(Partha Mukhopadhyay)
অনেক বছর আগে, তখন ল্যান্ডলাইন-এর যুগ, সেই সময় যোগাযোগ হয় অভিনেতা পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের বিষয়ে। ওঁকে বলেছিলাম অসীমাদি অর্থাৎ ওঁর স্ত্রী সুরকার-প্রযোজক অসীমা মুখোপাধ্যায়কেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। শেষ পর্যন্ত ওঁরা আসতে পেরেছিলেন কী না মনে করতে পারছি না। তবে এর কিছু বছর পরে আবার পার্থ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয় তপন সিংহকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। অতিথি ছবির পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় না বলে, বালিকা বধূর পার্থ মুখোপাধ্যায় বললে সবাই চিনবেন। (Partha Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: নিমাইসাধন বসু
বাংলা চলচ্চিত্রে অবশ্য পার্থদার হাতেখড়ি অতিথির তারাপদ হিসেবে। পার্থদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘনিষ্টতায় পৌঁছলো অনেকগুলো কারণে তার মধ্যে প্রধান কারণটি হল, তপন সিংহর প্রতি আমার অনুরাগ। তপনদার হাত ধরেই পার্থদার ছায়াছবির জগতে প্রবেশ। প্রথমদিকে তপনদার জন্মদিনে আমি আর পার্থদা একসঙ্গেই যেতাম, কখনও সকালে আবার কখনও বিকেলে। যাতায়াতের পথে অনেকরকমের কথা হত, বেশিরভাগটাই ছবি সংক্রান্ত। ২০০৩ সালে ‘অনুভবে তপন সিংহ’ শীর্ষক একটি বই সম্পাদনার কাজে আমি হাত দিয়েছিলাম, সেই সময় পার্থদা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। (Partha Mukhopadhyay)

অতিথি, আপনজনের একাধিক অপ্রকাশিত সাদাকালো ছবি জোগাড় করে দেন। ওই সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর কলকাতায় এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। বইয়ের জন্য আমি আর পার্থদা রবিশঙ্করজির অতি কাছের মানুষ, রবীন পালের সঙ্গে যোগাযোগ করে বালিগঞ্জ পার্ক রোডে লালা শ্রীধরের বাড়িতে গিয়ে পন্ডিতজির বক্তব্য রেকর্ড করি। রবিশঙ্করজি পার্থদার অতিথি ছবির কথা বলে ওঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন। মনে আছে সেইদিন অনেক ছবি তুলেছিলাম যেগুলো আজও রয়ে গেছে। ওখান থেকে ফেরার পথে, পার্থদা আমাদের বাড়িতে এলে অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা চলে। সেদিন একদম রাতের খাওয়া শেষ করে উনি বাড়ি ফেরেন। ওই আড্ডার মধ্যে একটা মজার ঘটনা শুনেছিলাম, অতিথির গান রেকর্ডিং হচ্ছে, সেই সময় পার্থদার গাওয়া একটা গান রেকর্ডিং চলছে, ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশেরো পাখি’। (Partha Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: অলোক আলপনায়
মাঝে মধ্যে সুর এদিক ওদিক হচ্ছে, গান পরিচালনা করছিলেন সুচিত্রা মিত্র। সুরের ভুল হলে তপনদা সুচিত্রা মিত্রর দিকে তাকাচ্ছিলেন কিন্ত সুচিত্রাদি ইশারায় পার্থদাকে গান চালিয়ে যেতে বলছিলেন। রেকর্ডিং শেষ হলে সুচিত্রাদি তপনদাকে বললেন, ‘গ্রামের ছেলে, শখে গান করে, কখনও প্রথাগতভাবে শিক্ষা পায়নি, তাই তারাপদর গলার গান কখনই নির্ভুল হবে না।’ তপনদাও সেই যুক্তি এক কথায় মেনে নিয়েছিলেন। (Partha Mukhopadhyay)

আর একদিন পার্থদা যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন তখন অসীমাদিও সঙ্গে ছিলেন। পার্থদা সব সময় বলতেন, ‘আমার বাবা-মার পরে তপনদা আমার অন্যতম গুরু।’ পার্থদার বাড়িতে গেলে অবশ্য বেশি গল্প হত অসীমাদির সঙ্গে কারণ উনি আমার মায়ের পূর্বপরিচিত। অতীতে স্থিরচিত্র গ্রহণটাকে আমি সাময়িকভাবে পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম, পার্থদা সেটা জানতেন তাই একদিন আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ওঁর কয়েকটি ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। ছবি তুলেওছিলাম কিন্তু কোনও পারিশ্রমিক যে নিইনি সেটা বলাই বাহুল্য। (Partha Mukhopadhyay)

ছবিগুলো পার্থদার খুব পছন্দ হয়েছিল, কোথাও নিজের ছবি দেওয়ার প্রয়োজন হলে উনি আমার তোলা ছবির মধ্যে থেকে দিতেন। অনেক ইয়ার্কি-ঠাট্টাও হত। একটা সময়ের পরে ছবিতে উনি খুব বেশি অভিনয় করতেন না। ফিল্ম কেরিয়ারে ওঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন- বৈজয়ন্তীমালা, জয়া ভাদুড়ী, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের মতো নায়িকারা! ছবির জগৎ থেকে সরে আসার পরে মাঝে-মধ্যে শ্রুতিনাটক করতেন। তেমন অনেক অনুষ্ঠানে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। ২০০৪ সালে কলকাতা বইমেলায় ‘অনুভবে তপন সিংহ’ গ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ অনুষ্ঠানে অন্য আরও অনেকের সঙ্গে পার্থদাও উপস্থিত ছিলেন। উনি নিজে আমার হয়ে অনেককে যোগাযোগ করে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ভারতী দেবী, নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর দিলীপ সরকার প্রমুখ ছিলেন। (Partha Mukhopadhyay)

অন্যদিকে চ্যাপলিন প্রেক্ষা গৃহে বিমল রায় মেমোরিয়াল কমিটির একটি অনুষ্ঠানে পার্থদা আর নির্মলকুমার, তপনদাকে নিয়ে এসেছিলেন কারণ শারীরিক কারণে তপনদা ওই সময় বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোতে চাইতেন না। তাই পার্থদাকে যখন বললাম যে এই অনুষ্ঠানে তপনদাকে আনতেই হবে তখন উনি আমাকে নির্মলদার কথা বললেন, এও বললেন যে নির্মলদার কথা তপনদা ফেলতে পারবেন না। পার্থদা যখন গল্প করতেন, তখন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উত্তমকুমারের কথা ভীষণ বলতেন। উত্তমকুমারের সঙ্গে ওঁর দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধা এবং স্নেহের সম্পর্ক নিয়ে পার্থদা একটা বইও লিখেছিলেন। (Partha Mukhopadhyay)

যেকোনও কারণেই হোক, বইটার তেমন প্রচার হয়নি। অনেকেই বইটার বিষয় প্রায় কিছুই জানেন না। অভিনেতা মৃণাল মুখোপাধ্যায়ের মতো পার্থ মুখোপাধ্যায়ও ভাল গান গাইতে পারতেন কিন্ত তেমন চৰ্চা করেননি কখনও তবুও অনেক করে অনুরোধ করলে এক দু’কলি শোনাতেন। ভেতরে ভেতরে যে শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছিল তা বোঝা যায়নি! হঠাৎ চলে গেলেন, শেষ দেখার অবকাশটুকুও পেলাম না। (Partha Mukhopadhyay)
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
মুদ্রিত ও ডিজিটাল ভার্শনে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।