এ এক অন্য চূড়াচাঁদপুরের গল্প। গল্প, তবে সত্যি। সে চূড়াচাঁদপুরে আগুন জ্বলে উঠত না যখন তখন। সেই চুড়াচাঁদাপুরে ছিল এক রাজার বাস। রাজকন্যাদেরও বাস।
এক সত্যি গল্প থেকে আর এক সত্যি গল্প। এক রাজকন্যা দূরদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে, আর লিখতে পারবে তারই চেনা আরেক রাজকন্যার গল্প। এত বেশি সুন্দর হবে সেই লেখা, তা পেয়ে যাবে দেশের অন্যতম সেরা সাহিত্য পুরষ্কার। তবে রাজকন্যার লেখার রাজকন্যার গল্প হবে অন্য সময়। আমরা শুরু করব রাজকন্যার নিজের গল্প দিয়ে। সেই রাজকন্যা, যার বাড়ি চূড়াচাঁদপুর।
চুড়াচাঁদপুর কোথায়? কোথায় সেই রাজকন্যের বাড়ি? এই পৃথিবীর কোন কোণায়? মানচিত্রে আছে তো সেই দেশ?
যাই তাহলে সেই দেশে, যে দেশের রাজার নামই ছিল চূড়াচাঁদ সিংহ। আর রাজত্বের নাম? মণিপুর। মণিপুরের মেইতেই নিংথৌজা বংশের রাজা কুলচন্দ্রের পুত্র ছিলেন চূড়াচাঁদ। অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধে তার শাসিত রাজ্যে ব্রিটিশ অনুপ্রবেশের বিরোধিতা করেন কুলচন্দ্র, কিন্তু যুদ্ধে রাজার পরাজয় হয়। মণিপুরে ব্রিটিশ এজেন্ট প্রতিষ্ঠিত হন, এবং আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া হয় পরাজিত রাজাকে। তখন ১৮৯১ সালে। কুলচন্দ্রের পরিবর্তে তার পাঁচ বছরের পুত্রসন্তানকে সিংহাসনে বসায় ব্রিটিশ সরকার। তিনিই রাজা চূড়াচাঁদ সিংহ (Churachand Singh)।

রাজা চূড়াচাঁদ সিংহের তিন কন্যা, সর্ব কনিষ্ঠার নাম বিনোদিনী। মহারাজ কুমারী বিনোদিনী, বা এমকে বিনোদিনী (M K Binodini)। একসময় যাকে সারা রাজ্য ভালোবেসে ডাকবে ইমাসি বলে। সর্বভারতীয় সাহিত্যের মঞ্চ সাহিত্য আকাদেমিতে উঠে আসবে বিনোদিনীর নাম, তার বই ‘বড়া সাহেব অঙ্গা সানাতোম্বি’র জন্য। এই বিনোদিনী, রাজার আদরের ওয়াঙ্গালসানা– আমাদের রাজকন্যা।
রাজকন্যার জন্ম ১৯২৪ সালে, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে। রাজ্যের নাম মণিপুর। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী বিনোদিনীকে রাজপরিবারের প্রথা ভেঙে গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞানের শিক্ষা দেন বাবা চূড়াচঁদ সিংহ। পরবর্তীকালে প্রথাগত শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য বিনোদিনীকে পাঠানো হয় শিলং-এ।
সেই মুহূর্তে, বিনোদিনীকে চূড়াচাঁদপুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখারও বিশেষ প্রয়োজন ছিল, যে প্রয়োজনের কথা পৃথিবী জানতে পারবে অনেক পরে। রাজকন্যা বিনোদিনী অনেক অনেক বছর পরে যখন কলম ধরবেন, যখন উঠে আসবে সেই আরেক রাজকন্যার গল্প, পৃথিবী জানতে পারবে অনেক না জানা কথা– সেই তখন জানা যাবে, কেন বিনোদিনীর থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয় বোধ করেছিল রাজপরিবার। রাজতন্ত্রের বিপরীতে, দীর্ঘদিনের অচলায়নের বিরুদ্ধে মাথা তোলার সাহস দেখাচ্ছিল বিনোদিনী– বদলে ফেলতে চাইছিল মণিপুরের মেইতেই রাজবংশের সব নিয়মকানুনের ঘেরাটোপ। বিনোদিনীর উৎসাহে রাজপরিবারের অন্দরমহলে ক্রমশ বেড়ে উঠছিল বিদ্রোহের আগুন। তাই চূড়াচাঁদ সিংহ উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনকে ব্যবহার করে বিনোদিনীকে পাঠিয়ে দিলেন শিলং, রাজপরিবারের কোনও রাজকন্যার সেই প্রথম উচ্চশিক্ষার জন্য রাজ্যের বাইরে যাত্রা।
শিলং-এ তো গেল বিনোদিনী, কিন্তু বিদ্রোহের আগুন তার থেকে দূরে সরে গেল কি? সময়ের গায়ে লেখা হবে যে বিপ্লব, তাকে মুছে ফেলা কি আদৌ সম্ভব?
ফিরে যাই ১৯৩৮ সালে। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যখন চরমপন্থী ও নরমপন্থী আন্দোলন উভয়ই এক বাঁকের মুখে। এই সময়েই দেশে অঙ্কুরিত হচ্ছে বামপন্থী আন্দোলনের সম্ভাবনাময় বৃক্ষ। চরমপন্থী বাম আন্দোলনেরই অংশীদার হয় বিনোদিনী। মনে করে নেওয়া ভাল, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির স্থাপনের সময়কাল ১৯২৫, তাই বিনোদিনীর শিক্ষার সময়, হয়ত যুগের চিহ্ন বহন করবে বলেই, সমপাতিত হয় বামপন্থী আন্দোলনের সূচনার সময়ের সঙ্গে।

ইতিহাস মনে করায় ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিবৃত্ত। ১৯২৫ সালে কানপুরে স্থাপিত হয় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। পরবর্তীকালে পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ও কানপুর বলশেভিক মামলার পরে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু গোপনে চলতে থাকে পার্টির উত্থান। ১৯২৬ সালে জর্জ আলিসনের ভারতে আগমনের পর শিলং শহরে গঠিত হয় ব্রিটিশ বিরোধী বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন, এবং আগামী দশকে তা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র আন্দোলনেও। ১৯৩৬ সালের রামগড় কমিউনিস্ট কংগ্রেসের প্রভাব পরে শিলং ছাত্র আন্দোলন, যার অংশ হয়ে ওঠেন রাজকুমারী বিনোদিনী।
বিনোদিনীর মতোই, রাজতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রের অংশ হয়েই গণতন্ত্রের পক্ষে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন, এমন মানুষরা হয়ে ওঠেন সময়ের মশাল-বাহক। তা ফরাসি বিপ্লবের লা ফায়াটেই হোন বা স্বাধীনতা ও জাতিভেদ বিরধী আন্দোলনে বরোদা রাজবংশ।
তবে মণিপুরের রাজতন্ত্রের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না, সম্ভবও ছিল না। তাই চূড়াচাঁদপুর থেকে শিলং, এবার শিলং থেকে শান্তিনিকেতন যাত্রা করলেন রাজকন্যা বিনোদিনী। তবে তিনি মনে প্রাণে, আত্মায় চেষ্টা করেছেন এই মোড়ক বিসর্জন করার। হয়ত তাই, চিত্রাঙ্গদার দেশের মেয়ে এসে পৌঁছল সেই মাটিতে। এ বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক কথা না বললেই নয়। রাজকন্যা বিনোদিনীর আদলেই কি তৈরি হয় রাজকন্যা চিত্রঙ্গদা? এই প্রশ্ন উঠে এসেছে বারবার। এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মণিপুরের রাজন্যাদের বিদ্রোহের গল্প? সেই অন্য এক রাজকন্যের গল্প যে হয়ত সত্যি সত্যিই বলে উঠেছিল – ‘পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা…’ সেই সত্যিকারের চিত্রাঙ্গদার গল্প আজ নয়, আর এক দিন।
এখন আমরা আছি লালমাটির দেশে, যেখানে গুরুদেবের সান্নিধ্যে এসে পৌঁছেছে বিনোদিনী।
গুরুদেব, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রমে তখন মণিমানিক্যের সম্ভার। আছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, রামকিংকর বেইজ (Ramkinkar Baij)। দেশবিদেশ থেকে বিখ্যাত অধ্যাপক, জ্ঞানীগুণী মানুষরা যেমন আসছেন, তেমনই আসছে নানা রাজ্য থেকে ছাত্রছাত্রীরাও। সবাই একসঙ্গে অধ্যয়ন করছে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য। ভিনরাজ্যের তৎকালীন কত কত ছাত্রছাত্রী পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছেন।

বিনোদিনীও তার সাম্প্রতিক অতীত ভুলে অঙ্গীভূত হয়ে গেলেন এই মহান স্রোতে। তার পিতার ইচ্ছা ছিল সঙ্গীতভবনে শিক্ষা নিক বিনোদিনী, কিন্তু রাজ-আদেশ অমান্য করে বিনোদিনী হয়ে উঠলেন কলাভবনের প্রিয় ছাত্রী। স্বয়ং শিল্পাচার্যের কাছে শিখলেন মূর্তি গড়া, ছবি আঁকা।
আর ধরা পড়লেন রামকিংকর বেইজের প্রথাভাঙা শিল্পের তুলিতে। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছেন, ভেঙেচুরে নিয়েছেন বিনোদিনী। রঙে, তুলিতে চারকোলে তাই নানা ভাবে বন্দী হলেন বিনোদিনী। কখনও পঠনরত অবস্থায়, কখনও মণিপুরী নাচের ভঙ্গিমায়, কখনও বা নিরাবরণ চিত্রকল্পে। রামকিঙ্কর বেইজের সেই ‘বিনোদিনী’ সিরিজ বিখ্যাত হবে সারা বিশ্বের শিল্পজগতে।
শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন শেষে বিনোদিনী ফিরে যান নিজ্রে রাজ্যে। রাজা চূড়াচাঁদ ও রাজকন্যা বিনোদিনীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যতই মতপার্থক্য থাক, পিতার প্রিয় কন্যা ছিলেন বিনোদিনীই। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন ঐতিহাসিকভাবে রাজতন্ত্রের শিরোপা ত্যাগের সময় আসে।
সত্যিই রাজকন্যা আর থাকলেন না বিনোদিনী। সকলের প্রিয় ইমাসি হয়ে যান তিনি। মণিপুরের মেয়েদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করতে থাকেন। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই ছাত্রাবস্থায়, শেষপর্যন্ত সেই আদর্শকেই স্থাপিত করেন মণিপুরের মাটিতে।
বিতর্ক, রাজপরিবারের সঙ্গে মতবিরোধ তার পিছু ছাড়ে না। সেই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকে সেই ঐতিহাসিক আখ্যান, যা তাকে এনে দেবে সাহিত্য আকাদেমি সম্মান। সেই বইয়ের কথা, বইয়ের কেন্দ্রে থাকা রাজকন্যার কথা আমরা জানব পরের পর্বে। তবে তো পূর্ণতা পাবে এই রাজকাহিনি।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, http://www.imasi.org/biography.php
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
One Response
এম কে বিনোদিনী দেবী ১৯৭৯-তে সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। মজার বিষয় মণিপুরী ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলের স্বীকৃতি ১৯৯২-এ পায়।