জ্যৈষ্ঠ এবারে জ্বলিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। রোদে জ্বলা মাঠ একা একা শুয়ে শুয়ে মেঘের স্বপ্ন দেখেছে তাই রোজ। মেঘরাজার ঘুম যদি ভাঙে! সেই স্বপ্নের ওপার হতে আষাঢ়ের সাড়া মিলেছে বোধহয় এতদিনে। মাঠের এদিক সেদিকে হাতির শুঁড়, কাল কাসুন্দা, ভুঁই আমলারা সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আর কদিনেই বেড়ার গা–ঘেঁষে লতিয়ে উঠবে রিফিউজি লতা (জার্মানি লতা)। বাস্তব পৃথিবীর এ যেন এক পরাবাস্তব খেয়াল, পৃথিবী কী ভীষণ অক্লান্ত! এসব গুল্ম আর লতাপাতাকে আমরা কি জংলি আর বুনো বলে দাগিয়ে দিতে চাই না! এ পৃথিবীর যা কিছু ‘wild’ তাদের সঙ্গে আমাদের কথা কি ফুরিয়ে গেছে তবে? কিন্তু লিন্ডা সেকথা বলে না।
আপনারা অনেকেই হয়তো লিন্ডাকে চেনেন, ওর ভালো নাম লিন্ডা ব্ল্যাক এলক্ (Linda Black Elk)। গাছপালা লতাপাতার সঙ্গে ওর নিত্যদিনের যোগ। আর কী আশ্চর্য দেখুন, লিন্ডা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের এসব গাছপালা চিনতে শেখায়। প্রতিদিনের খাদ্য–খাবারে কেমন করে এসব গাছপালাকে ব্যবহার করা যায়, কেমন করে আমাদের পূর্বপুরুষদের লোক–বিজ্ঞানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব সে গল্প বলতে চায় লিন্ডা। মা–ঠাকুমাদের কাছে সে জ্ঞানের পুঁটুলিখানা গচ্ছিত আছে, একথা কে না জানে! লিন্ডাও তাই মানুষের পরম্পরাগত জ্ঞানকে চিনতে চায়, জানতে চায়। প্রাক্তনদের অভিজ্ঞতাকে ভাগ করে নিতে চায়।
কোরিয়ান,মঙ্গোলিয়ান,কাটোবা – এই মিশ্র সাংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে লিন্ডা। রান্নাঘরের বৈচিত্র্যকে ও তাই ঢের ঢের কাছ থেকে দেখেছে। লিন্ডার স্বামীও বেড়ে উঠেছেন প্রকৃতির সাহচর্যে। স্ট্যাণ্ডিং রক যেখানে ডাকোটাকে উত্তর আর দক্ষিণে ভাগ করেছে, সেখানে ওর গাঁ। এইসব মিলিয়ে লিন্ডার কাজ হয়তো কিছুটা সহজ হয়েছে। লিন্ডা তাই ওর স্বামী আর তিন ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে বুনো ফুল আর ফলের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এমন করে ঘুরে ঘুরে ওরা গাছ চেনে, গাছেদের সঙ্গে কেমন করে জুড়ে আছে আমাদের রান্নাঘরের ইতিহাস সে গল্প শোনায়। ঔষধি গাছের সুলুক সন্ধান দেয় পৃথিবীর মানুষকে। সে গল্প শুনলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। উত্তর আমেরিকার উপজাতিদের রান্নায় কেমন করে জড়িয়ে ছিল গাছ–গাছালি আর বুনোলতা সেসব ওর আগ্রহের বিষয়।

এসব অধিতবিদ্যা তো মানুষ একদিনে অর্জন করেনি! কতশত বছরের ইতিহাস মিলেমিশে আছে তাই উনুনের উত্তাপে, হাঁড়ি–পাতিলের আধারে। মাঠে ঘাটে ঘুরে ঘুরে ওসব চিনে বেড়ায় ওরা। জীবন দিয়ে এমন করেও শেখা যায়! কাগজ কলমের পৃথিবী লিন্ডাদের ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি। বি–বামের (Beebalm) পাতা কী অনায়াসে চিবিয়ে দেখে ও। তাজা রস আর অপূর্ব নির্যাসে যখন ওর গাল ভরে যায় তখন ও টের পায় মাড়ির শুশ্রূষায় আর মুখশুদ্ধিতে কী অপূর্ব কার্যকরী এই সামান্য একখানা পাতা। এসব গল্পই তো ওর পাঠক্রমের বিষয়! ড্যাণ্ডেলিয়নের (dandelion) গাছ হয়তো দেখেছেন আপনারা, বা দেখেননি। হিমালয়ের কোল জুড়েও এ গাছ ফুল ফোটায়। কী সুন্দর হলুদ হলুদ ফুল! লিন্ডা মানুষদের শেখায়, এই সামান্য গাছও ওর আপাদমস্তক দিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে জীবনের প্রতিশ্রুতিতে। ওর ফুল দিয়ে লিন্ডা তাই ডিমভাজা করে, ফুল সাজিয়ে সুদৃশ্য রুটি বানায়। ওর ডাঁটি গুলো হালকা সেদ্ধ করে নেয় একেকদিন। নরম নরম ডাঁটি দিয়ে ছেলেভুলানো ছড়ার মতো পাস্তা রান্না করে। সেই স্বাদ যদি আপনার চেনা স্বাদের মতো বিলকুল এক না হয়? না হবে! গাছেরা তো মানুষের ঔপনিবেশিক তাঁবেদারি নাও করতে পারে। লিন্ডা তাই শেখায়, ড্যাণ্ডেলিয়নের শিকড় হালকা আঁচে সেঁকে সেঁকে কেমন করে ব্রু (brew) করতে হয়। আহা! সেই ব্রু–করা মূল রসের স্বাদ নাকি চকোলেট–ক্যারামেলের মতো। ডায়বেটিসের খাদ্য সহযোগী এই গাছের গল্প লিন্ডা ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের হেঁশেল ঘরে। জানাতে চায় চোকচেরির জাদুবাস্তবতা। লাল টুকটুকে চোকচেরির ভিতরের সায়নায়েড কেমন করে তাপের সংসর্গে বদলে যায় কে জানে! বিষ বুনোফল তখন মানুষেরা নির্ভয়ে খায়।

রান্নাঘরের কী অপার মহিমা বলুন! উত্তর আমেরিকার ইণ্ডিয়ানরা শীত আসার আগেই রোদ্দুরে শুকিয়ে শুকিয়ে পেম্মিকান বানাতেন। বনজ মশলায় মিলেমিশে সে আসলে রোদ্দুরে শুকনো মাংস। বরফের সাহায্য পেলে সে মাংস বিশ–কুড়ি বছর আপনিই থেকে যায় অবিকল। বরফ না পেলেও থাকে। বছর চারেক, বছর পাঁচেক। মানুষের অধিতবিদ্যা আর জীবনচর্যার কী অসাধারণ মিশেল! লিন্ডা আসলে কোভিড পরবর্তী পৃথিবীর মানুষদের খানিক খানিক ঘাস আর মাটির পৃথিবীর উপরে এসে দাঁড়াতে বলে। লিন্ডার কথাতেই বলি বরং – ‘…Practicing food sovereignty and going back to the way of our ancestors doesn’t have to be extreme and it doesn’t have to happen overnight. Get to know your plant relatives again…slowly and with care…they are waiting for you. Oh…and your neighbour probably won’t mind you clearing some of those pesky dandelions from your lawn!’ (খাবারের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করা আর আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়াটা রাতারাতি হবে না। তা নিয়ে তাড়াহুড়ো করারও দরকর নেই। নিজের চারপাশের গাছপালাদের চিনতে জানতে শিখুন। তাদের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। ওরা আপনাদেরই অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া আপনার প্রতিবেশীও বোধহয় ওঁর জমি থেকে খানিকটা আগাছা তুলে নিলে বিশেষ রাগ করবেন না।)
লিন্ডা তাই শেখায়, ড্যান্ডেলিয়নের শিকড় হালকা আঁচে সেঁকে সেঁকে কেমন করে ব্রু (brew) করতে হয়। আহা! সেই ব্রু-করা মূল রসের স্বাদ নাকি চকোলেট-ক্যারামেলের মতো। ডায়বেটিসের খাদ্য সহযোগী এই গাছের গল্প লিন্ডা ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের হেঁশেল ঘরে। জানাতে চায় চোকচেরির জাদুবাস্তবতা। লাল টুকটুকে চোকচেরির ভিতরের সায়নায়েড কেমন করে তাপের সংসর্গে বদলে যায় কে জানে!
এই মুহূর্তে, পৃথিবীতে অনেকেই লিন্ডার মতো করে ভাবছেন। ওঁর গল্প বলতে বলতে আমার তাই পিয়েত দেস্পেইন (Pyet Despain), ফ্রিদ্দি বিৎসোই (Freddie Bitsoie), সিওভান ডেটকাভিচের (Siobhan Detkavich) কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ঢাকা শহরের চাকমা রেস্তোরাঁয় শিমূল ফুলের শুঁটকি রান্নার কথা। এই তো আর কদিনেই মহুলের বীজ হবে। সে বীজের খোসা ফেলে কী সুন্দর ডালনা রাঁধে গৌরীদি (গৌরী টুডু)। গাছেদের আর ঘাসেদের থেকে অনেক দূরে সরে আসতে আসতে আমাদের হারিয়ে ফেলা রান্নাঘরটুকু মার্কেজের উপন্যাসের মতো জাদুবাস্তবতায় ভরে উঠতে থাকে।
ঔপনিবেশিকতায় ঘেরা আমাদের নতুন রান্নাঘরে খানিক খানিক গুল্ম ওদের বুনো গন্ধখানা ছড়াক না একেকদিন! আষাঢ়ের জলে মাঠ ময়দানে মাথা তুলে থাকা কত না চেনা–অচেনা গাছ জেগে আছে মানুষের প্রত্যাশায়। লিন্ডার মতো সংসার শুদ্ধু বেরিয়ে পড়া তো সহজ না! লিন্ডাও জানে সেকথা। ও তাই মানুষদের গল্প শোনায়। গাছেদের গল্প, এই পরে থাকা পৃথিবীটার গল্প, মা–মাসি–দাদু–কাকা আর কত না চুল পেকে যাওয়া খুড়োদের জঙ্গম জীবনের গল্প। সে গল্প রূপকথার চেয়ে কম আশ্চর্যের নয়। বরং বুনোফুলের গন্ধে সে গল্পের ঝুড়িখানা ভরে আছে সেই কবে থেকে। রূপোর কাঠির ছোঁয়ায় কেউ কি ওর ঘুম ভাঙাবে না! ভাঙাবে তো! এই যেমন পেরেছে আমাদের লিন্ডা! লিন্ডার ক্লাস লেকচারকে আমার তাই ভালোবেসে একখানা নাম দিতে সাধ হয়। এ তো কেবল একখানা লিভিং স্টাইল ন্যারেটিভ নয়! এ তো ‘জিয়ন কাঠি’!
এমন ইস্কুলে যেতে আমার ভারী ইচ্ছে করে একেকদিন। ডাকোটা কি অনেক দূরে?
ছবি সৌজন্য: লিন্ডা ব্ল্যাক এলক্ এর ফেসবুক
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।