাদে এখনও পুতুলের বিয়ে টিকে আছে। ঠাকুরদা সময় নিয়ে আসবাব, বাড়ি, পালকি বানিয়ে দিচ্ছেন, নাতনির পুতুলদের বিয়ের জন্য।
পুতুল খেলা পুরোনো খেলা হলেও তা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। সম্প্রতি কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক রীতিমতো গবেষণা করে দাবি করেছেন যে, অন্য যা কিছু নিয়ে খেললে শিশুদের মস্তিষ্কের পোস্টেরিয়র সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস (পিএসটিএস) অংশ যতটুকু উদ্দীপ্ত হয়, পুতুল নিয়ে খেললে তা হয় কয়েক গুণ বেশি। তা সে একা একাই পুতুল খেলাই হোক বা অনেকে মিলে।

পুতুল খেলা নিয়ে বেশি কিছু বলার আগে খেলনার আবির্ভাব নিয়ে একটু বলা দরকার, কারণ পুতুল হল এক ধরণের খেলনা। যে কোনো জন্তু জানোয়ার মায় মানুষ সকলেই জন্মানোর পর থেকে খেলতে শেখে, প্রথমে সে নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা করে, পরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করে, কখন আবার মাটি, পাথর, বালি, জল নিয়ে খেলা করে। অর্থাৎ খেলতে হলে কিছু একটা চাই, সে লিভিং বা নন লিভিং বস্তু যাই হোক না কেনো। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই বোধহয় খেলনার আবির্ভাব, সে প্রায় তিন চার হাজার বছর আগে। খেলনা হল জীবন ধারণের এক প্রধান অঙ্গ, মূলতঃ এক ধরণের জড় বস্তু, যা নিয়ে খেলা করা যায়, যেমন বল, ঘুড়ি, লাট্টু, মার্বেল, গাড়ি, সর্বোপরি পুতুল। এই সবের মধ্যে পুতুলই হচ্ছে সর্বাধিক বেশি প্রচলিত এবং আকর্ষণীয় এক খেলনা, কারণ, পুতুল জন্তু জানোয়ার এবং মানুষেরই আর এক রূপ, যদিও তা জড় পদার্থ ঠিকই, কিন্তু কল্পনায় তাকে জীবিত করা যায়, তাই তো পুতুল আমাদের এতো পছন্দের জিনিস।

এই পুতুলের চল শুধু আমাদের বাংলা তথা ভারতেই নয়, বিশ্বের সব দেশেই আছে। কিছুদিন আগে দিল্লীর ডল মিউজিয়াম দেখে অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, বিশ্বের প্রায় সব দেশই পুতুল নিয়ে খেলে। পুতুল শুধুমাত্র খেলার বস্তুই নয়, পুতুলের ধরণ ধারণ, পোশাক আশাক সেখানকার মানুষের শিল্পকলা, সামাজিক নিয়ম কানুন, এমনকি অর্থ ব্যবস্থার চিত্রও তুলে ধরে।

এবার বহির্বিশ্বর কথা ছেড়ে আবার নিজের দেশেই ফিরে আসি। আগেকার কালে বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে পুতুল খেলার বহুল চল ছিল। তার কারণ তখনকার বাজারে এখনকার মতো নানা ধরণের পুতুল পাওয়া যেত না, আর পাওয়া গেলেও সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তা মোটেই সহজলভ্য ছিল না। সেই জন্য বাড়ির মা বাবা এবং পরিবারের বড়রা নিজেরাই বাচ্চাদেরকে নানান ধরনের পুতুল বানিয়ে দিতেন, সামান্য মাটি, কাঠি, কাগজ, কার্ড বোর্ড, কাপড়, সুতো, তুলো এমন কি ডিমের খোলা প্রভৃতি দিয়ে। এতে শুধু পয়সার সাশ্রয়ই হত না, বাচ্চাদের শিল্পসত্তার বিকাশও ঘটতো। কারণ ঐ সব পুতুল বানানো হত বাচ্চাদেরকে পাশে রেখে এবং তাদেরই সহযোগিতায়। পুতুল এবং তাদের পোশক, দৈনন্দিন ব্যাবহারের সামগ্রী যেমন ঘরবাড়ি, চেয়ার টেবিল, খাট, আলমারি, পালকি সবই বানানো হত, যা ক্রাফটের পর্যায়ভুক্ত। তখন তো আর স্কুলে আলাদা করে ক্রাফটের ক্লাস হত না, বাড়িতেই এসবের ক্লাস হয়ে যেত পুতুল খেলার ছলে।

এতো গেলো শিল্পসত্তা বিকাশের দিক, এবার অন্যান্য দিকের কথাও একটু ভাবা যাক। যেহেতু বাচ্চারা পুতুলকে তাদের সন্তান হিসেবেই জানত তাই পুতুলের সঙ্গে তাদের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতো, অনেকটা মা ছেলের সম্পর্কেরই মতো, যা তাদের মনে ভালোবাসা, মায়া, মমতা, মানবিকতার বীজ বপন করে দিত, যা কোনো পাঠ্য পুস্তক দিয়ে রোপন করা হয়তো সহজ নয়। এইভাবেই বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে পুতুলও তাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ত। তাই তাদের বিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে হত। একসময় তাদের বিয়ে দেওয়া হত। সে এক আনন্দময় ব্যাপার, এক বাড়ির ছেলে পুতুলের সাথে অন্য বাড়ির মেয়ে পুতুলের বিয়ে হত বেশ জাঁকজমক করেই।

সেই বিয়ের রেশ থাকতো বেশ কয়েকদিন, বিশেষ করে মেয়ে পুতুলের বরের বাড়ি চলে যাওয়ার দুঃখ সামলাতে অনেকটা সময় লেগে যেতো। এইসব ঘটনা বাচ্চাদেরকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের প্রতি আস্থা, পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সম্পর্কের গভীরতা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করত, যা আজকালকার যুগে খুবই বিরল।
আগেকার কালের প্রায় প্রত্যেকের শৈশবের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে পুতুল খেলা, বদলেছে শুধু পুতুলের ধরণ ধারণ, এসেছে নানান ধরনের বেশি বিদেশী পুতুল। তবে একটা জিনিষ লক্ষ্য করার মতো, এখন হাতে তৈরী ঘরোয়া পুতুলের চেয়ে রেডিমেড কেনা পুতুলই বেশি।

আগেকার কালে পুতুল খেলা মূলতঃ মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। দোষ বাচ্চাদের নয়, দোষটা আমাদেরই, আমরাই পুতুল খেলাটাকে মেয়েদের খেলা বলে চিহ্নিত করে দিতাম, যেহেতু তার সঙ্গে ঘর সাংসারের মিল আছে, আর আমাদের ধারণা ছিল মেয়েরা শুধু ঘর সংসারের কাজই সামলাতে পারে/পারবে। সেই জন্যই আমরা ছেলেদেরকে খেলনা হিসেবে বল, ব্যাট, গাড়ি দিতাম আর মেয়েদেরকে পুতুল। এখন সেই ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে, এখন সবাই সব কিছু নিয়েই খেলতে পারে, ছেলে মেয়ের মধ্যে তফাৎ তেমন কিছু নেই। তবে একটা দুঃখ তো রয়েই যাচ্ছে, নিউক্লাস ফ্যামিলিতে বেশিরভাগই সিঙ্গল চাইল্ড, তাই খেলার সাথীর বড়ই অভাব। মজার ব্যাপার পুতুল খেলা কিন্তু একা একাও সম্ভব, কারণ পুতুলরাই তো তাদের খেলার সাথী।

এইতো সেদিন হঠাৎ দেখি আমার বছর ছয়েকের নাতনি একা একাই তার তিনটি পুতুলকে চেয়ারে বসিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে রীতিমতো ক্লাস নিচ্ছে। একদম সংস্কৃত শ্লোক থেকে শুরু করে ইংরেজী, অঙ্ক, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ক্লাস নিল, শুধু তাই নয়, ম্যাডামরা যেমন কমজোরি বাচ্চাদেরকে আলাদা মনযোগ দেয় ঠিক সেইভাবে সেও একটি পুতুলকে আলাদা করে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। এই পুতুল নিয়ে খেলা ওকে যে শুধু পড়াশুনাতেই তীক্ষ্ণ করবে তো নয়, ওর জীবিকা গঠনেরও কাজে লাগবে।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমি নিজে ছিলাম খুব বড় পরিবারের ছেলে। না না, আমি কোনো জমিদার পরিবারের কথা বলছি না, বড় অর্থাৎ সংখ্যায় বড়, অনেক ভাইবোন। তাই আমিও দিদিদের পুতুল খেলার সাথী ছিলাম, আমার যা কিছু ক্রাফটের কাজ ঐ সূত্রেই শেখা। এমন কি আমি আজ যে ডিমের খোলার কাজ অর্থাৎ এগ শেল আর্ট করি তার হাতেখড়িও ঐ ডিমের পুতুল দিয়েই।

প্রায় বছর চারেক আগে তখন আমার নাতনির বয়েস মাত্র দুই, আমি সম্পূর্ণ নিজ হাতে ওকে একটি মাঝারি সাইজের তিনতলা ডলহাউস বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেইসঙ্গে ডলহাউসের জন্য কিছু ক্ষুদ্রকায় সামগ্রী, যেমন খাট পালঙ্ক, মন্দির, ডিমের কিছু পুতুল প্রভৃতি বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেগুলি বানাতে প্রায় দিন কুড়ি সময় লেগেছিল। বানানোর সময় আমার নাতনি আমার পাশে থেকে ব্যাপারটা দেখত, যা এখনও তার স্মৃতিতে রয়েছে। জানিনা ভবিষ্যতে থাকবে কিনা, তবে আমার বানানো ডলহাউসটি দাদু-নাতনির মধুর সম্পর্কের নিদর্শন হয়ে সারাজীবন রয়ে যাবে, সেটিই বড় পাওনা।

শুধু কি তাই, এই ডলহাউসটির জন্য উপরি পাওনাও কিছু পাওয়া গেছে। আমার নাতনি ব্যাঙ্গালোরে যেখানে থাকে সেখানে প্রায় ২০০ ফ্ল্যাট রয়েছে, কিন্তু কারো বাড়িতে এইরকম ডলহাউস নেই, তাই কিছু বাচ্চারা মাঝে মধ্যেই আসে আমার নাতনির সঙ্গে ডলহাউসে পুতুল খেলতে। এর ফলে নাতনির অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা বেড়েছে, সেই সূত্রে তাদের মা বাবাদের সঙ্গেও, যা আজকালকার যুগে সহজে হয়ে ওঠে না।

দিন কয়েক আগে নাতনির পুতুলের এনগেজমেন্ট হয়ে গেল বেশ জাঁকজমক করে। অনেক বাচ্চারা সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল এবং পুতুল খেলা নিয়ে তারাও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর কদিন পরেই বিয়ে, দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গিয়েছে, আশা করছি সেখানে আরো অনেক বেশি বাচ্চার সমাগম হবে এবং পুতুল খেলা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। পালকি ছাড়া কি আর বিয়ে হয়, তাই আমি একটি কাঠের ছোট্ট পালকি বানিয়ে দিয়েছি, সেইসঙ্গে ডলহাউসের জন্য একটি ছোট্ট ড্রেসিং টেবিল এবং ডাইনিং টেবিল বানিয়ে দিয়েছি উপহার হিসেবে। আমার এই অবসরপ্রাপ্ত জীবনে নাতনির সঙ্গে পুতুল খেলায় সামিল হতে পেরে কী যে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করি তা বলে বোঝাতে পারবো না।

আমার বিশ্বাস, এই পুতুল খেলাকে যদি বাচ্চাদের মধ্যে আবার জনপ্রিয় করে তুলতে পারি, তাহলে সেটাই হবে ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় উপহার। এই পুতুল খেলাই হয়তো টিভি, কম্পিউটার, মোবাইলের যান্ত্রিক দুনিয়া থেকে কল্পনার জগতে ফিরিয়ে এনে, সৃষ্টিশীলতা বাড়িয়ে তুলে বাচ্চাদের সঠিক জীবিকা গড়ে তুলতেও সাহায্য করবে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ভূপদার্থবিদ, ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানী (ওএনজিসি) থেকে জেনারেল ম্যানেজার পদে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আর্ট ও ক্রাফটের প্রতি অনুরক্ত। কাঠ, কাচ, মাটি এবং ডিমের খোলা দিয়ে নানান রকমের জিনিস বানাতে ভালবাসেন। বিগত প্রায় ১০/১১ বছর "এগ শেল আর্ট" নিয়ে কাজ করছেন, বাংলা তথা ভারতে যার চল নেই বললেই চলে। কলকাতার অ্যাকাডেমিতে কয়েকবার এক্সিবিশনও হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। লেখালেখিও করেন, মূলত রম্যরচনা। দেশ প্রত্রিকা এবং সংবাদ প্রতিদিনের পূজাসংখ্যায় তাঁর রচিত রম্যরচনা প্রকাশিত। রম্যরচনা সংকলনের দুটি বইও আছে।
One Response
চমৎকার doll house এবং তার সাথে লেখা