অমলেন্দু চক্রবর্তী। নামটা কি চেনা ঠেকছে? অধিকাংশ মানুষই দু’পাশে মাথা নাড়বেন, “না, চিনি না।” অমল চক্রবর্তী (Amal Chakrabarty) বললে কিছু মানুষ ভুরু কুঁচকে বলতে পারেন, “হ্যাঁ, কোথায় যেন শুনেছি।” কিন্তু অমল বললে একডাকে সব বাঙালি তাঁকে চিনবে। প্রায় সাত দশক ধরে তিনি আমাদের হাসিয়েছেন, হাসির মোড়কে ভাবিয়েছেন, ছোট ছোট পকেট কার্টুন বা বক্স কার্টুনের মাধ্যমে চারপাশের নানান অসংগতির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। ‘তির্যক’ দিয়ে শুরু করে ‘অমল আলো’য় আমাদের হৃদয় ভরিয়েছেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার কদিন আগে পর্যন্ত।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে। ওঁর বাবা সুধীর চক্রবর্তীর ছিল জহুরির চোখ। ছেলের আঁকার হাতের আঁকিবুকিতেই দেখেছিলেন ভবিষ্যতের ছবি। পরিচিতজনেরা বাধা দিলেও তিনি কিন্তু ছোট্ট অমলকে উৎসাহ যুগিয়েছেন ছবি আঁকার প্রতি। ধর্মতলায় বিখ্যাত জি সি লাহার দোকানে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে নিয়মিত কিনে দিতেন আঁকার সাজ-সরঞ্জাম, রং, তুলি, খাতা ইত্যাদি। অমলের যখন পনেরো-ষোল বছর বয়েস, সেই সময় সংবাদপত্রে ‘চিল্ড্রেনস আর্ট কম্পিটিশন’এর বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়েছিল সুধীরবাবুরই। তাঁর কথাতেই অমল সেই প্রতিযোগিতায় নাম নথিভূক্ত করেছিলেন। সেই প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা ছিলেন কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট কে শংকর পিল্লাই। সব প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে প্রতিযোগিতার কার্টুন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন অমল (Amal Chakrabarty)। পুরস্কার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং শঙ্কর। কিংবদন্তির হাতের স্পর্শেই বোধহয় তাঁর জীবনের অভিমুখও তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ঠিক হয়ে গিয়েছিল তিনি ভবিষ্যতে কার্টুনিস্টই হবেন।

পেশার জগতে প্রবেশ করে বছর পাঁচেক চাকরিও করেছিলেন রেলওয়ে কো অপারেটিভে। ১৯৬১ তে শুরু হয় তাঁর কার্টুনিস্টের জীবন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তির্যক’ শিরোনামে বক্স কার্টুন শুরু করলেন তিনি। অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল সেই কার্টুনগুলি। কিন্ত বেশ কিছুদিন পর কর্তৃপক্ষ ‘তির্যক’ শিরোনামের ব্যানারে অন্য কার্টুনিস্টদের কাজ প্রকাশ করা শুরু করায় প্রতিবাদে আনন্দবাজারের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন অমল। এর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মূলত কার্টুন এবং সঙ্গে অলংকরণও করেছেন। দ্য স্টেটসম্যান ও যুগান্তরে তাঁর আঁকা কার্টুনগুলি তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সূচনা সংখ্যা থেকেই অমল প্রতিদিন পাঠকদের উপহার দিতে শুরু করেন তাঁর অনবদ্য পকেট বা বক্স কার্টুন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সেই উপহার থেকে বঞ্চিত হয়নি পাঠকেরা। তাঁর ইচ্ছে ছিল একশো বছর পর্যন্ত তিনি কাজ করে যেতে পারবেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, নব্বই অতিক্রম করে তাঁকে থেমে যেতে হল।
আজকের দিনের আরেক নামী কার্টুনিস্ট, অমলের ভক্ত ও অনুগামী উদয় দেব দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, “আজীবন বলেছি, এখনও বলছি এবং আগামী দিনেও বলে যাব যে অমল চক্রবর্তী হচ্ছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা একজন কার্টুনিস্ট।” অবশ্যই। উদয় দেবের সঙ্গে আমরাও একমত।

রাজনৈতিক কার্টুনের প্রতি ছিল তাঁর অপার উৎসাহ। নিজেই বলেছিলেন, “অ্যাপলিটিক্যাল বলে তো কিছু হয় না।” তাঁর অজস্র রাজনৈতিক কার্টুন বাংলা কার্টুনের ইতিহাসে সম্পদ হয়ে থাকবে। তাঁর সেই সব কার্টুনগুলির আলোচনায় যাব না। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে সুচিন্তিত মতামত দিতে পারবেন। আমি ওঁর আরেকটি দিক নিয়ে কয়েকটি কথা বলি।
রাজনৈতিক কার্টুনের পাশাপাশি অমল ছোটদের জন্যও প্রচুর মজাদার বক্স কার্টুন, কার্টুন স্ট্রিপ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সন্দেশীও। বাংলা শিশু সাহিত্যের ভগীরথ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষ অতিক্রম করা ‘সন্দেশ’ পত্রিকার লেখক, শিল্পী, গ্রাহক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের সন্দেশী পরিবারের সদস্য বলে অভিহিত করা হয়। এই প্রতিবেদকও একজন সন্দেশী। ১৯৬১ (বাংলা ১৩৬৮) সালে সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তৃতীয় পর্যায়ের সন্দেশ নতুনভাবে শুরু করার পর প্রায় প্রথম থেকেই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অমল। এই পর্যায়ের সন্দেশের প্রথম কার্টুনটি করেছিলেন তিনি। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬৯-এর শ্রাবণ সংখ্যায়। কার্টুনের ছবিটি ছিল একটা মৌমাছি স্ট্র দিয়ে ফুল থেকে মধু খাচ্ছে। নীচে ক্যাপশন, “কোকাকোলা নয় কিন্তু!” পরবর্তী ছয় দশকে অমল সন্দেশের পাতায় এঁকেছেন অনেক বক্স কার্টুন, মাঝে মাঝে একাধিক বক্স কার্টুনের সাহায্যে পাতাজোড়া গল্প। কখনো বা লম্বা একটা স্ট্রিপের কার্টুন।
ক্যাপশন সমেত বক্স কার্টুন প্রকাশিত হয় অনেক পত্রপত্রিকাতেই। কিন্তু ১৩৭০-এ সন্দেশের পাতায় ছড়া ও ছবির যুগলবন্দীতে প্রকাশিত তিনটি বক্স কার্টুন পেয়েছিল অন্য মাত্রা। দুই কিংবদন্তি— অমল ও সত্যজিৎ রায়ের আঁকা এবং ছড়ায় ওই তিনটি মজাদার কার্টুন মুগ্ধ করেছিল সব বয়েসী পাঠকদের। প্রথমটির ছবিতে ছিল ঢুলুঢুলু চোখে একটি মোরগ আড়মোড়া ভাঙছে, পাশে রাখা ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছে। সঙ্গে ছড়া, “ঠিক শুনেছি ঘড়ির আওয়াজ ঘুম জড়ানো চক্ষে/ নইলে ওঠা কঠিন হত ভোরে আমার পক্ষে।” দ্বিতীয়টির ছবি— জলের ধারে ডাঙায় দাঁড়িয়ে আছে বক। জলের নীচে মাছ, ওর চোখে পেরিস্কোপ। সঙ্গে ছড়া, “ডাঙার কাছে ঘুরে বেড়াই পেরিস্কোপের জোরে/ বকের এখন সাধ্যি নেই আমায় নেয় ধরে।” তৃতীয় কার্টুনটির ছবিতে দেখা যাচ্ছে চোখে দূরবিন লাগিয়ে একটি শকুন উড়ছে, আর মনে মনে ভাবছে, “একে টেকো তায় বুড়ো, চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি/ দূরবিনে ধরে ফেলি আছে কোথা ফিস্টি।”

পরবর্তী দিনে সন্দেশের পাতায় পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদিদের নিয়ে অজস্র বক্স কার্টুন, কার্টুন স্ট্রিপ করেছেন অমল। ছোটদের কাছে মজাদার, বড়দের ভাবনার খোরাক রয়েছে সেগুলিতে। কয়েকটির উল্লেখ করা যেতেই পারে। চারটি বক্সের একটি স্ট্রিপে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে দাঁড়ে বসা টিয়া পাখিকে ছোলা দিচ্ছে আর বলছে যে ছোলা দিচ্ছি, কথা বল। পাখি নিরুত্তর। রেগে উঠে ছেলেটি বলে, “বাজে পাখি, কথা বলতে জানে না।” তখন পাখিটিও রেগে বলে, “তুমিও তো উড়তে পার না।” মোক্ষম জবাব! এক পাতাজোড়া ছটি বক্সের প্রথম পাঁচটিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট্ট পাখি বারবার যাতায়াত করে বাসা বানাচ্ছে। শেষ বক্সে দেখা যায় বাসা বানানো শেষ, কিন্তু একটা বড় পাখি সে বাসা দখল করে বসে আছে। হাতি নিয়ে তাঁর একাধিক মজার কার্টুন এবং স্ট্রিপ রয়েছে। কখনও হাতি যাচ্ছে ডেন্টিস্টের কাছে, কখনও বা কোনও শিল্পী জীবন্ত হাতির দাঁতেই শিল্পকর্ম সৃষ্টি করছে। আবার কখনও হাতিরা দল বেঁধে আন্দোলনে নেমেছে। স্লোগান দিচ্ছে, “আমাদের একশো দিনের কাজ চাই”, “কুয়ো খোঁড়া চলবে না, আমাদের বাচ্চারা পড়ে যায়”, “আমাদের জঙ্গলে ফেরত পাঠানো চলবে না, চলবে না” ইত্যাদি… ইত্যাদি। এই কার্টুনগুলিতে মজার আড়ালে সূক্ষ্ম খোঁচা কি নেই? পাশাপাশি উল্লেখ করতেই হয় তাঁর অসম্ভব সুন্দর ড্রইং-এর।
তবে সন্দেশের পাতায় এই কার্টুনগুলির পাশাপাশি অমলের আরেকটি কীর্তির কথা বলতেই হবে। সেটি হল ‘প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর’—এর প্রথম হেডপিস। সন্দেশের এই বিভাগটি বাংলা পত্রিকার জগতে একটি অভাবনীয় বিষয়। সন্দেশের গ্রাহকদের প্রকৃতি চেনানোর এই হাতে-কলমে বিভাগটি চলছে ১৯৬২ থেকে। পরিচালনায় জীবন সর্দার। নব্বই অতিক্রান্ত জীবন সর্দার ছিলেন অমলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুর অনুরোধেই হোক, কি সম্পাদকের নির্দেশেই হোক, পত্রিকার পাতার জন্য এই বিভাগটির একটি হেডপিস করেছিলেন অমল। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, পত্রিকার অন্য সব বিভাগের হেডপিস করেছিলেন স্বয়ং সম্পাদক সত্যজিৎ রায়। চমৎকার ওই হেডপিসে গাছপালা, ফুল, প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি, ব্যাঙ, কাঠবেড়ালির পাশাপাশি দুই খুদে পড়ুয়াকেও প্রকৃতি অন্বেষণে ব্যস্ত থাকতে দেখি আমরা। একটুকরো প্রকৃতিই যেন উঠে আসে আমাদের সামনে।
চলে গেছেন সন্দেশীদের প্রিয় অমল। সন্দেশের পাতায় রয়ে গেছে ওঁর অজস্র কীর্তি। সব সন্দেশীদের তরফে জানাই সন্দেশী অমলকে শ্রদ্ধা।
(বয়সে তিনি আমার থেকে প্রায় তিরিশ বছরের বড়। কিন্তু পুরো লেখাটিতেই আমি ওঁকে অমল বলেই সম্বোধন করেছি। এই সম্বোধন যদি কারও দৃষ্টিকটু লাগে তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ওকে ‘অমলদা’ বলে ডাকার সৌভাগ্য হয়নি। বহু বছর আগে প্রতিদিনের অফিসে সন্দেশের কাজে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। সামান্যই কথা হয়েছিল। এর পর দুদিনই তাঁকে সামনে থেকে দেখেছি। তাঁর রচনাবলী প্রকাশ (লালমাটি) অনুষ্ঠানে আর আরেকদিন রিড বেঙ্গলি বুকসের একটি অনুষ্ঠানে। ছবি তুলেছি। কথা হয়নি। তবে তিনি তো ‘অমল’ নামেই সবার কাছে পরিচিত, তাই হয়তো আমার অপরাধ হয়নি।)
*ছবি সৌজন্য: Amal Chakrabarty Facebook page
দেবাশিস সেন (১৯৬১)। জন্ম আসামের ডিগবয়-এ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে আসামেরই আরেক ছোট্ট শহর দুলিয়াজানে। বাংলা থেকে দূরে থাকলেও বাংলা পত্রপত্রিকার সঙ্গে সখ্যতা জ্ঞান হবার পর থেকেই। কৈশোর পার করে কলকাতায় আসার কয়েক বছর পর যোগাযোগ সন্দেশ পত্রিকার সঙ্গে। দীর্ঘদিন যুক্ত সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে। জীবনের প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল অধুনালুপ্ত 'কিশোর মন' পত্রিকায়। সেটি ছিল একটি ভূতের গল্প। পরবর্তী দিনে প্রচুর ভূতের গল্প লিখলেও সব ধরনের গল্প, উপন্যাস ফিচারই লেখেন। পত্রিকার প্রয়োজনে স্বনামের পাশাপাশি সন্দেশের পাতায় অন্য নামেও লেখেন। বল বয় ও থার্ড আম্পায়ার নামে লেখেন খেলাধুলা সংক্রান্ত ফিচার, পুস্তক সমালোচনার সময় তাঁর ছদ্মনাম গ্রন্থবিমুখ গোস্বামী, টুকরো খবর লেখেন প্রবাল সেন বা সন্দেশী নামে। সন্দেশ-এর পাশাপাশি গল্প, ফিচার লিখেছেন 'শুকতারা', 'কিশোর ভারতী', 'চির সবুজ লেখা', 'কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান', 'ঝালাপালা', 'আমপাতা জামপাতা', 'রং বেরং', 'মায়াকানন' ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি প্রবল নেশা ছবি তোলার। অবশ্য নিজেকে ফটোগ্রাফার ভাবেন না। তাঁর মতে তিনি কিছু দৃশ্য এবং মুহূর্তকে শুধু ধরে রাখেন। অনেক গ্রন্থ সংকলন এবং সম্পাদনা করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সন্দীপ রায়ের সঙ্গে সম্পাদিত 'সন্দেশ-এর কমিক্স সমগ্র', প্রসাদরঞ্জন রায়ের সঙ্গে সম্পাদিত 'সন্দেশের সত্যজিৎ' ইত্যাদি...