বিভূতিভূষণের উপন্যাসের পাঠক হিসেবে অপু চরিত্রটি অনেকেরই মনের মধ্যে গাঁথা ছিল। কোনও কোনও সময় নিজেকেও সে চরিত্রটির সঙ্গে মিলিয়ে এসেছি বা নিজস্ব কল্পনা থেকে মনে মনে গড়ে তুলেছি তার একটা প্রতিচ্ছবি। সেই অতি পরিচিত, অতি আপন অপুকে পর্দায় চিত্রায়িত করতে সৌমিত্রর কম সংশয় ছিল না। দর্শকরা মেনে নেবে কি না! তাছাড়া চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে তিনি তখন ছিলেন আনকোরা। পরিচালকের প্রতিভার উপর সম্পূর্ণ আস্থা থাকলেও মনের দ্বিধা কি পুরোপুরি দূর হয়! বলা বাহুল্য, তিনি সসম্মানে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সে যুগের বাংলা সিনেমায় তিনি এসেছিলেন একজন আধুনিক মননশীল যুবকের প্রতিনিধি হয়ে। প্রথম ছবির সম্মোহনী আবির্ভাবে আমাদের বয়সী দর্শকদের মনপ্রাণ পূর্ণমাত্রায় জয় করে নিয়েছিলেন। বিমুগ্ধ ভাব এতটাই ছিল যে ‘অপুর সংসার’ দেখে এক যুবতী (সৌমিত্রর মুখেই শুনেছি) লিখেছিলেন, ‘এ কী করলেন আমার জীবনে! ওই রূপ আমাকে সর্বক্ষণ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না তার আকর্ষণ।’ এভাবেই আমাদের পরিচয় অভিনেতা সৌমিত্রর সঙ্গে।
[the_ad id=”270088″]
এর বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৬৬ সালে, কফি হাউসে, আমার একটি লেখা পড়ে (ভিয়েতনামের যুদ্ধ; ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত) নির্মাল্যদা (আচার্য) আমাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন। কয়েক দিন পর তাঁর সঙ্গে সিনেক্লাবের দপ্তরে দেখা। বললেন, ‘চলে যাবেন না, কথা আছে।’ আমাকে নিয়ে গেলেন টু-বি বাসে চড়ে গড়িয়াহাটে। মোড়ের মাথার আগের স্টপেজে নেমে সোজা সৌমিত্রর বাড়ি। সবটাই পরিকল্পনা মতো। তাঁরা জানতেন আমি আসব। কথা হল। পর্দার নায়ককে চাক্ষুষ করার বিস্ময়ে আমি এতটাই হতবুদ্ধি ছিলাম যে বেশি কথা বলতে পারিনি। রূপবান গৃহস্বামী, দীপ্তিময়ী গৃহিণী, প্রাণবন্ত দুটি ছেলে-মেয়ে, আলোছায়াময় সুসজ্জিত ঘর — সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নরাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছিলাম।
দীর্ঘ চুয়ান্ন বছর ধরে আমাদের পরিচয়। প্রথমে পূর্ণদাস রোডের এক তলায়; পরে সাদার্ন এভিন্যু-এর দোতলায়; তারপর লেক টেম্পল রোডের তিনতলার বাসা থেকে আশির দশকে তাঁর নিজের বাড়ি গলফ গ্রিনে।
খ্যাতির ঝলক তাঁকে বিচলিত করত, স্তুতি, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যশ, প্রতিপত্তি সেই সৌমিত্রের ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করত না। ভাঙা পথের রাঙা ধুলো মাখা একজন চিরপথিক নবীন যুবক, যিনি শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন শিক্ষার্থী। দেশব্যপী যশ তাঁর মনে কি মোহ আনেনি? নিশ্চয়ই এনেছে। কিন্তু সে সব ধারণা মনে পোষণ করতেন না। সরিয়ে ফেলতে পারতেন। তা না হলে এগিয়ে যাবেন কী করে!
ধাপে ধাপে আরোহণের কথা বলতে তিনি বলেছিলেন, ‘শেষে একেবারে ভূপতিত।’ বাড়ির বাগানে বসে কথা হচ্ছিল। বললাম, ‘তা কেন! এত সুন্দর বাড়ি।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইন উদ্ধৃত করে বললাম ‘বসতবাটি, মুখের মতো রাখত পরিপাটি।’ শুনে হেসে বললেন, ‘তোমরা তো শুধু বাইরেটাই দেখো, জানো না তো এই বসতবাটি করতে লেগেছে দাঁতকপাটি।’
২০০০ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগের বছর চলে আসি যাদবপুরে। সৌমিত্রর প্রায় প্রতিবেশী হয়ে। আমাদের যোগাযোগ তখন থেকে অনেক বেড়ে যায়।
আমরা সকলে যে সৌমিত্রকে দেখি খ্যাতি ও গৌরবের আলোকে তার ভেতরে মনের গভীরে আর এক সৌমিত্র লুকিয়ে ছিলেন যাঁর পরিচয় থাকত আড়ালে চাপা। তাঁর সঙ্গে যাঁরা খুব ঘনিষ্ঠ সহৃদয় ভাবে মিশেছেন তাঁরা হয়তো কিছুটা টের পেয়েছেন। কেননা সেই সৌমিত্র প্রায় অধরা। তাকে তিনি খুব সন্তর্পণে মেলে ধরতেন। খ্যাতির ঝলক তাঁকে বিচলিত করত, স্তুতি, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যশ, প্রতিপত্তি সেই সৌমিত্রের ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করত না। ভাঙা পথের রাঙা ধুলো মাখা একজন চিরপথিক নবীন যুবক, যিনি শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন শিক্ষার্থী। দেশব্যপী যশ তাঁর মনে কি মোহ আনেনি? নিশ্চয়ই এনেছে। কিন্তু সে সব ধারণা মনে পোষণ করতেন না। সরিয়ে ফেলতে পারতেন। তা না হলে এগিয়ে যাবেন কী করে! জন্মদিনের পরের দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেছি ফুল আর উপহারের প্লাবন। সারা ঘর ভর্তি নানা আকারের পুষ্পস্তবক ও অন্যান্য উপহারে। তার মধ্যে বসেও কথা বলছেন নিজের সৃষ্টি-যন্ত্রণার, অসম্পূর্ণতার। কল্পনার সঙ্গে কাজের, চিন্তার সঙ্গে প্রকাশের অসহনীয় বিরোধের।
[the_ad id=”270086″]
এই বহুমাত্রিক মানুষটি ছিলেন একাকী। নিঃসঙ্গে বিচরণ করতেন নিজস্ব সৃষ্টির জগতে। একজন প্রকৃত শিল্পীর মতো জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেও, অনুরাগীদের আবেষ্টনীর মধ্যে থেকেও তিনি নির্জন। জীবনের লক্ষ্যমাত্রা তাঁকে প্রাণিত করে টেনে নিয়ে গেছে উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে। গভীর অতৃপ্তিবোধ তাড়না করে বেরিয়েছে। আবার কোনও নিঃসঙ্গ মুহূর্তে প্রেম ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষায় তিনি কবি মানুষের মতো কাতর, সাধারণ মানুষের মতো অসহায়।
এই সৌমিত্রকে আমি চিনেছি বহু বছর ধরে মেলামেশার পর। তিনি আমার কাছে প্রিয় পুলুদা। একজন স্নেহপ্রবণ, সংবেদনশীল, প্রীতিপ্রদ মানুষ। এবং অনুপ্রেরণাদায়ী পথপ্রদর্শকও।
তাঁর বাড়িতে গেলে বসার আরামের ব্যবস্থা করে দিতেন, কোনও পানীয়ের ইচ্ছে আছে কি না জেনে নিতেন। কথা শেষে অধিকাংশ দিনই গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যতক্ষণ না বাঁকের আড়ালে চলে যাচ্ছি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর সেই স্নেহপ্রবণ রূপটি আমার মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দিত — সব স্নেহই তো মাতৃরূপে আসে।
[the_ad id=”270085″]
এই সহজ মানুষটি কোনও কোনও দিন আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন অবলীলায়। এসে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করতেন নানা বিষয়ে, সকলের সঙ্গে। ছেলেদের বলতেন কৃষ্ণনগরের ডানপিটে ছেলেবেলার কথা। আবার মহাভারতের কোন চরিত্র অভিনয় করার জন্য সবচেয়ে পছন্দ — ভীষ্ম, না ধৃতরাষ্ট্র — এই দ্বিধাকণ্টকিত প্রাজ্ঞ চরিত্র দুটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বা কোনও দিন আমার শাশুড়ির অনুরোধে তাঁর ঘরে গিয়ে জয় গোস্বামীর ‘মা নিষাদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করে সকৌতুকে জিজ্ঞেস করা, ‘ভাল লাগল তো মাসিমা?’
অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর, বইয়ের সাহায্য না নিয়েও বড় বড় কবিতা মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। একদিন খোশমেজাজে, কথার ফাঁকে ‘বিল্বমঙ্গল’ থেকে টানা কয়েকটা পঙ্ক্তি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। তাঁর আবেগের প্রকাশ দেখে বুঝেছিলাম নাটক তাঁর সত্তার সঙ্গে কতটা গভীরভাবে মিশে ছিল।
কথা বলতে ভালবাসতেন। মনের মতো বিষয় হলে কথা বলতেনও অজস্র। অভিজ্ঞতার পরিধি এতটাই ব্যাপক ছিল, যে কোনও বিষয় সম্পর্কে কথা বলার সময় ফেলে আসা সময়, হারিয়ে যাওয়া মানুষজন জীবন্ত হয়ে ফিরে আসত তাঁর বর্ণনায়। কথা বলার ভঙ্গিটিও ছিল খুব আকর্ষণীয়। কণ্ঠস্বরে পরিমিত আবেগ দিয়ে পরিশীলিত উচ্চারণে কথাকে করে তুলতেন আরও সুন্দর।
[the_ad id=”266919″]
একদিন কথায় কথায় একটি লেখার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। সুধীর চক্রবর্তী (আর একজন সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় মানুষ) লিখেছিলেন দীপঙ্কর ঘোষের ‘লোকশিল্পের মুখোমুখি’ বইটির আলোচনায় যে — লেখক এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে উদ্দিষ্ট একটি গ্রামের দূরত্ব জানতে চাইলে দোকানি গ্রামবাসী বললেন, ‘তা ধরুন গিয়ে আধা দুলকান হবে।’ দুলকান কী? সাঁওতালরা দল বেঁধে ভোরে যখন পেট পুরে আমানি পান্তা খেয়ে কাজে বের হয় তখন হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গিয়ে আবার খিদে পায় সেই দূরত্বের পরিমাপ হল ‘দুলকান’। মন দিয়ে শুনে পুলুদা বললেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। ‘অশনি সংকেত’-এ গঙ্গাচরণের হাঁটার ধরন রপ্ত করতে তিনি নজর করেছিলেন গ্রামের মানুষের দূরত্বের কষ্ট লাঘবের জন্য হাঁটার চালে একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। হাঁটু আর কোমরের উপর যাতে ভর বেশি না পড়ে সেজন্য শরীরের দুলুনিতে ওজন-কেন্দ্রকে ছড়িয়ে দেয়। একটু লক্ষ্য করলেই স্বল্প দূরত্বে হাঁটা শহুরে মানুষের সঙ্গে গ্রামের মানুষের হাঁটার পার্থক্যটা বোঝা যায়। তাঁর হাঁটার মধ্যে একটা নিজস্ব সাবলীল ভঙ্গি ছিল। বহু বছর ধরে মাথায় ওজন নিয়ে হাঁটা অভ্যেস করেছেন। তাঁর সেই স্বাভাবিক চলনকে পাল্টে ফেলেছিলেন ‘অশনি সংকেত’-এ।
তাঁর বাড়িতে গেলে বসার আরামের ব্যবস্থা করে দিতেন, কোনও পানীয়ের ইচ্ছে আছে কি না জেনে নিতেন। কথা শেষে অধিকাংশ দিনই গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যতক্ষণ না বাঁকের আড়ালে চলে যাচ্ছি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর সেই স্নেহপ্রবণ রূপটি আমার মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দিত — সব স্নেহই তো মাতৃরূপে আসে।
একজন সফল অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নিজের কাজ সম্পর্কে ছিল অদ্ভুত বিনয়, হয়তো সংশয় থেকে যেত মনের ভাবটি ঠিক মতো প্রকাশ করা হল কি না! তাঁর বিচারে সেই ‘ঠিক মতো প্রকাশ’ এতটাই উঁচু পর্যায়ে বাঁধা থাকত যে সেই মানকে দর্শক শ্রোতাদের মনে সঞ্চারিত করাটা প্রকৃত অর্থে দুঃসাধ্য কাজ। তিনি জানতেন এই ভাল লাগানোটা কতখানি কঠিন। তার চেয়ে বড় সাফল্য শিল্পীর আর কিছুই নেই। আর শিল্পের শেষ বিচার সেখানেই। তাই নিছক স্তুতির শূন্যতা তাঁকে স্পর্শ করত না। চাইতেন সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত দর্শকের বিশুদ্ধ উপভোগের সতেজ পরিচয়।
সত্তর দশকের গোড়া থেকেই তিনি খেরোর খাতার মতো নোটবই ব্যবহার করতে শুরু করেন। খানিকটা সত্যজিৎ রায়ের অনুসরণেই। প্রথমদিকে এমন খাতার প্রয়োজন ছিল নানা কাজের ব্যস্ততায় প্রয়োজনীয় কর্তব্যকর্ম মনে রাখার জন্য। পরে খাতাটা হয়ে ওঠে ‘পল্টনের মগ’, তাতে ডাল নেওয়া থেকে চান করা সব কাজই হয়। যে সব ভাবনা বা ঝংকার মনের মধ্যে শব্দের রণন তোলে, সে সব সারাদিনের ব্যস্ততায় যাতে হারিয়ে না যায়, তাকে অক্ষরে বন্দি করে রাখতেন। এর থেকে হয়তো একটা পুরো পদ্যও পরে তৈরি হতে পারে। ক্রমে খাতাগুলো হয়ে উঠেছিল সংগোপনে রাখা সুখদুঃখের কথা মনের দরজা খুলে বলার জন্য অজানা পাঠককে নিভৃতের আসনে ডেকে আনার আয়োজন। এভাবেই তিনি বজায় রেখেছিলেন পাঠকদের সঙ্গে অবিরত সংলাপ — কখনও প্রকাশ্যে, কখনও নিভৃতে।
[the_ad id=”266919″]
আমাদের চেতনার স্তরে এমন কতকগুলো গভীর অনুভূতি থাকে যা একান্তভাবে নিজস্ব হলেও তার প্রকাশ আমরা নিজেরাও করতে পারি না। এবং সেটা চিরকাল রহস্য থেকে যায়।
আমার এই স্মৃতিচারণও তেমন পুলুদার ব্যক্তিসত্তার আভাসমাত্র।
অবসরগ্রণের পর থেকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'জটায়ু জিন্দাবাদ', 'রাঁচিতে জ্যোতিরীন্দ্রনাথ', 'সত্যজিতের ছবি ও খেরোর খাতা'।