Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মনের রোগের নানাকথা

ড. সুমিত দাশ

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২০

Photo by Matthias Zomer from Pexels
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

মানসিক রোগ নিয়ে আজকাল যতই আলাপ-আলোচনা বোক বা সচেতনতা বৃদ্ধি হোক না কেন, মনের অসুখ নিয়ে কথা বলতে বা কতকগুলি প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে মনের অসুখকে স্বাভাবিক ভাবে বিচার করতে বহু মানুষই চান না এখনও। 

আমরা বরং কয়েকটি প্রচলিত ধারণা আর সত্যটা যাচিয়ে দেখে নিই, তা হলে মানসিক রোগ সম্পর্কে মনের আলো-আঁধারি অনেকটাই কেটে যাবে। 

মনের রোগ আসলে ইচ্ছাকৃত

কখনই তা নয়। শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন রোগ হতে পারে, সেরকম মনেও হতে পারে। সেটা অবসাদ, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, উদ্বেগ, যে কোনওটাই হতে পারে। এক ধরনের সমস্যা আছে যাকে বলা হয় ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। সেখানে মানুষটি এমন কিছু আচরণ করেন যেটা বদমায়েশি ভাবা যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেটিও তিনি ইচ্ছা করে করেন না।

মনের রোগের কি ওষুধ হয়

কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের ওঠা নামার জন্য মানসিক রোগ হয়। তাই এগুলোর ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায় বাইরে থেকে প্রয়োগ করা ওষুধ দিয়ে।

মনের রোগ কি সারে?

চিকিৎসা বিজ্ঞান চিরকালের মত সারিয়ে দিতে পারে এরকম রোগ খুব কম। কিছু সার্জারি আর কয়েকটা রোগ ছাড়া আর কিছু সারানো যায় না। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, বাত ইত্যাদি যেমন ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, অধিকাংশ মনের রোগও তাই। সারা জীবন ওষুধ  খেতে হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি পুরোপুরিও সেরে যায়।

মনের রোগের আসলে কোনও চিকিৎসা  হয় না, শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় মাত্র

অধিকাংশ মনের রোগের একটি প্রধান উপসর্গ হচ্ছে ঘুম কমে যাওয়া। তাই ঘুম পাড়ানো মনের রোগের চিকিৎসার অন্যতম উদ্দেশ্য, কিন্তু একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তা ছাড়া অধিকাংশ ওষুধের পার্শ্বক্রিয়া হচ্ছে ঘুম। তাই না চাইলেও ঘুম এসে যায়। কিন্তু বর্তমানে অনেক ওষুধ আছে যেগুলিতে অত ঘুম হয়না। অন্যান্য রোগের মত এক্ষেত্রেও উপসর্গ গুলো এবং তার কারণ দূর করাই ওষুধ প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য। 

মনের রোগের ওষুধ বেশি খেলে হার্ট,  লাংস, কিডনি, লিভার সব খারাপ হয়ে যায়

মনের রোগের এ রকম কোনও ওষুধ নেই যা খেলে সরাসরি ওই অঙ্গগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন ওষুধ খেলে কিছু কিছু পার্শ্বক্রিয়া হতে পারে। সেটা নিয়মিত ব্যবধানে কিছু পরীক্ষা করলে বোঝা যায়। তা ছাড়া অন্য কোনও কারণে ওই অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত  হলে ওষুধের মাত্রা কমাতে হয় বা বন্ধ করতে হয়। এই বিষয়টা অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ওষুধের ক্ষেত্রেও একই ভাবে সত্য।

ভূত বা অন্য কোনও শক্তির প্রভাবে মনের রোগ হয়

এক জন মানুষ বড় হয়ে ওঠে যে পরিবেশে, সেই সমাজ-সংস্কৃতি তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। যদি সে এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে, তার ওপর অন্য কোনও অ-প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব পড়তে পারে, তা হলে বিশেষ মানসিক চাপের সময় রোগীর অনিচ্ছাতেই  এই ‘ ভর’ হতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় পজেশান সিন্ড্রোম ( possession syndrome) বা আবেশ জনিত সংলক্ষণ।এই ভর যেন মৃত ব্যক্তি অর্থাৎ কোনও ভূত বা কোনও ভগবানের প্রভাবে  হতে পারে। কিন্তু এটা প্রকৃত পক্ষে একটা মানসিক রোগ। 

পূর্ব জন্মের পাপের জন্যে মনের রোগ হয়

এটারও কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ পূর্ব জন্ম কোনও প্রমানিত সত্য নয়। তবে মা-বাবার মানসিক রোগ থাকলে সন্তানের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মনের রোগ কি ছোঁয়াছে

মনের রোগ ছোঁয়াছে নয়। তবে খুব বিরল অবস্থায় দেখা গেছে একজনের রোগ হলে সেই পরিবারের রোগীর ঘনিষ্ঠ কারওর একই ধরনের মনোরোগ হতে পারে। এক জনের রোগ হয়েছে সেটা দীর্ঘ দিন দেখলে বা তার কাছাকাছি থাকলে, অন্য জনের মনে প্রভাব পড়তে পারে, তার মানসিক চাপ হতে পারে। সেই মানসিক চাপ সহ্য না করতে পেরে অন্য জনের একই ধরনের রোগ হতে পারে।  

মনের রোগী হলেই কি পাগলা গারদে পাঠাতে হয়

‘পাগল’ বা ‘পাগলাগারদ’ কথাগুলো এখন ব্যবহার করা হয় না। কারণ কথাগুলো অসম্মান জনক। অধিকাংশ রোগীকে বাড়িতেই চিকিৎসা করা যায়। বিশেষ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা হয়।

মনের রোগ আসলে বড়লোকের অসুখ

এই ধারণাটাও ভ্রান্ত। সারা বিশ্বে সমীক্ষা করে দেখা গেছে ধনী বা তথাকথিত উন্নত দেশ এবং গরিব বা তথাকথিত অনুন্নত দেশে মানসিক রোগের হার প্রায় একই রকম। শুধু রোগের ধরন এবং কারণগুলো অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা হয়।

মনের রোগ কি সত্যিই বাড়ছে

বর্তমান বিশ্বে মানসিক চাপ বাড়ার অনেক গুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, দারিদ্র্ — এই পৃথিবীর অন্তত শতকরা  ১০ ভাগ মানুষ  দারিদ্র‍্সীমার নীচে বসবাস করে। যাদের খাওয়া পরার কোনও নিশ্চয়তা নেই তাদের পক্ষে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বাস্তুচ্যুতি —সারা পৃথিবীই অশান্ত, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বা রাজনৈতিক ধর্মীয় কারণে লেগে আছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ। এ ছাড়া উন্নয়নের নামে কারখানা, বিশাল বাঁধ, মল,  বড় ফ্লাইওভার তৈরি করতে গিয়ে নিতে হচ্ছে জমি। ফলশ্রুতিতে হচ্ছে প্রচুর মানুষের বাস্তুচ্যুতি। এই গৃহহীন মানুষদের মধ্যে বাড়ছে মানসিক রোগ। তৃতীয়ত, দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রা — সারা পৃথিবীতেই নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আসছে নতুন নতুন বিনোদন,  নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। এগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বা চাওয়া পাওয়া দ্বন্দ্বের জন্যে তৈরি হচ্ছে মানসিক রোগ।চতুর্থত, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি —সমাজ বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু, বিশেষ করে ধনী দেশে। এর ফলে বাড়ছে বৃদ্ধ মানুষদের সংখ্যা। এই বৃদ্ধ মানুষদের একাকিত্ব, কর্মহীনতা, শারীরিক অক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে মানসিক রোগী করে দিচ্ছে। এছাড়া আরও নানা কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতা বাড়ছে, যে জন্য বাড়ছে মানসিক রোগ।

মনের রোগকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আছে কি

সাধারনভাবে একজন মানুষের অ্যাপেন্ডিক্সের বা গল ব্লাডারের ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক,  ডায়াবেটিস,  হাত পা ভাঙে  নিদেন পক্ষে জ্বরজারি হলেও অন্য মানুষে বুঝতে পারে। কিন্তু একজন বাহ্যত সুস্থ মানুষ মন খারাপ বলে কাজ করছে না বা ঘরে বসে উল্টোপাল্টা কথা বলছে,  এই ব্যাপারটা অন্যদের কাছে সেই গুরুত্ব পায় না বা বোধগম্য হয় না। কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা ঠিক উল্টো। যে কোনও রোগের ভয়াবহতা মাপার বর্তমান মাপকাঠি হচ্ছে ডিএএলওয়াই অথবা ডিসেবিলিটি অ্যাডজাস্টেড লাইফ ইয়ার্স। এই মাপকাঠিতে দেখা গেছে বর্তমানে বিশ্বের  প্রথম পনেরোটা ভয়ংকর রোগের মধ্যে তিনটি হচ্ছে মানসিক রোগ। তার মধ্যে ডিপ্রেশন  বা অবসাদ রোগ হচ্ছে তিন নম্বরে, হার্টের অসুখ এবং ক্যান্সার রোগের পরেই। সুতরাং  মানসিক রোগকে গুরুত্ব দিতেই হবে।

ডঃ সুমিত দাশ পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থ্যের বৃত্ত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গণ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অবসর সময়ে বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন।

Picture of ড. সুমিত দাশ

ড. সুমিত দাশ

ডঃ সুমিত দাশ পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থ্যের বৃত্ত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গণ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অবসর সময়ে বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন।
Picture of ড. সুমিত দাশ

ড. সুমিত দাশ

ডঃ সুমিত দাশ পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থ্যের বৃত্ত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গণ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অবসর সময়ে বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস