১৯৯৭ সালে আমার প্রথম পর্বত অভিযান (Mountaineering) ভারতবর্ষের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ ‘কামেট’ (৭৭৫৭ মিটার)। এবং প্রথম অভিযানেই সাফল্যের সাথেই আরোহণ। এরপর প্রায় প্রতি বছর একের পর এক ট্রেকিং, অভিযান। কিন্তু ২০০৮ আর ২০০৯ সালে কোনও অভিযানে যেতে পারলাম না। ২০০৮ এ থলয়সাগর অভিযানে অফিসে ছুটি পেলাম না। আর ২০০৯-এ ছাঙ্গুচ। রওনার দিন ছিল ১৫ ই আগস্ট, কিন্তু তার ঠিক আগেই ১২ই আগস্ট বাবা মারা যান। আগের বছর থেকেই ক্যান্সারে পুরোপুরি শয্যাশায়ী ছিলেন বাবা। স্বভাবতই সেই অভিযানে যাওয়া হল না। আমায় ছেড়ে দল অভিযানে বেরিয়ে পড়ে।
বাবার পারলৌকিক কাজ করার সময়েই ঠিক করে ফেলি, পরের বছর বড় এমন কিছু একটা করতে হবে, যাতে এই দু’বছরের অ্যাডভেঞ্চারের অপূর্ণতাকে পুষিয়ে দেওয়া যায়। সেই ভাবনাতে এসেছিল এভারেস্ট (Mount Everest)। ছাঙ্গুচ অভিযানে ক্লাবের সাথে গিয়েছিল দুই শেরপা ভাই – পেম্বা এবং পাসাং। অভিযান শেষে ফিরে আসা মাত্রই ধরেছিলাম পেম্বাকে – আমি এভারেস্ট যাব, তুমি সব ব্যবস্থা কর। পেম্বা জানিয়েছিল, ও দার্জিলিংয়ে ফিরে কাঠমান্ডুর এজেন্সির সাথে কথা বলে আমাকে জানাবে। কয়েক দিন বাদেই পেয়েছিলাম পেম্বার ফোন। জানিয়েছিল, এভারেস্ট অভিযানের জোগাড়যন্ত্র সব ও করে দেবে। অভিযানে খরচ পড়বে প্রায় তিরিশ হাজার ডলার।
আরও পড়ুন: বিস্মৃত বাঙালি অভিযাত্রী কৃষ্ণলালের ‘বিচিত্র ভ্রমণ’ অভিজ্ঞতা – সৌরপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
একদম প্রথমে আমি একাই যাব বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু আমার এভারেস্ট যাবার আগ্রহ দেখে আমাদের ক্লাব ‘মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কৃষ্ণনগর’ বা ‘ম্যাক’-এর সিনিয়ররা ঠিক করল ক্লাব থেকে একটা দল গঠনের। সেই মতো তৈরি হলো পাঁচ জনের দল। দুজন ক্লাইম্বিং মেম্বার – বসন্ত সিংহ রায় ও আমি। তিনজন সাপোর্টিং মেম্বার – অশোক রায়, বিভাস সরকার ও সৌরভ সিঞ্চন মণ্ডল। ২৬ মার্চ, ২০১০। কলকাতা প্রেস ক্লাবে বর্ষীয়ান পর্বতপ্রেমী প্রতিমা চট্টোপাধ্যায় ভারতের পতাকা তুলে দিলেন। পয়লা এপ্রিল রওনা। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কাঠমাণ্ডু।
এভারেস্ট নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তে অবস্থিত। দুদিক থেকেই আরোহণ হয়। কিন্তু খরচ কম হবে বলে আমরা উত্তরের তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট আরোহণ করবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু কাঠমান্ডু পৌঁছে জানতে পারলাম তিব্বতের দিক থেকে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না। তড়িঘড়ি চেষ্টায় নেপাল দিয়ে এভারেস্টের দিকে যাওয়ার অনুমতি মিলল। অর্থাৎ, নর্থ কল দিয়ে অভিযান হবে না। যেতে হবে সাউথ কল দিয়ে। তাই খরচ হবে অনেকটাই বেশি। দু-এক দিন চলল পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, যাত্রার মঙ্গল কামনায় পূজো দিতে- পশুপতিনাথ মন্দির, বৌদ্ধনাথ স্তূপে।
একদম প্রথমে আমি একাই যাব বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু আমার এভারেস্ট যাবার আগ্রহ দেখে আমাদের ক্লাব ‘মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কৃষ্ণনগর’ বা ‘ম্যাক’-এর সিনিয়ররা ঠিক করল ক্লাব থেকে একটা দল গঠনের। সেই মতো তৈরি হলো পাঁচ জনের দল। দুজন ক্লাইম্বিং মেম্বার – বসন্ত সিংহ রায় ও আমি।
দেবাশিস বিশ্বাস
৫ এপ্রিল যাত্রা শুরু। ছোট প্লেনে আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম লুকলার তেনজিং-হিলারি এয়ারপোর্টে। উচ্চতা ২৮৪২ মিটার। এখান থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাবার রুটের নামও হিলারি- তেনজিং রুট। এয়ারপোর্টের উপরেই হিমালয়া লজ। বেশ সাজানো-গোছানো। সেখানেই রাত কাটানো।
পরদিন, ৬ এপ্রিল, ট্রেকিং শুরু। হাঁটা আরম্ভ হল সকাল সোয়া আটটায়। উত্তরমুখে পথ। চওড়া রাস্তা নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। পুরো পথটাই দুধকোশী নদী বরাবর। কখনও বা ব্রিজ ধরে বাঁদিক থেকে ডানদিক, কখনও ডানদিক থেকে বাঁদিক পার হয়ে এগিয়ে চলা। ছিপলাং, নারনিং পার হয়ে পৌঁছলাম ফাকদিং। ২৬১০ মিটার। সেখানেই দুপুরে খাওয়া। ফের পথ চলা। এরপর বেঙ্কার থেকে নদী পেরিয়ে ভাঙতে হল কিছুটা চড়াই। পড়ল মঞ্জু নামের সুন্দর এক গ্রাম। মঞ্জু ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে সাগরমাথা স্যাংচুয়ারি পার্কের প্রবেশপথ। এরপর দড়ির ব্রিজ ধরে ফের দুধকোশী নদী পেরিয়ে পৌঁছলাম জোরসালে, উচ্চতা ২৭৪০ মিটার।
পরদিন ফের যাত্রা। দুধকোশী নদী পার হয়ে শুরু হল টানা চড়াই। অনেকটা উঠে কিছুটা চওড়া একটি জায়গা। পাথর দিয়ে সাজানো। এই জায়গাটিকে বলা হয় এভারেস্ট ভিউ পয়েন্ট। আবহাওয়া ভালো থাকলে এখান থেকেই প্রথম দেখা মিলতে পারে সেই রূপকথার রানি – মাউন্ট এভারেস্ট। এই পথে পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি, এখানকার গাছপালা, রঙিন ফুলের বাহার তৈরি করেছে এক আশ্চর্য পরিবেশ। কখনও পাহাড়ি লোকজন, কখনও মাল কাঁধে ইয়াকের দল যেন নিয়ে গিয়ে ফেলছে রূপকথার রাজ্যে। আরও অনেকটা উঠে পৌঁছলাম নামচে বাজার। উচ্চতা ৩৪৪০ মিটার।

পরের দুদিন সেখানেই বিশ্রাম। পরদিন উঠে গেলাম স্যাংবোচে। এখানে রয়েছে ছোট্ট একটি এয়ার স্ট্রিপ। মাটি-পাথর, নুড়ি-পাথরের মধ্যেই ওঠা-নামা করছে ছোট-ছোট বিমান। এগুলো ব্যবহৃত হয় মালপত্র বওয়ার জন্য। আর একটু ওপরেই এভারেস্ট ভিউ হোটেল। এখান থেকে এভারেস্টের চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। সামনেই এভারেস্ট, লোৎসে আর নুপৎসে। ডানদিকে আমাদাব্লাম। মনভোলানো রূপ, যার টানে ছুটে আসা এতদূর, এত বিপদ অস্বীকার করে, এত ত্যাগ আর পরিশ্রম স্বীকার করে। দূরে অনেকটা নীচে দেখা যাচ্ছে সুন্দর দুটি গ্রাম। খুন্দে আর খুমজুং। একসময় এরা নেহাতই ছোট্ট ছিল। তবে, এখন বেশ বর্ধিষ্ণু। গোটাটাই স্যার এডমন্ড হিলারির কৃতিত্ব। আজ এখানে হাসপাতাল, স্কুল, বাজার সবই গড়ে উঠেছে।
লুকলা থেকে পথ ছিল উত্তর দিকে। নামচে বাজার ছাড়িয়ে পথ উত্তর-পূর্ব অভিমুখে। ভারি সুন্দর এই পথ, ধীরে-ধীরে উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। সামনে সেই এভারেস্ট, লোৎসে আর নুপৎসে, একটু ডানদিকে আমাদাব্লাম, নীচে দুধকোশী নদী। আরও কিছুটা ওপরে উঠে, পৌঁছে গেলাম তেসিং, উচ্চতা ৩৩৮০ মিটার। ব্রিজ ধরে পেরোনো হল দুধকোশী নদী। এবার এগিয়ে যাওয়া দুধকোশী নদীকে পিছনে ফেলে। সামনে প্রাণান্তকর খাড়া চড়াই। এরপর পড়ল এক চৌমাথা। কোথা থেকে আসা, আর গন্তব্যই বা কোনদিকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয় এই চৌমাথায় টাঙানো এক বোর্ড। আমরা এসেছি নামচে বাজার থেকে, বাঁদিকের পথ এসেছে খুমজুং গ্রাম থেকে, সোজা উপরের দিকে গিয়েছে গোকও যাওয়ার পথ, আর ডানদিকে আমাদের গন্তব্য – ট্যাংবোচে। তেসিং থেকে খাড়া পথে একেবারে পাহাড়ের মাথায় এই ট্যাংবোচে – ৩৮৬০ মিটার। এভারেস্ট বেসক্যাম্প যাওয়ার পথ। এ পথের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে এখানেই।
ট্যাংবোচে ছাড়িয়ে পৌঁছলাম প্যাংবোচে, উচ্চতা ৩৯৩০ মিটার। এখানে রয়েছে অঞ্চলের প্রাচীনতম বৌদ্ধ গুম্ফা। এরপর উত্তর-পূর্ব দিকে ইমজা খোলা নদী বরাবর রাস্তা। ১২টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ডিংবোচে। ৪৪৪৫ মিটার। পরদিন ডিংবোচে ছাড়িয়ে আরও ওঠা। পথে পড়ছে অনেক চোরতেন। সেখানে নানাধরনের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ টাঙানো। ডিংবোচে থেকে দিক বদলেছে রাস্তা। এবার আর উত্তর-পূর্ব নয়, উত্তর-পশ্চিম বরাবর যাত্রা। পথের পাশে আর কোনও গাছ নেই। সঙ্গী বলতে শুধু জুনিপার আর পাথর-নুড়ি।

এই পথ ধরেই পৌঁছলাম থোকলা – ৪৬২০ মিটার। ডানদিকে খুম্বু গ্লেসিয়ার। লোৎসের পায়ের কাছ থেকে শুরু হয়ে এই থোকলাতে এসেই শেষ হয়েছে খুম্বু গ্লেসিয়ার। এবার পথ খুম্বু-র ডান দিক ধরে প্রায় উত্তর মুখে। টানা লম্বা চড়াই। চড়াই শেষ হলে বেশ কিছুটা বিস্তৃত এলাকা। বানানো রয়েছে বিভিন্ন স্মৃতি ফলক। সুদৃশ্য কিন্তু এরাই ভয়ঙ্কর সব মৃত্যুর সাক্ষী। শেষ যাত্রার নোটিস বোর্ড। অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ের নেশা যাঁদের জীবন কেড়ে নিয়েছে, সেইসব বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। এভারেস্ট অভিযানে এসে যাঁরা চলে গিয়েছেন আরও ঠান্ডা মৃত্যুর হিম জগতে, তাঁদের স্মৃতিতে বানানো। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত বাবু ছিরি শেরপার স্মৃতি ফলক।
এই পথ ধরেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লোবুচে – ৪২১০ মিটার। সেখানেই রাত কাটানো। পরদিন যাত্রা শুরু হল সকাল আটটায়। এবার গন্তব্য গোরখশেপ। চোখ ফেললেই নামী-অনামী বিভিন্ন শৃঙ্গ। গাছপালা-ঝোপঝাড়ের কোনও চিহ্নমাত্র নেই। শুধু বরফ আর বরফ। সঙ্গে পাথর, মাটি, নুড়ি। বিভিন্ন ছোট-ছোট মোরেনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা।
সামনেই তাকালেই চমৎকার এক শৃঙ্গ – পুমোরি ৭১৩৪ মিটার। এরই ডানপাশে লিংটার্ন – ৬৭১৩ মিটার। আরও ডানপাশে খুমবুৎসে – ৬৬৩৯ মিটার। এর পাশেই লোলা পাশ – উচ্চতা ৬০২৬ মিটার। লোলা পাশের পিছনে তিব্বতের দিক থেকেই উঁকি মারছে ছাংসে শৃঙ্গ। যাঁরা নর্থ কল দিয়ে এভারেস্ট আরোহণ করেন, তাঁদের এই ছাংসে শৃঙ্গকে ডানদিকে রেখে, বাঁ পাশ দিয়ে উঠে যেতে হয়। আর, লোলা পাশের ডানদিকে এই অংশটি অবশ্য আলাদা কোনও শৃঙ্গ নয়, এটি এভারেস্টেরই ওয়েস্ট শোল্ডার – উচ্চতা ৭২৬৮ মিটার। এর পাশ থেকেই উঁকি মারছে নুপৎসে – ৭৮৬৪ মিটার। এ পথে চলার সময় এভারেস্টের ওয়েস্ট শোল্ডার আর নুপৎসের মাঝের এই ফাঁক দিয়ে কখনও-কখনও দেখা মেলে তাঁর। যাঁর উদ্দেশে এই দুর্গম যাত্রা। মাউন্ট এভারেস্ট।
লুকলা থেকে পথ ছিল উত্তর দিকে। নামচে বাজার ছাড়িয়ে পথ উত্তর-পূর্ব অভিমুখে। ভারি সুন্দর এই পথ, ধীরে-ধীরে উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। সামনে সেই এভারেস্ট, লোৎসে আর নুপৎসে, একটু ডানদিকে আমাদাব্লাম, নীচে দুধকোশী নদী। আরও কিছুটা ওপরে উঠে, পৌঁছে গেলাম তেসিং, উচ্চতা ৩৩৮০ মিটার। ব্রিজ ধরে পেরোনো হল দুধকোশী নদী।
দেবাশিস বিশ্বাস
দুপুর এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম গোরখশেপ – ৫১৪০ মিটার। সামান্য কিছু জলযোগ করেই ফের বেরিয়ে পড়া। এবার গন্তব্য এভারেস্ট বেসক্যাম্প। ৫৩৬৪ মিটার। গোরখশেপ থেকে বাঁদিকে, ঠিক উত্তরে কালাপাত্থর। এই কালাপাত্থরের পাশ কাটিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে চলা। সময় লাগল ঘণ্টা দুয়েক। বেসক্যাম্পে পড়েছে অন্যান্য দলের কত-কত সুদৃশ্য তাঁবু। তার মধ্যেই নিজেদের অস্থায়ী ঘরদোর সাজিয়ে নেওয়া। ক্যালেন্ডারের পাতায় সেটা ১৪ এপ্রিল। টাঙিয়ে নেওয়া হল তাঁবু। সঙ্গে কিচেন টেন্ট, টয়লেট টেন্ট। কিচেন টেন্টের পিছনেই কুক লীলাবতী ও বুদ্ধি, আর সহযোগী সন্তোষ রানার জন্য তাঁবু। কিচেনের সামনে আরেকটি তাঁবু পেমবা শেরপা ও পাসাং শেরপার জন্য। এরপর তৈরি হল ডাইনিং টেন্ট – খাবার জায়গা। তার পাশেই মেম্বারদের জন্য তিনটি তাঁবু। মাঝের ফাঁকা চত্বরই আপাতত সকলে মিলে আড্ডা, আলোচনার জায়গা। জমজমাট রঁদেভু। আর সব শেষে তৈরি হল মন্দির। ঐতিহাসিক যাত্রার মাঝে এ এক চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণ।
শরীরটা ঝালিয়ে নিতে ১৮ তারিখ ওঠা হল খুম্বু আইসফলে। চলল বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত, ক্লাইম্বিং-এর প্রাকটিস। অবশ্য এ প্র্যাকটিস কম রোমহর্ষক নয়। খাড়াই উঠে যাওয়া, কিংবা ল্যাডার বেয়ে বরফের চওড়া ফাটল ক্রিভাস টপকানো। যেন মৃত্যুর গভীর হাঁ-কে অস্বীকার করা দুরন্ত ট্র্যাপিজের খেলা। কিছুটা ঘাম ঝরানো, কিছুটা রপ্ত করে নেওয়ার চেষ্টা। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়াস। সব মিলিয়ে পরিশ্রম মন্দ হল না। তাই বেসক্যাম্পে ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া ছিল খুব জরুরি। সঙ্গে মনটা হালকা রাখতে গল্প-গুজব। ১৯ তারিখ পুজো। শেরপাদের কাছে এ এক অবশ্য পালনীয় বৌদ্ধিক উপাচার। লামারা এসে শুরু করলেন পুজোপাঠ। ঈশ্বরের কাছে সুস্থ যাত্রার প্রার্থনা। টাঙানো হল প্রেয়ার ফ্ল্যাগ।

এরপরই শুরু হল আসল যাত্রা। লক্ষ্য ক্যাম্প ওয়ান। একদিন আগেই, ২০ এপ্রিল ক্যাম্প ওয়ানের দিকে রওনা দিয়েছেন শেরপা বন্ধুরা। ২১ তারিখ বেরিয়ে পড়লাম দুই বঙ্গসন্তান আমি আর বসন্ত। মাঝরাত দেড়টায়। তিন সাপোর্টিং মেম্বার অশোক রায়, বিভাস সরকার ও সৌরভ সিঞ্চন মণ্ডলকে ছেড়ে আসা হয়েছে বেসক্যাম্পে। এগিয়ে চললাম আমি আর বসন্ত সিংহ রায়। খুম্বু আইসফলের মাঝ দিয়ে উঠে যাওয়া। চারিদিকে বিচিত্র সব আকৃতির বরফ। জগতের শ্রেষ্ঠ আর্কিটেক্টের আশ্চর্য সৃষ্টি। ঈশ্বরের নিপুণ ভাস্কর্য। সেসব পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলা। কখনও দড়ি টেনে এগোনো, কখনও মই বেয়ে ওঠা। মৃত্যুর হাতযশ এখানে নেহাত মন্দ নয়। তাই বাড়তি সতর্কতা। কিন্তু দম ধরে রাখাই যেন দায়। প্রায় দশ ঘণ্টার নিরলস যাত্রার পর পৌঁছলাম ক্যাম্প ওয়ান। নুপৎসের পায়ের কাছে রয়েছে এই ক্যাম্প ওয়ান – ৬০০০ মিটার। সেই বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন কুম। এখানেও দেশ-বিদেশের বহু পর্বতারোহীর তাঁবু। নানা রঙের, নানা রকমের। সামনে যেন সুপ্রশস্ত ময়দান। সীমাহীন বরফ। বলা হয়, ভ্যালি অব সাইলেন্স। এখানে একটি তাঁবুতেই থাকার বন্দোবস্ত হল। সেখানেই রান্না, সেখানেই খাওয়া।
২২ তারিখ আবার ফিরে এলাম বেস ক্যাম্পে। পর্বতারোহণের এমনটাই নিয়ম। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, গোটা পথ নিজেদের মতো করে বুঝতে, ওঠা-নামা যাতায়াতের খেলা নিরন্তর চলতেই থাকে। পরের তিন দিন বেসক্যাম্পেই রইলাম। সে সময়ের মধ্যেই শেরপা আর কুকের দল পাড়ি দিয়েছে ক্যাম্প টু আর থ্রি-র উদ্দেশে। লক্ষ্য, ক্যাম্প প্রস্তুত করে রাখা।
ফের যাত্রা শুরু হল ২৬ এপ্রিল। বন্ধুর পথ এখন অনেকটাই বন্ধু। তাই সময় লাগল কম। ঘন্টা ছয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ক্যাম্প ওয়ান। পরদিন যাত্রা শুরু হল ক্যাম্প টু-এর উদ্দেশে। একটু দক্ষিণ ঘেঁষে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাওয়া। খুম্বু গ্লেসিয়ার বরাবর সোজা রাস্তা। একদম বাঁদিকে এভারেস্ট ওয়েস্ট শোল্ডার, আর তারপরেই নেমে এসেছে মাউন্ট এভারেস্টের ঢাল। সোজা গিয়ে যেখানে মিশেছে খুম্বু গ্লেসিয়ার, ওইটাই লোৎসে। পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ। ডানদিকে গোটাটাই নুপৎসে গিরিশিরা। তিনদিক ঘেরা পাথুরে দেওয়ালে, মাঝে বরফের ময়দান। এই পথেই উঠে যাওয়া। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ক্যাম্প টু – ৬৪০০ মিটার। এভারেস্টের ঢালের ঠিক পাশে। উত্তর-পশ্চিম দিক ছাড়া আর সবদিকই ঢাকা। উত্তর-পূর্ব দিকে এভারেস্ট, পূর্বদিকে সাউথ কল। দক্ষিণ-পূর্বদিকে লোৎসে, আর দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত নুপৎসের রিজ দিয়ে ঘেরা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই ক্যাম্প টু। পড়েছে নানা দলের তাঁবু। এখানেই লাগান হল তাঁবু আর কিচেন। বরফ কেটে গরম করে তৈরি হল খাওয়ার জল। লম্বা এই সফরে ধৈর্যই বড় খেলা। সময় কাটাতে তাই তাঁবুর মধ্যেই চলল ডাইরি লেখা, গান শোনা আর তাস – পেশেন্স।

২৯ এপ্রিল। এবার ক্যাম্প টু ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া ৭৩০০ মিটার উচ্চতায় – ক্যাম্প থ্রির উদ্দেশে। সামনে অনেকটাই বরফের ময়দান। হালকা চড়াই। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর শেষ হল বরফের প্রান্তর। এবার আর আড়াআড়ি নয়, এবার খাড়াই। খাড়া বরফের ঢাল। লোৎসে ফেসের দেওয়াল বরাবর উঠে যাওয়া। পিছু ফিরলে এখনও চোখে পড়ছে ক্যাম্প টু এরিয়া। আর সামনে তাকালে অজানা ভবিষ্যৎ। দড়িতে জুমার লাগিয়ে ঠেলে-ঠেলে সাবধানে চলা। প্রতি মুহূর্তে দম বন্ধ করা আরোহণ। বেশ কিছুটা উঠে খাটানো হল ক্যাম্প থ্রির তাঁবু।
পরদিন আবার নেমে আসা ক্যাম্প টু। পয়লা মে ফের বেস ক্যাম্পে। এবার দীর্ঘ অপেক্ষা। ওয়েদার ফোরকাস্ট থেকে কখন মিলবে সবুজ সঙ্কেত? এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন। অবশেষে খবর মিলল, ১৪ আর ১৬ মে আবহাওয়া থাকবে আদর্শ। হাওয়া থাকবে কম। ১৬ তারিখের লক্ষ্য মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চূড়ান্ত যাত্রায়। সেটা ১২ মে।
সেদিনই পৌঁছে গেলাম ক্যাম্প টু। পরদিনটা কাটল ক্যাম্প টু-তেই। ১৪ মে পৌঁছলাম ক্যাম্প থ্রি। এখানেই আরেকবার চেক করে নেওয়া হল অক্সিজেন মাস্ক। কেননা এরপরই লাগবে বাড়তি অক্সিজেন। স্যাকে নিয়ে নেওয়া হল চার লিটারের একেকটি অক্সিজেন সিলিন্ডার। ফের বেরিয়ে পড়া। দিনটা ১৫ মে। লক্ষ্য ক্যাম্প ফোর। উঠে যেতে হবে ৭৯৫৫ মিটার উচ্চতায়।
২৯ এপ্রিল। এবার ক্যাম্প টু ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া ৭৩০০ মিটার উচ্চতায় – ক্যাম্প থ্রির উদ্দেশে। সামনে অনেকটাই বরফের ময়দান। হালকা চড়াই। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর শেষ হল বরফের প্রান্তর। এবার আর আড়াআড়ি নয়, এবার খাড়াই। খাড়া বরফের ঢাল। লোৎসে ফেসের দেওয়াল বরাবর উঠে যাওয়া।
দেবাশিস বিশ্বাস
টানা বরফের ঢাল। লোৎসের গা বেয়ে অনেকটা উঠে আড়াআড়িভাবে উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে যাওয়া। এরপর ইয়েলো ব্যান্ড – হলুদ পাথরের শ্রেণি। এখানেই চোখে পড়লো এক মৃতদেহ। শেরপারা উপর থেকে নামিয়ে আনছে রাশিয়ান সেই আরোহীর মৃতদেহ, অক্সিজেনের অভাবে যার মৃত্যু হয়েছে দিন দুয়েক আগে।
ফের বরফের ময়দান। এগিয়ে চলা আরও উত্তর-পূর্বে। তারপর এল কালো পাথরের এক দেওয়াল। জেনিভা’স স্পার। দেওয়াল টপকে, আরও আধঘন্টা চলার পর পৌঁছলাম সাউথ কল – ৭৯৫৫ মিটার। সাউথ কলের উত্তরে সেই মাউন্ট এভারেস্ট, আর দক্ষিণে লোৎসে। এখন সামনে আর মাত্র এক দিনের পথই বাকি। একদিনের সেই লড়াই – বিশাল প্রকৃতির চরম দুর্গমতার সাথে, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার সাথে ক্ষুদ্র আমি’র অসম এক লড়াই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আজকে রাতেই শুরু হবে সেই যাত্রা – এভারেস্ট শীর্ষ ছোঁয়ার।
এলাকাটা প্রকৃত অর্থেই ডেথ জোন। বাতাসে অক্সিজেন নেই বললেই চলে। বসে থাকলেও যে শ্বাসকষ্ট হয়। একদিকে জয়ের আহ্বান, আরেকদিকে মৃত্যুর নিশিডাক। ‘আলোক ও আঁধার যেথা করে খেলা’। জীবন-মরণের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে বারবার ফিরে আসছে এই ক-দিনের স্মৃতি। তাঁবুর ভেতর আড্ডার কথা, শেরপাদের বিচিত্র উপাচার, আনন্দ-আহ্লাদের কথা।

মনে পড়ছে বাড়ির সদস্যদের কথা, বন্ধুবান্ধব- অফিস কলিগদের কথা। অশোক-বিভাস-সৌরভ সিঞ্চন যে বেস ক্যাম্পে পড়ে রয়েছেন, কী করছেন ওঁরা এখন? ওঁরা কি টেনশন করছে? না, চকিতেই সেসব ভাবনা মুছে ফিরে আসছে ভবিয্যত। পারতেই হবে। এতটা লড়াইয়ের পর বাকিটুকু না পারার স্রেফ কোনও মানেই হয় না।
প্রস্তুতি শেষ। এই দুর্গম পথে টেনশন হয়তো আছে, তবু আমরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। কনফিডেন্ট। এতদিনের স্বপ্ন আমাদের ডাকছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এতদিনের শিক্ষা। ঠিক তখনই ছন্দপতন। আবহাওয়া অত্যন্ত খারাপ। না, সেদিন যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। আরোহনের জন্য তৈরি হয়ে তাবু থেকে বের হয়েও বাতিল করতে হলো সেদিনের যাত্রা। এত ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে আরোহণ সম্ভব নয়। তাহলে কি তীরে এসে ডুববে তরী? কার্যতই হতাশা আর উদ্বেগ তখন আমাদের চোখে-মুখে। অস্থির বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যতের দোলাচলে আটকে দুই দুরন্ত বাঙালি।
বাধ্য হলাম একটা অতিরিক্ত দিন ওই ডেথ জোনে কাটাতে। পরদিন, ১৬ মে। আবহাওয়া বেশ ভালো, হাওয়া প্রায় নেই বললেই চলে। দুশ্চিন্তার বাতাস সরতেই চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। রাত আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম চূড়ান্ত গন্তব্যের লক্ষ্যে। উদ্দেশ্য মাউন্ট এভারেস্ট। সঙ্গে লাগেজ বিশেষ নেই। পিঠে চার লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার। মাথায় হেড টর্চ। পিঠের ব্যাগে সামান্য ওষুধপত্র আর জলের বোতল। এবং অবশ্যই স্মৃতিকে আটকে রাখার অনিবার্য সঙ্গী – ক্যামেরা। তাপমাত্রা মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রির কাছাকাছি। সময় যত গড়াবে, উচ্চতা বাড়বে, আরও জাঁকিয়ে বসবে ঠান্ডা। কে জানত, পথে বোতলের জলও আর মিলবে না। ততক্ষণে সব জমে বরফ। এভাবেই সারা রাত পথ চলা। অতি সন্তর্পণে। দড়িতে জুমার লাগিয়ে, ঠেলে-ঠেলে। ভোর চারটে নাগাদ চারপাশে তৈরি হল একটা আলোক বলয়। কিছু পরে সূর্য উঠল। পশ্চিমদিকে আকাশের মধ্যেই যেন ছায়া পড়েছে এভারেস্টের। এক অপূর্ব নিসর্গ। সামনেই সাউথ সামিট। ছোট্ট এক শৃঙ্গ। এরপর পড়ল হিলারি স্টেপ। তা পার হয়ে হালকা ঢাল বেয়ে উঠে আসলাম এভারেস্টের মাথায়। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশ। দক্ষিণ-পূর্বে মাকালু, দক্ষিণে লোৎসে। উপরে আকাশ ছাড়া আর কিছু নেই। নীচে গোটা পৃথিবী।

এখানে চিন ও নেপাল সরকার মিলে দুটি ধাতব স্তম্ভ স্থাপন করেছে। তার উপরে বিভিন্ন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বা খাদা জড়ানো, যা দেখেই বোঝা যায় এটাই এভারেস্টের শীর্ষ। পুজো দেওয়া হল এখানে। ন-টার সময় শুরু হল ফেরার পালা।
একই রাস্তায় ফিরে বেলা একটায় পৌঁছে গেলাম ক্যাম্প ফোর। সেদিন ক্যাম্প ফোরেই বিশ্রাম। পরের দিন একেবারেই নেমে এলাম ক্যাম্প টু। ১৯ মে সোজা চলে এলাম বেস ক্যাম্প। পরবর্তী দু-দিন চলল প্যাকিং। ২২ মে সকালে ফেরার পথ ধরা। নামচে হয়ে লুকলা পৌঁছলাম ২৪ মে। সেখান থেকে ছোট প্লেনে পরদিন কাঠমাণ্ডু। ২৭ মে বিমান নামল কলকাতায়।
এই দমদম বিমানবন্দর থেকেই পয়লা এপ্রিল কাঠমাণ্ডু উড়ে গিয়েছিল একটা বিমান। যে বিমানে সওয়ার হয়েছিলাম এই পাঁচ দামাল। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই শেষ এ কাহিনির। আর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঈশ্বরের সেই সাধের নির্মাণ, মাউন্ট এভারেস্ট — সে-ও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিকল। শুধু মাঝের ক-টা দিন কেটে গিয়েছে স্বপ্নের মতো। মাঝের এতটা পথ জুড়ে লেখা হয়েছে একটা নতুন রূপকথা। অনেকে আজ যাকে ইতিহাস বলেন।
ছবি সৌজন্য: লেখক
দেবাশিস বিশ্বাস আয়কর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার পদে কর্মরত। তিনি ২৯টি পর্বতারোহণ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন এবং মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু, অন্নপূর্ণা সহ অনেকগুলি শৃঙ্গ জয় করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি তেনজিং নোরগে ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড পান। তিনি প্রথম বাঙালি অসামরিক এভারেস্ট আরোহী যুগলের একজন এবং প্রথম ভারতীয় অসামরিক কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহী যুগলের একজন।