(Mrinal Chakraborty)
বলা উচিৎ ছিল মৃণালকাকু, কিন্ত বলতাম মৃণালদা। বাবা-মায়ের দেখাদেখি শুরু হয়েছিল এই ডাক। অনেক লেখাতেই লিখেছি, যে মা কর্মসূত্রে কলকাতা দূরদর্শনে ছিলেন। একদিন বাড়ি ফিরে এসে বললেন, ‘আজ অফিসে মৃণালদা এসেছিলেন, বলেছি ওঁকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করব।’ (Mrinal Chakraborty)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: নিমাইসাধন বসু
মৃণালদার পরিচয় তখন ঠিক মতো জানতাম না, কারণ, উনি মাঝে দীর্ঘদিন সঙ্গীতজগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন তাই আমাদের প্রজন্ম মৃণাল চক্রবর্তীকে সেইভাবে চিনত না। শুনেছিলাম যে আমাদের পরিবারের সঙ্গে মৃণালদার সম্পর্ক অনেকদিনের। মায়ের এক দাদু ছিলেন আনন্দময়ী মায়ের শিষ্য, সেই শ্রীমত কৃষ্ণনন্দ ব্রহ্মচারীর সঙ্গেই উত্তর কলকাতার একটি বাড়িতে মৃণালদার পরিচয় হয়। সেই শুরু, তারপর থেকে পরিবারের সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে, কিন্তু মাঝে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! শুনেছিলাম ওই সময় মৃণালদা গানও ছেড়ে দিয়েছিলেন, বাসের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যাক, অনেক বছর পরে যখন আবার নতুন করে গান শুরু করলেন তখন গলা শুনে রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম! (Mrinal Chakraborty)

দূরদর্শনে বেশ কয়েকটি গান রেকর্ড করেছিলেন। মনে আছে তার মধ্যে, ‘কতদিন যে খুঁজে গেলাম, কত রাত্রি কাছে এলাম’ আর ‘তুমি যে আশা নদী’ গান দুটি শুনে ভীষণ ভাল লেগেছিল। এর কিছুদিন পরে মৃণালদা ওঁর স্ত্রী উমাদি আর ছেলে বুবুলদাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। তখন লোডশেডিং চলছে, ওঁর একটা ক্যাসেট উপহার দিলেন। ওঁর গাওয়া সব জনপ্রিয় গানগুলো ওই ক্যাসেটে ছিল। তখন রেকর্ড গিয়ে ক্যাসেটের যুগ এসেছে। (Mrinal Chakraborty)
আমার কাছে তখন মানুষটাও নতুন আর গানগুলোও নতুন। পরে ক্রমে জেনেছিলাম যে উনিও বাংলা গানের স্বর্ণযুগের একজন জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। নিরহংকারী মানুষ, সাধারণ পোশাকে চলাফেরা করতেন কিন্ত গলা শুনলেই মনে হত ভীষণ রোমান্টিক কণ্ঠস্বর! থাকতেন বালিগঞ্জ প্লেসে চিত্রকর যামিনী রায়ের বাড়ির পাশেই। প্রায়ই ওঁর বাড়িতে আমরা যেতাম, আমি একা তো সপ্তাহের মধ্যে পাঁচদিনই যেতাম। (Mrinal Chakraborty)
ওঁর ছেলে বুবুলদার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। গান নিয়ে অনেকরকম গল্প হত। ভীষণ স্নেহ করতেন। ওই সময় গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে ওঁর গাওয়া গানের একটা লং-প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
ওঁর ছেলে বুবুলদার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। গান নিয়ে অনেকরকম গল্প হত। ভীষণ স্নেহ করতেন। ওই সময় গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে ওঁর গাওয়া গানের একটা লং-প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। আমি খবর পেয়েই রাসবিহারীর মেলোডি থেকে রেকর্ডটা কিনে মৃণালদাকে দিয়ে সই করাতে গেলে মজা করে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘সই করে দিতে পারি কিন্তু রেকর্ডটা যত টাকা দিয়ে কিনেছিস, সেই দামটা আমার কাছ থেকে নিতে হবে, তবে সই করব।’ (Mrinal Chakraborty)
বলাই বাহুল্য যে আপত্তি টিকল না। রেকর্ডের দামটা পকেটে গুঁজে দিলেন সঙ্গে রেকর্ডে ছাপা নিজের ছবির নীচে লিখলেন, ‘স্নেহের বুবানকে মৃণালকাকা’। আমার দিদাকে উনি, দিদি বলে ডাকতেন। আমাকে বললেন, ‘দিদির নাতি টাকা দিয়ে আমার রেকর্ড কিনবে! এটা হতেই পারে না।’ শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথের দুটো গান উনি রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলি শুনিনি কখনও। রেকর্ডের এক পিঠে ছিল, ‘আজি বর্ষারাতের শেষে’ আর অন্য পিঠে ‘নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা’। একদিন ওঁর বাড়িতে গান দুটো শুনতে চাইলাম, সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান দুটি শোনালেন। মনে আছে আমার মামারবাড়ির রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও একবার ওই গান দু’টি গেয়েছিলেন। (Mrinal Chakraborty)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: অলোক আলপনায়
হেমন্তদাদুর জন্য মৃণালদা একবার দু’টি গানে সুর দিয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ হেমন্তদাদু চলে যাওয়ার ফলে আর রেকর্ডিং করার সুযোগ হয়নি। পরে ওই গান দুটি মৃণালদা নিজের উদ্যোগে ক্যাসেটবন্দি করেন। একদিন আমাকে ডেকে ওই ক্যাসেটটা নিয়ে গেলেন, ওঁর বন্ধু সঙ্গীতশিল্পী ধীরেন বসুর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে আমরা তিনজনে গানগুলো শুনলাম। গান সোনার সময় মৃণালদা বারে বারে আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘ইস! এই দুটো গান যদি হেমন্তদার গলায় রেকর্ড হত তাহলে কী কান্ডটাই না হত!’ (Mrinal Chakraborty)
সাধারণত ল্যান্সডাউন রোড-হাজরা রোড ক্রসিং থেকে বন্ডেল রোডের অটোরিক্সা ধরে মৃণালদার বাড়ি যেতাম আর উনি আমাদের বাড়িতে এলে সেইভাবেই যাতায়াত করতেন। মৃণালদা আমায় বললেন, ‘তুই একটু আমার সঙ্গে চল, মূর্তিটা ভারি আছে, আমার সঙ্গে গিয়ে একটু অটোতে তুলে দে।’
লিখতে গিয়ে আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। আমাদেরকে কেউ একটি দুর্গামূর্তি দিয়েছিল কাচের বাক্সে বাঁধানো। সেটা দেখে মৃণালদার খুব ভাল লেগেছিল তাই বাবা মৃণালদাকে বলেছিল মূর্তিটা নিয়ে যেতে, কিন্তু মৃণালদা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। এরপর মা প্রায় জোর করেই সেটাকে মৃণালদার হাতে তুলে দেন। (Mrinal Chakraborty)
সাধারণত ল্যান্সডাউন রোড-হাজরা রোড ক্রসিং থেকে বন্ডেল রোডের অটোরিক্সা ধরে মৃণালদার বাড়ি যেতাম আর উনি আমাদের বাড়িতে এলে সেইভাবেই যাতায়াত করতেন। মৃণালদা আমায় বললেন, ‘তুই একটু আমার সঙ্গে চল, মূর্তিটা ভারি আছে, আমার সঙ্গে গিয়ে একটু অটোতে তুলে দে।’ আমি ওঁর সঙ্গে চললাম কিন্তু রাস্তায় গিয়ে মত পরিবর্তন করলেন, বললেন, ‘দাঁড়া, একটা ট্যাক্সি নিই, মাকে যখন বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি, তখন অটোর ঝাঁকুনি খাওয়াতে খাওয়াতে মাকে নিয়ে যাব না।’ (Mrinal Chakraborty)

ওঁর বাড়িতে আড্ডা বসলে অনেক রাত পর্যন্তই চলত। এমন একটা দিনে খুব বৃষ্টি পড়ছে, মৃণালদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছাতা আনিসনি?’ আমি বলেছিলাম, ‘না, ছাতা কিনলেই দেখেছি বৃষ্টি আর পড়ে না।’ শুনে মজা করে বলেছিলেন, ‘তাহলে তোকে আমরা সবাই মিলে একটা ছাতা কিনে দিই, তাহলে বৃষ্টিটা থামবে।’ এ কথা বলার কারণ ছিল এই যে সেবারে কলকাতায় বর্ষা খুব বেশিদিন ধরে চলেছিল। একবার নৈহাটিতে একটা অনুষ্ঠানে মৃণালদা আর ধীরেনদার সঙ্গে গিয়েছিলাম, রাস্তায় যেতে যেতে খাওয়া নিয়ে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছিল। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যে সব খাবারের আয়োজন করেছিল, সেগুলো খুব ঝাল ছিল, ধীরেনদার খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না কিন্তু মৃণালদার সমস্যা হচ্ছিল এবং তিনি প্রতিবাদ করছিলেন। খাওয়া শেষ করে যখন গাড়িতে ওঠা হল, মৃণালদা ধীরেনদাকে খুব আস্তে করে বলেছিলেন, ‘তুই এত মানিয়ে নিস বলে এত অনুষ্ঠান পাস আর আমি রেগে যাই, তাই আমার অনুষ্ঠানের সংখ্যা কম।’ (Mrinal Chakraborty)
মৃণালদার অনেকগুলো গানের মধ্যে, ‘ঠুং ঠাঙ ঠুং ঠাঙ চুড়ির তালে’ অন্যতম, একটা গানের জলসায় শ্রোতারা মৃণালদাকেই অনুরোধ করে বলেন আপনি অমুক শিল্পীর গাওয়া এই গানটা করুন। সেই কথা শুনে মৃণালদা তো রেগে আগুন, তারপর তিনি শ্রোতাদের বলেন এই গানটি তাঁরই গাওয়া।
একবার একটা অনুষ্ঠানে, মজার ঘটনা ঘটেছিল। মৃণালদার অনেকগুলো গানের মধ্যে, ‘ঠুং ঠাঙ ঠুং ঠাঙ চুড়ির তালে’ অন্যতম, একটা গানের জলসায় শ্রোতারা মৃণালদাকেই অনুরোধ করে বলেন আপনি অমুক শিল্পীর গাওয়া এই গানটা করুন। সেই কথা শুনে মৃণালদা তো রেগে আগুন, তারপর তিনি শ্রোতাদের বলেন এই গানটি তাঁরই গাওয়া। আসলে সেই সময় নতুন কিছু শিল্পী, পুরোনো গায়কদের কিছু গান রিমেক করছিল এবং অনুষ্ঠানেও গাইত, তাই এরকম ভ্রম হয়েছিল। কত সান্নিধ্য, কত স্মৃতি, কত কথা! সব কি আর মনে থাকে সব সময়! (Mrinal Chakraborty)
কিছুদিন আগে পুরোনো রেকর্ডগুলো বের করে পরিষ্কার করছিলাম তখন চোখে পড়ল মৃণালদার রেকর্ডের ওপর ওঁর হাতের লেখাটা আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে আর তখনই বুঝতে পারি, সময় তার নিজের নিয়মে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা, অতীতের মানুষদের রেখে যাওয়া স্মৃতি থেকে কত দূরে সরে যাচ্ছি! (Mrinal Chakraborty)
ছবি সৌজন্য- আন্তর্জাল
মুদ্রিত ও ডিজিটাল ভার্শনে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।