(Partition)
বইয়ের নাম: আংলা বাংলা
লেখক: শান্তি লাহিড়ী
প্রকাশক: পারুল
প্রচ্ছদ: দেবাশীষ দেব
অলংকরণ: গৌতম দাশগুপ্ত
প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০২৫(পারুল সংস্করণ)
বিনিময় মূল্য: ২০০.০০
শান্তি লাহিড়ী, পঞ্চাশের একজন বিস্মৃত কবি। আজকের পাঠক তাঁর নাম শোনেননি হয়তো। শুধু কবিতা রচনা নয়, ‘বাংলা কবিতা’ নামে বিগত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশকের কবিদের কবিতা নিয়ে তিনি একটি সমুদ্রিত সংকলন করেছিলেন। এমনকি বাংলা কবিতার প্রথম লং প্লেয়িং রেকর্ড তাঁর হাত ধরে। তাঁর আরেকটি বড় পরিচয়, কবিতার দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ। যে কথা বিস্ময়ের, আমরা কেউই খেয়াল রাখিনি তিনি একটি অসামান্য কিশোর উপন্যাস ‘আংলা বাংলা’ লিখেছিলেন। এই উপন্যাস যখন প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে তখন তা রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। সম্প্রতি উপন্যাসটির পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এভাবেই কত মণিমাণিক্য হারিয়ে গেছে আমাদেরই আত্মছলনায়। (Partition)

তাঁর জন্ম ১৩৪২ বঙ্গাব্দের অবিভক্ত বঙ্গের রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে শৈশব এবং কৈশোরের কয়েকটি দিন। কথাটির উল্লেখ করছি এই কারণে, এই উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে দেশভাগ, এক কিশোরের চোখে পালটে যাওয়া স্বদেশের পরিচয়। তাই একে নিছক কিশোর উপন্যাস বললে আমাদের অলক্ষ্যেই ভুল হয়ে যাবে। আসুন সুমনের চোখ দিয়ে প্রবেশ করি অবিভক্ত বাংলায়। সুমন কিশোর, একটু একটু করে লতাপাতার মতো বেড়ে ওঠা বয়ঃসন্ধির কিশোর। এক একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে সে। অবিভক্ত বাংলার কাফুরিয়া গ্রাম। যার একদিকে রাজশাহী অন্যদিকে নাটোর। আর আছে বাড়ির সামনে লোকের মুখে প্রচলিত নদীর ভগ্নাংশ। নারদের নালা। এই উপন্যাস শুরু হয় শ্রোতার অভিপ্রায় নিয়ে। তাই শুরুতেই এক নিদারুণ সত্যি একটি নিছক কথকতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। (Partition)
ভাবনাসঞ্চারী অবচেতনের সংলাপ: পঙ্কজ চক্রবর্তী
‘বাংলা নামে একটা দেশ ছিল। সেই দেশের গোটা উত্তর দিক ঘিরে ছিল পাহাড় আর পাহাড়। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। দক্ষিণে থৈথৈ সমুদ্দুর। পশ্চিমে ভারতবর্ষ। পূবে অন্য দেশ। (Partition)
আকাশের চাঁদ উঠত। চাঁদ তো এখনো ওঠে, কিন্তু তখন একটা দেশে একটাই চাঁদ উঠত। এখন সেই চাঁদ ওঠে দুটো দেশে। এক দেশের নাম বাংলাদেশ, অন্য দেশের অন্য নাম।’
কিশোরকে ঘুমপাড়ানি গল্প দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রথম থেকেই নির্মম এই সত্যি, তখন একটা দেশে একটাই চাঁদ উঠত। আর সেই চাঁদ এখন দু’টো দেশে ওঠে।
কিশোরকে ঘুমপাড়ানি গল্প দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রথম থেকেই নির্মম এই সত্যি, তখন একটা দেশে একটাই চাঁদ উঠত। আর সেই চাঁদ এখন দু’টো দেশে ওঠে। সেই বাংলাদেশে সুমনদের একান্নবর্তী ছোট্ট পরিবার। সদর, অন্দর, ঠাকুরবাড়ির উঠোন, কাছারি বাড়ি আর চারপাশে গাছপালায় ছেয়ে আছে সব। সেই কাছারি বাড়িতে আজও ছায়া ফেলে নিরীহ প্রজাদের দীর্ঘশ্বাস। সুমনের মনকেমন, সুমনের চারপাশ- তার একটি চমৎকার বর্ণনা আছে এই উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে:
‘বাড়ির সামনে হাট বসে, হাটের ওপারে পাঠশালা। পাঠশালার পাশ দিয়ে বর্ষাকালে জল জমত। লোকে বলে ওটা নারদের নালা। সদর শহরের দিকে নারদ এখনো তাজা নদী। এখানে তেমন নয়। তাকালে মজা নদীর বাঁক চোখে লাগে। যে জায়গায় আটচালা ঘরের সামনে একটা প্রকাণ্ড বকুল গাছ, নারদের জলে নৌকা এসে ভিড়ত সেখানে। দুপুরের রোদে মাঝিমাল্লারা গাছের গুঁড়িতে নৌকা বাঁধত। হাটে কেনা-বেচা করত। সন্ধ্যা হলে হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে একে একে চলে যেত এদিকে ওদিকে। সে নদী এখন নেই।

এখন তার ওপরে পাটের চাষ। লাল-সাদা পাটগাছের গলা পর্যন্ত জলে ডোবা। নালার ওপরে একটা কাঠের সাঁকো, সাঁকোয় দাঁড়িয়ে ঘোলা জলে ছিপ ফেলছে গ্রামের ছেলেরা কেঁচো অথবা বোলতার টোপে।’
সুমন মেজঠাকুমাকে চোখে হারায়। তার কোল ঘেঁষে গল্প শোনে আর সেই গল্পে ফিরে আসে মেজঠাকুরদার মৃত্যু। মাঝে মাঝে দুপুরে ঠাকুমাকে রামায়ণ পড়ে শোনায়। মা বাবা ছাড়াও আছে তার ভাই কান্তি আর আছে মেজকা। তাদের সমস্ত দস্যিপনার অনুঘটক মেজকা। মাছ ধরতে বলো মেজকা আছে, আম পাড়তে বলো মেজকা আছে। সাঁতার, সাইকেল চড়া, যাত্রা করা সবই মেজকাকে ঘিরে। মেজকা ছাদে তার হাতে তুলে দেয় ঘুড়ির লাটাই।
সুমনের খেলার আরেক সাথী মেজকার মেয়ে মঞ্জু। আছে পাশের প্রতিবেশী বড়বাড়ির মেয়ে বুবাই। বুবাইকে সঙ্গী করে হাট, নদী, বাগান সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় সুমন। আর একদিন টের পায় বুবাই বড়দের মতো বড় হয়ে যাচ্ছে। নাকি একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে সুমন? (Partition)
বাড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কাছারি বাড়ি। সেখানে শিকারী তাহের মৌলভি গল্পের ঝুলি খুলে বসে। আর এইভাবে একটু একটু করে একদিন ভোরে ঘুমের মধ্যেই সুমন টের পায় আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। পুজো আসছে।
বাড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কাছারি বাড়ি। সেখানে শিকারী তাহের মৌলভি গল্পের ঝুলি খুলে বসে। আর এইভাবে একটু একটু করে একদিন ভোরে ঘুমের মধ্যেই সুমন টের পায় আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। পুজো আসছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভরে উঠছে একটু একটু করে। সেজোকাকা এসেছেন কলকাতা থেকে। জলপাইগুড়ি থেকে এসেছেন লালদি, লালদি মানে বাবার পিসিমা। সুমনের ঠাকুরদার বেঁচে থাকা বোন। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, লক্ষীবিলাস মাখেন। মেজঠাকমার সঙ্গে লালদির রান্না হয় একসাথে। বিধবা বলে। এছাড়াও এসেছেন বড় পিসিমা, মেজো পিসিমা, সেজো পিসিমা- তাদের ছেলেমেয়েরা। শুধু আসেনি ভুটু পিসি, বাড়ির অমতে বিয়ে করেছে বলে তাকে কেউ ডাকে না। এখন বাবা-কাকা নয় সুমনরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। চুমকি, মঞ্জু, মিতুল রবিদা, হাবুসদা, ভুটুসদা, লিলিদি, রেখা, বুবাই সবাই মিলে বাড়ি সরগরম। সকালবেলা লাল চালের ফেনা ভাত। সঙ্গে আলু, বেগুন, কুমড়ো সেদ্ধ, ঘি। কলার পাতায় লম্বালম্বি বসে সকলে খায়। (Partition)

একদিন হাঁটতে হাঁটতে সুমন চলেছে পুকুরের পাশ দিয়ে। আটচালা পার হতেই ডান হাতে বকুল গাছ বাঁদিকে বিনোদ জেলেনীর ঘর। ঘরের পাশে গাবগাছ। গাব জাল দিয়ে রং করে বিনোদ। আজ হাট বার। হরি সার দোকান জমজমাট। লঙ্কা থেকে নুন সব পাওয়া যায় হরি সার দোকানে। এখানে আড়ানি থেকে সন্দেশের দোকানে আসে। শহর থেকে শাড়ি কাপড়ের। যে পথটা নাটোর রাজশাহীর দিকে চলে গেছে সেই নির্জন পথে হাঁটা লাগানোর সময় পথেই দেখা হয় সখিনার সঙ্গে। উর্দুর মৌলভির মেয়ে সখিনা। সুমনের সাথে এক পাঠশালায় পড়ত। এখন আর পড়ে না। সুমনকে জলচৌকি পেতে চিঁড়ে আর গুড়ের মুড়কি ভরা সানকি এগিয়ে দেয় সখিনার মা। সুমন জানে সখিনার মা কলা, চিঁড়ে মেখে দিতে পারবে না। তাহলে সুমন বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। বাড়ি ফেরার পথে হাটখোলায় একটা টমটম দেখল সুমন। কাঠের পোল পার হয়ে আসছে। (Partition)
গাড়ির উপর বসে আছে ঘেতু দারোয়ান। পুজোর ছুটিতে তাদের বাড়িতেই আসছে টমটম। বড়বাবু এলেন কাশী থেকে। বড় দাদুর সঙ্গে বড় মা। ঠাকুরদার বাবা বুড়ো বাবা। সাথে বিন্দুদি আর বিন্দুর মেয়ে জোনা। সুমন টনটমে চড়ে বসে। ছোটবেলায় ঘেতুর কোলে পিঠে সুমন মানুষ হয়েছে।
গাড়ির উপর বসে আছে ঘেতু দারোয়ান। পুজোর ছুটিতে তাদের বাড়িতেই আসছে টমটম। বড়বাবু এলেন কাশী থেকে। বড় দাদুর সঙ্গে বড় মা। ঠাকুরদার বাবা বুড়ো বাবা। সাথে বিন্দুদি আর বিন্দুর মেয়ে জোনা। সুমন টনটমে চড়ে বসে। ছোটবেলায় ঘেতুর কোলে পিঠে সুমন মানুষ হয়েছে। পাড়ায় সকলের বাড়িতেই দূরের মানুষ দেশে ফিরছে। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে ঘেতু দারোয়ান স্নান করছে। ঘেতু স্নান করাকে বলে গোসুল। এরপর সে নামাজ পড়বে। সুমন ভেবে পায় না হিন্দুরা জপ করে, মুসলমানরা নামাজ পড়ে কেন? কেন ভগবানকে দু’রকমভাবে ডাকতে হয়? কেন ঘেতু দারোয়ান তাদের রান্নাঘরে বসে খেতে পারে না? এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই তার কাছে। ঘেতু প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে চলে যায় নাটোর স্টেশনে। যেদিক থেকেই ট্রেন আসুক সে তাদের নিয়ে যায় দীঘাপাতিয়া, পুঠিয়া, তাহিরপুর, রাজশাহী যে যেখানে যাবে। সুমনদের পাড়ায় দুর্গাপুজো হয় না। তাই পুজোর প্রতিমা দেখতে পুঠিয়া বা তাহিরপুর যেতে হয়। (Partition)
এই গ্রামদেশ, স্বপ্নাদেশে লিখিত কবিতা: পঙ্কজ চক্রবর্তী
সুমন অতিরিক্ত সংবেদনশীল, আর তাই মনখারাপ তার নিত্যসঙ্গী। কারণে অকারণে তার মন খারাপ হয়। পুজোর মুহূর্তে সে উদাসী ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। খাওয়ায় মন নেই। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরদা সবাইকে নিয়ে বিসর্জন দেখতে যান। পীরগাছা নদীর দু’পাশ ঘিরে মেলা বসেছে। চারপাশের গ্রাম থেকে প্রতিমা এখানেই বিসর্জন দেওয়া হবে। সেখানে নানা খাবারের দোকান। কেউ চুড়ি কিনছে, কেউ দাঁড়ে-বসা শোলার ময়না। নৌকায় ঝকঝক করছে হ্যাজাক আর পেট্রোম্যাক্সের আলো। পীরগাছা নদীর দু’ধারে শ্মশান। শ্মশানের কোল থেকে নীলকরের পুরনো কুঠী পর্যন্ত মেলা চলবে। বিসর্জনের ছোঁয়া লাগল সুমনের মনে। (Partition)
এই উপন্যাসে বয়ঃসন্ধির পরিমিত যৌনতাকে লেখক উপেক্ষা করেননি। তাই সুমনের প্রথম যৌন অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছে প্রথম মৃত্যুর স্মৃতি। সে এক ঘোর বর্ষার দিন। মা আঁতুরঘরে চিৎকার করে কাঁদছেন।
এই উপন্যাসে বয়ঃসন্ধির পরিমিত যৌনতাকে লেখক উপেক্ষা করেননি। তাই সুমনের প্রথম যৌন অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছে প্রথম মৃত্যুর স্মৃতি। সে এক ঘোর বর্ষার দিন। মা আঁতুরঘরে চিৎকার করে কাঁদছেন। আঁতুরঘরে তার না দেখা ছোট ভাই মরে গেল। ছোটকার দলবল একটা কোদাল দিয়ে গাব গাছের তলায় গর্ত খুঁড়ে হাঁড়িসমেত পুঁতে রাখল মৃত শিশুকে। সেদিনও সুমন খুঁজতে খুঁজতে এসেছিল গাব গাছের নিচে সঙ্গে ছিল বুবাই। তখনই প্রচন্ড বৃষ্টি। মৃত ভাইয়ের স্মৃতির কষ্টের সঙ্গে সুমন দু’হাতে বুবাইকে আরও কাছে টেনে নেয়। টের পায় উষ্ণতা। (Partition)
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা কিছুদিন পরে কালীপুজোর সময়। বড়বাড়িতে ইরা, মিরাদির দল এসেছে। ইরা সুমনকে হাত ধরে লাইব্রেরি ঘরের দিকে নিয়ে যায়। লাইব্রেরির বই দেখতে দেখতে ইরা ভয় পেয়ে সুমনের হাত দু’টো গলার নিচে টেনে নেয়। নিজের হাত দুটো দিয়ে সুমনকে কাছে টানে। সুমন একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। ইরাদির কাছে গেলে সুমনের মনে হয় সেও বড় হয়ে যাচ্ছে। কাকিমার কাছে গেলে তো এমন হয় না। তার মনে হয় ‘ইরা কি তবে কাকিমাদের চেয়ে আলাদা কেউ।’ এভাবেই দু’জন কিশোর কিশোরী এক অবচেতন মনে পরস্পরকে একই পৃথিবীর মানুষ ভাবতে থাকে। (Partition)

পুজোর পর সবাই যে যার বাড়ি চলে গেছে। এরই মধ্যে একদিন সামান্য জ্বরে চলে গেল ছোট ভাই কান্তি। জ্বরের ঘোরে মা’কে বলেছিল মধুটুসকি গাছের সব আম সে খাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো গেল না। ভোররাতে শেষ নিশ্বাস ফেলল কান্তি। সবাই শুনল আমবাগানে ঠকঠক কুঠারের শব্দ। বাবা নিজের হাতে মধুটুসকি আম গাছ কেটে কান্তির দাহকার্য করলেন পীরগাছা শ্মশানে। মাঝখানে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সুমন এখন পুঠিয়ায় ছোড়দাদুর কাছে থাকে। তার নিজের চেনা গ্রাম কত যে বদলে গেল। কান্তি নেই আটচালা থেকে বকুলতলা, বকুলতলা থেকে নারদের নালা, আরানির পথ, খেলার মাঠ, ভোগ মন্দিদের পিছনের জঙ্গল, সমস্ত বাড়িটা যেন এক নিথর শূন্যতায় ভরে আছে। বাবা কঠিন আর একা হয়ে গেছেন। নিমতলা ঘরের কবরেজদাদু কোথায় চলে গেলেন আর ফিরলেন না। ঠাকুরদা একদিন সন্ন্যাস নিয়ে কাশী গেলেন। কাশীঠাকুর চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। সুমন বুঝল এক একটা ইট দিয়ে যেমন একদিন ওর পূর্বপুরুষ নিভৃতে সন্তান-সন্ততি নিয়ে থাকার জন্য প্রকাণ্ড অট্টালিকা গড়ে তুলেছিলেন তার পরবর্তী সন্তানরা একটি একটি করে ইট খুলে নিয়ে জায়গাটা বিশাল প্রান্তরে রূপান্তরিত করে দিলেন। (Partition)
উপন্যাসের চোদ্দ পরিচ্ছেদ এসে দেখি স্বাধীনতার আহ্বানে সোচ্চার মিছিল বেরিয়েছে। সারা পাড়া ঘুরে মিছিল থামল মহারানী হেমন্তকুমারী রাজবাড়ির মাঠে। দেশ স্বাধীন হবে। সুমন জানে না স্বাধীনতা কাকে বলে। মেজকা তাকে বলে বড় হলে বুঝবি।
উপন্যাসের চোদ্দ পরিচ্ছেদ এসে দেখি স্বাধীনতার আহ্বানে সোচ্চার মিছিল বেরিয়েছে। সারা পাড়া ঘুরে মিছিল থামল মহারানী হেমন্তকুমারী রাজবাড়ির মাঠে। দেশ স্বাধীন হবে। সুমন জানে না স্বাধীনতা কাকে বলে। মেজকা তাকে বলে বড় হলে বুঝবি। ইংরেজরা ওদের দেশে চলে যাচ্ছে তাই এ দেশটা আমাদের হাতে দিয়ে যাচ্ছে। সুমন ভাবে দেশ কীভাবে একজন আরেকজনের হাতে তুলে দেয়? বাবাকে সামনে পেলে জিজ্ঞেস করত ‘পাকিস্তান মানে কি? একটা দেশ দুটো হবে কেন? পার্টিশান মানে কি?’ এইসব নানা প্রশ্নের অনিশ্চিত কুয়াশা সুমনের বুকটাকে তোলপাড় করে দেয়। (Partition)
নিজের চেনা দেশ বদলে যায়, প্রতিবেশীর মুখের ভাষা, চোখের ভাষা বদলে যায়। এইসবেরই সাক্ষী থাকে সুমন। ছোট ঠাকুরদা জলপাইগুড়ি চলে যাবেন। তার সঙ্গে নতুন দিদি, রেখা, ছায়া সবাই। ‘বাতাস জুড়ে একটাই প্রশ্ন আপনি নাকি চলে যাচ্ছেন? আপনি সত্যিই চলে যাচ্ছেন? সারাদিন কান পাতা যায় না পথে-ঘাটে। গোপন এখন সোচ্চার। একপক্ষ নিথর পাথর আরেকপক্ষ উদ্বেল অস্থির। মেজকা শুধু বলেছেন চুপ কর, বড় হয়ে বুঝবি। সুমন জানে না আর কবে সে এসব বুঝবে। চলে যাওয়া শুরু হয় নিঃসাড়ে, নিঃশব্দে। পথের ধুলো না উড়িয়ে। নিঃশ্বাসের শব্দ না ফেলে। সিদ্ধান্ত বাড়ির সবাই চলে গেছে গঙ্গেশ সিদ্ধান্ত ছাড়া। নীরেন মাস্টারের বাড়ি খালি। অশ্বিনী লাহিড়ীরা চলে গেছে। দানী খাঁ, ধাদু খাঁ, আদু খাঁ সবাই চলে গেছে। অনাথ দু-একজন মানুষকে ফেলে চলে গেছে সকলে। শুধু যেতে চায় না সুমনের বাবা। হিন্দু জানি না, মুসলমান জানি না, এটা আমার দেশ। জন্মেছি এখানেই এখানেই মরতে চাই এই তাঁর পণ। কোনও জটলায় কোনও পরিত্রাণ নেই। আশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই। শুধু উদ্যত আছে গোপনে এক ছুরি। একদলের জন্য অরাজক অধিকার, অন্য দলের জন্য দেশান্তর। (Partition)

হঠাৎ মেজ ঠাকমার মৃত্যু সংবাদ এল। সুমনের বাবা পড়লেন কঠিন অসুখে। মেজকা কলকাতা থেকে চিঠি লিখলেন। বাবাকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। এখন আর রাজবাড়ির গজালপেটা ঘড়ির সারাদিনে আটবার ঘণ্টা পেটা শোনা যায় না। ঘণ্টা পেটার লোক দেশ ছেড়ে চলে গেছে। সবাই প্রায় চলে গেছে। এখন স্কুলে পানুদা হেডমাস্টার। শচীন স্যার, চাদু স্যার, নীরেন স্যার, অতুল স্যার সবাই চলে গেছেন। শুধু আছেন ভূগোলের মাস্টারমশাই জ্যোতিপ্রসাদবাবু। তিনি আজ ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর এক নতুন ম্যাপ খুলে বলেন:
‘ভারতবর্ষের সীমানা সম্বন্ধে তোমরা একটু সতর্ক থাকবে, একটু খেয়াল করবে। ভারতবর্ষের উত্তরে আর দক্ষিণে যথাক্রমে হিমালয় আর ভারত মহাসাগর ঠিকই থাকবে, কিন্তু পূর্বে ব্রহ্মদেশ নয় থাকবে পূর্ব পাকিস্তান। আর পশ্চিমে আরব সাগরের সঙ্গে থাকবে পশ্চিম পাকিস্তান।’ (Partition)
সুমন এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারে না কেননা ‘আজ অঙ্কের হিসেব ঠিক আছে, অঙ্কের অক্ষর পালটায়নি অথচ ভূগোলের হিসেব পালটে গেছে’। কারা যেন রাজবাড়ির দখল নিল।
সুমন এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারে না কেননা ‘আজ অঙ্কের হিসেব ঠিক আছে, অঙ্কের অক্ষর পালটায়নি অথচ ভূগোলের হিসেব পালটে গেছে’। কারা যেন রাজবাড়ির দখল নিল। নাড়ুগোপালকে গোবিন্দসাগরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল। রাজবাড়িতে আর নামগান নেই, তার বদলে উঠল আজান। শুধু সুমনের বাবা নয়, অনিল কাকা, নিখিল সান্যাল এরা রয়ে গেলেন দেশের মাটি কামড়ে। কিন্তু ভাল নেই তারা। কোনও মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলেই একটাই প্রশ্ন ‘কবে যাবে? যাবার সময় তোমার গরুবাছুরগুলো আমার কাছেই বেচে দিও। ‘এর মধ্যেই ধর্ষণ, খুনখারাপির ঘটনা বাড়ছে। ঈদের সময় বরাবর সিধে আসে সুমনদের বাড়িতে। খাসির মাংস চাল ডাল তরকারি। পাড়ায় বিলিয়েও দিতে হয় এত বেশি দেওয়া হয়। এবার আবীর মন্ডল উঠোনে এনে রাখল গরুর মাংস। এই স্পর্ধা দেখে সুমনের বাবা চোখের জল ফেললেন। তারপর তাকেও বলতে হল- ‘চল সু আমরাও দেশ ছেড়ে চলে যাই।’ (Partition)

তারপর একদিন রাতে বাড়ির সিং দরজায় তালা ঝুলল। জিনিসপত্তর যা যেখানে ছিল তেমনই পড়ে রইল। আলের ওপর দিয়ে চলল গাড়ি। গাড়ির নিচে ঝোলানো লন্ঠন। দোল খাচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে। সঙ্গে রয়েছেন ময়েজ পন্ডিতমশাই, মইনুদ্দি সর্দার। তারা নির্ভরযোগ্যভাবে তাদের পার করে দিতে চান। ‘অনেকদিন ধরে আপনাদের বাড়ি নুন খেয়েছি। বিপদে না বাঁচালে জাহান্নামে যেতে হবে’ এই ছিল তাদের কথা। সুমনের মনে পড়ল এই দেশের প্রতিটি মুহূর্ত। এগুলি সত্যি না মিথ্যে আজ সুমন জানে না। শুধু মনে মনে বলে ‘না, ও-সব মিথ্যে, ও-সব অলীক কল্পনা মাত্র। স্মৃতির মধ্যে থেকে বিস্মৃতির দিকে ধীরে ধীরে ওগুলো একদিন হারিয়ে যাবে।’ (Partition)
মানুষ রইল। দেশ হারিয়ে গেল। সুমনের মনে পড়ে সখিনার কথা। আবার যদি কখনও ফেরে তাহলে কি নির্জন প্লাটফর্মে আলো হাতে অপেক্ষা করবে মৌলভী সাহেবের মেয়ে সখিনা? সুমন জানে না। হয়তো জানে অনিশ্চয়তার কোনও এক বিপুল অন্ধকার। (Partition)
উপন্যাস শেষ করার পর দেখি কখন যেন সুমনের দেশ আমারও দেশ হয়ে উঠেছে। দেশ হারানোর বেদনা আমার রক্তের ভিতরে ছলাৎ ঢেউ তোলে। শুধু সুমনের সখিনার কাছে ফেরা হবে না তাই নয় আর ফেরা হবে না নাটোরের কাছে।
উপন্যাস শেষ করার পর দেখি কখন যেন সুমনের দেশ আমারও দেশ হয়ে উঠেছে। দেশ হারানোর বেদনা আমার রক্তের ভিতরে ছলাৎ ঢেউ তোলে। শুধু সুমনের সখিনার কাছে ফেরা হবে না তাই নয় আর ফেরা হবে না নাটোরের কাছে। নাটোরের বনলতা সেন কিংবদন্তি কিন্তু নাটোরের সখিনার কথা কোনওদিন কারোর মনে পড়বে না। (Partition)
জনশ্রুতির দায় হয়তো ইতিহাস কিছুটা নেয়, কিন্তু মানুষের স্মৃতির ভিতর বেড়ে ওঠে যে অবান্তর গাছপালা তার পাঠক কোথায়? তার মাটি আছে অথচ দেশ নেই। বয়ঃসন্ধি ছিন্ন ভিন্ন করা এই বিপুল বেদনাই উপন্যাসটির গৌরব। কিশোর মনের সরল প্রশ্নের ছলনায় দেশ- হারানো ইতিহাসের ধিক্কার। (Partition)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা। গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।